সোভিয়েত বিরোধী সাম্রাজ্যবাদী প্রচার ও স্ট্যালিন

(ব্রিটেনের লেবার পার্টি সরকারের তৎকালীন বিদেশমন্ত্রী মিঃ মরিসনের একটি ঘোষণা সম্পর্কে স্ট্যালিনের জবাব ১৯৫১ সালে প্রথম ‘প্রাভদা’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল৷ পূর্বতন সোভিয়েট কমিউনিস্ট পার্টির সংরক্ষণাগারে রক্ষিত দলিল থেকে জানা যায় যে, স্ট্যালিন রচনাবলির চতুর্দশ খণ্ডে এটি অন্তর্ভুক্ত করার কথা ছিল৷ অনেকেই জানেন,  স্ট্যালিন রচনাবলির ১৩টি খণ্ড এ যাবৎ প্রকাশিত হয়েছে৷ ১৯৫৬ সালে সংশোধনবাদীরা ক্ষমতায় আসার পর স্ট্যালিনের আর কোনও রচনাই প্রকাশ করা হয়নি৷ ২০০২ সালে মস্কোর ‘ইলেকট্রনিক পাবলিকেশন’ এটি প্রকাশ করে, যার ইংরেজি তর্জমা দিল্লির ‘রেভলিউশনারি ডেমোক্রেসি’ পত্রিকা ২০০৩ সালের সেপ্টেম্বর সংখ্যায় প্রকাশ করেছে৷ ৫ মার্চ স্ট্যালিনের প্রয়াণ দিবস উদযাপন উপলক্ষে আমরা তার বাংলা তর্জমা এখানে প্রকাশ করছি৷)

সোভিয়েট ইউনিয়নের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক রাজনীতি সম্পর্কে মিঃ মরিসন দু’ভাগে কিছু প্রশ্ন তুলেছেন৷

অভ্যন্তরীণ রাজনীতি

মিঃ মরিসন জোরের সাথে বলেছেন, বাক স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও ব্যক্তিস্বাধীনতা সোভিয়েট ইউনিয়নে নেই৷

মিঃ মরিসন এ ব্যাপারে গুরুতর ভুল করেছেন৷ সোভিয়েট ইউনিয়নে যে রকম বাক স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের ও ব্যক্তির স্বাধীনতা আছে, শ্রমিক, চাষি ও বুদ্ধিজীবীদের যে রকম সংগঠন আছে, তা অন্য কোনও দেশে নেই৷ শ্রমিক ও চাষিদের জন্য যত সংখ্যায় ক্লাব সোভিয়েট ইউনিয়নে আছে, বিশেষ করে শুধু তাদেরই জন্য যত বেশি সংখ্যায় সংবাদপত্র আছে তা অন্য কোথাও নেই৷ সোভিয়েট ইউনিয়ন ছাড়া অন্য কোথাও শ্রমিকশ্রেণিকে এমন সুসংবদ্ধভাবে সংগঠিত করা হয়নি৷ এ কথা কারও কাছেই গোপন নেই যে, সোভিয়েট ইউনিয়নের সমগ্র শ্রমিক শ্রেণি, আক্ষরিক অর্থে সমস্ত শ্রমিককেই ইউনিয়নের মধ্যে সংগঠিত করা হয়েছে – যেমন সমস্ত চাষিদেরই কো–পারেটিভগুলিতে সংগঠিত করা হয়েছে৷

এ সত্য কি মিঃ মরিসন জানেন? তিনি অবশ্যই জানেন না৷ তাঁর ভাবভঙ্গি দেখে মনে হয়, এগুলি জানার কোনও ইচ্ছাও তাঁর নেই৷ রাশিয়ায় পঁজিপতিদের যারা প্রতিনিধি, সোভিয়েট জনগণের অভিপ্রায় অনুযায়ীই যাদের দেশ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে, তারা সোভিয়েট ইউনিয়নের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ তোলে, তাদের কাছ থেকেই জ্ঞান আহরণ করতে মিঃ মরিসন পছন্দ করেন৷

সোভিয়েট ইউনিয়নে বাক স্বাধীনতা, সংবাদপত্র চালাবার বা সংগঠন করার স্বাধীনতা নেই কেবলমাত্র জনগণের শত্রুদের এবং ভূস্বামী ও পঁজিপতিদের, যাদের বিপ্লবের দ্বারা ক্ষমতা থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে৷ একইভাবে যারা হাড়ে–মজ্জায় চোর, যারা অন্তর্ঘাতক, সন্ত্রাসবাদী, খুনি এবং ক্রিমিনাল– তাদের জন্য সোভিয়েট ইউনিয়নে কোনও স্বাধীনতা নেই৷ এরাই লেনিনকে গুলি করেছিল, ভোলোদারস্কি, উরিস্টস্কি, কিরভকে হত্যা করেছিল, ম্যাক্সিম গোর্কি ও কুইবিসেভকে বিষ প্রয়োগ করেছিল– এ ধরনের সমস্ত ক্রিমিনাল, ভূস্বামী ও পুঁজিপতিদের থেকে শুরু করে সন্ত্রাসবাদী চোর, খুনি এবং যারা অন্তর্ঘাতমূলক কার্যকলাপে লিপ্ত এদের সকলের একটিই উদ্দেশ্য, এরা সকলেই সোভিয়েট ইউনিয়নে পুঁজিবাদকে আবার ফিরিয়ে আনতে চায়, মানুষের দ্বারা মানুষের শোষণের পুনঃপ্রতিষ্ঠা চায় এবং গোটা দেশে শ্রমিক–চাষির রক্তের বন্যা বইয়ে দিতে চায়৷ বন্দিশালা ও লেবার ক্যাম্পগুলি রয়েছে এইসব ভদ্রমহোদয়দের জন্য এবং কেবল তাদেরই জন্য৷

মিঃ মরিসন কি এসব লোকেদের জন্যই বাক স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও ব্যক্তি স্বাধীনতা অর্জন করার জন্য চেষ্টা চালাচ্ছেন? মিঃ মরিসন কি সত্যিই মনে করেন যে, এসব লোকেদের জন্য বাক স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও ব্যক্তি স্বাধীনতা দিতে অর্থাৎ শ্রমিকদের শোষণ করার স্বাধীনতা দিতে সোভিয়েট জনগণ রাজি হবে?

মিঃ মরিসন কিন্তু অন্য ধরনের স্বাধীনতা– যার তাৎপর্য বাক স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ইত্যাদির চেয়েও অনেক গভীরে– সে বিষয়ে নীরব রয়েছেন৷ শোষণের জোয়াল থেকে জনগণের স্বাধীন হওয়া, অর্থনৈতিক সংকট, বেকারি, দারিদ্র্য থেকে জনগণের স্বাধীন হওয়া সম্পর্কে তিনি কিছুই বলেননি৷ সোভিয়েট ইউনিয়নে এইসব স্বাধীনতা যে দীর্ঘকাল ধরে বিরাজ করছে, মিঃ মরিসন সম্ভবত তা জানেন না৷ অথচ ঠিক এইসব স্বাধীনতাগুলিই হচ্ছে অন্য সকল স্বাধীনতার বনিয়াদ৷ এজন্যই কি মিঃ মরিসন এসব বনিয়াদি স্বাধীনতাগুলি সম্পর্কে মুখ খুলতে লজ্জা পাচ্ছেন– যেহেতু দুর্ভাগ্যজনকভাবে ইংল্যান্ডে এসব স্বাধীনতার অস্তিত্ব নেই এবং লেবার পার্টি গত ছ’বছর ধরে ইংল্যান্ডের ক্ষমতায় থাকা সত্ত্বেও সেখানকার শ্রমিক শ্রেণি আজও শোষক পুঁজিপতিদের দাসত্ব করে যাচ্ছে৷

মিঃ মরিসন জোর দিয়ে বলেছেন, লেবার পার্টির সরকার একটি সমাজতান্ত্রিক সরকার৷ ফলে এ ধরনের একটি সরকারের নিয়ন্ত্রণে যে রেডিও সম্প্রচারগুলি করা হয়, সোভিয়েটের দিক থেকে তাতে বাধা আসা উচিত নয়৷

দুঃখের কথা, এ ব্যাপারে মিঃ মরিসনের সাথে আমরা একমত হতে পারছি না৷ লেবার পার্টি প্রথম যখন ক্ষমতায় এসেছিল, তখন কেউ ভেবে থাকতে পারে যে, এই সরকার সমাজতন্ত্রের পথ অনুসরণ করবে৷  কালক্রমে দেখা গেল, যে কোনও বুর্জোয়া সরকারের সাথে কোনও পার্থক্যই নেই লেবার সরকারের৷ এই সরকারেরও লক্ষ্য পুঁজিবাদী কাঠামোকেই টিকিয়ে রাখা ও পুঁজিপতিদের জন্য বিস্তর মুনাফা লোটার ব্যবস্থা করে দেওয়া৷

বাস্তবে, ইংল্যান্ডে পুঁজিপতিদের মুনাফা বছর বছর বাড়ছে, কিন্তু শ্রমিকদের মজুরি এক জায়গায় বেঁধে দেওয়া হয়েছে৷ তদুপরি, এই শ্রমিক–বিরোধী, শোষণমূলক শাসনব্যবস্থাকেই লেবার সরকার রক্ষা করছে৷ সেজন্য নানা ব্যবস্থা নিচ্ছে, শ্রমিকদের উপর নিপীড়ন চালাচ্ছে, এমনকী তাদের গ্রেপ্তার করছে৷ এমন একটি সরকারকে সমাজতান্ত্রিক বলা যায় কি?

কেউ ভেবে থাকতে পারে যে, লেবার সরকার যখন ক্ষমতায়, তখন পুঁজিবাদী শোষণ নির্মূল হবে, সাধারণ মানুষের ব্যবহার্য জিনিসপত্রের দাম নিয়ম করে কমানো হবে এবং শ্রমিকদের অবস্থার ব্যাপক উন্নতি ঘটানো হবে৷ উল্টে আমরা দেখছি, ইংল্যান্ডে পুঁজিপতিদের মুনাফা বাড়ছে, শ্রমিকদের মজুরি বেঁধে দেওয়া হচ্ছে এবং তাদের নিত্য ব্যবহার্য পণ্যগুলির দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে৷ না, এ ধরনের রাজনীতিকে আমরা সমাজতান্ত্রিক বলতে পারি না৷ সোভিয়েট ইউনিয়নকে লক্ষ্য করে ইংল্যান্ড থেকে পরিচালিত রেডিও সম্প্রচার (বিবিসি) সম্পর্কে বলতে হয়, জনগণের যে শত্রুরা সোভিয়েট ইউনিয়নে পুঁজিবাদী শোষণ ফিরিয়ে আনার মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছে, প্রধানত তাদের মদত দিতেই ওই সম্প্রচারগুলি করা হয় এবং এটা সকলেই জানেন৷ এটা বোঝাই যায় যে, এইসব জনস্বার্থবিরোধী প্রচার, যা বাস্তবিকপক্ষে সোভিয়েট ইউনিয়নের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপেরই সামিল, তাকে সোভিয়েট সরকার সমর্থন করতে পারে না৷ মিঃ মরিসন বলেন, সোভিয়েট ইউনিয়নে সোভিয়েটের ক্ষমতা হচ্ছে একটি মনোলিথিক ক্ষমতা, কারণ, তা কেবলমাত্র একটি পার্টিরই ক্ষমতার প্রতিনিধিত্ব করে, সেটি হচ্ছে কমিউনিস্ট পার্টি৷ একই যুক্তিতে আমরাও বলতে পারি, ইংল্যান্ডের লেবার সরকারও একটি মনোলিথিক সরকার, যেহেতু এই সরকারও একটি পার্টিরই, অর্থাৎ একমাত্র লেবার পার্টিরই প্রতিনিধিত্ব করে৷

মূল কথা অবশ্য এটা নয়৷ এখানে মূল কথা হল, সোভিয়েট ইউনিয়নে কমিউনিস্টরা, প্রথমত স্বতন্ত্রভাবে একাকী কাজ করে না, পার্টির বাইরের মানুষদের (নন–পার্টি পিপল) সাথে জোটবদ্ধ হয়ে কাজ করে৷ দ্বিতীয়ত, সোভিয়েট ইউনিয়নের ঐতিহাসিক বিকাশে কমিউনিস্ট পার্টিই নিজেকে একমাত্র পুঁজিবাদবিরোধী পার্টি, জনগণের পার্টি রূপে প্রমাণ করেছে৷

গত ৫০ বছর ধরে রাশিয়ায় যেসব প্রধান প্রধান পার্টি ছিল, রাশিয়ার জনগণ তাদের সকলকেই দেখেছে : ভূস্বামীদের পার্টি (দি ব্ল্যাক হান্ড্রেডস), পুঁজিপতিদের পার্টি (দি ক্যাডেটস), মেনশেভিক পার্টি (দক্ষিণপন্থী সমাজতন্ত্রী), দি পার্টি অফ দি সোস্যাল রেভলিউশনারিজ (কুলাকদের রক্ষক), কমিউনিস্ট পার্টি৷ বিপ্লবী আন্দোলনের গতিপথে আমাদের জনগণ সকল বুর্জোয়া পার্টিকে বর্জন করেছে এবং পছন্দ করেছে কমিউনিস্টদেরই– যেহেতু তারা দেখেছে একমাত্র কমিউনিস্ট পার্টিই ভূস্বামী বিরোধী ও পুঁজিবাদবিরোধী পার্টি৷ এটা একটা বাস্তব ঘটনা এবং বোঝাই যায় যে, কমিউনিস্ট পার্টি যে সংগ্রাম করেছে, তাকে সোভিয়েট জনগণ সম্পূর্ণভাবে সমর্থন করেছে৷

এই বাস্তব ঘটনাকে মিঃ মরিসন কী দিয়ে নস্যাৎ করবেন? তিনি কি মনে করেন, বিরোধীদের সন্দেহজনক মতলব চরিতার্থ করার প্রয়োজনে কেউ চাইলেই ইতিহাসের চাকা ঘুরিয়ে দিতে পারে এবং যেসব পার্টি  দীর্ঘকাল আগে শেষ হয়ে গিয়েছে, তাদের বাঁচিয়ে তুলতে পারে?

বৈদেশিক রাজনীতি

মিঃ মরিসন দাবি করেছেন, লেবার সরকার শান্তি বজায় রাখার পক্ষে, তাদের দিক থেকে সোভিয়েট ইউনিয়নের কোনও আশঙ্কা নেই৷ নর্থ আটলান্টিক চুক্তি যুদ্ধের জন্য সামরিক বাহিনী তৈরির উদ্দেশ্যে হলেও এটি একটি অনাক্রমণ চুক্তি৷ ইংল্যান্ড অস্ত্র প্রতিযোগিতার পথে নামতে বাধ্য হয়েছে, কারণ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সোভিয়েট ইউনিয়ন তার সেনাবাহিনীর আকার যথেষ্ট পরিমাণে কমায়নি৷

মিঃ মরিসনের এইসব দাবিগুলির মধ্যে দুঃখের বিষয় এক বিন্দুও সত্য নেই৷

লেবার সরকার যদি প্রকৃতই শান্তির পক্ষে হয়, তাহলে কেন তারা পাঁচটি রাষ্ট্রের মধ্যে শান্তি চুক্তি সম্পাদনের বিষয়টি এড়িয়ে যাচ্ছে? কেন তারা সকল বৃহৎ শক্তির অস্ত্র হ্রাসের বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করছে? কেন তারা পারমাণবিক অস্ত্র নিষিদ্ধকরণের বিরুদ্ধে বলছে? শান্তির পক্ষে যারা দাঁড়াচ্ছে কেন লেবার সরকার তাদের উৎপীড়ন করছে? ইংল্যান্ডে যুদ্ধের উন্মাদনা সৃষ্টির জন্য যে পরিকল্পিত প্রচার চালানো হচ্ছে, কেন তারা সেই প্রচার নিষিদ্ধ করছে না?

মিঃ মরিসন চাইছেন আমরা যেন তাঁর মুখের কথায় বিশ্বাস করি৷ কিন্তু সোভিয়েট জনগণ কারোরই– তিনি  যেই হোন না কেন– মুখের কথায় বিশ্বাস করে না৷ তারা মৌখিক ঘোষণা নয়, বাস্তবে কাজ দাবি করে৷

একইভাবে মিঃ মরিসন যে বলেছেন– দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সোভিয়েট ইউনিয়ন তার সেনাবাহিনীর আকার যথেষ্ট পরিমাণে কমায়নি, সেটাও ধোপে টেকে না৷ সোভিয়েট সরকার ইতিমধ্যেই ঘোষণা করেছে যে, সেনাবাহিনীর আকার কমানো হয়েছে এবং বর্তমানে সোভিয়েট সেনাবাহিনীর আকার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগেকার শান্তির সময়ের মতোই প্রায়৷ অন্য দিকে, ইংল্যান্ডের বর্তমান সেনাবাহিনীর আকার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগেকার চেয়ে দ্বিগুণ বেশি৷ এই হচ্ছে বাস্তব তথ্য যা অস্বীকার করার উপায় নেই, অথচ এর বিরোধিতা করা হচ্ছে ভিত্তিহীন অমূলক বিবৃতি  দিয়ে৷

মিঃ মরিসন হয়তো চাইছেন, সোভিয়েট ইউনিয়ন এমন সেনাবাহিনী রাখুক, যাদের অস্ত্রেরই কোনও প্রয়োজন নেই৷ বাস্তবে সেনাবাহিনীর পিছনেই সরকারি বাজেটের মাত্রাতিরিক্ত ব্যয় হয়ে যায়, এবং সোভিয়েট জনগণ খুশি মনেই নিয়মিত সেনাবাহিনী ভেঙে দেওয়ার পক্ষে মত দেবে, যদি বাইরের থেকে আক্রমণের আশঙ্কা না থাকে৷ কিন্তু ১৯১৮–২০ সালের অভিজ্ঞতা আমাদের অন্য রকম শিক্ষা দিয়েছে৷ তখন ইংল্যান্ড, আমেরিকা ও ফ্রান্স (জাপানের সাথে যুক্ত হয়ে) সোভিয়েট ইউনিয়নকে আক্রমণ করেছিল এবং ইউক্রেন, ককেশাস, মধ্য এশিয়া, দূর প্রাচ্য ও আরখানজেলস্কি অঞ্চল ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছিল, তিন বছর ধরে আমাদের কষ্ট দিয়েছিল৷ এই ঘটনা আমাদের শিখিয়েছে, সোভিয়েট ইউনিয়নকে অবশ্যই নতম প্রায়োজনীয় আকারে নিয়মিত সেনাবাহিনী বজায় রাখতে হবে, যাতে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনকারীদের হাত থেকে নিজের স্বাধীনতা সে রক্ষা করতে পারে৷ রাশিয়ানরা কখনও ইংল্যান্ডের ভূখণ্ডে আক্রমণ চালিয়েছে, ইতিহাসে এরকম একটি নজিরও পাওয়া যাবে না৷ কিন্তু ইংরেজরা রাশিয়ার ভূখণ্ডে আক্রমণ চালিয়েছে ও ভূখণ্ড দখল করেছে এমন নজির ইতিহাসে ভুরি ভুরি পাওয়া যাবে৷

মিঃ মরিসন বলেছেন যে, রাশিয়ানরা জার্মান প্রশ্নে, ইউরোপের পুনরুজ্জীবনের প্রশ্নে ইংরেজদের সঙ্গে সহযোগিতা করতে অস্বীকার করেছে৷ এটি একটি ডাহা মিথ্যা এবং কত বড় মিথ্যা সেটা মিঃ মরিসনও জানেন৷ আসলে সত্য কী, সেটা সকলেই ভাল জানেন এবং তা হচ্ছে, এক্ষেত্রে সহযোগিতা করতে রাশিয়ানরা অস্বীকার করেনি৷ আসলে ইংল্যান্ড ও আমেরিকা আগেই জানত যে, রাশিয়ানরা কখনই জার্মানিতে ফ্যাসিবাদের পুনরুত্থান ঘটানোর পথে যাবে না, পশ্চিম জার্মানিকে আগ্রাসন চালাবার ঘাঁটিতে রূপান্তরিত করার পথে যাবে না৷

তবে ইউরোপের অর্থনৈতিক পুনরুজ্জীবনের প্রশ্নে সহযোগিতা করতে রাশিয়া কখনই অস্বীকার করেনি৷ উল্টে রাশিয়া নিজেই প্রস্তাব দিয়েছে যাতে অর্থনৈতিক পুনরুজ্জীবনের কর্মসূচি বাইরের হুকুমদারি ছাড়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হুকুমদারি ছাড়া ইউরোপীয় দেশগুলির সমতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার নীতির ভিত্তিতে কার্যকর করা হয়৷

একই ভাবে মিঃ মরিসন অভিযোগ করেছেন যে, জনগণতান্ত্রিক দেশগুলিতে কমিউনিস্টরা বলপ্রয়োগ করে ক্ষমতায় এসেছে৷ কমিনফর্ম জোর–জুলুম চালাচ্ছে ও দুরভিসন্ধিমূলক প্রচারকর্মে লিপ্ত রয়েছে৷ এসব কোনও অভিযোগেরই কোনও ভিত্তি নেই৷ কমিউনিস্টদের কুৎসা না করে যারা জল স্পর্শ করে না, একমাত্র তারাই এসব কথা বলতে পারে৷

ঘটনা হচ্ছে, জনগণতান্ত্রিক দেশগুলিতে কমিউনিস্টরা সাধারণ নির্বাচনের মধ্য দিয়েই ক্ষমতায় এসেছে৷ স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে, এই দেশগুলির জনগণ শোষকদের ও বিদেশি গুপ্তচর বাহিনীর এজেন্টদের ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে৷ এটাই জনগণের ইচ্ছা৷ কমিনফর্ম প্রসঙ্গে বলা যায়, জোরজুলুম ও দুরভিসন্ধিমূলক প্রচারকার্যে কমিনফর্ম লিপ্ত আছে, এ কথা একমাত্র তারাই বলতে পারে যারা পুরোপুরি মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছে৷ কমিনফর্ম–এর দলিলগুলি প্রকাশ করে দেওয়া হয়েছে এবং এখনও প্রকাশিত হয়ে চলেছে৷ সকলেই সেগুলি জানেন এবং কমিউনিস্টদের সম্পর্কে যাবতীয় কুৎসামূলক ও অবমাননাকর বক্তব্যকে দলিলগুলি পুরোপুরি মিথ্যা প্রমাণ করে দেয়৷

এ প্রসঙ্গে খুব জোর দিয়েই আমরা বলতে চাই, বলপ্রয়োগ কমিউনিস্টদের কর্মপদ্ধতি নয়৷ বরং উল্টোটাই সত্য৷ ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, বাস্তবে সাম্যবাদের শত্রুরা ও অন্যান্য বিদেশি গুপ্তচরবাহিনীর এজেন্টরাই জোরজুলুমের রাস্তা নেয়৷ তার দৃষ্টান্তের জন্য বেশি খোঁজাখুঁজির দরকার নেই৷ অতি সম্প্রতি  ইরানের  প্রধানমন্ত্রীকে হত্যা করা হয়েছে, লেবাননের প্রধানমন্ত্রী ও ট্রান্স–জর্ডনের রাজাকেও হত্যা করা হয়েছে৷ এই সমস্ত হত্যাকাণ্ড এই দেশগুলির শাসন ক্ষমতায় জোর করে পরিবর্তন ঘটাবার একমাত্র মতলব থেকেই করানো হয়েছে৷ কারা এদের হত্যা করেছে? কমিউনিস্টরা বা কমিনফর্মের সমর্থকরা করেছে কি? এরকম একটি প্রশ্ন উত্থাপন করাটাই বরং মজার৷ মিঃ মরিসনই যেহেতু এ ব্যাপারে ভাল খোঁজখবর রাখেন, তাই সঠিক উত্তরটি পেতে তিনি নিশ্চয়ই আমাদের সাহায্য করবেন৷

মিঃ মরিসন বলেন, নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি হচ্ছে একটি আত্মরক্ষামূলক চুক্তি৷ আগ্রাসন চালাবার জন্য নয়, উল্টে আগ্রাসনের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোই এর লক্ষ্য৷

এ কথাই যদি সত্য হয়, তবে এই চুক্তির উদগাতারা কেন সোভিয়েট ইউনিয়নকে এতে যোগ দিতে আমন্ত্রণ জানাননি? কেন তাঁরা সোভিয়েট ইউনিয়নকে ঘিরে সামরিক বেষ্টনী খাড়া করেছেন? কেন তারা সোভিয়েট ইউনিয়নের অনুপস্থিতিতে গোপনে এই চুক্তি সম্পাদন করলেন? হিটলার ও জাপানের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে সোভিয়েট ইউনিয়ন কি প্রমাণ দেয়নি যে, সে আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়তে পারে এবং লড়তে চায়ও৷ এই চুক্তিতে যে নরওয়ে একজন স্বাক্ষরকারী– আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সোভিয়েট ইউনিয়নের লড়াই কি সেই নরওয়ের থেকেও খারাপ ছিল? এই উদ্ভট আচরণের কী ব্যাখ্যা হতে পারে?

সোভিয়েট সরকার প্রস্তাব দিয়েছিল, এই চুক্তিটি নিয়ে বিদেশ দপ্তরের মন্ত্রী পরিষদের সাথে আলোচনা করা হোক৷ নর্থ আটলান্টিক চুক্তিটি যদি ইংল্যান্ড–আমেরিকার ক্ষেত্রে আত্মরক্ষামূলকই হত, তবে সোভিয়েট সরকারের এই প্রস্তাবে তারা রাজি হল না কেন? তার কারণ কি এটাই নয় যে, এ চুক্তির মধ্যে সোভিয়েট ইউনিয়নের বিরুদ্ধে আগ্রাসন চালানো সম্পর্কে অনুচ্ছেদ রয়েছে, যেটা চুক্তির উদগাতারা সমাজের ব্যাপক অংশের মানুষের কাছ থেকে গোপন  করতে  চান  রাজি না হওয়ার কারণ কি এটাই নয় যে, সোভিয়েট ইউনিয়নের বিরুদ্ধে আক্রমণে সাহায্য করার জন্য ইংল্যান্ডকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ও বিমান ঘাঁটিরূপে পরিণত করতে লেবার সরকার সম্মতি দিয়েছে?

এ কারণেই সোভিয়েট জনগণ পুনরায় বলতে চায়, নর্থ আটলান্টিক চুক্তি হচ্ছে আগ্রাসন চালাবারই একটি জোট, যার টার্গেট হল সোভিয়েট ইউনিয়ন৷ এ ঘটনা বিশেষ করে পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে কোরিয়ায় ইঙ্গ–মার্কিন দক্ষিণপন্থী চক্রের আগ্রাসী কার্যকলাপ থেকে৷ দু’বছরেরও বেশি সময়  হয়ে গেল ইঙ্গ–মার্কিন সেনারা কোরিয়ার স্বাধীনতাকামী, শান্তিপ্রিয় জনগণকে ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে, গ্রাম–শহরকে ধ্বংস করছে, নারী–শিশু ও বৃদ্ধদের হত্যা করছে৷ ইঙ্গ–মার্কিন শক্তির এই হিংস্র কার্যকলাপকে কি কেউ আত্মরক্ষামূলক বলতে পারে? কেউ কি বলবে যে, ইংরেজ সেনাবাহিনী কোরিয়ায় গিয়ে কোরিয়ার জনগণের হাত থেকে ইংল্যান্ডকে রক্ষা করছে? ইঙ্গ–মার্কিন বাহিনীর এইসব কার্যকলাপকে সামরিক আগ্রাসন বলাই কি অধিকতর সততার পরিচায়ক হবে না? মিঃ মরিসন পারেন তো এমন কী একজন সোভিয়েট সৈন্যকেও দেখান, যে শান্তিপ্রিয় জনগণের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছে৷ না, এমন একজন সোভিয়েট সৈন্যও নেই৷ এবং মিঃ মরিসন সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দিন যে, কেন ইংরেজ সৈন্যরা কোরিয়ার শান্তিপ্রিয় জনগণকে হত্যা করছে, কেন ইংরেজ সৈন্য স্বদেশ থেকে বহুদূরে এক অচেনা দেশে গিয়ে মারা যাচ্ছে? এ কারণেই সোভিয়েট জনগণ মনে করে, বর্তমান ইঙ্গ–মার্কিন রাজনীতি একটি নতুন বিশ্বযুদ্ধে প্ররোচনা দিচ্ছে৷

(গণদাবী : ৭১ বর্ষ ৩২ সংখ্যা)