জয়ী হলে বলতেন ঠিক উল্টো কথা

দিল্লি ভোটের ফল বেরনোর দুদিন বাদে বিজেপি নেতা অমিত শাহ মুখোমুখি হলেন সাংবাদিকদের। তিনিই ছিলেন দিল্লি ভোটে দলের প্রধান সেনাপতি। এমন শোচনীয় পরাজয়ের কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘ভোটের মূল্যায়নে আমাদের ভুল হয়েছিল।’ অর্থাৎ ভোটের ফল বেরনোর আগে বিজেপিই সরকার গড়বে বলে যে দাবি তিনি করেছিলেন সেই মূল্যায়নে ভুল ছিল। কেন বিজেপি হারল তার জবাবে তিনি বলেছেন, শাহিনবাগকে পাকিস্তান বলে যেভাবে দাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল, অন্যান্য নেতারাও যেসব কুকথার বন্যা ছুটিয়েছিলেন সেগুলো ঠিক হয়নি। এ এক আশ্চর্য ঘটনা। বিজেপি নেতা বলছেন– কুকথা বলা ঠিক হয়নি, একথা শুনতে ভারতবাসী অভ্যস্ত নয়। পশ্চিমবঙ্গে তো বটেই। তাদের চেনা কথা হল, বেশ করেছি বলেছি, আরও বলব। তা হলে অমিত শাহ এবার উল্টো কথা বললেন কেন? এ ছাড়া বলার আর কিছু ছিল না। কিন্তু যদি মনে করেন, এগুলো তাঁর অন্তরের কথা, তবে ভুল হবে। যদি কোনও ভাবে বিজেপি এই নির্বাচনে জিততে পারত, তা হলেই অমিত শাহরা বুক বাজিয়ে নিজেদের কৌশলের জয়গান গাইতেন। কুকথাকেই নির্বাচনের মহৎ কৌশল বলে প্রচার করতেন। অর্থাৎ জয়ী হলেই মিথ্যা সত্য হয়ে যেত, অনৈতিকতা নৈতিক ও সভ্য আচরণ হয়ে যেত। এ জন্যই ভারতের পার্লামেন্টারি রাজনীতির অঙ্গন এতটাই পচে গিয়েছে যে তার দুর্গন্ধে টেকা দায়।

দিল্লি নির্বাচনের আগে যতগুলি বিধানসভা নির্বাচন হয়েছে তার বেশিরভাগেই বিজেপি পরাজিত হয়েছে। গত লোকসভা নির্বাচনের কয়েক মাস আগে মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, ছত্তিশগড়ে বিজেপিকে গদিচূ্যত করেছিল সেখানকার মানুষ। মহারাষ্ট্রের বিজেপি গদিচ্যুত। অতি সম্প্রতি ঝাড়খণ্ডেও ক্ষমতা হারিয়েছে বিজেপি। হরিয়ানায় গঠন করেছে এক গোঁজামিলের সরকার। ২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনে দেশের মানুষকে যে অজস্র প্রতিশ্রুতি বিলিয়েছিল বিজেপি, প্রমাণ হয়ে যায় তার সবই ভুয়ো। ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনের আগে বিজেপির জনসমর্থন পৌঁছে যায় একেবারে তলানিতে। বিজেপি নেতারা বুঝে যান, গত পাঁচ বছরের কাজের যা রেকর্ড তা দিয়ে আর যা-ই হোক, নির্বাচনে জেতা যাবে না। বেকারসমস্যা অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। মূল্যবৃদ্ধি আকাশছোঁয়া। ছাঁটাই হয়ে যাচ্ছে লাখ লাখ শ্রমিক-কর্মচারী। এই অবস্থায় তাঁদের দরকার ছিল একটা পুলওয়ামা, বালাকোটে বিমান হানার গল্প। পুলওয়ামা হত্যাকাণ্ডের এক বছর পরও সরকার তা নিয়ে কী তদন্ত করেছে, আদৌ কোনও তদন্ত হয়েছে কি না, তা না জানতে পারল দেশের মানুষ, না জানতে পারল নিহত জওয়ানদের পরিবার-পরিজনরা। এই অবস্থায় দিল্লি নির্বাচনে জনজীবনের সমস্যাগুলি নিয়ে বিজেপির বলার কিছুই ছিল না।

স্বাভাবিক ভাবেই প্রচারে বিজেপির কোনও নেতাই উন্নয়ন, মূল্যবৃদ্ধি, কর্মসংস্থান, মন্দা প্রভৃতি বিষয়গুলির ধার দিয়েও যাননি। তাঁদের একমাত্র ইস্যু হয়ে ওঠে শাহিনবাগ। তাঁরা নির্বিচারে আক্রমণ শুরু করেন শাহিনবাগের আন্দোলনকারীদের। বলতে থাকেন, শাহিনবাগে যাঁরা অবস্থান করছেন তাঁরা পাকিস্তানি। কোনও কোনও নেতা বললেন, এঁদের কারও কাগজ নেই। এঁরা সব বাংলাদেশি। কেউ বললেন, এঁরা দেশকে ভাঙতে চায়। সব দেশদ্রোহী। কেন্দ্রীয় অর্থ প্রতিমন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুর বললেন, দেশ কে গদ্দারো কো, গোলি মারো শালোঁ কো। দিল্লির সাংসদ প্রবেশ বর্মা শাহিনবাগের আন্দোলনকারীদের সম্পর্কে বলে দিলেন, ‘‘এরা ঘরে ঢুকে আপনাদের মেয়ে-বোনকে ধর্ষণ করবে।” বললেন, ‘বিজেপি ক্ষমতায় এলে শাহিনবাগ খালি করতে এক ঘণ্টাও লাগবে না।’ নির্বাচনকে হিন্দু-মুসলমানের যুদ্ধ হিসাবে দেখাতে আপ থেকে বিজেপিতে যাওয়া নেতা কপিল মিশ্র বললেন, এটা আসলে ‘ভারত-পাকিস্তান মোকাবিলা’। প্রধানমন্ত্রী কিংবা অমিত শাহ সেদিন এঁদের কাউকে বলেননি, যে এমন বক্তব্য অনুচিত। বলেননি যে এর দ্বারা রাজনৈতিক পরিবেশ কলুষিত হয়। গণতন্তে্র বিরোধী মতপ্রকাশের যে অধিকার রয়েছে তাকে দমন করা হয়। অবশ্য অমিত শাহরা তাঁদের সংযত করবেন কী করে– তিনি তো নিজেই প্রচারে বলেছিলেন, এত রাগে ইভিএমের বোতাম টিপুন যেন কারেন্ট লাগে শাহিনবাগে।’ ফলে কুকথা বলা উচিত না অনুচিত তা বলার কোনও অধিকারই তাঁর নেই। কারণ তিনিও সমান অপরাধে অপরাধী। তা ছাড়া মূল্যায়নে ভুলের যে কথা তিনি বলেছেন তাও সত্য নয়। কারণ এটা ভুলের বিষয়ই নয়। যখন তাঁরা বুঝেছিলেন মানুষকে তাঁদের বলার কিছু নেই, তখন অত্যন্ত ঠাণ্ডা মাথায় তাঁরা পরিকল্পনা করেছিলেন যে, শাহিনবাগকেই তাঁরা আক্রমণের কেন্দ্রবিন্দু করবেন। সাম্প্রদায়িক প্রচারকেই তাঁরা একমাত্র হাতিয়ার করবেন। মেরুকরণকেই গোটা দল একমাত্র অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করবে।

অথচ অমিত শাহরা পরিষ্কার জানতেন, শাহিনবাগের অবস্থানকারীরা কারা। কী তাঁদের উদ্দেশ্য। তাঁদের দাবি এবং পদ্ধতি যে সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক তা-ও বিজেপি নেতাদের অজানা ছিল না। কিন্তু যে উদ্বেগ-আতঙ্ক থেকে দু’ডিগ্রি তাপমাত্রার শীতে সদ্যোজাত সন্তানকে নিয়ে কোনও মা দিন-রাত খোলা আকাশের নিচে কাটাতে পারেন তা উপলব্ধি করার জন্য রাজনীতির মধ্যে যে নৈতিকতা, যে সংবেদনশীলতা থাকা দরকার তা অমিত শাহদের রাজনীতিতে নেই। এই অবস্থানেই দিনের পর দিন কাটানো এক শিশুর ঠাণ্ডা লেগে মৃত্যুর ঘটনা কারও অজানা নয়। তারপরও সন্তানহারা মা বলেছেন, আমার অপর সন্তানের ভবিষ্যতের কথা ভেবেই আমি আবারও যাব অবস্থানে। সংগ্রামী মাতৃত্বের এই মনোভাবকে সারা দেশ কুর্নিশ জানিয়েছে। শুধু বিদ্বেষ-বিষে পরিপূর্ণ বিজেপি নেতাদের মনেই তা কোনও দাগ কাটতে পারেনি।

শুধু তো শাহিনবাগের মানুষই নন, সিএএ-এনআরসির বিরোধিতায় সোচ্চার আজ সমস্ত স্তরের মানুষ। ছাত্ররা বেরিয়ে আসছেন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। যাঁরা সাধারণত নিজেদের পেশা নিয়েই ব্যস্ত থাকেন সেই শিল্পী সাহিত্যিক নাট্যকর্মী সাংবাদিক শিক্ষক চিকিৎসক বুদ্ধিজীবীরাও প্রতিবাদে মুখর হয়েছেন। একের পর এক রাজ্যে বিধানসভায় পাশ হচ্ছে সিএএ-এনপিআর বিরোধী প্রস্তাব। মুখ খুলছেন বিচারপতিরা। বলছেন, সরকারি আইনের প্রতিবাদ করা মানুষের ন্যায্য অধিকার। গায়ের জোরে কোনও সরকার তা কেড়ে নিতে পারে না।

দেশ জুড়ে মানুষের এই আতঙ্ক-উদ্বেগকে শুধুমাত্র সরকারি ক্ষমতার ঔদ্ধত্যেই উড়িয়ে দিচ্ছেন বিজেপি নেতারা। তাঁদের রাজনীতির মধ্যে গণতান্ত্রিক মনোভাবের কোনও জায়গা নেই, তাঁদের রাজনীতি শুধুই ক্ষমতা দখলের উপায়। তাই এই রাজনীতিতে জেতাটাই শেষ কথা। ক্ষমতা দখলটাই শেষ কথা। তাই কুলদীপ সেঙ্গারের মতো উন্নাওয়ের শিশুঘাতী, ধর্ষকরা অনায়াসেই দলে নেতা বলে জায়গা পেয়ে যায়। মালেগাঁও বিস্ফোরণের অন্যতম অভিযুক্ত সাধ্বী প্রজ্ঞার মতো মহিলা দিব্যি সাংসদ হয়ে সমাজে বিভাজনের বিষ ছড়াতে থাকেন।

অমিত শাহ দাবি করেছেন, দিল্লি নির্বাচনে এই শোচনীয় পরাজয়ের সঙ্গে সিএএ-প্রতিবাদের কোনও যোগ নেই। এর দ্বারা মানুষের রায়কে ঢাকতে চাইছেন। যদি তাঁরা জিততেন তা হলেও কি এ কথা বলতেন? তখন কি বলতেন না, এই ফল বাস্তবে সিএএ-র পক্ষে রায়। তা হলে এখন কেন তাঁরা এটা মেনে নেবেন না যে, এই রায় আসলে সিএএ-এনআরসির বিরুদ্ধে জনগণের রায়? অমিত শাহ মুখে যা-ই বলুন, তাঁরা নিজেরা জানেন, কারা সরকার গড়বে এটা যেমন এই নির্বাচনের বিচার্য বিষয় ছিল, তেমনই বিজেপির বিভাজনের রাজনীতিকে মানুষ সমর্থন করছে কি না, তারও পরীক্ষা ছিল এই নির্বাচন। ফল থেকে স্পষ্ট, মানুষ দিল্লির সরকারে যেমন বিজেপিকে দেখতে চায়নি, তেমনই তাদের বিভাজনের রাজনীতিকে, এনআরসি-সিএএ চালুর কর্মসূচিকেও মানুষ প্রত্যাখান করেছে। প্রত্যাখ্যান করেছে জেএনইউ, জামিয়া মিলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশ-সমাজবিরোধীদের একতরফা আক্রমণকে। এই রায় দেশজুড়ে এনআরসি-সিএএ বিরোধী আন্দোলনকে আরও জোরদার করবে। আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী মানুষের মনোবল আরও বাড়িয়ে দেবে। বিজেপি সরকার যদি এর থেকে শিক্ষা নিয়ে সিএএ প্রত্যাহার না করে, তবে মানুষের আরও জোরালো প্রতিবাদের জন্য তাঁদের প্রস্তুত থাকতে হবে।

(গণদাবী : ৭২ বর্ষ ২৮ সংখ্যা)