স্বাধীনতার স্বপ্নপূরণ!

স্বাধীনতার ৭৫ বছর উপলক্ষে কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের চোখ ধাঁধানো কর্মসূচি, লালকেল্লায় প্রধানমন্ত্রীর বত্তৃতায় প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরি, কোনও কিছুই আর এ সত্য চেপে রাখতে পারছে না যে দেশে ধনী-গরিবের বৈষম্য আজ এক বীভৎস চেহারা নিয়েছে।

স্বাধীনতার জন্য যাঁরা সংগ্রাম করেছিলেন, ব্রিটিশের অত্যাচার সহ্য করেছিলেন, জেলে গিয়েছিলেন, প্রাণ দিয়েছিলেন তাঁরা যে বৈষম্যহীন, শোষণহীন এক সুন্দর সমাজের স্বপ্ন দেখেছিলেন, সে স্বপ্ন সফল হওয়া দূরে থাক, আর্থিক অসাম্য এমন চেহারা নিয়েছে যা ছিল তাঁদের দুঃস্বপ্নেরও অতীত। বৈষম্যের এই বীভৎসতার কথা শুধু আমরা কমিউনিস্টরা নয়, বুর্জোয়া মিডিয়া, বহু বুর্জোয়া পণ্ডিত এমনকি বুর্জোয়া রাজনীতিবিদরাও বলতে বাধ্য হচ্ছেন।

প্রথম প্রধানমন্ত্রী নেহেরু ১৯৪৭-এর ১৫ আগস্ট ঘোষণা করেছিলেন– স্বাধীনতার উদ্দেশ্য প্রতিটি মানুষের চোখ থেকে প্রতিটি অশ্রুবিন্দু মুছে ফেলা। বলেছিলেন, যত দিন মানুষের চোখে অশ্রুবিন্দু থাকবে, আমরা জানব, আমাদের কাজ শেষ হয়নি। অথচ আজ স্বাধীনতার এতগুলি বছর পরে শুধু অশ্রুবিন্দু নয়, শোষিত নিপীড়িত মানুষের চোখে অশ্রুর ধারা বইছে। দেশের এক বিরাট অংশের মানুষের পেটে খাদ্য নেই, পরনে বস্ত্র নেই, মাথার উপর ছাদ নেই, রোগে চিকিৎসা নেই, শিক্ষা নেই, চাকরি নেই– তাঁরা যেন নেই রাজ্যের বাসিন্দা, যেন এ দেশে বেঁচে থাকার কোনও অধিকারই তাদের নেই। অথচ ৭৫ বছরে দেশে সম্পদবৃদ্ধি তো কম হয়নি। ভারত আজ আর্থিক বৃদ্ধিতে ধনী পুঁজিবাদী দেশগুলিকে টেক্কা দিচ্ছে। তবু কেন এঁদের চোখের জল মোছানো গেল না? কেন এই সম্পদ সমাজের বৃহত্তর অংশের মানুষের কাছে পৌঁছল না? আর্থিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে যে দিগন্ত-প্রমাণ বৈষম্য, যা ক্রমাগত কমিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি সেদিন রাষ্ট্রনায়করা দিয়েছিলেন, কমা দূরে থাক, কেন তা বেড়ে আসমান-জমিন হয়ে গেল? তবে কি সেদিন তাঁরা যা বলেছিলেন তা শুধুমাত্র দেশের মানুষের চোখে ধুলো দেওয়ার জন্য? যে পথে তাঁরা নিপীড়িত মানুষের চোখের জল মোছাতে চেয়েছিলেন তা কি সঠিক ছিল? কারণ উদ্দেশ্য যতই সৎ হোক, পথ যদি সঠিক না হয় তবে লক্ষ্যে কিছুতেই পৌঁছানো সম্ভব নয়।

স্বাধীনতার পরে দেশ শাসনের ভার যাঁরা নিলেন, তাঁরা পুঁজিবাদী আর্থিক উন্নয়নের রাস্তাতেই এগোতে থাকলেন। এ কথা ঠিক, সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েতের অনুকরণে তাঁরা পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা নিতে থাকলেন। ভারী শিল্প এবং অন্য গুরুত্বপূর্ণ শিল্পগুলি রাষ্ট্রীয় মালিকানায় স্থাপিত হল। সামাজিক ক্ষেত্রে দারিদ্র দূরীকরণের নানা প্রকল্পও নেওয়া হল। কিন্তু এ-সব কোনও কিছুই সাধারণ মানুষের জীবনে উন্নয়নের কোনও ছোঁয়াই নিয়ে এল না। এর কারণ কী? আমাদের শিক্ষক, মার্ক্সবাদী চিন্তানায়ক কমরেড শিবদাস ঘোষ সেদিনই দেখিয়েছিলেন, এই যে সব রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ, যাকে অনেকে সমাজতান্ত্রিক পদক্ষেপ বলে ভুল করছেন, সেগুলির উদ্দেশ্য পুঁজিবাদকে বিকশিত করা, শক্তিশালী করা। কারণ রাষ্ট্রটি একটি পুঁজিবাদী রাষ্ট্র এবং তা পরিচালনা করছে পুঁজিপতি শ্রেণি। যদিও পুঁজিপতিরা কখনওই একে একটি পুঁজিবাদী রাষ্ট্র বলে স্বীকার করে না। তারা বলে এটি একটি জাতীয় রাষ্ট্র, অর্থাৎ ধনী-গরিব নির্বিশেষে সকলের রাষ্ট্র এবং জাতীয়তাবাদকেই তারা এই রাষ্টে্রর আদর্শ হিসাবে তুলে ধরে। অথচ একটি স্বাধীন দেশে জাতীয়তাবাদের আদর্শ আর কোনও প্রগতিশীল আদর্শ হিসাবে কাজ করে না। যতদিন স্বাধীনতা না এসেছে, ততদিন এই জাতীয়তাবাদ আদর্শ হিসাবে ছিল প্রগতিশীল। বহু ধর্ম বহু বর্ণ বহু ভাষার মানুষের এক জাতি হিসাবে গড়ে উঠতে এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে সকলকে সামিল করতে জাতীয়তাবাদের আদর্শ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। কারণ সেদিন ধর্ম-বর্ণ, ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সবার মুক্তির পথে বাধা হিসাবে দাঁড়িয়েছিল সকলেরই সাধারণ শত্রু ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ। কিন্তু যখনই একটি সার্বভৌম, জাতীয় বুর্জোয়া রাষ্ট্র হিসাবে ভারত আবিভূর্ত হল, তখনই আদর্শ হিসাবে জাতীয়তাবাদ প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে পড়ল। কারণ তা পুঁজিবাদী শোষণের আদর্শগত হাতিয়ার হয়ে দাঁড়াল এবং শোষিত শ্রেণির মুক্তির রাস্তায় বিরাট বাধা হিসাবে দাঁড়িয়ে গেল। কারণ জাতীয় রাষ্ট্র মানেই তা বুর্জোয়া রাষ্ট্র, ধনী-দরিদ্রে, শোষক-শোষিতে বিভক্ত সমাজে শাসক পুঁজিপতিদেরই স্বার্থরক্ষাকারী রাষ্ট্র। পুঁজিপতিদের বিকাশ, তাদের স্বার্থরক্ষা, তাদের মুনাফা বাড়িয়ে চলাই রাষ্টে্রর যে কোনও নীতি, যে কোনও আইনের একমাত্র লক্ষ্য। আর তারই বলি হয়ে চলেছে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষ।

আজ আকাশছোঁয়া বৈষম্য দেখে কোনও কোনও পুঁজিবাদী পণ্ডিত বলছেন, বণ্টনের সাম্য না থাকার ফলেই বৈষম্য এই চেহারা নিয়েছে। যেন বণ্টনের সাম্য তৈরিটা একটা পদ্ধতিগত ব্যাপার এবং সেটা ঠিক করে নিলেই আর কোনও সমস্যা থাকবে না। বণ্টনের বৈষম্য পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার অনিবার্য পরিণতি! কারণ পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থায় উৎপাদনের উদ্দেশ্য সামাজিক, উৎপাদনের প্রক্রিয়াটা সামাজিক কিন্তু মালিকানা ব্যক্তিগত। তাই পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থাটিকে অটুট রেখে কারও ইচ্ছায় কখনও এই বৈষম্য দূর হতে পারে না। কারণ ব্যক্তিমালিকানা ভিত্তিক এই ব্যবস্থায় পুঁজিপতিদের পুঁজি তথা সম্পদের জন্মই হয় শ্রমিক এবং জনগণকে শোষণের, বঞ্চনার মধ্য দিয়ে। অসম বণ্টন পুঁজিবাদী সমাজের অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য।

ভারত আজ একটি শক্তিশালী পুঁজিবাদী রাষ্ট্র। পুঁজির কেন্দ্রীভবন আজ অতীতের সমস্ত রেকর্ডকে ছাড়িয়ে গেছে। এক শতাংশ পুঁজিপতি দেশের মোট সম্পদের ৭৩ শতাংশের মালিক। গত দশ বছরে শত কোটিপতির সংখ্যা দশগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। উল্টোদিকে বেশির ভাগ দেশবাসী নিঃস্ব, রিক্তে পরিণত হয়েছে। গত লকডাউনের সময়ে যখন দেশের বেশির ভাগ মানুষ কাজ হারিয়ে অর্ধাহারে অনাহারে দিন কাটাচ্ছে, ঠিক তখনই অনিল আম্বানির সম্পদ বেড়েছে ৩৫ শতাংশ হারে। যেখানে দেশের ২৪ শতাংশ মানুষ মাসে ৩ হাজার টাকা রোজগার করেছেন, সেখানে মুকেশ আম্বানি ঘণ্টায় রোজগার করেছেন ৯০ কোটি টাকা। এই বৈষম্য সীমাহীন শোষণের ফল ছাড়া আর কিছু নয়।

তা হলে কি স্বাধীন দেশে এই শোষণ, এই বঞ্চনা, প্রতারণা থেকে রেহাইয়ের কোনও রাস্তাই ছিল না? অবশ্যই ছিল। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতৃত্ব যদি পুঁজিপতিদের হাতে না থেকে শ্রমিক শ্রেণির পার্টি তথা যথার্থ কমিউনিস্টদের হাতে থাকত, চীনে যেমন সাম্রাজ্যবাদ এবং সামন্ততন্ত্রের বিরুদ্ধে সংগ্রামে মাও সে তুঙের নেতৃত্বে শ্রমিক শ্রেণি নেতৃত্ব দিয়েছিল এবং জাতীয় বুর্জোয়ারা মিত্র হিসাবে সেই সংগ্রামে অংশ নিয়েছিল, যদি ভারতেও তা ঘটত তবে স্বাধীন ভারতে পুঁজিবাদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে শ্রমিক শ্রেণির নেতৃত্বে প্রথমে জনগণতান্ত্রিক রাষ্ট্র এবং বিকাশের পথে পরে তা সমাজতান্ত্রিক রাষ্টে্র পরিণত হত। একমাত্র এই পথেই শোষণকে খতম করা, সম্পদের পুঞ্জীভবনের প্রক্রিয়াকে ধ্বংস করে সমবণ্টন সম্ভব হত।

আজ মাত্রাহীন শোষণের প্রক্রিয়াটি জাতীয়তাবাদী আদর্শের ঝাণ্ডা উড়িয়েই চলছে। জাতীয়তাবাদের নামেই বিজেপি শাসনে মানুষের ন্যূনতম গণতান্ত্রিক অধিকারগুলিকে কেড়ে নেওয়া হচ্ছে, বিরোধী কণ্ঠকে রোধ করা হচ্ছে। স্বাভাবিক ভাবেই শোষিত মানুষের মনে এ প্রশ্ন বার বার উঠছে যে, একে বন্ধ করার কি কোনও উপায়ই নেই? বাস্তবে বর্তমান পুঁজিবাদী ব্যবস্থাটিকে টিকিয়ে রেখে এই কুৎসিত বৈষম্য বন্ধ করার অন্য কোনও উপায় নেই। একে বন্ধ করতে হলে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থাকে ভাঙতে হবে। গড়ে তুলতে হবে শ্রমিক শ্রেণির রাষ্ট্র সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা। এ ছাড়া শোষিত মানুষের মুক্তির আর কোনও রাস্তা খোলা নেই। আজ প্রয়োজন জনজীবনের জ্বলন্ত সমস্যাগুলিকে নিয়ে ব্যাপক গণআন্দোলন গড়ে তোলা এবং সেই আন্দোলনগুলিতে সমস্ত স্তরের শোষিত মানুষকে সামিল করা। গণআন্দোলনের এই পথেই শোষিত মানুষের সংগ্রামের হাতিয়ার অজস্র গণকমিটি গড়ে উঠবে, যা একদিন একটি যথার্থ কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থাকে ভেঙে ফেলার শক্তিশালী হাতিয়ারে পরিণত হবে। সেই শেষ যুদ্ধে শোষিত শ্রেণির মানুষের জয় অবশ্যম্ভাবী।

গণদাবী ৭৪ বর্ষ ৪ সংখ্যা