স্বাধীনতার উৎসব : নেই বাঁচার স্বাধীনতাই

ক’দিন আগে স্বাধীনতার উৎসবে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী– ছোট–বড় নানা মন্ত্রী কত কথাই না বললেন পড়ল হাততালি, পুষ্পবৃষ্টিতে রঙিন হয়ে গেল রাস্তার কালো পিচ৷

ঠিক তখনই লালকেল্লায় প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ মঞ্চ থেকে মাত্র কয়েক শো মিটার দূরের ঝুপড়িতে খিদের সাথে যুদ্ধ করছিল কত শিশু! ৭১ বছরের স্বাধীন দেশের নানা প্রান্তে খালি পেটের মোচড়কে সঙ্গী করে যারা ইট বয়, মাটি কাটে, গাড়ি ধোয়, চায়ের দোকানের কাপ–ডিশ ধুতে ধুতে তাদের প্রাপ্তি অপরিসীম ক্লান্তি আর দুঃসহ জীবন৷ দিল্লির ঝুপড়িরযে তিন শিশুর প্রাণহীন দেহে এক কণা খাবারও খুঁজে পাননি ময়না তদন্তকারীরা– তাদের পরিজনদের কানেও সজোরে প্রবেশ করছিল ‘বৃহত্তম গণতন্ত্রের’ কান্ডারির উচ্চনাদ আস্ফালন৷

স্বাধীনতার উৎসবে প্রধানমন্ত্রী বললেন, তিনি অস্থির, কারণ উন্নয়নে আরও গতি চাই কীসের গতি? তাঁদের উন্নয়নের গতিতে সাত দশকের স্বাধীন ভারত এখন পৃথিবীর ১১৯টি ক্ষুধার্ত দেশের তালিকায় ১০০ নম্বরে পৌঁছেছে৷ এ দেশের শতকরা ৭৭ জন লোক দারিদ্র্যসীমার নিচে৷ প্রতিদিন অনাহারে মারা যায় ৭ হাজার মানুষ৷ প্রতি ঘন্টায় আত্মহত্যা করেন ৫ জন কৃষক৷ প্রতিদিন ১২০ জন শ্রমিক আত্মহত্যা করেন৷ অন্য দিকে এই ভারতেই এক বছরে ১০ জন শিল্পপতির সম্পদ বেড়েছে ২০.৯ লক্ষ কোটি টাকা৷ এক বছরের কেন্দ্রীয় বাজেটের যা পরিমাণ, ১০ জন শিল্পপতি এক বছরে নানা পথে সেই পরিমাণ টাকা লুঠ করেছে৷ প্রধানমন্ত্রী আরও চান? তাই অস্থির?

প্রধানমন্ত্রী ‘আয়ুষ্মান ভারত’–এর স্বপ্ন দেখিয়েছেন দেশের ১০ লক্ষ পরিবারে প্রায় ৫০ লক্ষ মানুষের কাছে নাকি স্বাস্থ্য বিমা পৌঁছে দেবে সরকার৷ আগামী ভোটের প্রচারের দিকে তাকিয়ে সরকারি কর্তারা যার নাম দিয়েছেন ‘মোদি কেয়ার’৷ কিন্তু সার্বজনীন স্বাস্থ্যের কী হবে? নামী–দামি বেসরকারি বিমা কোম্পানি আর কর্পোরেট হাসপাতালের বড় বড় মালিকরা সরকারি কোষাগারের কোটি কোটি টাকা দেশসেবার পুরস্কার হিসাবে পকেটে পুরতে পারবেন৷ কিন্তু দেশের ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু, আন্ত্রিকে ভোগা আমজনতার সার্বজনীন স্বাস্থ্য, রোগ প্রতিরোধের ব্যবস্থার কী হবে? বিমা কোম্পানির তো এইসব সামলানোর দায় নেই বাস্তবে স্বাধীন দেশের সরকার সকলের জন্য স্বাস্থ্য অধিকারকে ছুঁড়ে ফেলে দিল৷ এই কি স্বাধীন দেশের নাগরিকদের ৭১ বছরের প্রাপ্তি!

দেশ এগিয়েছে দেখাতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী হিসাব দিয়েছেন, প্রত্যক্ষ করদাতার সংখ্যা দেশে বেড়েছে৷ জিএসটির ফলে অনেক বেশি সংখ্যায় মানুষ পরোক্ষ করের আওতায় এসেছেন৷ কিন্তু বলতে ভুলে গেছেন, নিতান্ত সাধারণ মানুষ, মধ্যবিত্ত চাকুরিজীবী, ছোট ব্যবসায়ীদের ঘাড় ভেঙে ট্যাক্স আদায় করার সাথে সাথে বৃহৎ পুঁজিপতিদের হাজার হাজার কোটি টাকা ট্যাক্স ছাড় দিয়েছে বিজেপির কেন্দ্রীয় সরকার৷

২০২২ সালে স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্তির মধ্যেই নাকি কৃষকদের আয় দ্বিগুণ করে দেবেন প্রধানমন্ত্রী যদিও ২০১৯–এ লোকসভা ভোটের গন্ডি তিনি পার হতে পারেন কি না, তার পরীক্ষাই বাকি৷ তারপর তো ’২২ তিনি বলেছেন, ফসলের সহায়ক মূল্য দিয়ে কৃষকের পাশে দাঁড়িয়েছে সরকার৷ বাস্তবে কী করেছে বিজেপি সরকার? সহায়ক মূল্যের নামে কৃষকদের প্রতারণা করেছে৷ সহায়ক মূল্য নির্ধারণ করতে গিয়ে চাষের খরচের হিসাব থেকে ঋণের সুদ, জমির ভাড়া, পরিবহণ, সেচের জলের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি বাদ দেওয়া হয়েছে৷ ফলে কৃষকের কাছে এই সহায়ক মূল্য একেবারে মূল্যহীন৷ আর, কতটুকু ফসল চাষিরা সহায়ক মূল্যে বেচতে পারে? ২০১৭–১৮–র খরিফ মরশুমে সারা দেশে ১১১ মিলিয়ন টন উৎপাদিত ধানের মাত্র ২৫.৩ মিলিয়ন টন সহায়ক মূল্যে কিনেছে সরকার৷ বাকি সবটাই চাষিকে বিক্রি করতে হয়েছে ফড়ে–মহাজন, বড় বড় কৃষি বিপণন কোম্পানির শর্তে৷ বাজারে খাদ্যশস্যের দাম ক্রমাগত বেড়েছে, অথচ চাষির প্রাপ্তি কমেছে৷ এ বিষয়ে অতীতের কংগ্রেসের সাথে বিজেপির কোনও পার্থক্যই নেই৷

স্বাধীনতার উৎসবে প্রধানমন্ত্রী বললেন, ২০২২ সালে মহাকাশে মানুষ পাঠাবে ভারত৷ মহাকাশ গবেষণায় হাজার হাজার কোটি টাকা বরাদ্দে কোনও ঘাটতি থাকবে না৷ লালকেল্লার চত্বরে বসে থাকা আম্বানি, আদানি, টাটা, বিড়লাদের প্রতিনিধি আর আমলাদের করতালিতে ফেটে পড়ল স্বাধীনতার অনুষ্ঠান৷ বড় বড় পুঁজি মালিকরা যন্ত্রাংশ বানানোর বরাত পাবে, উপগ্রহ ব্যবসায় বিনিয়োগ করবে৷ প্রতিরক্ষা শিল্পে তাদের ব্যবসা বাড়বে৷ আর স্বাধীন ভারতের জনগণ? কাজের সুযোগ? বেকারদের চাকরি? কোথায় বছরে ২ কোটি চাকরি ২ লক্ষও যে পুরোয়নি ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ২ লক্ষের বেশি স্নাতক পর্যন্ত কর্মহীন৷ প্রধানমন্ত্রী পরামর্শ দিয়েছেন, পকোড়া ভাজতে৷ কখনও বলেছেন মেয়েদের ঘরের কাজকেও কর্মসংস্থান ধরে হিসাব করে দেখাতে হবে৷ স্বাধীনতার উৎসব তবে কার মুখে হাসি ফোটালো! 

প্রধানমন্ত্রী আওয়াজ তুলেছিলেন, বেটি বাঁচাও৷ স্বাধীনতার উৎসবে বলেছেন, সশস্ত্র বাহিনীতে বেশি মহিলা নিয়ে মেয়েদের সম্মান দিচ্ছে তাঁর সরকার অথচ বিজেপিশাসিত রাজ্যগুলিতেই কন্যাভ্রূণ হত্যা সবচেয়ে বেশি৷ তাঁর দলের এমএলএ উত্তরপ্রদেশে ধর্ষণ এবং খুনে অভিযুক্ত৷ প্রধানমন্ত্রীর দলের নেতারা জম্মুতে শিশুকন্যা আসিফার ধর্ষক এবং খুনিদের সমর্থনে মিছিল করেছে৷ প্রধানমন্ত্রী নীরবই থেকেছেন৷ সারা দেশে নারী নির্যাতন ভয়াবহভাবে বেড়েছে, স্বাধীন ভারতকে নারীদের কাছে সবচেয়ে বিপজ্জনক স্থান হিসাবে চিহ্ণিত করেছে আন্তর্জাতিক সমীক্ষা৷ ৭১ বছরে কোনও প্রধানমন্ত্রী এতটুকু লজ্জিত হয়েছেন কি? আর পার্টি উইথ এ ডিফারেন্স (অন্যরকম দল) বিজেপির প্রধানমন্ত্রী? তাঁর লজ্জা কোথায়? তিনি কি জানেন না–রিজার্ভ ব্যাঙ্কে নন–অফিসিয়াল ডাইরেক্টর হিসাবে তাঁর সরকার দ্বারা মনোনীত আরএসএস সদস্য এস গুরুমূর্তি কেরালার বন্যার জন্য শবরীমালা মন্দিরে মেয়েদের প্রবেশাধিকার পাওয়াকে দায়ী করেছেন এই হল আধুনিক ভারতে মেয়েদের স্থান গর্বিত আরএসএস সদস্য প্রধানমন্ত্রী এর প্রতিবাদ করতে পারবেন? মহিলাদের সম্বন্ধে এটাই কিন্তু আরএসএসের ঘোষিত মানসিক অবস্থান৷ এই পথেই কি যাবে স্বাধীন ভারত!

স্বাধীনতার উৎসবে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী আবারও দুর্নীতিমুক্ত দেশের কথা বলেছেন৷ আগে বলতেন– না খাউঙ্গা, না খানে দুঙ্গা আর তাঁর ঘনিষ্ঠ শুধু নয় দলীয় সাংসদ বিজয় মালিয়া, তাঁর একান্ত স্নেহের নীরব মোদি, তাঁর আদরের ‘ভাই’মেহুল চোকসি হাজার হাজার কোটি টাকা মেরে দিয়ে নিশ্চিন্তে বিদেশে পাড়ি দিয়েছে৷তাঁর সরকার মেহুল ভাইদের বিদেশে নাগরিকত্ব পেতে সাহায্য করে দিয়েছে৷ রাফাল বিমান তৈরিতে বাড়তি মুনাফা পাইয়ে দিতে আম্বানিদের পাশে দাঁড়িয়েছে তাঁর সরকার৷ ব্যপম কেলেঙ্কারি, গুজরাটের তেল কোম্পানির কেলেঙ্কারি, অসংখ্য দুর্নীতির সাথে জড়িয়ে প্রধানমন্ত্রীর দল ও সরকার৷ বলেছিলেন হবেন চৌকিদার, হলেন বখরাদার!

সামান্য অজুহাতে পিটিয়ে মানুষ মারা এখন যেন স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে যাচ্ছে৷ গো–রক্ষার নামে নৃশংস হত্যা করলে শাসক দলের কাছে বীরের সম্মান জুটছে৷ কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মালা পরিয়ে সংবর্ধনা দিচ্ছেন হত্যাকারীদের  বিজেপি–আরএসএসের উগ্র হিন্দুত্ববাদ আর বিদ্বেষের রাজনীতির সমালোচনাটুকু করলেই সাংবাদিক, যুক্তিবাদীদের হত্যা করা হচ্ছে৷ এর বিরুদ্ধে একটা অন্তত প্রতিবাদী শব্দ উচ্চারণ করে দেশের স্বাধীনতার মর্যাদা তো রক্ষা করলেন না স্বাধীন ভারতের কর্ণধাররা!

এ দেশের ৪০ লক্ষ নাগরিক প্রবল অনিশ্চয়তায়৷ নাগরিকপঞ্জিতে তাদের ঠাঁই দেয়নি ৭১ বছরের স্বাধীন ভারতের সরকার৷ ভাষাগত, ধর্মগত সংখ্যালঘুদের রক্ষার যে প্রতিশ্রুতি একদিন স্বাধীন ভারত দিয়েছিল, যে ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের স্বপ্ন নিয়ে অসংখ্য শহিদ প্রাণ দিয়েছেন, তার অস্তিত্বই বিপন্ন৷ প্রধানমন্ত্রীর দল এই কাজে সবচেয়ে বড় অভিযুক্ত৷ স্বাধীনতা হরণের এই দায় অস্বীকার করতে পারবেন তিনি?

স্বাধীন ভারতের নাগরিকের কাছে তাই সবচেয়ে বড় কাজ যথার্থ স্বাধীন, শোষণমুক্ত যে ভারতের স্বপ্ন অগণিত শহিদ দেখেছিলেন, সেই লক্ষ্য পূরণের সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া৷

(৭১ বর্ষ ৫ সংখ্যা ৩১ আগস্ট, ২০১৮)