নন্দীগ্রামের সত্য (পাঠকের মতামত)

সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নির্বাচনসর্বস্ব রাজনৈতিক দলগুলির ন্যক্করজনক মন্তব্য প্রচারমাধ্যমে আসছে। ঐতিহাসিক সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম আন্দোলনকে কালিমালিপ্ত করতে এবং নিজেদের অপকীর্তি ঢাকতে এই সুযোগে সিপিএম কোমর বেঁধে আসরে নেমে পড়েছে। তাদের ভাবভঙ্গি এমন যেন এই সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম গণআন্দোলনের ফলে রাজ্যে অন্ধকার নেমে এসেছে। তাদের বক্তব্য, বেকার সমস্যা মেটাতে যে শিল্পায়নের উদ্যোগ নিয়েছিল বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সরকার, তা বন্ধ হয়ে যায় এই গণআন্দোলনের ফলে যা বাংলার চরম ক্ষতি করেছে এবং এই আন্দোলন না হলে বাংলায় বেকার সমস্যা থাকত না এবং শিল্পায়নের জোয়ার বয়ে যেত। সত্যিই কি তাই?

১৯৭৭ থেকে ২০১১ পর্যন্ত, বিশেষ করে ২০০৬ সাল পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের শিল্প পরিস্থিতি খতিয়ে দেখা যাক ।

পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন শিল্পের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল জুট শিল্প। পশ্চিমবঙ্গের জুটমিলের সংখ্যা ছিল প্রায় ৬২টি, যার মধ্যে বহু কারখানা পূর্বতন সিপিআই(এম)-ফ্রন্ট সরকারের আমলেই বন্ধ হয়ে যায়, কিছু কারখানা ধুঁকতে থাকে। কানোরিয়া জুট মিল, নিউ সেন্ট্রাল জুট মিল এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য। হুগলি নদীর দুই পাড়ে গড়ে উঠেছিল জুট মিল সহ অসংখ্য ভারী ও মাঝারি শিল্প যার অধিকাংশ সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম আন্দোলনের বহু আগেই বন্ধ হয়ে যায়। বাউড়িয়া কটন মিল, বজবজ অঞ্চলের বিড়লাপুরের বিড়লা পাওয়ার প্লান্ট, কার্বাইড ফ্যাক্টরি, উল কারখানা বন্ধ হয়ে কর্মহীন হয়ে যান হাজার হাজার শ্রমিক, যাদের বড় অংশ প্রাপ্য টাকা থেকে বঞ্চিত। বর্তমানে বন্ধ হয়ে যাওয়া হিন্দমোটরের দুরবস্থাও বহুদিনের। বর্তমান সময়ে ঐক্যবদ্ধ শ্রমিক আন্দোলনের দাবি ন্যূনতম বেতন ১৮০০০-২১০০০ টাকার। কিন্তু সিপিএম ক্ষমতায় থাকার সময়ে জুট মিলের শ্রমিকদের ক্ষেত্রে নিয়ে আসে কালা আইন যার মধ্য দিয়ে তারা ন্যূনতম দৈনিক মজুরি করে মাত্র ১০০ টাকা। দীর্ঘদিন এক গোপন আঁতাতের মধ্যে দিয়ে শ্রমিকদের ন্যায্য ডিএ থেকেও বঞ্চিত করা হয়। এই হল তৎকালীন সময়ের (২০১১ সালের পূর্বে) শিল্প ও শ্রমিকদের দুরবস্থা।

এবার দেখা যাক সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামে শিল্পপতিদের আগমন ও জমি অধিগ্রহণের বিষয়ে। নন্দীগ্রামে ২০০৫ সাল নাগাদ কেমিক্যাল হাব গড়ে তুলতে ইন্দোনেশিয়ার পুঁজিপতি সালেম গোষ্ঠীর জন্য যে প্রায় ১৯ হাজার একরের বেশি জমি অধিগ্রহণের জন্য উদ্যোগ নিয়েছিল (সিপিএমের এক জনসভায় ঘোষণা করা হয় সাড়ে ১৪ হাজার একর জমি), তা যদি বাস্তবায়ন হত তা হলে যেমন শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সহ হাজার হাজার পরিবার উচ্ছেদ হয়ে যেত, তেমনি কেমিক্যাল হাবের বর্জ্যে খাল-বিল-নদীর জল, জমি সহ বিস্তীর্ণ অঞ্চলের পরিবেশ দূষিত হত, মাছ-কাঁকড়া সহ বিভিন্ন জলজ জীবকূলের ভারসাম্য নষ্ট হত এবং এর প্রভাবে কয়েক হাজার জনসাধারণের জীবিকা বিপর্যস্ত হয়ে যেত। একই অবস্থা সিঙ্গুরের ক্ষেত্রেও। প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি জমি (কৃষি জমি) অধিগ্রহণ করে নেওয়া হয়েছিল। যেখানে দেশের মোট জমির মাত্র ১৮ শতাংশ (প্রায়) কৃষিজমি সেখানে শিল্পের নামে এই ভাবে জমি কেড়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিক ও ধ্বংসাত্মক চিন্তাভাবনা।

সিঙ্গুর এবং বিশেষ করে নন্দীগ্রাম আন্দোলনের ক্ষেত্রে,কোনও নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দল কিংবা একজন নেতা বা নেত্রীকে কোনও ভাবেই পেটেন্ট দেওয়া যায় না। এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ না থাকলেও বলা চলে নন্দীগ্রামে জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে আন্দোলন প্রকৃত অর্থে ছিল স্বতঃস্ফূর্ত,ঐক্যবদ্ধ গণআন্দোলন,বর্তমান সময়ের কৃষি আইন বিরোধী গণআন্দোলনের মতো। নন্দীগ্রামে এই আন্দোলন পরিচালনার ক্ষেত্রে গড়ে ওঠে দলমত নির্বিশেষে ‘ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটি,এই কমিটিতে এসইউসিআই(সি) সহ বেশ কিছু সংগঠন ও তৎকালীন শাসক দলের নিচুতলার কর্মী সমর্থকরা,যারা শঙ্কিত ছিলেন জমি হারাবার ভয়ে–সকলেই ছিলেন। একই ভাবে সিঙ্গুরের ক্ষেত্রেও জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধে নামে এলাকার সংগ্রামী কৃষক রমণী সহ জনসাধারণ। এলাকার গ্রামে গ্রামে প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে মহিলা ও ছাত্রযুবদের নিয়ে গড়ে ওঠে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী, সংগ্রাম কমিটি প্রভৃতি। সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম গণআন্দোলনের সমর্থনে এগিয়ে আসেন সমাজের বিশিষ্ট শিল্পী-সাহিত্যিক-কবি-সাংস্কৃতিক কর্মী-অধ্যাপক-অধ্যাপিকা-শিক্ষক-শিক্ষিকা-নাট্যকর্মী এবং সর্বোপরি ছাত্র ও যুব সমাজ। কবি তরুণ সান্যালের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে শিল্পী-সাংস্কৃতিক কর্মী-বুদ্ধিজীবী মঞ্চ । যাতে যোগ দেন পশ্চিমবঙ্গের প্রায় সকল বিদ্বজ্জন ও শিল্পী-সাংস্কৃতিক কর্মীরা।

সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামে গণআন্দোলনের উপর তৎকালীন শাসক দলের দমনপীড়ন সারা দেশে আলোড়ন সৃষ্টি করে। বর্তমান সময়ে এটাকে একটা বিতর্কের বিষয় বলে দেখানোর চেষ্টা হচ্ছে। যা জটিলতর হয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীর বক্তব্যে। অপরদিকে ‘অপারেশন সূর্যোদয়’-এর নামে নন্দীগ্রামের আন্দোলনকারীদের উপর শুরু হয় পুলিশ ও ঘাতক বাহিনীর নারকীয় অত্যাচার, শহিদ হন ১৪ জন, ক্ষত-বিক্ষত হন অনেকেই। তৎকালীন শাসক সিপিএমের বক্তব্য ছিল, ‘আন্দোলনকারীদের উপর গুলিচালনা না করে কী ফুল ছোড়া হবে’। এই নন্দীগ্রাম আন্দোলনের মধ্যেই দেখা মেলে আন্দোলন দমনে চটি জুতো পরিহিত পুলিশের, শুরু হয় বিতর্ক। এই বিষয়ে সরকার, শাসক দল নীরব, বিরোধীরা অভিযোগ তোলে এরা শাসক দলের হার্মাদ বাহিনী।

বর্তমান সময়ে এই চটি জুতো এবং পুলিশের পোষাক পরিহিত সমাজ বিরোধীরা প্রকৃতপক্ষে কোন দলের বা কোন নেতা বা নেত্রীর ছিল তা নিয়ে শুরু হয়েছে জলঘোলা, সেই ঘোলা জলে মাছ ধরার আশায় নেমেছে সিপিএম। তারা নির্বাচনী ফায়দা হাসিল করতে প্রচার করছে যে তারা এই অনভিপ্রেত ঘটনার সাথে যুক্ত নয় এবং উক্ত ঘাতকবাহিনী ছিল বিরোধীদের। সিপিএম-এর এই যুক্তির পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্ন ওঠে ১) সিপিএম ফ্রন্ট সরকারের স্বরাষ্ট্র দপ্তর, গোয়েন্দা দপ্তরের কাছে সেই সময় কি এই বিষয়ে কোনও খবর ছিল না যে বিরোধীরা সেখানে ঘাতকবাহিনী জমায়েত করেছে? ২) ২৩৫ আসন পাওয়া মহাশক্তিধর সিপিএম ফ্রন্ট সরকার সেই ঘাতকবাহিনীকে ধরার বিষয়ে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল?

এই ঘটনাক্রম বিচার করলে সহজেই অনুমান করা যায় ১) তৎকালীন সিপিএম সরকারের জমি অধিগ্রহণ নীতি কতটুকু জনস্বার্থমূলক ছিল। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামে জমি দখল করতে গিয়ে যে শিল্পায়ন এবং বেকারত্ব দূরীকরণের কথা তারা বলেছিল এবং এখনও পর্যন্ত বলছে তা প্রকৃতপক্ষে এক ভাঁওতা, যার বাস্তব ভিত্তি কিছু নেই, ২) এই বশ্যতাবিরোধী সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের প্রতিরোধ আন্দোলন ছিল জনবিরোধী শাসকের বিরুদ্ধে, জাত-ধর্ম, দলমত নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ গণসংগ্রাম। পরিশেষে এটুকুই বলার, নির্বাচনে জেতার স্বার্থে, ক্ষমতায় আসার জন্য সত্য বিকৃত করে এই ঐতিহাসিক গণআন্দোলন তথা সংগ্রামী জনসাধারণকে কালিমালিপ্ত করা কখনও সুস্থ মূল্যবোধের পরিচয় নয়।

 সুজয় দাস, ছাত্র,বঙ্গবাসী কলেজ,কলকাতা