‘কৃষকবন্ধু’ কীভাবে হলেন মুখ্যমন্ত্রী একটু ব্যাখ্যা করে বলুন

সুখে–শান্তিতে সপরিবারে বেঁচে থাকার জন্য নয়, মরলে চাষির পরিবারকে রাজ্য সরকার দেবে দু’লাখ টাকা৷

ফসলের দাম না পেয়ে দেনার দায়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত চাষিকে যদি বলা হয়, বেঁচে থাকলে তুমি কিছু পাবে না, মরলে পাবে ২ লাখ টাকা– একে সরকারি উদ্যোগে আত্মহত্যার প্ররোচনা ছাড়া আর কী–ই বা বলা যায়! গরিব মানুষের প্রতি এ এক নিষ্ঠুর ব্যঙ্গ৷ অথচ এই প্রকল্পের নাম ‘কৃষকবন্ধু’

সংবাদমাধ্যমে ঢালাও বিজ্ঞাপন– কৃষকবন্ধু প্রকল্প নতুন বছরে মুখমন্ত্রীর উপহার৷ কিন্তু কৃষকরা কি সরকারের কাছে এমন উপহার চেয়েছে? কৃষকরা যা চায় তা হল সার বীজ কীটনাশকের দাম তাদের আয়ত্তের মধ্যে থাকুক৷ এগুলি নিয়ে ফাটকাবাজি বন্ধ হোক৷ সরকার কৃষিতে ব্যবহূত বিদ্যুতের দাম, ডিজেলের দাম কমাক৷ তারা চায় ফড়ে–কালোবাজারি–মজুরদারের থাবা থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে ফসলের উপযুক্ত দাম৷ তাদের দাবি, সরকার উপযুক্ত পরিমাণ সহায়ক মূল্য ঘোষণা করুক এবং সে দাম যাতে প্রত্যেক কৃষক পায় সরকার তার ব্যবস্থা করুক৷ এগুলি হলে কৃষককে আত্মহত্যা করতে হয় না৷ সরকারকেও টাকা দিতে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করতে হয় না৷ মুখ্যমন্ত্রী কি এই সমস্যাগুলির সমাধানের ব্যাপারে উদ্যোগী হয়েছেন? সমাধান দূরের কথা, মূল এই সমস্যাগুলির কথা তিনি উচ্চারণও করেননি৷ সিপিএম সরকারের মতো তৃণমূল সরকারও কৃষি–বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েই চলেছে৷ কেন্দ্রের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তেলের উপর ট্যাক্স চাপিয়ে চলেছে– সেচের জন্য ব্যবহৃত পাম্পের তেলও তার থেকে রেহাই পায়নি৷ সরকার ঘোষিত সহায়ক মূল্য ফড়ে আড়তদার নামক নেপোতে খেয়ে যাচ্ছে, যা মুখ্যমন্ত্রী নিজেও স্বীকার করেছেন৷ সার বীজ কীটনাশক একচেটিয়া পুঁজির দখলে৷ সেগুলি নিয়ন্ত্রণের কোনও উদ্যোগ কেন্দ্রের মতো রাজ্য সরকারেরও নেই৷ এই সমস্যাগুলি এড়িয়ে কৃষকবন্ধু কি সত্যিই হওয়া যায়? নাকি গরিব কৃষকের অসহায়তার সুযোগে তাদের কিছু পাইয়ে দেওয়ার ঘোষণা করে ভোটের বাজার চাঙ্গা করাই এই ঘোষণার একমাত্র উদ্দেশ্য!

মুখ্যমন্ত্রী দাবি করেছেন, তাঁদের রাজত্বে কৃষকদের আয় নাকি তিনগুণ বেড়ে গেছে৷ একেবারে তিনগুণ এ তো বাংলায় একেবারে স্বর্গ নামিয়ে আনা অবশ্য হবে না–ই বা কেন, কেন্দ্র সরকার যদি ২০২২ সালের মধ্যে কৃষকদের আয় দ্বিগুণ করে দেব বলে ঘোষণা করে তবে তাকে টেক্কা দিতে তিন গুণের কমে আর ঘোষণা করা যায় কী করে কিন্তু এই যেখানে চাষিদের দুরবস্থা সেখানে কোন জাদুমন্ত্রে মুখ্যমন্ত্রী বাংলার কৃষকদের আয় তিন গুণ করে দিলেন? আর তাই যদি করে দিলেন তবে কৃষকরা অনাহারে কিংবা আত্মহত্যায় মরছে কেন? কেন মৃত্যুর জন্য ২ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ ঘোষণা করে কৃষক দরদি সাজার মরিয়া চেষ্টা করতে হচ্ছে সরকারকে? দেখা যাক, সরকারি এই দাবির বাস্তব ভিত্তি কতখানি৷

ন্যাশনাল স্যাম্পল সার্ভের দেওয়া তথ্য অনুসারে, ২০০২–০৩ থেকে ২০১২–১৩ এই সময়ে কৃষিতে বৃদ্ধির হার যেখানে হরিয়ানায় ৮.৩ শতাংশ, ওড়িশায় ৭.৬ শতাংশ, সেখানে পশ্চিমবঙ্গে তা –১.৩ শতাংশ৷ সারা দেশে বৃদ্ধির হারে সবচেয়ে নিচে৷ ২০১৩–র জানুয়ারি–ডিসেম্বর রিপোর্ট অনুসারে ভারতে কৃষক পরিবারের ৫৩.৩৭ শতাংশ দারিদ্রসীমার নিচে বাস করে, পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে সেই সংখ্যা ৫৬.৯৪ শতাংশ, যা সর্বভারতীয় গড় পরিসংখ্যানের চেয়ে ৩.৫ শতাংশ বেশি৷ পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, এ রাজ্যে কৃষি থেকে আয় ক্রমাগত নেমে চলেছে৷ মুখ্যমন্ত্রী দাবি করতে পারেন, তাঁদের আগে যাঁরা ক্ষমতায় ছিলেন তাঁদের অপদার্থতাতেই রাজ্যের এই দুরবস্থা৷ তাঁরা এসে কৃষির খোলনলচে এমন বদলে দিয়েছেন যার ফলে এমন অভাবনীয় উন্নতি ঘটেছে৷ কিন্তু কীভাবে তাঁরা তা করলেন তার কোনও হদিশ রাজ্যের মানুষ জানে না৷ রাজ্য সরকারের ব্যুরো অফ অ্যাপ্লায়েড ইকনমিকস অ্যান্ড স্ট্যাটিস্টিকসের ‘স্টেট স্ট্যাটিস্টিক্যাল হ্যান্ডবুক ২০১৫’–র তথ্য অনুসারে ২০১১ থেকে ২০১৫–তে ভোগ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির হার বেড়েছে ৩৪.০৯ শতাংশ৷ সেই সময়ে কৃষিক্ষেত্রে আয় বেড়েছে ৫৯.২৯ শতাংশ৷ অর্থাৎ কৃষকের যথার্থ আয়বৃদ্ধির পরিমাণ ২৫.২০ শতাংশ৷ তা হলে কৃষকের বার্ষিক আয় বৃদ্ধির পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে ৬.৩ শতাংশ হারে৷ যাকে মুদ্রাস্ফীতির নিরিখে বিচার করলে আয়বৃদ্ধিই বলা যায় না৷ ২০১৭ ও ২০১৮ এই দু’বছরেই পশ্চিমবাংলায় বন্যার প্রকোপে চাষের মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে৷ রাজ্য সরকার ঘোষণা করেছিল ২০১৭–র বন্যায় ৮০ শতাংশ কৃষি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল এবং ২০১৮–র বন্যার ক্ষতিপূরণ হিসাবে মুখ্যমন্ত্রী কেন্দ্রের থেকে ৩০ হাজার কোটি টাকা চেয়েছিলেন৷ তা সত্ত্বেও এই সময়ে কী এমন মিরাকল ঘটল যে চাষির আয় তিনগুণ হয়ে গেল তা কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী রাজ্যের মানুষকে জানাননি৷ 

আসলে এ সব অবাস্তব কথা বলে, সরকার কৃষকদের কত ভাল রেখেছে তারই প্রচার করা হয়, মিথ্যার জাল বুনে কৃষকদের ধোঁকা দেওয়া হয়৷ ‘কৃষকবন্ধু’ প্রকল্পটি তেমনই একটি প্রকল্প৷ মৃত কৃষকের পরিবারকে ২ লাখ টাকা পেতে হলে প্রথমে মৃত ব্যক্তি যে কৃষক তা প্রমাণ করতে হবে৷ আর এই প্রমাণ তখনই সম্ভব হবে যখন তৃণমূলের নেতামন্ত্রীরা তাকে কৃষক হিসেবে স্বীকৃতি দেবেন৷ তাঁদের স্বীকৃতির অভাবেই তো রাজ্যে একের পর এক কৃষক মৃত্যুর পরও তাঁরা সগর্বে ঘোষণা করেন রাজ্যে ঋণের দায়ে কিংবা ফসলের ন্যায্য দাম না পেয়ে কোনও কৃষকের মৃত্যু ঘটেনি৷ ফলে আগামী দিনেও যত কৃষকের মৃত্যুই ঘটুক কোনও পরিবার এই টাকা পাবে কি না তাতে গুরুতর সন্দেহ রয়েছে৷ একই ভাবে প্রতি একর খারিফ এবং রবি চাষের জন্য দু–কিস্তিতে ৫ হাজার টাকা প্রতি কৃষককে দেওয়ার যে ঘোষণা সরকার করেছে তা–ও কতজন কৃষক পাবে বা আদৌ পাবে কি না, তা কেউ জানে না৷ পেলেও তৃণমূল নেতাদের কমিশন কেটে কৃষকের হাতে কত থাকবে তা একমাত্র সংশ্লিষ্ট তৃণমূল নেতাদের মর্জির উপরই নির্ভর করছে৷

ভোটের নামে কৃষকদের নিয়ে এই খেলা কেন্দ্র এবং রাজ্য দুই সরকারই খেলে চলেছে৷ কৃষকরা সেই দুরবস্থার মধ্যেই পড়ে রয়েছে৷ এ অন্যায়–মিথ্যাচার–প্রতারণার অবসান নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার পাল্টেপাল্টে এতদিন হয়নি, ভবিষ্যতেও হবে না৷ এর জন্য চাই কৃষক–শ্রমিক তথা গরিব খেটে খাওয়া মেহনতি মানুষের ঐক্যবদ্ধ গণআন্দোলন– যে আন্দোলন একদিকে কৃষকদের দাবিগুলি আদায় করবে, অন্য দিকে শোষণমূলক, ভোটকেন্দ্রিক এই ব্যবস্থাকে পাল্টে সত্যিকারের জনগণের রাজ কায়েম করবে৷

(গণদাবী : ৭১ বর্ষ ২২ সংখ্যা)