করোনা অতিমারি হয়ে ওঠার জন্য সরকারি অবহেলাই দায়ী

করোনা অতিমারি মোকাবিলায় চিকিৎসকদের অভিজ্ঞতা জানতে গণদাবীর পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয়েছিল সার্ভিস ডক্টর্স ফোরামের সাধারণ সম্পাদক ডাঃ সজল বিশ্বাসের সঙ্গে৷ তাঁর মতামত এখানে প্রকাশ করা হলঃ

করোনা সংক্রমণে দেখতে দেখতে ভারত বিশ্বের বেশির ভাগ দেশকে পিছনে ফেলে উঠে এসেছে চতুর্থ স্থানে৷ সর্বোচ্চ স্থান দখল এখন কেবল সময়ের অপেক্ষা৷ দেশের প্রধানমন্ত্রীর তালি বাজাও, থালা বাজাও–এর আহ্বানও পারল না করোনা আক্রমণের হাত থেকে আমজনতাকে রক্ষা করতে৷

অত্যন্ত অপ্রতুল সংখ্যক করোনা পরীক্ষা এবং তথ্য গোপনের সব রকম সরকারি প্রচেষ্টা সত্ত্বেও এখন প্রতিদিন দশ হাজারের উপরে মানুষ দেশে করোনা আক্রান্ত হচ্ছেন৷ এ রাজ্যেও সংখ্যাটি চারশোর উপরে৷ মৃত্যুর হারও নেহাত কম নয়৷ দেশে গড়ে চার শতাংশের কাছাকাছি মানুষ এই রোগে মারা যাচ্ছেন৷ পশ্চিমবঙ্গে সংখ্যাটা পাঁচ শতাংশের উপরে৷ মৃত্যুহার হয়ত আর পাঁচটা রোগের তুলনায় কমই৷ কিন্তু ভয়ের বিষয় হল, রোগটি যেহেতু অতিরিক্ত মাত্রায় সংক্রামক, ফলে জনস্বাস্থ্য বিজ্ঞানকে ঠিকমতো প্রয়োগ না করলে রোগটি দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়তে পারে৷ এর ফলে এক সাথে বিপুল সংখ্যক মানুষকে হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসা করার প্রয়োজন হয়ে পড়ে৷ সেই ব্যবস্থা না করতে পারলে মৃত্যুহার বহুগুণ বেড়ে যেতে পারে৷ সেই কারণেই রোগটি নিয়ন্ত্রণে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া দরকার৷ রোগটি নতুন হলেও, অর্থাৎ এর ভাইরাসটি পৃথিবীতে নতুন রূপে এলেও যেহেতু রোগটি প্রতিরোধযোগ্য এবং এর প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থাদি আমাদের জানা, তাই আমরা আশা করেছিলাম, ভারতের মতো একটি জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রের সরকার এই অতিমারি দমনে যথাযথ ভূমিকা পালন করবে৷ কিন্তু বাস্তবে মানুষ কী দেখতে পেল?

করোনা নিয়ন্ত্রণে লকডাউন একমাত্র পদক্ষেপ না হলেও তা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ৷ এর দ্বারা করোনা নির্মূল হয়ত করা যায় না, কিন্তু এর মাধ্যমে রোগ সংক্রমণের হারকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় কিছু দিনের জন্য৷ যে সুযোগকে কাজে লাগিয়ে রোগ নির্মূলীকরণের ব্যবস্থা করা, অর্থাৎ দ্রুত রোগ নির্ণয় করার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে টেস্টের ব্যবস্থা করা, চিহ্ণিত এবং সন্দেহজনক মানুষদের সরকারি ভাবে এবং বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে চিকিৎসা এবং কোয়ারেন্টাইনের ব্যবস্থা করা, চিকিৎসার ডপযুক্ত পরিকাঠামো গড়ে তোলা ইত্যাদি কাজ করা যায়৷ আমাদের দেশের স্বাস্থ্য পরিকাঠামো এমনিতেই অত্যন্ত অপ্রতুল৷ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ অনুযায়ী যেখানে প্রতি হাজার মানুষ পিছু কমপক্ষে ৩টি হাসপাতাল শয্যা থাকার কথা, সেখানে আমাদের দেশে রয়েছে মাত্র ০.৭টি৷ অর্থাৎ এমনিতেই দেশে প্রয়োজন আরও প্রায় পাঁচগুণ বেশি হাসপাতাল শয্যা৷ করোনাজনিত কারণে এই প্রয়োজন স্বভাবতই আরও বহু গুণ বেড়ে গেছে৷ অথচ দেশে আজ পর্যন্ত করোনার জন্য নতুন কোনও হাসপাতাল তৈরি করা হয়নি৷ ঠিক তেমনই বর্তমানে সরকারি পরিষেবায় ডাক্তারের সংখ্যাও খুবই কম৷ বতর্মানে রয়েছে ১১০৮২ জন মানুষ পিছু মাত্র একজন ডাক্তার৷ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশিকা অনুযায়ী করোনা পূর্ববর্তী সময়েই এই প্রয়োজনটা ছিল এর পঁচিশ গুণ বেশি৷ করোনা পরিস্থিতিতে এই প্রয়োজন আরও বহুগুণ বেড়েছে৷ একই ভাবে অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীদের ঘাটতিও মারাত্মক৷

এই পরিস্থিতিতে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার ডভয়েই এই পদক্ষেপকে বাস্তবায়িত করার ক্ষেত্রে কী কী করল? আজ যখন আমরা জগতে আবার শ্রেষ্ঠ আসন গ্রহণ করতে চলেছি বলে সরকারি নেতা–মন্ত্রীদের দাবি, তার প্রাক্কালে একজন সুনাগরিক হিসেবে আপনি কি একবার ভেবে দেখবেন না, যে করোনা প্রতিরোধে বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে কী করা যেত এবং সরকার কী করে চলেছে?

এ কথা আজ দিনের আলোর মতো পরিষ্কার যে, কেন্দ্র এবং রাজ্য উভয় সরকারই এ ব্যাপারে একের পর এক অবৈজ্ঞানিক ও ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে চলেছে৷ এর ফলে সারা দেশব্যাপী করোনা আজ অতিমাত্রায় ছড়িয়ে পড়েছে৷ বহু মানুষ ইতিমধ্যে এই রোগে প্রাণ হারিয়েছেন৷ অন্য দেশের তুলনায় এ দেশে অনেক পরে করোনার প্রবেশ ঘটা সত্ত্বেও সংক্রমণের নিরিখে ভারত আজ ইতিমধ্যেই বিশ্বে চতুর্থ স্থান দখল করেছে৷ এ–ও লক্ষণীয় যে, ইতিমধ্যেই আমেরিকা, ইতালি, স্পেনের মত তথাকথিত ডন্নত দেশগুলি যখন করোনা যুদ্ধে ধরাশায়ী হয়েছে সেখানে জনস্বাস্থ্য বিজ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে এবং সঠিকভাবে লকডাউনকে কাজে লাগিয়ে কিডবা, ভিয়েতনামের মতো কয়েকটি দেশ করোনা নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়েছে৷ অর্থাৎ জনস্বাস্থ্যের প্রতি সরকারের দায়বদ্ধতা এবং সরকারি জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা ও স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর উপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ এবং জনগণের প্রতি সরকারের দায়িত্ববোধ এক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়৷ আমরা লক্ষ করলাম, আমাদের দেশ জনস্বাস্থ্য বিজ্ঞানকে কাজে না লাগিয়ে এবং লকডাউন সফল করার জন্য প্রয়োজনীয় বৈজ্ঞানিক পদক্ষেপগুলি না নেওয়ায় আজ দেশের জনগণ এই ভয়ঙ্কর পরিণতির শিকার হচ্ছে এবং দেশবাসী আরও ভয়ঙ্করতম দিনের দিকে এগিয়ে চলেছে৷ আমরা উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করছি– ক) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর বন্ধ করার ক্ষেত্রে অস্বাভাবিক দেরি, খ) ডোনাল্ড ট্রাম্পের সংবর্ধনা সভায় লক্ষ লক্ষ মানুষের জমায়েত করা, গ) দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ধর্মীয় সভায় লক্ষ লক্ষ মানুষের জমায়েতের অনুমতি দেওয়া, ঘ) বিদেশ থেকে আসা ১৬ লক্ষ মানুষের কোয়ারেন্টাইন বা করোনা পরীক্ষার ব্যবস্থা না করা, ঙ) পরিযায়ী শ্রমিকদের প্রথমেই ঘরে ফিরিয়ে না আনা এবং ফেরানো নিয়ে কেন্দ্র–রাজ্যের দড়ি টানাটানি৷ ফিরে আসার পরে তাদের উপযুক্ত পরীক্ষা ও সরকারি কোয়ারেন্টাইনের ব্যবস্থা না করা, চ) প্রথম থেকেই দরিদ্র দিনমজুর, সাধারণ মানুষের কাছে রেশনের মাধ্যমে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস পৌঁছে না দেওয়া এবং রেশন নিয়ে চূড়ান্ত দুর্নীতি, ছ) অর্থনৈতিক ব্যবস্থা চাঙ্গা করার নাম করে মদের দোকান খুলে দেওয়া৷

লকডাউন চালু করা, শিথিল করা বা বন্ধ করা কোনও ক্ষেত্রেই জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, ভাইরোলজিস্ট, এপিডেমোলজিস্টদের নিয়ে গঠিত কোনও বিশেষজ্ঞ কমিটির মতামত নেওয়া হয়নি৷ করোনা আক্রান্তের সংখ্যা যখন দ্রুতগতিতে বেড়েই চলেছে, তখন মদের দোকান, শপিং মল, ধর্মীয় স্থানের মতো অধিক জমায়েতের জায়গাগুলি খুলে দেওয়া হল৷ কর্মস্থলে যাতায়াতের জন্য, মানুষ যাতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে যাতায়াত করতে পারে তার জন্য উপযুক্ত সংখ্যক গণপরিবহণের ব্যবস্থা করা হল না৷

এই সব কিছুর পরিণাম হল মারাত্মক৷ লকডাডনের জন্য দেশের দরিদ্র সাধারণ মানুষ চরম দুর্দশায় পড়লেও, কোটিকোটি মানুষ ইতিমধ্যে কর্মচ্যুত হলেও এবং দেশের অর্থনীতি ভেঙে তছনছ হয়ে গেলেও করোনা নিয়ন্ত্রণে তার কার্যকারিতা প্রায় কিছুই দেখা গেল না৷ উপরন্তু আজ দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে গেল যে, সরকার চতুর্থ দফা লকডাউন শেষে করোনা নিয়ন্ত্রণে সমস্ত দায়িত্ব থেকেই হাত গুটিয়ে নিয়ে এবং সমস্ত দায় মানুষের উপর চাপিয়ে দিয়ে দেশের মানুষকে আরও ঘোরতর বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছে৷ মানুষকে বিপদের মুখে ঠেলে দেওয়ার সরকারি এই পদক্ষেপের আমরা তীব্র বিরোধিতা করছি এবং লকডাউন শিথিল করা বা তুলে নেওয়ার আগে সরকার যাতে বিশেষজ্ঞ কমিটির পরামর্শ নেয় সেই দাবি করছি৷