আমাদের শিরায় শিরায় বইছে শহিদের রক্ত

 

শহিদ পরিবারের সদস্যদের হাতে স্মারক তুলে দিচ্ছেন কমরেডস দেবপ্রসাদ সরকার, সৌমেন বসু, চণ্ডীদাস ভট্টাচার্য প্রমুখ নেতৃবৃন্দ

১১ জানুয়ারি, আবেগ চোখের জল আর দৃঢ় প্রত্যয়-ভরা শপথে মেশা এক অভূতপূর্ব সমাবেশ দেখল ১৮৪ জন শহিদের রক্ত-পূত দক্ষিণ ২৪ পরগণার মাটি।

১৯৯৭ সালে এমনই এক ১১ জানুয়ারি সিপিএম আশ্রিত দুষ্কৃতীরা বোমা মেরে, কুপিয়ে হত্যা করেছিল তেভাগা আন্দোলনের প্রবীণ নেতা, কৃষক সংগঠন এ আই কে কে এম এস-এর পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সম্পাদক এবং এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)-এর রাজ্য কমিটির সদস্য কমরেড আমির আলি হালদারকে।

এ বার এই দিনটিতেই এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট) ডাক দিয়েছিল কংগ্রেস, সিপিএম, তৃণমূল শাসকদের হাতে দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলায় যাঁরা শহিদ হয়েছেন এবং নির্যাতন ভোগ করেছেন তাঁদের প্রতি সম্মাননা জ্ঞাপন সমাবেশের। এই ডাকে সাড়া দিয়ে বাইশহাটার বকুলতলা-নতুনহাট মাঠের সমাবেশে যোগ দিলেন ২০ হাজার মানুষ।

সুন্দরবন লাগোয়া এই জেলার নানা প্রান্ত-প্রত্যন্ত থেকে বহু পথ পেরিয়ে যেমন তাঁরা এসেছেন, তেমনই এসেছেন ডায়মন্ডহারবার, বারুইপুর, নামখানা, কাকদ্বীপ, সাগর এলাকা থেকে। অঞ্চলে অঞ্চলে ইতিহাস খুঁজে শহিদদের তালিকা প্রস্তুত করেছে দল। নেতা-কর্মীরা প্রত্যেক শহিদের পরিবার এবং নির্যাতিতদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে পৌঁছে দিয়েছেন আমন্ত্রণ। একদিকে প্রিয়জন হারানোর ব্যথা, অন্য দিকে শহিদদের অপূরিত স্বপ্নপূরণের অঙ্গীকার নিয়ে সেই সব পরিবারের সদস্যরা উপস্থিত হয়েছেন সমাবেশে।

চোখের জলে স্মরণ

কত ইতিহাস বুকে নিয়ে, মানুষ এই সমাবেশে এসেছে তা বোঝা যাচ্ছিল শুরুর আগে থেকেই। তখন সবে ধীরে ধীরে শুরু হচ্ছে জনসমাগম। সাদা ফেজ টুপি, সাদা দাড়ির বৃদ্ধ মোক্তার মোল্লা বাইশহাটার বটতলা থেকে অশক্ত শরীর কিন্তু তাজা একটা মন নিয়ে এসে বসেছেন চেয়ারে। এক যুবকর্মী এগিয়ে গেলেন তাঁর কাছে– দক্ষিণ ২৪ পরগণার অসংখ্য লড়াইয়ের ইতিহাস থেকে একটু উত্তাপের স্পর্শ পেতে। প্রবীণ কমরেড দিলেনও সেই উত্তাপের পরশ। নতুন প্রজন্মের কর্মীদের হাতে তুলে দিয়ে গেলেন তাঁদের লড়াইয়ের উত্তরাধিকার। বললেন, ‘৮২ বছর বয়স আমার, ৫২-৫৩ বছর ধরে এই দলটা করছি। আমি তো ক’দিন বাদে মরে যাব, কিন্তু আপনারা এ দলটাকে বাড়িয়ে তুলুন। এ সোনা হারালে এমন সোনা আর পাবেন না। মানুষ আজ বুঝতে পারছে না, আজ বিজেপি-তৃণমূল কাল আর একটা– এ সব যতই আসুক কিচ্ছু হবে না। সব সমস্যার সমাধানের জন্য, হিন্দু-মুসলমান লড়াইয়ের মীমাংসার জন্য এই এস ইউ সি-র কাছেই মানুষকে শেষ পর্যন্ত আসতে হবে। আপনারা শক্ত হয়ে থাকুন, কোনও ভয় নেই। এরা সব চলে যাবে, থাকবে এই দলটাই।’

নতুনহাটের চায়ের দোকানের বেঞ্চে বসে তাড়াতাড়ি একটু খেয়ে নিয়ে সভায় ঢোকার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন রাধাবল্লভপুর গাজি পাড়ার মোর আলম গাজি। বললেন, ‘আমির আলি মাস্টারকে যারা খুন করে, প্রবোধ পুরকায়েতের মতো মানুষকে যারা মিথ্যে কেসে জেল খাটায় তারা কি মানুষ! কত মার খেয়েছি ওই গুণ্ডাদের হাতে, আমায় ওরা ভিখারি করে দিয়েছে, কিন্ত আমি পিছিয়ে যাইনি। যারা এমন সব দেবতার মতো মানুষকে দেখেছে তারা ভয়ে পিছিয়ে যেতে পারে না।’

বক্তব্য রাখছেন কমরেড সৌমেন বসু

সভা মঞ্চের সামনে মাঠের বাঁ দিকের বড় একটা অংশ জুড়ে ব্যবস্থা হয়েছিল শহিদদের পরিবার এবং নির্যাতিতদের বসার। সেখানে কান পাততেই শোনা গেল স্বাধীনতা-উত্তর সুন্দরবনের মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের গৌরবের এক একটি অধ্যায়ের কথা। মৈপীঠ অঞ্চলের শহিদ পরিবারের সকলে মিলে এক সাথে মালা দিচ্ছিলেন মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা শহিদ বেদিতে। ফুল দিয়ে লাল সেলাম জানিয়ে গভীর শ্রদ্ধায় তাকাচ্ছেন পতপত করে উড়তে থাকা সংগ্রামী লাল পতাকার দিকে। কেউ কেউ কান্নায় ভেঙে পড়ছেন। তার মধ্যেও এক মা বলে গেলেন– ‘অনেক নির্যাতন সয়েছি, কিন্তু এই দলটার প্রতি ভালবাসা কেউ কেড়ে নিতে পারেনি।’ মৈপীঠেরই কিশোরীমোহনপুরের পঞ্চানন জানা সেই ১৯৭৬ সাল থেকে দলের সাথে। বহু লড়াইয়ে থেকেছেন, বহু লড়াই দেখেছেন, নির্যাতন সয়েছেন। কিন্তু দলের ঝান্ডা ছাড়েননি। বললেন, ‘শত্রুপক্ষ সন্ত্রাস কায়েম করেছে, সাময়িক ভাবে সংগঠকরা অনেকে ঘরছাড়া। কিন্তু এই পার্টিটাকেই মানুষ বুকে ধরে রেখেছে। তাঁরা আবার মাথা তুলবেন।’ মৈপীঠের আর এক মা বলে গেলেন, ‘দল ডেকেছে– যত নির্যাতন হোক আমাদের আসতেই হবে।’

মেরিগঞ্জ-১-এর সর্বজনশ্রদ্ধেয় নেতা কমরেড মোকাররম খাঁকে ১৯৮৪ সালে হত্যা করেছিল কংগ্রেসি দুষ্কৃতীরা। তাঁর ভাই মফিজুল খান বলে গেলেন, ‘এলাকার গরিব মানুষ শোষিত মানুষ আজও মোকাররম খাঁয়ের স্মৃতি বুকে বহন করে। আজও তারা শাসক দলের গুণ্ডা আর পুলিশের বিরুদ্ধে বুক চিতিয়ে লড়ে। শিবদাস ঘোষের শিক্ষাই আমাদের আসল শক্তি। এই আদর্শ নিয়েই বীরের মতো লড়ছে মানুষ।’ বললেন, ‘সাধারণ মানুষকে ধন্যবাদ দিতে হয়, এত প্রলোভন, মিথ্যে কেস, পুলিশের হুমকি অত্যাচার, তবু তারা শিবদাস ঘোষের আদর্শটাকে ছেড়ে দেয়নি, বুকে আগলে রেখেছে।’ ঠিক তাঁর পাশেই বসে ছিলেন আখতারুল খাঁ, ২০০৩ সালে গরিব মানুষের অধিকার রক্ষার লড়াইতে প্রাণ গেছে তাঁর ১৮ বছরের তরতাজা পুত্রের। এই সমাবেশে এসে তাঁর অনুভূতি কী? বলতে গিয়ে গলা ভিজে এল কান্নায়। বলে চললেন মোকাররম খাঁ, আমির আলি হালদার, ঢোষা-চন্দনেশ্বরের গোবিন্দ হালদার সহ আরও অনেক শহিদ কমরেডের নাম। ‘আপনার ছেলেকে হারিয়েও দলটাকে আঁকড়ে ধরেছেন কীসের জোরে?’ চোখের জল মুছে মুহূর্তে বেরিয়ে এল এক বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর–‘শুধু আমার ছেলে শহিদ হয়েছে তা তো নয়, এত কমরেডকে হারিয়েছি, কতজন জেলে বন্দি, তাদের সকলের কথা বলুন।’ বললেন, ‘আজকের দিনে প্রলোভন দেখিয়ে মানুষকে কেনার চেষ্টা করছে, টিএমসি, বিজেপি। কিছু ছেলে হয়তো ওই লোভে পা দিচ্ছে, কিন্তু এতে ওদের কত ক্ষতি হবে বুঝছে না। আমরা যে আদর্শ নিয়ে চলেছি সেটাই ওদের কাছে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি। এই আদর্শটাই সফল হবে।’ এই সেই নৈতিকতা, সেই বিপ্লবী জীবনবোধ, যা কুলতলি জয়নগর সহ দক্ষিণ ২৪ পরগণার বিস্তীর্ণ এলাকার সংগ্রামী গরিব মানুষ অর্জন করেছেন মহান মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-শিবদাস ঘোষের আদর্শকে পাথেয় করে।

 

বক্তব্য রাখছেন কমরেড চণ্ডীদাস ভট্টাচার্য

১৯৮০ সালে কংগ্রেস এবং সিপিএমের মিলিত বাহিনী খুন করে কমরেড সুজাউদ্দিন আখন্দকে। তাঁর পরিবারের সদস্যদের সাথে বসে আছেন ক্যানিংয়ের গোপালগঞ্জ এলাকার বহু মানুষ। তাঁরাও যা বলে গেলেন তাতে স্পষ্ট, রক্ত ঝরিয়েছে ঘাতকেরা, সংগ্রামী মানুষকে হত্যা করে তার দেহটাকে নিথর করে দিয়েছে, কিন্তু পারেনি শোষণমুক্তির স্বপ্নকে, আদর্শকে হত্যা করতে। পারেনি বিপ্লবের গতিটাকে রুখে দিতে।

কুলতলির মনিরতটের সংগ্রামী নেতা শহিদ কমরেড হাকিম শেখকে নিয়ে একদিন মানুষ গান বেঁধেছিল ‘মনিরতটের মাথার মণি’। সেই হাকিম শেখের ছেলে রুহুল আমিন শেখ, কন্যা মীনা শেখ (বৈদ্য) জানিয়ে গেলেন ওই এলাকার মানুষের লড়াইয়ের কথা। নলগোড়ার মানুষ শোনালেন সম্ভাবনাময় বিপ্লবী সংগঠক শহিদ অশোক হালদারের কথা। বলে গেলেন শহিদ মোসলেম মিস্ত্রির কথাও। শহিদ কমরেড ইলিয়াস পুরকাইতের ভাই ইউসুফ পুরকাইত শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর এই সমাবেশে এসে বলে গেলেন ‘এখানে শপথ নিয়ে যাচ্ছি– বিপ্লবী আন্দোলনের প্রয়োজনে আরও জীবন দিতে হলে আমরা দেব। কমরেড শিবদাস ঘোষের অপূর্ণ স্বপ্ন সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবকে আমরা সফল করবই।’

২০২০-র ৪ জুলাই তৃণমূল দুষ্কৃতীদের হাতে খুন হয়েছেন জেলার শ্রমিক আন্দোলনের নেতা মৈপীঠের কমরেড সুধাংশু জানা। তাঁর কন্যা সুতপা অনুভব করেন শহিদের মেয়ে হওয়ার গর্ব। বলে গেলেন, ‘আমার বাবার মৃত্যুতে শাসকদের বিরুদ্ধে যে জনজোয়ার উঠেছিল, জনগণ আমার বাবাকে আজ যেভাবে বরণ করেছে তার সাথী হতেই সমাবেশে এসেছি।’

কিশোর শহিদ মাধাই হালদারের বোন অলকা হালদার (সরদার) ছুঁয়ে গেলেন এই সমাবেশের আসল সুরটিকে। চোখে তাঁর জল, কিন্তু কণ্ঠে নতুন সমাজ গড়ার শপথ। বললেন, ‘শহিদদের স্মৃতিকে শিরায় শিরায়, আমাদের রক্তের ভিতরে বহন করছি আমরা। আমার সন্তানকেও এই মহান আদর্শ, এই মহান লড়াইয়ের অংশীদার করার চেষ্টা করে চলেছি।’

শহিদ বেদিতে মল্যদান করছেন জেলা সম্পাদক কমরেড দেবপ্রসাদ সরকার

শহিদ আমির আলি হালদারের পরিবারের পক্ষ থেকে দলের পলিটবুরো সদস্য এবং দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলা সম্পাদক কমরেড দেবপ্রসাদ সরকারের হাত থেকে শহিদ স্মারক নিয়ে সালেহা গাজি বলে গেলেন, ‘আজ আমার খুব দুঃখের দিন। কী নৃশংস ভাবে ওরা আমার বাবাকে মেরেছিল তা জানে সবাই। আজ আমার বুকভরা ভালবাসা এই দলটার জন্য। শিবদাস ঘোষের স্মৃতির সঙ্গী হয়ে আছেন আমার বাবা। যিনি পার্টির সবচেয়ে বড় নেতা তিনিই আমার কাছে সবার বড়।’

সমাবেশে এসেছিলেন আরও অনেক শহিদের পরিবার, সময়ের অভাবে সবার সাথে কথা বলা যায়নি। বলতে পারলে ছুঁয়ে আসা যেত দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলার সংগ্রামী মানুষের শোষণবিরোধী অসমসাহসী লড়াইয়ের ইতিহাসের গৌরবময় আরও অনেক অধ্যায়কে। কথা বলা যায়নি সমাবেশে উপস্থিত কংগ্রেস, সিপিএম, তৃণমূলের দুষ্কৃতীবাহিনীর অত্যাচারে ঘরহারা, সব-খোয়ানো দলের অসংখ্য কর্মী-সমর্থক-সাধারণ মানুষের সঙ্গেও, যাঁরা যাবতীয় সন্ত্রাস নির্যাতনের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে রক্ষা করে চলেছেন সংগ্রামের সাথী প্রিয় দলটিকে। মঞ্চের পাশে সুউচ্চে উড্ডীন লাল পতাকা জেলার মানুষের অসাধারণ সংগ্রামের সেই উজ্জ্বল ইতিহাসের গৌরবময় স্মৃতি আরও একবার জাগিয়ে দিয়ে গেল।

(গণদাবী-৭৩ বর্ষ ১৭ সংখ্যা_১৫ জানুয়ারি, ২০২১)