আমরা যখন মিছিলের মুখ

৩০ জানুয়ারি এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট) পার্টির তরফ থেকে এক মহামিছিলের আহ্বান জানানো হয়েছিল বাংলার সমস্ত স্তরের মানুষের কাছে৷ সেই ঐতিহাসিক মিছিলে ঘটনাচক্রে অংশগ্রহণের সুযোগ ঘটে পত্রকারের৷

হেদুয়া পার্কে পৌঁছতেই মহানগরীর জনরণ্যের ক্যানভাস বদলে গেল জনসমুদ্রে৷ সমুদ্রতটের ছোট ছোট ঢেউয়ের মতো হেদুয়া পার্কের সামনে স্বল্প পরিসর রাস্তায় আনাগোনা করছে ছোট বড় লম্বা বেঁটে নানা বয়সের নানা আকৃতির মানুষ৷ এই জনসমুদ্রের আচরণে চট করে যেটা আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করল তা হল এক প্রচ্ছন্ন শৃঙ্খলাবোধ ও সৌজন্যমূলক আচরণের পরিবেশ৷ সকলের মুখেই সৌহার্দ্যপূর্ণ সপ্রতিভ হাসি, বিভিন্ন দিক থেকে যাঁরা মিছিল প্রাঙ্গণে উপনীত হচ্ছেন তাঁদের সাদরে জনসমুদ্রে অভ্যর্থনা জানানোর দেহভঙ্গি৷

সম্প্রতি ঘটনাচক্রে সর্বহারার মহান বিপ্লবী নেতা কমরেড শিবদাস ঘোষের আদর্শে অনুপ্রাণিত এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট) পার্টির মেডিকেল ফ্রন্টের শীর্ষস্থানীয় নেতৃবর্গের সান্নিধ্য লাভের সৌভাগ্য হয়েছে আমার৷ অবাক চোখে লক্ষ করেছি, হাসপাতালের দায়িত্ব, পার্টির কাজ, কমিউন লাইফ কী অবলীলায় যাপন করেন তাঁরা৷ এই সুবিস্তৃত কর্মকাণ্ডের মাঝেও নবীনতম কমরেডদের প্রতি তাঁদের স্নেহদৃষ্টি সর্বক্ষণ সজাগ৷ এমনই একজন সিনিয়র দাদার অনুরোধে মহামিছিলে অংশগ্রহণ করতে হেদুয়া পার্কে পৌঁছেছিলাম৷

আমরা যারা শহুরে মধ্যবিত্ত তথাকথিত ভদ্র শিক্ষিত পরিশীলিত পরিবারে বড় হয়ে উঠি, কীভাবে যেন আত্মকেন্দ্রিকতার পাঠ আমাদের বেশিরভাগের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করে যায়৷ রাজনৈতিক মিছিলে যোগদানের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সচেতনতা তাই আমার জীবনে এর পূর্বে ঘটেনি৷ বরং রাজনীতির মিটিং মিছিলের জগৎটিকে যেন ভিন গ্রহের প্রাণীদের জগৎ জ্ঞান করতাম৷ তাই মিছিলে যোগ দিতে হবে শুনে এক অজানা অমূলক ত্রাসে খানিকটা আঁতকে উঠেছিলাম৷ কিন্তু সে প্রসঙ্গ এখন থাক৷

ডায়াসে তখন পার্টির রাজ্য সম্পাদক কমরেড চণ্ডীদাস ভট্টাচার্য তাঁর অমূল্য বক্তব্য রাখছেন৷ জানতে পারলাম, মিছিলের মূল অ্যাজেন্ডা প্রথম শ্রেণি থেকে পাশ–ফেল চালু হলেও পাশাপাশি স্থান পাচ্ছে আরও কিছু সামাজিক ব্যাধির প্রতিকারের প্রসঙ্গ৷ যেমন, রাজ্য সরকারের সাম্প্রতিক ঢালাও মদের লাইসেন্স বিতরণ বন্ধের দাবি, সমাজের বুকে পর্বতপ্রমাণ ভার নিয়ে চেপে বসা বেকার সমস্যার সমাধান, ক্রমবর্ধমান নারী নির্যাতনের প্রতিকার, অশ্লীল কদর্য সংস্কৃতির যে ব্যাপক পৃষ্ঠপোষকতা চলছে তার অবসান ঘটানোর দাবি, অস্বাভাবিক দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি রোধ এবং পাশাপাশি সরকারি কর্মচারীদের ন্যায্য পাওনা বেতন ভাতা বৃদ্ধি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের বেসরকারিকরণে সরকারের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতার প্রতিবাদ ইত্যাদি নানা জ্বলন্ত সমস্যার প্রতিকারের দাবি৷

শীতের দুপুরের মিঠে রোদে দাঁডিয়ে মেডিক্যাল ফ্রন্টের অতিপ্রিয় সদস্যদের সঙ্গে রাজনৈতিক বক্তৃতা শোনার সুখকর অভিজ্ঞতা যাঁদের হয়েছে একমাত্র তাঁদের পক্ষেই বোঝা সম্ভব, জগৎ সংসারে যত রকম সম্পর্ক তৈরি হয়, তার মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্পর্ক কমরেডশিপ৷ কমরেডশিপের প্রকৃত অর্থ কী, তার একটা হালকা আভাসমাত্র সেদিন আস্বাদন করলাম৷

শুরু হল মিছিল৷ অভিজ্ঞ পদাতিকেরা স্লোগান তুলছেন, বাকিরা গলা মেলাচ্ছি৷ এতদিন যাদের সৌম্য, মার্জিত, স্নেহময় রূপ দেখেছি, আজ চাক্ষুষ করলাম তাঁদের উদ্যোগী, প্রতিবাদী সত্তা––

‘মুষ্টিবদ্ধ শাণিত হাত আকাশের দিকে নিক্ষিপ্ত,

বিস্রস্ত কয়েকটি কেশাগ্র আগুনের শিখার মতো

           হাওয়ায় কম্পমান

ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ জনসমুদ্রের ফেনিল চূড়ায়

ফসফরাসের মতো জ্বলজ্বল করতে থাকল–

                                  মিছিলের সেই মুখ৷’

অবাক চোখে নিরীক্ষণ করতে থাকলাম আমার আশেপাশে হেঁটে চলা মিছিলের মুখগুলি৷ প্রত্যেকটি মুখে প্রস্ফূটিত একেকটি স্বতন্ত্র জীবনের কাহিনী৷ কলকাতাবাসী শহুরে মানুষের তুলনায় গ্রামের মানুষের যোগদান তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি মনে হল৷ স্বাভাবিক, দারিদ্রের নাগপাশে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা তাঁদের দৈনন্দিন জীবন, আধুনিক সুযোগসুবিধার বঞ্চনা, সরকারি অপশাসনের কুফলের ভুক্তভোগী তো তাঁরাই সবচেয়ে বেশি৷ অশিক্ষার বলি হবে তো সর্বাগ্রে তাঁদের ঘরের সন্তান৷ শহুরে মানুষের মধ্যেও নিম্ন–মধ্যবিত্ত খেটে খাওয়া মানুষের সংখ্যাই বেশি৷

শুনেছিলাম, এস ইউ সি আই (সি)–র মিছিলে মেয়েদের উপস্থিতি খুব প্রমিনেন্ট হয়৷ সেটা যে এত উজ্জ্বল, বলিষ্ঠ আকারে, দেখে মেয়ে হিসাবে ক্ষণিকের জন্য আত্মহারা হয়ে পডেছিলাম৷ উদাত্ত জডতাহীন গলায় স্লোগান দিচ্ছিলেন দলের প্রাজ্ঞ মহিলা কর্মীরা৷ দেখে বুঝলাম, এঁরা অনেকেই সদ্যযুবতী, বিভিন্ন কলেজের ইউনিয়নের দায়িত্বে রয়েছেন, চোখে মুখে আত্মপ্রত্যয়ী প্রতিবাদী ভাব৷ আর আছেন মহিলা সাংসৃক্তিক সংগঠনের কর্মীরা– পুরুষতান্ত্রিক নিপীডনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, প্রতিরোধে  সিদ্ধহস্ত  তাঁরা, স্বভাবসিদ্ধ  অনায়াস লডাকু ভঙ্গিতে স্লোগান দিতে দিতে এগোচ্ছেন৷ এঁদের সঙ্গে সমান তালে গলা মিলিয়ে চলেছেন অসংখ্য সাধারণ গ্রাম্য গৃহবধূ, কেউ বাংলা তো কেউ হিন্দিভাষী৷ বাডির কচিকাঁচা, কিশোর–কিশোরীদের নিয়ে সপরিবারে অংশগ্রহণ করেছেন বাঁকুডা, পুরুলিয়া, মেদিনীপুর, দার্জিলিং, উত্তর এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনার বহু মানুষজন৷ এঁদের প্রত্যেকের হাবেভাবে মূর্ত হয়ে উঠেছে শোষিত, বঞ্চিত, লাঞ্ছিত মানবাত্মার চিরায়ত মুক্তির আকাঙক্ষা৷

‘আমরা এসেছি কারা যেন আজ দুহাতে

খুলেছে, ভেঙেছে খিল,

মিছিলে আমরা নিমগ্ন তাই দোলে মিছিল৷

দুঃখ–যুগের ধারায় ধারায়

যারা আনে প্রাণ, যারা তা হারায়

তারাই ভরিয়ে তুলেছে সাডায় হৃদয়–বিল৷

তারাই এসেছে মিছিলে, আজকে চলে মিছিল৷’

বাড়ি ফিরে একটু আত্ম–অণ্বেষণ করে আবিষ্কার করলাম, আমিও তো মুক্তিপিপাসু এক ক্ষুদ্র প্রাণ৷ সর্বগ্রাসী পচনশীল বুর্জোয়া সংস্কৃতির করাল গ্রাস থেকে মুক্তি খুঁজেছি আমি, যে সংস্কৃতি প্রতি পদে মানুষের মনুষ্যত্বকে অপমান করে চলেছে, সামাজিক মানুষকে একেকটি ক্রয়সাপেক্ষ বাজারি পণ্য বানিয়ে ছেডেছে, পারস্পরিক সহজ সম্পর্কগুলিকে লাভ লোকসানের নিক্তিতে মেপে চলার শিক্ষা দিয়ে মানুষকে অন্তর থেকে সর্বস্বান্ত, একাকী করে দিয়েছে৷

আর খুঁজেছি নিষ্ঠুর পুরুষতান্ত্রিক সমাজের দমবন্ধ করা রীতি রেওয়াজ থেকে মুক্তি, যে রীতি রেওয়াজ যুগে যুগে নারীর জীবনকে এক দুর্বিষহ অভিশাপ করে তুলেছে৷ এর রূপ–আকার–মাত্রা শহুরে এবং গ্রাম্য জীবনে ভিন্ন, উচ্চবিত্ত এবং নিম্নবিত্ত পরিবারে এর প্রকাশের ধরন ভিন্ন, শোষণ–বঞ্চনার অনুভূতিও হয়তো পরিস্থিতি বিশেষে একেকজনের একেকরকম, কিন্তু মুক্তির আকাঙক্ষার তীব্রতায় আমরা সকলেই বোধহয় এক সুতোয় গাঁথা৷ এই সুতীব্র শোষণমুক্তির আকাঙক্ষা থেকেই তো জন্ম নিয়েছে সামাজিক বিপ্লবের স্বপ্ন৷ হয়তো এই গুরুগম্ভীর মিছিলে এক আনন্দময় প্রাণোচ্ছল ভাইব দিতেই হাজির হয়েছিল আমাদের ভীষণ আদরের তিতলি, উৎসা, প্রদীপ্ত৷ ফুলের মতো নিষ্পাপ এই কচিকাঁচারা আমাদের সুবিদিত সিনিয়র কমরেডদের সন্তানদল৷ তাদের এই সবুজের অভিযান আমাদের মিছিলকে রূপলাবণ্য, শ্রী, প্রাণোচ্ছ্বাস দিয়ে অন্য মাত্রায় ঋদ্ধ করেছে৷ জীবনের ঊষালগ্ন থেকেই কী সুন্দর সার্বিক শিক্ষায় সমৃদ্ধ  হয়ে বড় হচ্ছে ওরা৷ ওরা জীবনপথেও একইরকম নির্ভীক সত্যদৃষ্টি নিয়ে এগিয়ে যাক৷

দৃপ্ত পদক্ষেপে এগিয়ে চলেছে পঞ্চাশ হাজার ছাড়ানো ঐতিহাসিক মহামিছিল৷ কলেজ স্ট্রিট, ওয়েলিংটন ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ ক্রসিংগুলিতে সারিবদ্ধ জনতা ফুলের তোড়া দিয়ে বারংবার আমাদের শীর্ষনেতৃত্বকে অভিনন্দিত করেছেন– প্রকৃত সার্থকতা লাভ করেছি আমরা৷ জনসমর্থনের চেয়ে বড় প্রাপ্তি তো কোনও রাজনৈতিক মিছিলের হতে পারে না৷

হেদুয়া থেকে ধর্মতলার যাত্রাপথে আমার উত্তরণের কথা না বললেই নয়৷ মিছিলের প্রারম্ভে  নিজেকে আকস্মিকভাবে মিছিলে এসে পড়া এক সাধারণ নাগরিক বলে ভাবছিলাম৷ কিন্তু ক্রমে এক ঘন্টা চল্লিশ মিনিট সমবেত পদযাত্রার পর পার্টির সঙ্গে অদ্ভুত একাত্মবোধ অনুভব করতে লাগলাম৷ আমার ধারাভাষ্যেও তাই এই পদযাত্রার উল্লেখ প্রথমে ‘এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট) পার্টির মহামিছিল’ থেকে শেষে  ‘আমাদের মিছিল’–এ পরিণত হয়েছে৷

মিছিল যত এগিয়েছে, বুর্জোয়া সংস্কৃতির পাষাণভার যা বুকের ভিতর জমে ছিল, অবিরাম উদাত্ত স্লোগান হয়ে সেই পাথর যেন টুকরো টুকরো হয়ে মিলিয়ে গেছে মাথার উপর উন্মুক্ত শীত শেষের পরিষ্কার ঘন নীল আকাশে৷

ফিনিক্স

সল্টলেক

(গণদাবী : ৭১ বর্ষ ২৮ সংখ্যা)