হোম কেলেঙ্কারিতে জড়িত বিজেপির নেতা–মন্ত্রীরাই

বিজেপি–জেডিইউ জোট সরকার পরিচালিত বিহার এবং বিজেপি পরিচালিত উত্তরপ্রদেশের হোমগুলি সম্পর্কে যে চাঞ্চল্যকর খবর সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, তা দেখে দেশের জনসাধারণ শিউরে উঠেছেন৷ এ বছরের জুন মাসেই বিশ্ব সমীক্ষায় প্রকাশিত হয়েছে যে ভারত নারীদের জন্য সবচেয়ে বিপজ্জনক দেশ, এমনকী আফগানিস্তান, সিরিয়া, সোমালিয়া, পাকিস্তান, কঙ্গোর চেয়েও এদেশের পরিস্থিতি খারাপ৷ কিন্তু তা যে কতটা বিপজ্জনক এই ঘটনাগুলো প্রকাশ্যে না এলে মানুষ বুঝতে পারত না৷ মুম্বাইয়ের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা বিহারের মজফফরপুরের সরকার পোষিত হোমের ঘটনাটি প্রথম প্রকাশ্যে আনে৷ সেবা সংকল্প নামের এই হোমের একজন আবাসিককে খুন করে হোম প্রাঙ্গণেই পুঁতে দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ এবং ডাক্তারি পরীক্ষায় আবাসিকদের ৩৪ জনের মধ্যে ২৯ জনের ওপর যৌন অত্যাচারের প্রমাণ মিলেছে৷ তদন্তে প্রকাশ, এই হোমের ভিতর গর্ভপাতের ব্যবস্থা রয়েছে এবং ৬৭ ধরনের ওষুধ পাওয়া গিয়েছে যা খাইয়ে মেয়েদের অচেতন করে যৌন নির্যাতন করা হত৷ ওই মালিকের পরিচালিত আর একটি হোম থেকেও ১১ জন মহিলা ও ৪ জন শিশুর কোনও হদিশ পাওয়া যাচ্ছে না৷ খবর জনসমক্ষে আসার পর রাজ্যের শিশু সুরক্ষা আধিকারিকদের সাসপেন্ড করা হয়েছে৷ কিন্তু খবরে প্রকাশ, এর আগেই একটি স্বেছাসেবী সংস্থা শিশু সুরক্ষা দফতরে রিপোর্ট পাঠালেও তা চেপে দেওয়া হয়৷ এই হোমগুলির মালিক যেহেতু অত্যন্ত প্রভাবশালী ও বিত্তবান লোক, তিনটি সংবাদপত্রের মালিক এবং রাজনৈতিক নেতাদের সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আছে, তাই প্রশাসন সব জেনেশুনেও বিষয়টা চেপে দেওয়ার চেষ্টা করেছে৷ এই হোমে অসহায় মেয়েদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে স্বনির্ভর করে তোলার জন্য কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার বছরে এক কোটি টাকার উপর অনুদান দেয় ও নানারকম সহযোগিতা করে অথচ সেই মেয়েদের উপর দিনের পর দিন এভাবে পৈশাচিক অত্যাচার করা হয়েছে৷ হোমের মালিক–সরকারি আধিকারিক, রাজনৈতিক নেতা–মন্ত্রীর যোগ ছাড়া দীর্ঘদিন ধরে এভাবে যৌন নিগ্রহ, ধর্ষণ, পাচারচক্র চলতে পারে না৷ আইনজীবী সঙ্গীতা সাহানির মতে হোমগুলিকে পুরোপুরি পতিতালয়ে পরিণত করা হয়েছিল৷ একইভাবে মুঙ্গের, আরারিয়া, মধুবনি, ভাগলপুর, ভোজপুর জেলাতেও এ ধরনের ঘটনার সন্ধান মিলেছে৷ রাজনৈতিক ক্ষমতা আশ্রিত এইসব চক্রগুলি যে কতটা সুসংবদ্ধ এবং কতটা বিস্তৃত তা অনুমান করাও কঠিন৷ শুধু বোঝা যাচ্ছে যতটুকু খবর প্রকাশ্যে এসেছে তা হিমশৈলের চূড়ামাত্র৷ যখনই কোনও স্বতন্ত্র সংস্থা এ ধরনের অনুসন্ধান করে তখনই সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত বেসরকারি হোমগুলি, যেগুলি অসহায় শিশু–নারী–মানসিক রোগীদের আশ্রয়স্থল হওয়ার কথা ছিল, সেগুলির ভয়ঙ্কর চিত্র সামনে আসে৷ 

একই ঘটনা ঘটেছে বিজেপি সরকার পরিচালিত উত্তরপ্রদেশে৷ দেওরিয়াতে রাজ্য সরকারের অনুদানপ্রাপ্ত হোম ‘বিন্ধ্যবাসিনী মহিলা প্রশিক্ষণ এবং সামাজিক সেবা সংস্থান’–এর পরিচালক দম্পতি ও তাদের মেয়েকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে৷ এই হোম থেকে ২৪ জন আবাসিককে উদ্ধার করা হয়েছে এবং ১৮ জন নিখোঁজ৷ এক বছর আগে লাইসেন্স বাজেয়াপ্ত হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও এই হোমটি পুলিশের নাকের ডগায় তাদের সমস্ত অপরাধমূলক পৈশাচিক কার্যকলাপ চালিয়ে যাচ্ছিল এবং গত এক বছরে পুলিশই এখানে ৯৩০ জন মেয়েকে পাঠিয়েছে৷ পুলিশের যোগসাজশেই যে যৌন চক্রটি চলত তা এই ঘটনা থেকে স্পষ্ট৷ জানা যাচ্ছে প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলা নানা রঙের গাড়িতে করে মেয়েদের নিয়ে যেত কিছু ধনী এবং প্রভাবশালী ব্যক্তি, সকালে ফিরিয়ে দেওয়া হত৷ ফিরে আসার পর মেয়েরা কান্নাকাটি করত৷ 

বিহারের মজফফরপুর এবং উত্তরপ্রদেশের দেওরিয়ার ঘটনা থেকে এটা স্পষ্ট যে, সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত ও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা পরিচালিত বেশিরভাগ হোম রাজনৈতিক যোগাযোগের ভিত্তিতে বেআইনিভাবে চালানো হয় এবং প্রচুর সরকারি অনুদান আত্মসাৎ করা হয়৷ এই সব হোমের আবাসিকদের যে শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হতে হয়, তাও পরিষ্কার৷ ভাবতে অবাক লাগে, যেখানে অসহায় শিশু ও নারীদের নিরাপদ পরিবেশে থেকে শিক্ষা ও স্বনির্ভর হয়ে ওঠার জন্য নানারকম প্রশিক্ষণ পাওয়ার কথা যাতে তারা ধীরে ধীরে সমাজের মূলস্রোতে ফিরে আসতে পারে, সেখানে তার পরিবর্তে এদের উপর নানাভাবে নির্যাতন চালানো হয়, অমানুষিক পরিশ্রম করানো হয়, সর্বোপরি টাকার লোভে তাদের উপর বীভৎস যৌন নির্যাতন চলে৷ এমনকী এই পৈশাচিক নির্যাতনের ফলে কারওর মৃত্যু হলে বা কেউ প্রতিবাদ করলে তাকে খুন করে মাটিতে পুঁতে দেওয়া আকছারই চলছে৷ এই সমস্ত সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত হোমগুলি যেন এক একটি আতঙ্কপুরী৷

সঠিক তদন্ত হলে এরকম উদাহরণ আরও প্রচুর মিলবে৷ প্রশ্ন হল, উপরিউক্ত দুটি ঘটনাই ঘটেছে বিজেপি পরিচালিত রাজ্যে৷ যে বিজেপির নেতা–মন্ত্রীরা আচ্ছে দিন, স্বচ্ছ ভারত, বেটি পড়াও বেটি বাঁচাও কথায় কথায় বলেন, তাদের পরিচালিত রাজ্যে অসহায় নারীদের এই করুণ অবস্থা কেন? হোমের আবাসিক শিশু–মহিলাদের নিরাপত্তা দিতে যারা চূড়ান্ত ব্যর্থ তাদের মুখে উন্নত ভারতের কথা মানায় কি? কিছুদিন আগে পশ্চিমবঙ্গের লিলুয়া হোম নিয়ে এরকমই অত্যাচারের অভিযোগ উঠেছিল৷ পশ্চিমবঙ্গ সহ সর্বত্র নারীর নিরাপত্তা, নারীর সম্মান ধূলায় লুন্ঠিত৷ অথচ আমাদের রাজ্যে কন্যাশ্রী, রূপশ্রীর ঢক্কানিনাদে কত নির্যাতিতা নারীর আর্তনাদ চাপা পড়ে যাচ্ছে তার ইয়ত্তা নেই৷ সি পি এম পরিচালিত বামফ্রন্ট সরকারের আমলেও ঘটেছে ধানতলা, বানতলা সহ কত শত ঘটনা৷ সরকারের রঙ বদলেছে কিন্তু মানুষের সমস্যা বেড়েছে, বেড়েছে নারীদের উপর নির্যাতন, ধর্ষণ, গণধর্ষণ, পণের জন্য খুন, নারী–শিশু পাচার৷ সব সরকারেরই ভূমিকা একইরকম, ফাঁকা প্রতিশ্রুতি সর্বস্ব৷ অপরাধীরা রাজনৈতিক নেতাদের আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে দাপিয়ে বেড়ায়৷ বিচারের বাণী নিরবে নিভৃতে কাঁদে৷ প্রতিকারের কোনও পথ চোখে পড়ে না৷

 বর্তমান পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় অর্থ উপার্জনই জীবনের মূল উদ্দেশ্য, তাই বিবেক, মনুষ্যত্ব, দায়বদ্ধতা এই বোধগুলো ক্রমাগত অবলুপ্ত হচ্ছে, মানুষ ধীরে ধীরে অমানুষে পরিণত হচ্ছে৷ পুঁজিবাদের সংকট যত বাড়ছে, মূল্যবোধের অবক্ষয় তত বাডছে৷ শুধু নতুন নতুন আইন তৈরি করে এ সমস্যার সমাধান করা যাবে না৷ প্রয়োজন এই ব্যবস্থা পরিবর্তনের জন্য পরিপূরক সামাজিক আন্দোলন৷ প্রয়োজন এমন সমাজ যেখানে অর্থ নয়, মানুষের মঙ্গলই হবে সমাজ পরিচালনার মূল উদ্দেশ্য৷ অন্যথায় নতুন নতুন আইন হবে, দেশের সরকার পোষিত ৯০০০ হোমে ‘নজরদারি’র নামে অফিসার আমলাদের পোষা হবে, কিন্তু কাজের কাজ কিছু হবে না৷ একমাত্র আন্দোলন গড়ে তুলে প্রবল জনমতের চাপে সরকারকে বাধ্য করতে পারলে কিছুটা সুরাহা হতে পারে৷

(৭১ বর্ষ ৫ সংখ্যা ৩১ আগস্ট, ২০১৮)