গণবিক্ষোভে ফুঁসছে ইরাক

ইরাকের রাজপথ উত্তাল সরকার বিরোধী বিক্ষোভে৷ আন্দোলনের চাপে প্রধানমন্ত্রী আদেল আবদুল মাহদি জানিয়েছেন, যদি রাজনৈতিক দলগুলি রাজি থাকে, পদত্যাগে তাঁর আপত্তি নেই৷ নির্বাচন এগিয়ে আনতে ইরাকের প্রেসিডেন্ট বারহাম সালেহ নতুন আইনের খসড়া তৈরি করা শুরু করেছেন৷

অক্টোবর মাস জুড়ে ইরাক দু–দফায় উত্তাল হয়ে ওঠে বিক্ষোভে৷ ব্যাপক গরিবি, বেকারি, প্রশাসনিক অপদার্থতা ও সরকারের দুর্নীতির বিরুদ্ধে ১ অক্টোবর পথে নামেন ইরাকের হাজার হাজার মানুষ৷ তাঁদের দাবি ইরাকের রাজনৈতিক ব্যবস্থার সংস্কার করতে হবে৷ বিক্ষোভে প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবিও ওঠে৷ বিক্ষোভকারীদের অধিকাংশই বয়সে তরুণ৷ ছিলেন স্কুল–কলেজ–বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরাও৷

এক বছর আগে উন্নয়নের ঢালাও প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর পদে বসেছিলেন আবদুল মাহদি, যার এক শতাংশও পূরণ করেননি তিনি৷ এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে ইরাকের মানুষ৷ ১ অক্টোবর রাজধানী বাগদাদে শুরু হয়ে দ্রুত দেশের নানা জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে বিক্ষোভ৷ প্রথম দফায় ছ’দিন ধরে লাগাতার চলতে থাকে প্রতিবাদী মিছিল, রাজপথ অবরোধের ঘটনা৷ আন্দোলনকারীদের উপর নির্মম আক্রমণ চালায় পুলিশ৷ মাথা, বুক লক্ষ্য করে গুলি, বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে কড়া ধরনের কাঁদানে গ্যাসের শেল খুব কাছ থেকে ছোঁড়া যাতে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে– এসব কোনও কিছুই বাদ দেয়নি পুলিশ৷ সংঘর্ষে মৃত্যু হয় ১৪৯ জনের৷ বিক্ষোভের চাপে প্রধানমন্ত্রী তাঁর মন্ত্রীসভার রদবদল, উঁচু পদের সরকারি কর্মীদের বেতন ছাঁটাই এবং বেকারি দূর করার জন্য নতুন নতুন প্রকল্প ঘোষণা করার প্রতিশ্রুতি দেন৷

কিন্তু বেশ কয়েকদিন কেটে গেলেও প্রতিশ্রুতি পালনে সরকারের উদ্যোগ চোখে না পড়ায় ২৫ অক্টোবর থেকে ইরাকের মানুষ আবার রাস্তায় নামেন৷ ২৮ অক্টোবর মহিলা–পুরুষ নির্বিশেষে হাজার হাজার মানুষ, বিশেষত ছাত্র–যুবরা রাজধানী বাগদাদ সহ অন্যান্য শহরে বিক্ষোভ মিছিলে সামিল হন৷ রাজধানী শহরের তাহরির স্কোয়ারে ধরনা এবং রাজনৈতিক কেন্দ্রস্থল ‘গ্রিন জোন’–এ পৌঁছবার সেতু অবরোধ করে রাখেন বিক্ষোভকারীরা৷ অবরোধ হঠাতে পুলিশ আবার ব্যাপক হামলা চালায়৷

প্রাকৃতিক সম্পদে, ঐতিহ্যে, প্রগতিশীলতায় আরব দুনিয়ার অন্যতম সমৃদ্ধ দেশ ইরাকের দুঃসময়ের শুরু ২০০৩ সালে৷ দেশের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হুসেন গণবিধ্বংসী অস্ত্র মজুত রেখেছেন, এই অজুহাতে ওই বছর ইরাকে নির্মম আগ্রাসন শুরু করে সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা৷ লক্ষ্য ছিল ইরাকের বিপুল তেলসম্পদের দখল নেওয়া৷ এই হানাদারিতে নিহত হন ইরাকের হাজার হাজার মানুষ৷ আহত অসংখ্য৷ গোটা দেশটাকে গুঁড়িয়ে দেয় সাম্রাজ্যবাদী সেনারা৷ সন্ত্রাসবাদী আইসিস বাহিনীকে দমনের নামে বছরের পর বছর ধরে ইরাকে সেনা মোতায়েন রাখে আমেরিকা৷ ২০০৫–এ ইরাকে কায়েম হয় মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের পুতুল সরকারের শাসন৷ সেই থেকে একের পর এক নির্বাচন হয়েছে৷ কিন্তু দুর্নীতিমুক্ত, জনদরদী সরকারের দেখা মেলেনি৷ দুনিয়ার আর পাঁচটা পুঁজিবাদী দেশের মতো ইরাকেও ক্রমাগত বেড়ে চলেছে গরিবি, বেকারি, দুর্নীতির মতো সমস্যা৷ বিপুল তেল সম্পদে সমৃদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও বর্তমানে সরকারি হিসাবেই ইরাকের ২৩ শতাংশেরও বেশি মানুষ বাস করেন দারিদ্রসীমার নিচে৷ সরকারি হিসাবেই তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হার ২৫ শতাংশ৷ বাস্তবটা এর চেয়েও ভয়ঙ্কর৷ অসহনীয় এই পরিস্থিতির বিরুদ্ধে ইরাকের মানুষ পুলিশের নির্মম আক্রমণ উপেক্ষা করে দিনের পর দিন বিক্ষোভ চালিয়ে যাচ্ছেন৷ প্রাণ দিচ্ছেন৷ আবার রক্তে ভিজছে ইরাকের পথঘাট৷

বিক্ষোভকারীদের প্রতি সংহতি জানিয়ে ইরাকী সংসদের চারজন সদস্য পদত্যাগ করেছেন৷ আন্দোলনের চাপে প্রধানমন্ত্রী মাহদি কর্মহীন দরিদ্র পরিবারগুলির জন্য পেনশন, গরিব মানুষের থাকার জন্য জমি এবং যুবকদের সহজে ঋণ দেওয়ার মতো কিছু প্রকল্পের কথা ঘোষণা করেছেন৷ এমনকি সম্প্রতি পদত্যাগেও রাজি হয়েছেন তিনি৷

প্রধানমন্ত্রীকে ক্ষমতা থেকে সরে যেতে বাধ্য করা অবশ্যই গণআন্দোলনের একটা গুরুত্বপূর্ণ দাবি আদায়৷ কিন্তু এক প্রধানমন্ত্রীর বদলে অন্য প্রধানমন্ত্রী এলেও মানুষের মূল সমস্যাগুলির সমাধান যে হবে না, এই আন্দোলনে সেই সচেতনতা আসা আজ খুবই জরুরি৷ সমৃদ্ধ ইরাককে যে সাম্রাজ্যবাদী হানাদারি ধ্বংস করেছে, ইরাকের মানুষের আন্দোলন একদিকে তার বিরুদ্ধে যেমন পরিচালিত হওয়া দরকার, একই সাথে দেশের অভ্যন্তরে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা উচ্ছেদের পথেই এই আন্দোলন চালিত করা দরকার৷ এই পথেই ইরাকের জনগণ পাবেন তাঁদের আকাঙ্খিত মুক্তি৷

(গণদাবী : ৭২ বর্ষ ১৩ সংখ্যা)