Breaking News

কমরেড শঙ্কর সাহা বিপ্লবী জীবনচর্চায় দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন– স্মরণসভায় কমরেড প্রভাস ঘোষ

(বিশিষ্ট শ্রমিক নেতা ও এসইউসিআই(সি)-র পলিটবুরো সদস্য কমরেড শঙ্কর সাহা ৩১ মে প্রয়াত হন। ২০ জুন দলের কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষ থেকে আয়োজিত অনলাইন স্মরণ সভায় বক্তব্য রাখেন সাধারণ সম্পাদক কমরেড প্রভাস ঘোষ। তাঁর পূর্ণাঙ্গ ভাষণটির বাংলা অনুবাদ এখানে প্রকাশ করা হল)

কমরেড প্রেসিডেন্ট ও কমরেডস,

কমরেড শঙ্কর সাহা যদিও বয়সে আমার থেকে ছোট ছিল, তবুও আমি তাঁকে বলতাম আপনার মৃত্যু আমার আগেই ঘটবে এবং আপনার স্মরণ সভায় আমিই বলব। তিনি হেসে বলতেন, ‘আমিও সেটা চাই’। আজ সেটাই নিষ্ঠুর বাস্তব হয়ে আমার কাছে এসেছে। আমি এটা আশা করিনি।

কমরেডস, সমগ্র মানবজাতি আজ বিপন্ন। কোটি কোটি মানুষ কোভিড অতিমারিতে সংক্রমিত। এক কোটিরও বেশি মানুষ ইতিমধ্যেই মারা গিয়েছেন। আরও বহু জন মারা যাবেন। আমাদের পার্টিও বেশ কিছু মূল্যবান নেতা-সংগঠক ও সদস্যদের হারিয়েছে। এখনও কিছু কমরেড মৃত্যুশয্যায়। যে কোনও সময় তাঁদের বেদনাদায়ক সংবাদ আসতে পারে। কিন্তু এই দুঃখ এবং শোককে আমরা কীভাবে মোকাবিলা করব? সাধারণ মানুষ এসব ক্ষেত্রে মানসিকভাবে বিধ্বস্ত হয়ে যায়, মন ভেঙে গিয়ে হতাশ হয়ে পড়ে। কিন্তু আমাদের কাছে রয়েছে মহান নেতাদের মূল্যবান শিক্ষা। মহান লেনিনের মৃত্যুর পর মহান স্ট্যালিন বলেছিলেন, ‘শপথ করছি কমরেড লেনিনের শিক্ষা আমরা বাস্তবায়িত করব।’ আবার মহান স্ট্যালিনের মৃত্যুর পর মহান মাও সে তুং বলেছিলেন, ‘শোককে শক্তিতে পরিণত কর’। এবার আমি মহান প্রয়াত নেতা কমরেড শিবদাস ঘোষের বক্তব্য উদ্ধৃত করব, যা তিনি এই ধরনের কোনও ঘটনার ক্ষেত্রে আমাদের পার্টির নেতা-কর্মীরা কী ভাবে মোকাবিলা করবে তার প্রস্তুতির জন্য বলেছিলেন।

১৯৭৪ সালে কলকাতায় কমরেড শিবদাস ঘোষের পরিচালনায় একটি রাজনৈতিক শিক্ষাশিবির অনুষ্ঠিত হচ্ছিল। ওই সময় আমাদের অপর একজন শ্রদ্ধেয় নেতা কমরেড সুবোধ ব্যানার্জী হাসপাতালে মৃত্যুশয্যায় ছিলেন। তাঁর ব্লাড ক্যান্সার হয়েছিল। এ নিয়ে আমাদের দলের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীতে আমরা বিতর্ক করছিলাম যে এই সময় রাজনৈতিক শিক্ষাশিবির বন্ধ করে দেওয়া উচিত কি না। আমাদের মধ্যে মতপার্থক্য ছিল এবং যখন এই বিতর্ক চলছিল সেই সময় কমরেড শিবদাস ঘোষ সেই বৈঠকে আসেন। আলোচনায় ঢুকে বলেন, ‘তোমরা যখন ময়দানে সংগ্রামে থাকবে যদি শোনো আমি মারা যাচ্ছি, তখন বিপ্লবী হিসেবে তোমরা কি সংগ্রাম বন্ধ করে দেবে? না, তা বন্ধ করা যায় না।’ কমরেড সুবোধ ব্যানার্জীর মৃত্যুর পর তাঁর স্মরণ সভায় কমরেড ঘোষ বক্তব্য রাখেন। ওই ভাষণ ‘এক মহান বিপ্লবীর প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য’ শিরোনামে শিবদাস ঘোষ নির্বাচিত রচনাবলিতে আছে, আমি পরে তার থেকে পড়ে শোনাব।

কমরেড শিবদাস ঘোষ যখন স্মরণ সভায় তাঁর কথাগুলো রাখছিলেন, আমরা অনুভব করেছিলাম এটা আমাদের প্রতি একটা বিরাট শিক্ষা ও বার্তা। কারণ তিনি জানতেন, তাঁর মৃত্যু আমাদের জীবনে কী গভীর শোক ডেকে আনবে, তিনি আমাদের মনকে সেই দুঃখের দিনের জন্য প্রস্তুত করছিলেন। এই প্রসঙ্গে আমি আর একটি পয়েন্ট বলব, যার দ্বারা আপনারা বুঝতে পারবেন বিপ্লব ও দলের সঙ্গে কমরেড শিবদাস ঘোষ কতটা একাত্ম ছিলেন।

কমরেড সুবোধ ব্যানার্জীর জীবনাবসানের পর তাঁর মরদেহ নিয়ে কলকাতা শহরে যে মিছিল হয়েছিল, তার শৃঙ্খলা এবং যে নীরব শোকের ছবি সেই মিছিলের মধ্য দিয়ে ফুটে বেরিয়েছিল তা মানুষের মধ্যে যথেষ্ট প্রভাব ফেলেছিল। কিন্তু কমরেড ঘোষের কাছে রিপোর্ট পৌঁছেছিল যে ওই মিছিলে গ্রাম থেকে আসা অল্প সংখ্যায় কিছু নতুন মানুষ ছিলেন, যারা মিছিলের শৃঙ্খলা রক্ষা করতে পারেননি। পরের দিন অফিসে কমরেড ঘোষ আমাকে বললেন, ‘পরবর্তী কালে তোমরা যখন এ ধরনের শেষযাত্রার মিছিল সংগঠিত করবে, তখন যে সব জায়গায় গ্রাম থেকে নতুন চাষি মানুষরা থাকবেন তাদের সাথে পার্টি ভলান্টিয়ার দিও যাতে শৃঙ্খলা রক্ষা করা যায়।’ দেখুন, এমনকি তাঁর মরদেহ নিয়ে যে মিছিল হবে সেটাও যাতে জনসাধারণের মধ্যে প্রশংসার সৃষ্টি করে এবং পার্টি ও বিপ্লবের প্রতি জনগণের আকর্ষণ সৃষ্টি করতে পারে, সেই চিন্তাও তিনি করেছেন। সেই ভাবনাও তাঁর ছিল। এখন আমি আপনাদের সামনে কমরেড শিবদাস ঘোষের ভাষণের সেই অংশটি পড়ে শোনাব। অধিকাংশ কমরেডই এটা শুনেছেন। মূল ভাষণ বাংলাতেই ছিল– ‘‘রাজনীতি একটা উচ্চ হৃদয়বৃত্তি। বিপ্লবী রাজনীতি তো উচ্চতর হৃদয়বৃত্তি। এ যেমন একদিকে কোমল, আবার এই রাজনীতির মধ্যেই রয়েছে কঠোর বাস্তবতা, কঠোর নিয়মানুবর্তিতা, কঠোর এবং কঠিন কর্তব্যপরায়ণতা। শোকের জন্য আমাদের কাজ বসে থাকতে পারে না। বাইরের দিক থেকে রাজনীতির আচরণটা এমনই নিষ্ঠুর। কিন্তু এই বাইরে থেকে যেটাকে নিষ্ঠুর মনে হয়, তার মধ্যেই রয়েছে যথার্থ শোকোপলব্ধির তাৎপর্য। তাই বড় বিপ্লবীরা গভীর শোকের মধ্যেও তাদের কাজ ঠিক করে যায়। কাজ তাদের করতেই হয়। কাজ করার ব্যাপারটা তাদের কোনও অবস্থাতেই গোলমাল করা চলে না।”

কমরেড শিবদাস ঘোষের সেদিনের এই আবেদন সমগ্র পার্টিকে প্রয়াত নেতা শ্রদ্ধেয় কমরেড নীহার মুখার্জীর নেতৃত্বে এক মানুষের মতো দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। এইভাবেই আমরা ওই পরিস্থিতির মোকাবিলা করেছিলাম। আজ এবং ভবিষ্যতেও এ ভাবেই আমাদের শোককে দেখতে হবে এবং মোকাবিলা করতে হবে।

আমি যতদূর জানি, কমরেড শঙ্কর সাহা ১৯৬৩ সালে পার্টিতে যুক্ত হয়েছিলেন। সেই সময় দমদম অঞ্চলে কমরেড কৃষiর চক্রবর্তীর সাথে কাজ করতেন কমরেড তপন রায়চৌধুরীর দাদা কমরেড স্বপন রায়চৌধুরী। কমরেড তপন রায়চৌধুরীও সাহায্য করতেন। তাঁরা ওখানে ক্লাব, কোচিং ক্লাস, নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, ছাত্র-যুব উৎসব ইত্যাদি সংগঠিত করতেন। শঙ্কর সাহা এগুলিতে যোগ দেন এবং তাঁকে পার্টির সঙ্গে যুক্ত করিয়ে দেন কমরেড স্বপন রায়চৌধুরী। কমরেড শঙ্কর সাহা তখন জেশপ কোম্পানিতে চাকরি করতেন, সম্ভবত কোনও উচ্চপদেই। এই ভাবে দমদম অঞ্চলে কাজ করার সময় তিনি দেখেন সুদসন কারখানায় মালিকরা শ্রমিকদের গুণ্ডা দিয়ে নির্দয়ভাবে মারছে। এটা তাঁর মনকে স্পর্শ করে। তিনি তা আটকাতে এগিয়ে যান, প্রতিরোধ সংগঠিত করেন এবং ওই অত্যাচার বন্ধ করেন। এই পথে ওই কারখানায় শ্রমিক ইউনিয়ন তৈরি হয়। লক্ষ করুন পার্টি কিন্তু তাঁকে ট্রেড ইউনিয়ন গড়বার জন্য বলেওনি, নিয়োগও করেনি। তিনি নিজের উদ্যোগে শ্রমিকদের দুর্দশার কথা ভেবে ওই কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। এভাবেই তাঁর ট্রেড ইউনিয়নের কাজ শুরু হয়। দমদমের একটি বড় কারখানা হিন্দুস্তান আয়রন অ্যান্ড স্টিল কোম্পানিতে অন্যান্যদের সাহায্য নিয়ে ইউনিয়ন গড়ে তোলেন। তাঁর নেতৃত্বে ও উদ্যোগে সেই সময়ে দমদমে অনেক কারখানায় ট্রেড ইউনিয়ন তৈরি হয়। সিপিএম বাধা দিয়েছিল, পুলিশের সহায়তায় তাঁর উপর আক্রমণ করেছিল। পুলিশের সাহায্যে কংগ্রেসও আক্রমণ চালিয়েছিল। এ ধরনের সব আক্রমণকে কমরেড শঙ্কর সাহা সাহসের সাথে মোকাবিলা করেছেন। এই পথেই তিনি একজন ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠক রূপে বিকশিত হন। একেবারে তৃণমূল স্তর থেকেই তিনি কাজ শুরু করেছিলেন। পরবর্তী কালে তিনি ট্রেড ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় অফিসে চলে আসেন এবং ট্রেড ইউনিয়ন কাজকর্মে আরও বেশি করে আত্মনিয়োগ করেন। সেই সময়ে ওই ট্রেড ইউনিয়নে আরও একজন সিনিয়র কমরেড ছিলেন। বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই হয়ত তাঁর নাম শোনেননি। তাঁর নাম গণেশ দাশগুপ্ত। তাঁরা দুজনেই অফিসে থাকতেন, ওখানেই রান্না করে খেতেন, অফিসের বেঞ্চে শুয়ে রাত কাটাতেন। বহু দিন, মাস, বছর এভাবেই কেটেছে। কমরেড শঙ্কর সাহা তাঁর বেতনের সবটাই পার্টিকে দিতেন। কিছুকাল পর তিনি স্বেচ্ছাবসর নেন এবং প্রাপ্ত পুরো টাকাই পার্টি ফান্ডে দিয়ে দেন।

এখানে আমি আর একটি বিষয় বলব, যা অধিকাংশ কমরেডই জানেন না। ওই সময় ট্রেড ইউনিয়নের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির সম্পাদক ছিলেন ফটিক ঘোষ। আপনারা জানেন, তাঁর অনৈতিক, অধঃপতিত, পার্টিবিরোধী কার্যকলাপের জন্য পার্টি তাঁকে বহিঃষ্কার করেছিল। তাঁর বহিষ্কারের পর প্রয়াত নেতা কমরেড নীহার মুখার্জী একটি সভায় চোখের জলে বলেছিলেন, ফটিক ঘোষের বহু দোষের জন্য ফটিক ঘোষকে দলে যুক্ত করতে কমরেড শিবদাস ঘোষ নিষেধ করেছিলেন। কমরেড নীহার মুখার্জী কমরেড শিবদাস ঘোষকে অনুরোধ করেছিলেন ফটিক ঘোষকে শোধরানোর একটা সুযোগ নীহারবাবুকে দিতে– একথা বলেই চোখের জলে কমরেড নীহার মুখার্জী বলেন, কিন্তু আমি ব্যর্থ হয়েছি। ফটিক ঘোষ অত্যন্ত ধূর্ত লোক ছিল, আত্মসর্বস্ব, আমলাতান্ত্রিক, আধিপত্যবাদী ও স্বৈরাচারী প্রবণতার মানুষ ছিল। শ্রমিকদের স্বার্থ বলি দিয়ে নিজের স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য সে মালিকদের সঙ্গে, নানা মহলের অফিসারদের সঙ্গে মাখামাখি করত। ফ্রন্টের আপেক্ষিক স্বাধীনতার সুযোগ নিয়ে সে পার্টি এবং ফ্রন্টের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি করেছিল এবং ট্রেড ইউনিয়নকে নিজস্ব খাসতালুক বানিয়ে ফেলেছিল। শঙ্কর সাহা তাঁর অধীনেই কাজ করতেন। কিন্তু তাঁর দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে তিনি পার্টির নির্দেশ কার্যকর করবার জন্যই কঠিন সংগ্রাম করতেন। ট্রেড ইউনিয়ন ফ্রন্টে কমরেড শিবদাস ঘোষের শিক্ষা কার্যকর করার জন্য লড়াই চালাতেন। তখন ট্রেড ইউনিয়ন ফ্রন্টে কার্যত দুই লাইন ছিল। একটা ফটিক ঘোষের লাইন যেটা পার্টির শিক্ষার বিরোধী, আর একটা পার্টি শিক্ষার অনুসারী লাইন যেটা কমরেড শঙ্কর সাহা কার্যকর করতেন। ফটিক ঘোষ যেহেতু সেক্রেটারি ছিল, তাই শঙ্কর সাহাকে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে পার্টি লাইন কার্যকর করতে হত এবং ফটিক ঘোষের দুষ্ট প্রভাব থেকে অন্যান্য কমরেডদের রক্ষা করতে হত। যদিও এই দুই লাইনের সংঘাত ছিল বিরোধাত্মক, তবুও কমরেড শঙ্কর সাহা কখনও এই বিরোধকে সামনে আসতে দিতেন না, যাতে অন্যান্য কমরেডরা মনোবল না হারায়। এ ছিল অত্যন্ত কঠিন সংগ্রাম। কোনও উচ্চস্তরের নেতা তাঁকে এই দায়িত্ব দেনওনি। আমি আপনাদের বলতে পারি, কমরেড শঙ্কর সাহা নিজস্ব প্রত্যয় ও উপলব্ধি থেকেই এই কাজ করেছেন। এই জায়গা থেকেই কমরেড শঙ্কর সাহার প্রতি আমার শ্রদ্ধা শুরু হয়। আমি জানি, কত ধৈর্য, বুদ্ধি ও দৃঢ় প্রত্যয় থেকে তিনি এ কাজ করেছেন এবং ফটিক ঘোষের প্রভাব থেকে ট্রেড ইউনিয়নকে রক্ষা করেছেন।

এই প্রসঙ্গে আমি আর একটি বিষয় আপনাদের বলব। এই ঘটনা অবশ্য ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। ফটিক ঘোষ অত্যন্ত অনৈতিক একটি কাজ করেছিল। একজন মহিলা কমরেড যিনি কলেজ জীবনে আমাদের সংগঠন পরিচালিত একটি ছাত্র ইউনিয়নে সাধারণ সম্পাদিকা ছিলেন। পরবর্তী কালে তিনি খাদ্যদপ্তরে চাকরিতে যোগ দেন। পার্টির ট্রেড ইউনিয়ন কর্মকাণ্ডের সাথেও তিনি যুক্ত হন। তবে তিনি কখনই পার্টির সর্বক্ষণের কর্মী ছিলেন না। তাঁকে বিবাহ করবেন বলে নিশ্চয়তা দিয়েছিলেন ফটিক ঘোষ। কিন্তু পরে বিশ্বাসঘাতকতা করে অন্য এক মহিলাকে গ্রহণ করে। সবটাই ঘটে পার্টি নেতৃত্বের অজ্ঞাতে। ফটিক ঘোষ পরে ওই কমরেডকে অস্বীকার করলে সে প্রায় পাগলের মতো হয়ে যায়, কমরেড নীহার মুখার্জীর কাছে ছুটে যায়। তাঁর মানসিক বিপর্যস্ত অবস্থা দেখে কমরেড নীহার মুখার্জী তাঁকে রক্ষা করার জন্য কমরেড শঙ্কর সাহাকে অনুরোধ করেন। কমরেড শঙ্কর সাহা তাঁকে গ্রহণ করেছিলেন। তিনি অসুস্থ ছিলেন, কিছুটা খিটখিটে মেজাজ ছিল। তাঁর কিছু মানসিক সমস্যাও সৃষ্টি হয়েছিল সম্ভবত আগেকার এই ঘটনার জন্য। কিন্তু তিনি পার্টি এবং শঙ্কর সাহাকে ভালোবাসতেন। আমি মনে করি, বিবাহিত জীবনে সুখ-শান্তি বলতে যা বোঝায় শঙ্কর সাহা তা পাননি। কিন্তু এ নিয়ে কোনও দিন কোনও অভিযোগ করেননি। সমস্ত ঝড়ঝাপটা তিনি নীরবে একা সহ্য করেছেন। এটাও কমরেডদের সামনে একটা দৃষ্টান্ত।

এখন আমি আপনাদের বলব, আমাদের দেশে অনেক ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠন আছে, কংগ্রেস ও বিজেপি পরিচালিত আছে, সিপিএম-সিপিআই পরিচালিত ট্রেড ইউনিয়নও আছে। আমাদের সংগঠন মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারায় বলিয়ান এবং এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)-এর নেতৃত্বে পরিচালিত। কংগ্রেস-বিজেপির ট্রেড ইউনিয়ন কার্যত বুর্জোয়াদের এজেন্ট হিসাবে কাজ করে। শ্রমিকদের ঠকাবার জন্য বুর্জোয়াদেরও ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠন প্রয়োজন। সাধারণ শ্রমিকরা অধিকাংশই নিরক্ষর, রাজনৈতিক ভাবে অসচেতন এবং ঐক্যবদ্ধ নয়। বুর্জোয়া আদর্শ, সংস্কৃতি ও নৈতিকতার সঙ্গে নানা সূতোয় এই শ্রমিকদের জীবন বাঁধা। বুর্জোয়ারা এজেন্ট বা দালাল ভাড়া করে, যারা শ্রমিকদের মাঝে ট্রেড ইউনিয়ন নেতা হিসাবে কাজ করে শ্রমিকদের বিপথচালিত করতে পারে, বিভ্রান্ত করতে পারে, কানুনিবাদ-অর্থনীতিবাদের বেড়াজালে তাদের বেঁধে ফেলতে পারে এবং বুর্জোয়া সংস্কারবাদী রাজনীতি সম্পর্কে অত্যন্ত রঙিন ছবি তুলে ধরে শেষ পর্যন্ত তাদের বিপ্লবের পথ থেকে সরিয়ে বুর্জোয়া পার্লামেন্টারি রাজনীতির কানাগলিতে ঠেলে দিতে পারে। এর ফলে আজ সাধারণ শ্রমিকদের প্রকৃত অবস্থা কী? পুঁজিবাদী শোষণ যন্তে্রর দ্বারা তারা শোষিত হচ্ছে, নির্যাতিত হচ্ছে ও কার্যত ধ্বংস হচ্ছে। কিন্তু তারা মনে করে, ধনী ও গরিবে বিভক্তি, শোষক ও শোষিতের বিভাজন, মালিক ও শ্রমিকের দুই ভাগ– এ সবই ঈশ্বরপ্রদত্ত, চিরন্তন। সব কিছুই সর্বশক্তিমান ঈশ্বর সৃষ্টি করেছেন। তার উপর তারা ধর্ম, ভাষা, জাতীয়তা, জাত-পাত ইত্যাদির দ্বারাও বিভক্ত। তাদের শিক্ষিত, সংগঠিত ও ঐক্যবদ্ধ করা অত্যন্ত কঠিন ও কঠোর সংগ্রাম। বুর্জোয়া মালিকরা যদি কখনও কোনও ক্ষমতাসম্পন্ন ট্রেড ইউনিয়ন নেতাকে পায়, তবে তাকে ঘুষ দিয়ে ও নানা উপায়ে চতুরতার সাথে কিনে নেয়। বুর্জোয়া ট্রেড ইউনিয়ন নেতারা প্রকাশ্যেই বুর্জোয়াদের স্বার্থে কাজ করে। কিন্তু সোস্যাল ডেমোক্র্যাট ট্রেড ইউনিয়ন নেতারা বামপন্থী বুলি আউড়ে তলে তলে বুর্জোয়াদের সেবা করে। বিপ্লবী শ্রমিক শ্রেণির নেতৃত্বের অবশ্যকরণীয় দায়িত্ব হল, বুর্জোয়া এবং সোস্যাল ডেমোক্রেটিক ক্রিয়াকলাপ ও দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে লড়াই করা, তাদের মুখোশ খুলে দেওয়া, তাদের প্রভাব থেকে শ্রমিকদের মুক্ত করে আনা ও বিপ্লবী লাইনে তাদের সংগঠিত করা। এই প্রসঙ্গেই আমি কিছু শিক্ষার কথা বলব, যা সকল বিপ্লবীদের কাছে অনুসরণীয় এবং কমরেড শঙ্কর সাহা যা অনুসরণ করেছেন। প্রথমেই আমি ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন সম্পর্কে কমরেড লেনিন এবং কমরেড শিবদাস ঘোষের কিছু শিক্ষা পড়ে শোনাব।

লেনিন বলেছেন, ‘‘শ্রমিকদের মধ্যে চেতনা একমাত্র বাইরে থেকেই নিয়ে আসা যায়”। এখানে বাইরে থেকে অভিব্যক্তিটার মানে হল, ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের ভেতর থেকেই এই চেতনা জন্ম নেয় না। একে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের বাইরে থেকে নিয়ে যেতে হয়। সে জন্যই তিনি বাইরে থেকে কথাটা ব্যবহার করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘সমস্ত দেশের ইতিহাস দেখায় যে, শ্রমিক শ্রেণি শুধুমাত্র নিজের চেষ্টায় কেবল ট্রেড ইউনিয়ন চেতনার জন্ম দিতে পারে। অর্থাৎ তারা ইউনিয়ন তৈরি করা, মালিকের বিরুদ্ধে লড়াই করা এবং প্রয়োজনীয় শ্রম আইন পাশ করানোর জন্য সরকারকে বাধ্য করার চেষ্টার প্রয়োজনীয়তা নিজের থেকেই উপলব্ধি করতে পারে। কিন্তু সমাজতন্ত্রের তত্ত্ব বিকশিত হয়েছে দর্শনগত, ইতিহাসগত এবং অর্থনৈতিক তত্ত্বগুলি থেকে, যা ব্যাখ্যা করেছেন, উপস্থিত করেছেন মালিক শ্রেণির শিক্ষিত প্রতিনিধিরা, বুদ্ধিজীবীরা। আধুনিক বৈজ্ঞানিক সমাজতন্তে্রর প্রতিষ্ঠাতা মার্কস, এঙ্গেলস তাঁদের সামাজিক অবস্থানগত দিক থেকে বুর্জোয়া বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়েরই অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।’ কিন্তু তাঁরা শ্রেণিচ্যুত বুদ্ধিজীবীতে পরিণত হয়েছিলেন। ‘আধুনিক সমাজতান্ত্রিক চেতনা কেবলমাত্র গভীর বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের উপর ভিত্তি করে জন্ম নিতে পারে। সর্বহারা শ্রেণি বিজ্ঞানের বাহক নয়, বুর্জোয়া বুদ্ধিজীবীরাই, শ্রেণিচ্যুত বুর্জোয়া বুদ্ধিজীবীরাই তার বাহক। এই অংশের সদস্যদের চিন্তা থেকেই আধুনিক সমাজতন্ত্রের উৎপত্তি এবং তারাই এটা সর্বহারা শ্রেণির মধ্যে বুদ্ধিগত দিক থেকে বিকশিত অংশের কাছে এই চিন্তা দেন এবং চিন্তায় উন্নত এই সর্বহারারাই সর্বহারা শ্রেণিসংগ্রামের মধ্যে যেখানে পরিস্থিতি তাদের সাহায্য করেছে, এই চিন্তা বহন করে নিয়ে যান। এইভাবে সমাজতান্ত্রিক চেতনা হচ্ছে এমন কিছু যা সর্বহারা শ্রেণিসংগ্রামের ভিতর থেকে আপনাআপনি জন্ম নেয়নি, তাকে বাইরে থেকে নিয়ে যেতে হয়েছে।’ এই হচ্ছে লেনিনের বক্তব্য।

এখন আমি কমরেড শিবদাস ঘোষকে উদ্ধৃত করব– ‘‘মার্কস সূচনা থেকেই যে প্রশ্ন রেখেছেন, শ্রমিকরা ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনে কেন যোগ দেবে? তারা যোগ দেবে কারণ, ট্রেড ইউনিয়ন হচ্ছে সাম্যবাদ শেখার বিদ্যালয় – কমিউনিজমে শিক্ষিত হবার, শিক্ষা গ্রহণ করবার একটা বিরাট রাজনৈতিক শিক্ষাশিবির। এই হল ট্রেড ইউনিয়ন। এই ট্রেড ইউনিয়নগুলোকে যদি এই শিক্ষাশিবির হিসাবে দেখা না হয়, এগুলো রাজনীতি চর্চার একটা প্রাণকেন্দ্র হিসাবে গড়ে না ওঠে তা হলে এই ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনগুলো শেষ পর্যন্ত বুর্জোয়া ও পেটি বুর্জোয়া শ্রেণির হাতে বিপ্লবী শ্রমিক আন্দোলনে বিভেদ ও বিভ্রান্তি সৃষ্টি করার অস্তে্র পর্যবসিত হতে বাধ্য। এমতাবস্থায় শ্রমিক শ্রেণির বিপ্লবী রাজনৈতিক চেতনাবৃদ্ধির বদলে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনগুলো শেষপর্যন্ত শ্রমিক আন্দোলনে অর্থনীতিবাদ বা সুবিধাবাদের জন্ম দিয়ে থাকে।” অবিচার এবং অত্যাচারের বিরুদ্ধে এই ট্রেড ইউনিয়ন প্ল্যাটফর্ম থেকে সমষ্টিগত ভাবে লড়াই করতে গিয়ে শ্রমিকরা ঘটনাবলি ব্যাখ্যা করার এবং সত্যের সন্ধান করার সুযোগ পায়। দৈনন্দিন লড়াই পরিচালনা করতে গিয়ে এই চেতনা তাদের মধ্যে দেখা দেয় কেন বিপ্লব ছাড়া শোষণমুক্তি সম্ভব নয়। এভাবে একমাত্র বিপ্লবীরাই শ্রমিকদের এই চেতনায় শিক্ষিত করতে চায়। কেবলমাত্র সেই শ্রমিকরাই দুনিয়াকে বদলাতে পারে যারা এই ধরনের গুণসম্পন্ন বিপ্লবী নেতৃত্বের জন্ম দিতে সক্ষম হয়েছে। এবং সেটা শুধুমাত্র রাজনৈতিক লড়াইয়ের ক্ষেত্রে নয় অথবা স্লোগানে নয়, আচার-আচরণে এবং জীবন-যাপনে, নীতি- নৈতিকতার ক্ষেত্রে, রুচি-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে। এই হল কমরেড শিবদাস ঘোষের শিক্ষা।

মহান লেনিন এবং কমরেড শিবদাস ঘোষের এই শিক্ষাগুলি ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনে কমরেড শঙ্কর সাহাকে গাইড করেছে। এটা অত্যন্ত কঠিন সংগ্রাম ছিল। পার্টির অন্যান্য আরও নানা ফ্রন্ট রয়েছে। ট্রেড ইউনিয়ন ফ্রন্টে শ্রমিকরা সর্বদা অফিসে আসে চার্জশিটের কী জবাব হবে তা জানতে, পুলিস কেস হলে কী করণীয় তা বুঝতে এবং কারখানা বন্ধ হয়ে গেলে তা খোলার জন্য কী করতে হবে তা জানতে। শ্রমিকরা প্রতিদিন আসে তাদের সমস্যা নিয়ে, ইউনিয়ন নেতারা আসে তাদের সমস্যা নিয়ে এবং নেতাকে তাদের গাইড করতে হয়। সাধারণত শ্রমিকদের মধ্যে রাজনীতি নিয়ে আগ্রহ থাকে না, রাজনৈতিক আলোচনায় ঢুকতে চায় না। রাজনৈতিক ভাবে তাদের শিক্ষিত করা একটি কঠিন কাজ। কিন্তু কমরেড শঙ্কর সাহা মহান নেতাদের শিক্ষাগুলি স্মরণে রেখে এই কাজটি নিয়মিত করে গেছেন। অন্যান্য ফ্রন্টকে এই ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হতে হয় না। এই কাজগুলি করতে করতেই কমরেড শঙ্কর সাহাকে পড়াশুনো করতে হয়েছে। কমরেড রাধাকৃষ্ণ-র কাছ থেকে শুনলাম, অন্যান্য ট্রেড ইউনিয়ন নেতারাও বলেছেন, শ্রমআইনগুলি সম্পর্কে কমরেড সাহার গভীর জ্ঞান ছিল। এর জন্য তাঁকে পড়াশুনো করতে হয়েছে। বিভিন্ন শ্রম ট্রাইবুনালে শুনানির সময় তিনি শ্রম আইনের বিভিন্ন ধারা এমন দক্ষতার সাথে উপস্থিত করতেন, যা শুনে অত্যন্ত আমলাতান্ত্রিক ম্যানেজাররা, মালিকরা ও লেবার অফিসাররাও চমৎকৃত হতেন এবং আইনগত ভাবে তাদের বক্তব্য প্রতিষ্ঠা করতে পারতেন না। কমরেড সাহা শ্রমআইনগুলি এত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ার পাশাপাশি পার্টির পুস্তক ও পত্রপত্রিকাও গভীর মনোযোগের সঙ্গে পড়তেন।

অনেকে জানেন না, কমরেড শঙ্কর সাহা তত্ত্বগত দিক থেকে পরিণত ছিলেন। প্রায়ই আমার সঙ্গে তাঁর আলোচনা হত। মার্কসীয় দর্শন, বিপ্লবী রাজনীতি এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নানা বিষয়ে তাঁর গভীর জ্ঞান ছিল। নিয়মিত এ সব নিয়ে পড়াশোনা করতেন। কিন্তু মিটিং কিংবা ক্লাসে সাধারণত তিনি মুখ খুলতেন না। এটাই ছিল তাঁর স্বভাব। সবসময় অন্যদের বলার সুযোগ দিতেন। প্রয়োজন হলে তবেই তিনি বলতেন– বলতেন খুব সংক্ষেপে মূল পয়েন্টগুলিকে তুলে ধরে।

বহু ট্রেড ইউনিয়ন নেতাই অধঃপতিত হয়েছেন, দুর্নীতিগ্রস্ত হয়েছেন। এ এমনই এক জায়গা যেখানে মালিকরা নানা ভাবে– তোষামোদ করে, ঘুষ দিয়ে, প্রশস্তি করে, বিলাসবহুল হোটেলে ভাল ভাল খাবার খাইয়ে– ট্রেড ইউনিয়ন নেতাদের প্রভাবিত করে। সেই পরিবেশেই থাকতেন কমরেড শঙ্কর সাহা। কিন্তু মালিকরা কোনও ভাবেই তাঁকে কখনও প্রভাবিত করতে পারেনি। তিনি নিজের সর্বহারা বিপ্লবী চরিত্র অক্ষুণ্ন রেখেছেন।

ট্রেড ইউনিয়নের যে কমরেডরা কমরেড শঙ্কর সাহার খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন, আমি তাঁদের সঙ্গে কথা বলেছি। দেখেছি, তাঁর সম্পর্কে এঁদের মনে কী প্রবল আবেগ ও শ্রদ্ধা! কমরেড শিবদাস ঘোষ বলতেন, ‘নেতা দু’ধরনের হয়। একদল আছেন, আনুষ্ঠানিক ভাবে যাঁরা কোনও কমিটির সেক্রেটারি নির্বাচিত হয়েছেন। যান্ত্রিক ভাবে অন্যেরা তাঁদের মেনে নেয়। আরেক দল আছেন– নির্বাচিত হোন আর না-ই হোন– নিজের চরিত্র, আচার-ব্যবহার ও বিপ্লবী শিক্ষার প্রগাঢ় জ্ঞানের কারণে কমরেড ও শ্রমিকরা হৃদয়ের গভীর থেকে যাঁদের শ্রদ্ধা করেন, ভরসা করেন। এঁরাই হলেন প্রকৃত নেতা।’ আমি বুঝেছি, কমরেড শঙ্কর সাহা এই দ্বিতীয় পথ ধরেই একজন সত্যিকারের নেতা হিসাবে নিজের জায়গা করে নিয়েছিলেন। ওই কমরেডরা গভীর শ্রদ্ধা, আবেগ ও চোখের জলে আমাকে বলেছেন, আমরা আমাদের পিতাকে, আমাদের অত্যন্ত প্রিয় অভিভাবককে হারালাম। কমরেড শঙ্কর সাহা শুধু একজন নেতা ছিলেন না, কমরেড শিবদাস ঘোষের শিক্ষার ভিত্তিতে চরিত্রের এমন কতকগুলি বৈশিষ্ট্য তিনি অর্জন করেছিলেন, যেগুলি উদাহরণ হিসাবে রয়ে যাবে। ওই কমরেডরা আমাকে বলেছেন, জাতীয় বা আন্তর্জাতিক– যে কোনও মিটিংয়ে যোগদান করার আগে যখন প্রস্তাবের খসড়া তিনি তৈরি করতেন, সেই খসড়া সকলের বিবেচনার জন্য রাখতেন, মতামত দিতে বলতেন। প্রয়োজন হলে অন্যদের পরামর্শ গ্রহণ করতেন। মিটিংয়ে অন্যদের কথা বলার, মতামত ও পরামর্শ দেওয়ার সুযোগ দিতেন। আলোচনা করতে গিয়ে তাঁরা অনেক সময় লাগিয়ে ফেলতেন। কিন্তু কমরেড শঙ্কর সাহা ধৈর্যের সঙ্গে মনোযোগ দিয়ে তাঁদের কথা শুনতেন এবং তারপর ১৫-২০ মিনিট বা ৩০ মিনিট সময় নিয়ে সিদ্ধান্ত টানতেন। সেই সিদ্ধান্তও হত চমৎকার। কমরেডরা আমাকে বলেছেন, তাঁরা কেউ যদি কোনও ভুল করে ফেলতেন, এমনকি সে ভুল যদি মারাত্মকও হত, তা সত্ত্বেও খুব কম সময়েই তাঁকে রাগতে দেখা গেছে। কঠিন কথা বলে কোনও দিন কাউকে তিনি আঘাত করেননি, আহত করেননি। কমরেডটিকে শেখানোর জন্য অত্যন্ত শান্তভাবে, সহানুভূতির সঙ্গে তিনি আলোচনা করতেন। জুনিয়র কমরেডদের কখনও তিনি বকাবকি করতেন না। কোনও কমরেডই, এমনকি যাঁরা আমাদের শ্রমিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্তও নন, তাঁরাও খুব সহজে কমরেড শঙ্কর সাহার কাছে আসতে পারতেন, নিজের সমস্যা খুলে বলতে পারতেন। তাঁরা কখনও কোনও বাধা অনুভব করেননি। কমরেডরা আমাকে জানিয়েছেন, শঙ্কর সাহা শুধু সিনিয়রদের নয়, জুনিয়রদের সমালোচনাও গ্রহণ করতেন এবং তা করতেন হাসিমুখে। (কমরেড শঙ্কর সাহার প্রতিকৃতির দিকে দেখিয়ে) এই দেখুন তাঁর মুখ– কত শান্ত, সৌম্য। কমরেড শিবদাস ঘোষের শিক্ষা– ‘‘আপনি যদি হঠাৎ এমন কোনও অসুবিধার সামনে পড়েন, যা আগে কখনও আসেনি, কিংবা এমন কোনও বিপদ আসে, যাতে আগে কখনও পড়েননি অথবা এমন কোনও সমস্যা আসে যা আগে কখনও মোকাবিলা করতে হয়নি আপনাকে– এসবের মুখোমুখি হয়েও যদি আপনাকে সমস্যাকে নিয়ন্ত্রণে এনে সকলকে নিয়ে একত্রে শৃঙ্খলার সাথে কাজ করে যেতে হয়, তা হলে প্রয়োজন শান্ত ভাব ও অসীম ধৈর্য।” কমরেড শঙ্কর সাহা সব সময় এই শিক্ষা স্মরণে রেখেছিলেন।

এই ভাবে হাসি মুখেই কমরেড শঙ্কর সাহা সমস্ত সমস্যা ও বাধা-বিপত্তি মোকাবিলা করতেন। কমরেড শিবদাস ঘোষের শিক্ষা অনুসরণ করে সবসময় তিনি অন্য কমরেডদের ভাল দিক, গুণের দিকগুলি লক্ষ করতেন। তাদের খারাপ দিকগুলি, ত্রুটিবিচ্যুতি– এসব তিনি বড় করে দেখতেন না। কমরেডরা আমাকে বলেছেন, কোনও কমরেড সম্পর্কে অভিযোগ নিয়ে তাঁর কাছে গেলে, সবকিছু শোনার পর ওই কমরেডের গুণের দিকগুলি দেখিয়ে এমনভাবে তিনি আলোচনা করতেন যে অভিযোগকারী কমরেডরা খুশি মনে ফিরে আসতেন। কারও সম্পর্কে নিজের মতো করে ভেবে নেওয়া, এখানে সেখানে তাকে নিয়ে আলোচনা করা– এ সব কখনও তিনি করতেন না। কিছু মনে হলে, তিনি নেতৃত্বের মতামত নিতেন। প্রতিটি কমরেড সম্পর্কে তিনি ছিলেন সদাসতর্ক। তাঁর সামনে সকলে খুব সহজ ভাবে, খুশি মনে থাকতে পারত। অনেকে এমনকি এও বলেছেন যে, কোনও কষ্ট বা মানসিক অস্থিরতার সময়ে তাঁরা কমরেড শঙ্কর সাহার কাছে চলে যেতেন। তাঁর কাছে কিছুক্ষণ বসে থাকলে, তাঁর সাহচর্য পেলে সেইসব মানসিক যন্ত্রণা কোথায় হারিয়ে যেত, কোনও কথা বলারও দরকার পড়ত না! এমনই ছিল তাঁর সাহচর্যের প্রভাব! কোনও ট্রাইব্যুনালে যখন কোনও শ্রমিকের হয়ে তিনি লড়তেন, মনে হত যেন তিনি নিজের জন্যই লড়ছেন। জিজ্ঞাসা করলে বলতেন, ‘‘আমি নিজেকে নেতা মনে করি না। ওই শ্রমিক, তার পরিবার, তাদের দুঃখকষ্ট– এসবের সঙ্গে আমি একাত্ম হয়ে যাই। ওদের কষ্টের সঙ্গে একাত্ম না হলে আমরা ওদের হয়ে লড়ব কী করে! এ তো আর শুধু আইনের লড়াই নয়!” এটিও আমাদের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি শিক্ষা। শ্রমিকরাও সব সময় বুঝতে পারত যে, কমরেড শঙ্কর সাহা তাদের নিজের লোক। কেউ কেউ বলেছে, উনি যখন কারখানা-গেটে কিংবা কোনও বস্তি এলাকায় যেতেন, কারওরই মনে হত না উনি একজন নেতা। তিনি যেন নিতান্তই তাদের আপনজন। এই ছিল কমরেড শঙ্কর সাহার প্রকৃতি। আমার মনে হয়, তিনি পার্টিতে এসেছিলেন মানবতাবাদী মূল্যবোধ নিয়ে। পরবর্তী সময়ে আমাদের প্রয়াত নেতা কমরেড শিবদাস ঘোষের শিক্ষায় তিনি সর্বহারা মূল্যবোধ অর্জন করেছিলেন।

স্মরণসভার সভাপতি কমরেড রাধাকৃষ্ণের সঙ্গে আমি সম্পূর্ণ একমত যে, জনপ্রিয়তা অর্জনের কোনও ঝোঁক তাঁর ছিল না। বহু আন্তর্জাতিক ও সর্বভারতীয় বৈঠকে তাঁকে অংশগ্রহণ করতে হত। প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি যোগ দিতেন মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারায় বলীয়ান বিপ্লবী সর্বহারা আন্দোলনের একমাত্র প্রতিনিধি হিসাবে। বর্তমানে, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কোনও শ্রমিক সংগঠনই এই বিপ্লবী আদর্শ নিয়ে চলছে না। দেশের মধ্যেও আমাদের সংগঠন ছাড়া আর কোথাও এই আদর্শের চর্চা হচ্ছে না। আমাদের দল ও শ্রমিক সংগঠনের পক্ষ থেকে কমরেড শঙ্কর সাহা এই বিপ্লবী লাইনের ভিত্তিতে আলোচনা করতেন এবং তা উপস্থিত জনদের মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টি করত। নানা জায়গা থেকে তিনি প্রশংসা পেতেন, শ্রদ্ধা-সম্মান লাভ করতেন, কিন্তু কোনও দিন সে সবের জন্য এতটুকু অহঙ্কারের প্রকাশ তাঁর মধ্যে দেখা যায়নি। কোনও দিন নিজের ঢাক নিজে পেটাননি। কোনও দিন কেউ তাঁকে বলতে শোনেনি– আমি এই করেছি, ওই করেছি– ওরা প্রশংসা করে আমার সম্পর্কে এই বলেছে, ওই বলেছে– কোনও দিনও তাঁর মুখে এসব কথা শোনা যায়নি। আমার কাছে যখন রিপোর্ট করতেন, এ সমস্ত বাদ দিয়ে সাধারণ ভাবে বিবরণ দিতেন।

আমাদের ট্রেড ইউনিয়ন অফিসেও কেউ তাঁকে এসব বলতে শোনেনি। বরং সবসময় তাঁর চিন্তা ছিল, পার্টি নেতৃত্ব তাঁর উপরে যে দায়িত্ব দিয়েছেন, তিনি তা ঠিকমতো পালন করতে পারছেন না, পিছিয়ে আছেন। তাঁকে আরও কাজ করতে হবে। এই ছিল তাঁর ভাবনা।

আরেকটি বিষয় আমি এখানে বলতে চাই। সরকার ও মালিকের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তিনি ছিলেন অত্যন্ত দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। কিন্তু ব্যক্তিগত ভাবে কারও প্রতি তাঁর শত্রুতা, কারও সঙ্গে সম্পর্কে তিক্ততা ছিল না। তাঁরা তাঁকে শ্রদ্ধা করতেন। এখানেও আমি কমরেড শিবদাস ঘোষের বক্তব্য উদ্ধৃত করছি– ‘‘সর্বহারা শ্রেণিচেতনায় উদ্বুদ্ধ একজন বিপ্লবীর কাছে বুর্জোয়া শ্রেণির বিরুদ্ধে সংগ্রামটা হল ব্যক্তিনিরপেক্ষ শ্রেণিসংগ্রাম। নিজে ধনী না হতে পারার ঈর্ষা থেকে বুর্জোয়া শ্রেণির বিরুদ্ধে সংগ্রামের এই চেতনা জন্ম নেয় না। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দাবিদাওয়া নিয়ে তার লড়াইয়ের চরিত্রও ব্যক্তিগত নয়। এগুলো ব্যক্তিনিরপেক্ষ। তার ঘৃণা মালিক শ্রেণির বিরুদ্ধে, ব্যক্তিমালিকের বিরুদ্ধে নয়। এই ঘৃণার চরিত্র যদি ব্যক্তিগত হয় এবং যদি তা শ্রেণি চেতনা থেকে জন্ম না নেয়, তা হলে সুযোগ-সুবিধা পেলে, পরিস্থিতি তৈরি হলে একজন শ্রমিকের বুর্জোয়া বনে যাওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়।” কর্তৃপক্ষ ও মালিকদের সঙ্গে আচরণের ক্ষেত্রে কমরেড শঙ্কর সাহা সর্বদা এই সংস্কৃতির দ্বারা পরিচালিত হয়েছেন। সেই কারণেই তিনি তাঁদের সম্মান পেয়েছেন।

একটা ঘটনার কথা বলছি। একটা কারখানায় লাগাতার শ্রমিক বিক্ষোভ চলছিল। কোনও একটা ঝামেলায় একজন ম্যানেজার মারা যান। মালিকরা ট্রেড ইউনিয়নের নেতাদের বিরুদ্ধে কেস করে। এই নেতাদের একজন ছিলেন আমাদের ইউনিয়নের। যদিও ঘটনার সময় উনি ওখানে উপস্থিত ছিলেন না, ঘটনার সঙ্গে আদৌ জড়িত ছিলেন না। কিন্তু তার বিরুদ্ধে ‘অ্যাটেম্পট টু মার্ডার’ (খুন করার চেষ্টা)-এর গুরুতর অভিযোগ দায়ের করা হয়েছিল। শঙ্কর সাহা মালিকের সাথে দেখা করেন। বলেন, ‘‘আমি আপনার কাছে দয়াদাক্ষিণ্য চাইতে আসিনি। আপনি আমায় চেনেন। যদি আপনি জেনে থাকেন যে আমাদের ইউনিয়নের নেতাটি দোষী, তা হলে তাকে শাস্তি দিন। কিন্তু আমি জানি যে, সে ওই ঘটনার সঙ্গে যুক্ত ছিল না। এই অবস্থায় আপনি কী করবেন?” মালিক উত্তর দিলেন, ‘‘শঙ্করবাবু, আমি জানি আপনি আমাদের ঘোর বিরোধী। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমি আপনাকে এবং আপনার ট্রেড ইউনিয়নের নেতাকে সৎ মানুষ হিসাবে সম্মান করি। আমি জানি উনি ওই ঘটনায় জড়িত ছিলেন না। আমি কথা দিচ্ছি, ওঁর বিরুদ্ধে মামলা করা হবে না।” সত্যিই ওই নেতার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হয়নি। দেখুন একবার, শুধু শঙ্কর সাহাকে মালিক শ্রদ্ধা করতেন বলে কী ঘটনা ঘটল!

এবার অন্য একটি ঘটনার কথা বলব। আসানসোলের এক কমরেড আমাকে বলেছিলেন যে, তাঁর এক বন্ধু ইস্ট ইন্ডিয়ান ইলেকট্রিসিটি কোম্পানির জেনারেল ম্যানেজার হিসাবে শিলং-এ চাকরি করছেন। দিল্লিতে সরকারি বডি মিটিং সেরে কমরেড শঙ্কর সাহা যে প্লেনে ফিরছিলেন, ওই জেনারেল ম্যানেজারও সেই প্লেনে ছিলেন। পরের দিন ভোরে ওই জেনারেল ম্যানেজার আমাদের আসানসোলের কমরেডটিকে বলেন, ‘‘গতকাল প্লেনে আসার সময় এক ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ হল। কথাবার্তা ও আচরণ থেকে তাঁর গভীর জ্ঞান ও রুচি-সংস্কৃতির উঁচু মানের পরিচয় পেলাম। এমন মানুষ আমি আগে কখনও দেখিনি! তাঁর কথা চিরদিন আমার মনে থাকবে।” পরে ওই কমরেড জেনেছেন যে, এই মানুষটি ছিলেন আমাদের ট্রেড ইউনিয়ন নেতা কমরেড শঙ্কর সাহা। ঘটনাটা আপনারা লক্ষ করুন– প্লেনে যাওয়ার অল্প সময়ের মধ্যেই একজন সাধারণ মানুষের মনে কমরেড শঙ্কর সাহা কী গভীর ভাবে প্রভাব ফেলেছিলেন। তাও তো প্লেনে কথা বলারই বিশেষ সুযোগ পাওয়া যায় না। তাঁর সংস্পর্শে যাঁরাই আসতেন, তাঁদের ওপরেই তাঁর এমন প্রভাব পড়ত। একেই বলে চরিত্র, সংস্কৃতি। অন্ধকার ঘরে আলো ছাড়া সোনার টুকরো খুঁজে পাওয়া যায় না। কিন্তু আলো ছাড়াই অন্ধকারের মধ্যে হিরের টুকরো দেখতে পাওয়া যায়। সংস্কৃতি ও চরিত্র হল এমনই। দ্ব্যর্থহীন ভাবেই আমি বলতে পারি যে, তিনি সংস্কৃতির অত্যন্ত উচ্চ মান অর্জন করেছিলেন। বিপ্লবী পার্টির সঙ্গে একাত্মতা অর্জনের প্রক্রিয়ায় তিনি অনেক উঁচু স্তরে পৌঁছেছিলেন। শুধু ট্রেড ইউনিয়ন কর্মীদের সামনে নয়, আমাদের সমস্ত নেতা ও কর্মীদের কাছে, এমনকি আমার কাছেও কমরেড শঙ্কর সাহা দৃষ্টান্তস্বরূপ। কোনও দ্বিধা না রেখেই এ কথা আমি বলছি। জীবনের অধিকাংশ সময়টা তিনি কাটিয়েছেন ট্রেড ইউনিয়ন অফিসে, তার পরে স্ত্রীর সঙ্গে একটা ছোট্ট ঘরে। যে যত্ন ও পরিচর্যার প্রয়োজন তাঁর ছিল, তা তিনি পাননি।

তাঁর স্ত্রীর মৃত্যুর পর আমি তাঁকে আমাদের শিবপুর সেন্টারে নিয়ে আসতে পেরেছিলাম। প্রথম দিকে তাঁর একটু দ্বিধা ছিল। আরেকটি কথা আমি বলতে ভুলে গেছি। কমরেড শঙ্কর সাহার জীবনযাত্রা ছিল খুবই সাধারণ। খাওয়া-দাওয়া, জামাকাপড়, থাকা– সব দিক দিয়েই তাঁর জীবনযাত্রা ছিল অত্যন্ত সাদামাটা। নিজের জন্য একটা টাকা খরচ করতে হলেও তিনি দু’বার ভাবতেন– বাজে খরচ হচ্ছে না তো! কারণ, এ তো জনগণের টাকা! অনেক কমরেডই জানেন না, যখন তিনি আইএলও সম্মেলনে যোগ দিতে গিয়েছিলেন, সঙ্গে করে চাল, আলু, অন্যান্য জিনিসপত্র নিয়ে গিয়েছিলেন। সেখানে সে সব তিনি রান্না করে খেতেন যাতে ওখানে যাওয়া এবং থাকার জন্য যে টাকা তাঁকে বরাদ্দ করা হয়েছিল, তার কিছুটা তিনি বাঁচাতে পারেন। নিজের খাওয়ার জন্য সে টাকার পুরোটা তিনি খরচ করে ফেলেননি যাতে পার্টির হাতে কিছু টাকা তুলে দেওয়া যায়। পার্টি কিন্তু এটা তাঁকে করতে বলেনি। এ ছিল সম্পূর্ণ তাঁর নিজের সিদ্ধান্ত।

যখন অসুস্থ হলেন, হার্ট অপারেশন হল, তখন হাঁটতে কষ্ট হত। একবার ফুটপাতে পড়েও গিয়েছিলেন। আমি বলেছিলাম– ‘‘তুমি একটা গাড়ি বা ট্যাক্সি নাও”। কিন্তু তিনি রাজি হননি। আমি বলেছিলাম, ‘‘তুমি একটু বেশি করে প্রোটিন খাও”। ডিম, কলা– এসব খাওয়া দরকার ছিল তাঁর। কিন্তু শঙ্কর সে সব খাননি। খবর পেয়ে আমি বকলাম। বললাম– ‘‘যদি তুমি নিজে ব্যবস্থা না করো, তা হলে পার্টি অফিস থেকে আমি এসব পাঠাব। তুমি কি সেটা চাও?” তারপর সে সব চালু হয়।

শিবপুর সেন্টারে যখন তাঁকে আনা হল, সেন্টারের সদস্যরা হয়ত জানেন না, ভীষণ খুশি হয়েছিলেন। কারণ, এই প্রথম তাঁর কোনও সেন্টারে থাকার সুযোগ হল। কলকাতা হাইকোর্টের প্রখ্যাত একজন অ্যাডভোকেট, যিনি আমাদের দলের একজন শুভাকাঙক্ষী– তাঁকে, আমার নাম করে আনন্দ আর গর্বের সঙ্গে জানিয়েছিলেন যে তিনি সেন্টারে থাকছেন। বোধহয় এক বছরের কাছাকাছি এখানে ছিলেন এবং সারা জীবনে শুধু এই সময়টুকুতেই তিনি একটু যত্ন পেয়েছিলেন। এ কথা আমি বলছি।

এই সেন্টারের সকলকে নিয়ে বসে আমি কমরেড শঙ্কর সাহা সম্পর্কে তাদের অনুভূতির কথা জানতে চেয়েছিলাম। তিনি কতখানি ব্যক্তি-নিরপেক্ষ বিচারধারা নিয়ে চলতেন, সকলেই চোখের জলে সে কথা বলেছে। তিনি কখনও এটা খাব, সেটা খাব– এমন বলতেন না। এসব নিয়ে তিনি মাথা ঘামাতেন না। যা দেওয়া হত খুশি মনে সেটাই খেতেন। কখনও নিজের জন্য অন্যকে ব্যস্ত করতে চাইতেন না। কমরেডরা নিজেরাই এগিয়ে এসে তার জন্য করত। এখানেই হোক বা অফিসে, যদি কোনও বিষয়ে কারও সাহায্য দরকার হত, প্রথমেই তিনি জিজ্ঞাসা করতেন, ‘‘তুমি কি ফাঁকা আছ, নাকি কোনও কাজ আছে?” যদি সেই কমরেডটির হাতে সময় থাকত, তা হলে তাকে বলতেন, ‘‘আমাকে একটু সাহায্য করো”। প্রত্যেকের সাথে– বয়স্ক, কমবয়সী এমনকি বাচ্চাদের সাথেও তাঁর ছিল বন্ধুসুলভ, কমরেডসুলভ সহজ সম্পর্ক। আগে কখনও সেন্টারে না থাকলেও এক বছরের মধ্যেই নিজেকে তিনি সেন্টারের সুযোগ্য সদস্য প্রমাণ করেছিলেন। অত্যন্ত ইম্পার্সোনাল এই মানুষটি সেন্টারের অন্য সদস্যদের সামনে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। সেন্টার মিটিংয়ে অনেকে বলেছেন, ‘উনি আমাদের অনেক কিছু শিখিয়েছেন, প্রেরণা দিয়েছেন’। কমরেডরা তাঁর ধৈর্য, অধ্যবসায়, দৃঢ়তা, অদম্য তেজ এবং জীবনের প্রতি ইম্পার্সোনাল দৃষ্টিভঙ্গির কথা লিখেছেন। কোনও কমরেডের সাথে যখনই তিনি কিছু আলোচনা করতেন, কমরেড শিবদাস ঘোষের শিক্ষার কথা তুলে ধরতেন।

উল্লেখ করা দরকার, কমরেড প্রীতীশ চন্দ, কমরেড তাপস দত্ত, কমরেড আশুতোষ ব্যানার্জী– এঁরাও আমাদের শ্রমিক সংগঠনের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। কমরেড প্রীতীশ চন্দ, কমরেড তাপস দত্ত প্রথম দিকে শ্রমিক আন্দোলনও গড়ে তুলেছিলেন। কিন্তু এঁরা মূলত পার্টির নেতা হিসাবে পরিচিত ছিলেন। ফলে কমরেড শঙ্কর সাহার সঙ্গে তাঁদের তুলনা করা চলে না। কমরেড শঙ্কর সাহা ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনে পুরোপুরি যুক্ত ছিলেন। কিন্তু ট্রেড ইউনিয়ন নেতা হিসাবে কমরেড শঙ্কর সাহা ছিলেন অতুলনীয়। শ্রমিক আন্দোলনে তাঁর মধ্যে দিয়েই কমরেড শিবদাস ঘোষের সুগভীর চিন্তাধারা ও উন্নত সংস্কৃতির প্রকৃত ও সর্বোন্নত প্রতিফলন ঘটত। আমাদের সামনে কমরেড শঙ্কর সাহা এক উজ্জ্বল উদাহরণ।

বর্তমানে আমরা একটা অত্যন্ত কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে চলেছি। আমাদের দেশ সহ পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী বিশ্ব জুড়ে শ্রমিক শ্রেণি নানা ভয়ঙ্কর আক্রমণের শিকার। বিশ্বে এখন সমাজতান্ত্রিক শিবির নেই, নেই শ্রমিক আন্দোলনের শক্তিশালী জোয়ার। আমরা দেখতে পাচ্ছি প্রতিদিন, প্রতি ঘন্টায় সমস্যার পর সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। আমাদের দেশে কোটি কোটি মানুষের হাতে কাজ নেই। ছাঁটাই হয়েছেন কোটি কোটি শ্রমিক-কর্মচারী। প্রতি মুহূর্তে হাজার হাজার মানুষ না খেতে পেয়ে, বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছে। শ্রমিক অধিকার বলে কিছু নেই। শ্রম-আইনগুলিকে এমন ভাবে পাল্টে দেওয়া হয়েছে যে সেগুলিকে শ্রমিকদের স্বার্থে আইন না বলে মালিকদের স্বার্থে আইন বলাই ভাল। স্থায়ী পদ তুলে দেওয়া হচ্ছে। শ্রমিকদের বেশিরভাগই এখন অস্থায়ী বা চুক্তিবদ্ধ শ্রমিক। তাদের মজুরি বা কাজের সময়, কোনওটাই নির্দিষ্ট নয়। দাসশ্রমিকের মতো করে তারা কাজ করে। নতুন একদল শ্রমিক সৃষ্টি হয়েছে– পরিযায়ী শ্রমিক। আগে পরিযায়ী শ্রমিক বলে কিছু ছিল না। ফলে, এই পরিস্থিতিতে প্রয়োজন শক্তিশালী বিপ্লবী শ্রমিক আন্দোলন গড়ে তোলা। এই পরিস্থিতিতে প্রয়োজন কমরেড শঙ্কর সাহার মতো আরও অনেক নেতা। শ্রমিক শ্রেণির আন্দোলনের এখন এটাই দাবি। বিপ্লবী আন্দোলনের এখন এটাই দাবি। বর্তমান সময় জোরালো ভাবে এই দাবি জানাচ্ছে।

কমরেডদের কাছে আমি বলছি– বর্তমানে আমরা অনেক নেতা ও কর্মীকে হারাচ্ছি। এই শূন্যস্থান আপনাদের পূরণ করতে হবে। মা’র্বাদ-লেনিনবাদ-শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারা গভীর ভাবে চর্চা করুন। নিজেকে বিকশিত করুন। পুঁজিবাদী দোষ, অভ্যাস, অপসংস্কৃতি ইত্যাদির সঙ্গে আপস করবেন না। নিজের উদ্যোগ বাড়ান। বিপ্লবী জ্ঞানকে সমৃদ্ধ করুন। এটাই এখন সময়ের আহ্বান। শ্রমিকদের প্রতি কমরেড শিবদাস ঘোষ একটি আহ্বান রেখেছেন। আমাদের বহু নেতা-কর্মী প্রয়োজন যাঁরা সেই আহ্বান শ্রমিকদের কাছে নিয়ে যাবেন। কী সেই আহ্বান? ‘‘আপনারা শ্রমিক। আপনারা সভ্যতার স্রষ্টা। এই সভ্যতা মুক্তির জন্য আর্তনাদ করছে। এই সভ্যতা আপনাদের কাছে মুক্তি চাইছে। শুধু আপনার নিজের মুক্তি নয়, আপনার উপর নির্ভর করে রয়েছে গোটা মানবজাতির মুক্তি।”– শ্রমিকদের প্রতি এই ছিল কমরেড শিবদাস ঘোষের আহ্বান। আমাদের আজ দরকার কমরেড শঙ্কর সাহার মতো অনেক নেতা যাঁরা এই আহ্বান শ্রমিকের কাছে, চাষির কাছে, সাধারণ মানুষের কাছে বহন করে নিয়ে যাবেন।

কমরেড শিবদাস ঘোষ আমাদের শিখিয়েছেন, শোককে কী ভাবে গ্রহণ করতে হয়। আপনাদের সে কথা অবশ্যই বুঝতে হবে। এই পথে অবিরাম সংগ্রাম চালিয়ে আপনারা যদি আমাদের সমৃদ্ধ করতে পারেন, তাহলেই কেবল মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদ-শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারার ঝান্ডা বহন করে, উন্নততর সর্বহারা সংস্কৃতির ঝান্ডা কাঁধে নিয়ে আমরা শোষিত মানুষ তথা গোটা মানবজাতির মুক্তির ব্রত সার্থক করতে পারব। এটাই আমাদের দৃঢ় পণ হওয়া উচিত। এই কথা বলেই আমি আলোচনা শেষ করলাম।

গণদাবী ৭৩ বর্ষ ৪১ সংখ্যা