জিডিপি-র নিরিখে শিক্ষা বরাদ্দ কমাল বিজেপি

সর্বকালীন দীর্ঘ বাজেট বক্তৃতায় কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমন ২০২০-২১ সালের যে বাজেট সংসদে পেশ করেছেন তা সাধারণ মানুষের স্বার্থবিরোধী। তিনি শিক্ষায় ৯৯,৩১১কোটি টাকা এবং দক্ষতা উন্নয়নের জন্য ৩০০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছেন। শিক্ষায় গত অর্থবর্ষের বাজেট বরাদ্দের তুলনায় এ বছর বরাদ্দের পরিমাণ বেড়েছে ৪৫০০ কোটি টাকা। কিন্তু ৪ শতাংশ মুদ্রাস্ফীতি ধরলে এই বৃদ্ধি সামান্য। টাকার পরিমাণে বরাদ্দ বেশি হলেও বাস্তবে বরাদ্দ গত বছরের তুলনায় বাড়েনি। এই বরাদ্দ জিডিপির মাত্র ০.৪৪ শতাংশ, যেখানে গত বছর তা ছিল ০.৪৫ শতাংশ। আর ২০১৪ সালে বিজেপি ক্ষমতায় আসার আগে ২০১৪-১৫ সালে তা ছিল ০.৫৩ শতাংশ। তারপর থেকে তা ক্রমশই কমেছে।

মোট খরচের হিসাবেও শিক্ষায় বরাদ্দ কমেছে। ২০১৪-১৫ সালে তা ছিলমোট খরচের ৪.১৪ শতাংশ। আর এ বছর তা কমে হয়েছে ৩.২৬ শতাংশ। শিক্ষাবিদদের দাবি শিক্ষায় বাজেট বরাদ্দ জিডিপির ১০ শতাংশ করতে হবে। কিন্তু স্বাধীনতার পর কেন্দে্র আসীন কোনও সরকারই সে দাবি মানেনি। বাজেট বত্তৃতায় অর্থমন্ত্রী দাবি করেছেন কেন্দ্রীয় সরকার দেশে উচ্চমানের শিক্ষা দেবার পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। কিন্তু অর্থ বরাদ্দের পরিমাণ তাঁর সঙ্গতিপূর্ণ নয়। তিনি বলেছেন নতুন শিক্ষানীতি শীঘ্রই চালু করা হবে। উল্লেখ্য, ২০১৯ সালে প্রকাশিত জাতীয় শিক্ষানীতির খসড়ায় বলা হয়েছে ২০৩০ সালের মধ্যে শিক্ষা খাতে খরচ মোট সরকারি খরচের ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২০ শতাংশ করতে হবে। অথচ এবারের বাজেটে যে অর্থ শিক্ষায় বরাদ্দ করা হয়েছে তা এর ধারে কাছেও নেই। এর কারণ সরকার শিক্ষার ব্যয় বহনের দায়িত্ব অস্বীকার করতে চাইছে। যে নতুন জাতীয় শিক্ষানীতি কেন্দ্রীয় সরকার চালু করতে চলেছে তা শিক্ষার বেসরকারিকরণ ও বাণিজ্যিকীকরণকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছে। সেইসঙ্গে জনহিতকর সংস্থা ও কর্পোরেট হাউসগুলিকে শিক্ষায় অর্থব্যয় করতে আহ্বান জানানো হয়েছে। এটা অবশ্য প্রথম নয়। রাজীব গান্ধীর প্রধানমন্ত্রীত্বের সময় ১৯৮৬ সালের জাতীয় শিক্ষানীতি থেকেই কেন্দ্রীয় সরকার শিক্ষার ব্যয়ভার বহনের দায়িত্ব অস্বীকার করে বলে সরকারের পক্ষে শিক্ষার সব ব্যয়ভার বহন করা সম্ভব নয়। বর্তমান শিক্ষানীতিও সেই পথেই চলেছে। কাজেই এই শিক্ষানীতি সাধারণ মানুষের স্বার্থ রক্ষা করবে না, করবে দেশি-বিদেশি পুঁজিপতি ও কর্পোরেট হাউসের।

উচ্চমানের শিক্ষা দেবার উদ্দেশে এই বাজেটে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ ও বাণিজ্যিক ঋণ নেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। বর্তমানে শিক্ষায় ১০০ শতাংশ প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ করা যায়। শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিবর্গের আশঙ্কা এর ফলে ভারতের শিক্ষাক্ষেত্রটি বিদেশি পুঁজির মুনাফার বাজারে পরিণত হবে। স্বাভাবিকভাবেই শিক্ষার ব্যয়ভার এত বৃদ্ধি পাবে যে শিক্ষা সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাবে। বাজেটে অনলাইন শিক্ষার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। এর ফলে শ্রেণি কক্ষে ছাত্র- শিক্ষক সম্পর্কের ভিত্তিতে শিক্ষা লাভের সুযোগ থেকে ছাত্ররা বঞ্চিত হবে। তাছাড়া এর দ্বারা প্রয়োজনীয় সংখ্যক নতুন নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন এবং শিক্ষক নিয়োগ করার দায়িত্ব থেকে সরকার অব্যাহতি নিতে চাইছে। আর যেখানে দেশে অধিকাংশ মানুষ দারিদ্রসীমার নীচে সেখানে অনলাইন শিক্ষার সুযোগ থেকেও তাঁরা বঞ্চিত হবে। এই বাজেটের আর একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হল সাধারণ শিক্ষার সঙ্গে নিয়োগযোগ্যতাকে সংযুক্ত করা। অর্থাৎ সরকারের দৃষ্টিতে শিক্ষার উদ্দেশ্য হবে চাকরির উপযুক্ত করা। চাকরির নতুন নতুন ক্ষেত্র তৈরি না করে এসব কথা বলার অর্থ কী? বাস্তবে এর দ্বারা মানুষকে বিভ্রান্ত করে শিক্ষার উদ্দেশ্য যে ‘ম্যান-মেকিং ক্যারেকটার-বিল্ডিং’ তা অস্বীকার করা হচ্ছে না কি ? একজন ছাত্র শিক্ষার মধ্য দিয়ে আধুনিক মানুষ হোক, উন্নত মূল্যবোধ ও নৈতিকতার সন্ধান পাক, পশ্চাৎপদ চিন্তা ও অপসংস্কৃতির কবল থেকে মুক্ত হোক এটাতেই কি জোর দেওয়া জরুরি ছিল না?

ডঃ প্রদীপ কুমার দত্ত

অবসরপ্রাপ্ত প্রধান, পদার্থবিদ্যা বিভাগ, প্রেসিডেন্সি কলেজ

(গণদাবী : ৭২ বর্ষ ২৮ সংখ্যা)