সামাজিক আন্দোলনই একমাত্র পারে উগ্র হিন্দুত্বকে রুখতে

মানুষের শুভবুদ্ধিই যেভাবে একদিন বারাসাত–বসিরহাটের মানুষকে নানা প্ররোচনার জাল থেকে নিজেদের মুক্ত করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে সাহায্য করেছিল, আসানসোল–রানিগঞ্জ সেভাবেই স্বাভাবিক জীবনে ফিরছে৷ রামভক্তির মহড়া দিতে ভোটকারবারিদের লড়ালড়ি এবং পুলিশি নিষ্ক্রিয়তার বলি ছয় ছয়টি তাজা প্রাণ অকালে ঝরে যাওয়ার গভীর ব্যথার মুহূর্তেও তাদের বিবেককে নাড়া দিয়ে গিয়েছে সদ্য পুত্র হারা ইমাম রশিদি এবং তাঁর মতো রক্তাক্ত মানুষদের বুকফাটা সেই আর্তি–অনেক হয়েছে, আর নয়৷ এই হানাহানি বন্ধ কর৷

সংবাদে প্রকাশ, নবান্নের একাংশের অভিমত– রামনবমীর দিন পুলিশের ভূমিকা সন্দেহের ঊর্ধ্বে ছিল না৷ রামনবমীর দিন যেভাবে রাজ্যের একাধিক স্থানে রক্ত ঝরল, লুটপাট হল, আগুন ধরানো হল, ছ’জন নিরাপরাধ মানুষ প্রাণ হারালেন, তাতে এ প্রশ্ন উঠতে বাধ্য– সেদিন পুলিশ–প্রশাসনের বাস্তবে কোনও ভূমিকা আদৌ ছিল কি? অথচ সকলেই লক্ষ করেছিলেন, ওইদিন অস্ত্র হাতে মিছিল করা না–করা নিয়ে উত্তেজনার পারদ ক্রমেই চড়ছিল৷

কিছু কিছু এলাকায় মানুষের মধ্যে উদ্বেগ ও আশঙ্কাও তীব্র আকার নিয়েছিল৷ এ বিষয়গুলি প্রশাসনের দৃষ্টি এড়িয়ে যাওয়ার কথা নয়৷ তা হলে সব জেনেও তারা পরিস্থিতি মোকাবিলায় যথাযথ ব্যবস্থা নেননি কেন? না কি রামভক্তির প্রতিযোগিতায় অন্যতম পক্ষ তৃণমূলও– এ কারণেই গোড়ায় তারা কিছুটা গা–ছাড়া অবস্থান নিয়েছিল? অন্যদিকে রাজ্যপালের অতি–তৎপরতাও ছিল লক্ষ করার মতো৷ ঘটনার একদিন বাদেই কি কারণে আসানসোলে যেতে তিনি ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন? আক্রান্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানোই কি তাঁর উদ্দেশ্য ছিল, না কি কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধির ভূমিকা নিয়ে ঘোলা জলে ফয়দা তুলতেই তিনি বেশি আগ্রহী ছিলেন?

আশার কথা, উত্তেজনার পারদ যত কমছে, রামভক্তির প্রতিযোগিতার পেছনকার উদ্দেশ্যও সাধারণ মানুষের কাছে ততই পরিষ্কার হয়ে আসছে৷ বিজেপি–আরএসএসের রামভক্তি ও অস্ত্র আস্ফালনের সঙ্গে যে ধর্মের কোনও সম্বন্ধ নেই, রয়েছে নির্ভেজাল ভোটের অঙ্ক, শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষদের কাছে তা বিশেষ ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না৷ কারণ বার বারই তাঁরা দেখছেন, হিন্দু ভোটব্যাঙ্ক নিশ্চিত করতে কোনও অপকর্ম করতেই এদের বাধে না৷ ধর্মের নামে উন্মাদনা সৃষ্টি করতে, দাঙ্গা বাধিয়ে অসংখ্য মানুষের জীবন কেড়ে নিতে এদের হাত কাঁপে না৷ দাভোলকর, পানেসর, কালবূর্গি, গৌরী লঙ্কেশের মতো মুক্ত মনের মানুষেরা এদের শিকার৷ কারণ সত্যকে এরা ভয় পায়৷ এদের হাতিয়ার অন্ধতা, ধর্মীয় গোঁড়ামি৷ অসহিষ্ণুতা এদের মূলধন– যা ভোটের মুখে চূড়ান্ত রূপ নেয়৷ সম্প্রতি উত্তরপ্রদেশ, গুজরাটের ভোটেও মানুষ তা দেখেছেন৷ এর মধ্যে ধর্ম কোথায়? আজ এদের লক্ষ্য পশ্চিমবাংলা৷ তাই বিদ্যাসাগর, শরৎচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের বাংলাকে এরা সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পে কলুষিত করতে চাইছে৷

এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, মানুষের ধর্ম বিশ্বাস এবং ধর্মের নামে ভোটব্যাঙ্ক তৈরির ঘৃণ্য রাজনীতি এক নয়৷ কোনও ধর্মবিশ্বাসী মানুষই অপর ধর্মের মানুষের ধর্মবিশ্বাসকে আঘাত করতে পারে না৷ হিন্দু ধর্মের নানা প্রবক্তার মুখে আমরা এ কথাই শুনে এসেছি৷ রামকৃষ্ণ বলেছেন, যত মত তত পথ৷ বিবেকানন্দ বলেছেন, একই সঙ্গে আমার স্ত্রী বৌদ্ধ, আমার পুত্র হিন্দু এবং আমি মুসলিম ধর্মে বিশ্বাস করতে পারি৷ এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই৷ চৈতন্যদেব তাঁর যুগে মানুষে মানুষে বিভেদ–বিদ্বেষের প্রাচীরকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন৷ বিজেপি–আরএসএসের হিন্দুত্বের সাথে চৈতন্যদেব, বিবেকানন্দের হিন্দুত্বের কোনও মিল খুঁজে পাওয়া যায় কি?

এখানে একটি বিষয় বুঝতে হবে৷ বর্তমানে দেশের আসল শাসক যারা সেই শোষক বুর্জোয়া শ্রেণি এই বিভেদ–বিদ্বেষের রাজনীতির মধ্যেই খুঁজে পেয়েছে তাদের বাঁচার শেষ আশ্রয়৷ একদিন যে বুর্জোয়া শ্রেণি নবজাগরণের চিন্তা নিয়ে এসেছিল, পুরনো সমাজের কূপমণ্ডুকতাকে ভেঙে গণতান্ত্রিক চিন্তা–চেতনায় নতুন সমাজ গড়তে চেয়েছিল, ইতিহাসের গতিপথে ক্ষয়িষ্ণু মরণোন্মুখ স্তরে এসে সেই বুর্জোয়া শ্রেণিই আজ সমাজে বিভেদের সমস্ত উপাদানগুলিকে জিইয়ে তুলতে চাইছে, তাতে ইন্ধন জোগাচ্ছে৷ এইভাবে তারা চাইছে, ধর্ম–বর্ণ নির্বিশেষে সমস্ত খেটে–খাওয়া মানুষের ঐক্যকে ভেঙে দিতে, যাতে বর্তমান শোষণব্যবস্থার বিরুদ্ধে তারা এক হয়ে রুখে দাঁড়াতে না পারে৷

একই সঙ্গে এ কথাও বুঝতে হবে, বিজেপি–আর এস এসের উগ্র হিন্দুত্বকে ঠেকাতে রাজ্যের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস যেভাবে রাস্তায় নেমে রামভক্তির প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়েছে এবং হিন্দু ভাবাবেগের চ্যাম্পিয়ান সাজতে চেয়েছে, সাম্প্রদায়িকতাকে ঠেকানোর এটা কোনও কার্যকরী পথই নয়৷ বরং এর দ্বারা সাম্প্রদায়িকতাই আরও পুষ্ট হবে৷

অবশ্য বর্তমান ব্যবস্থায় নানা রঙের শাসক বা শাসক–পদাকাঙক্ষী বুর্জোয়া শ্রেণি নানা দলগুলিকে এই ভূমিকাতেই আমরা দেখতে অভ্যস্ত৷ ভোটব্যাঙ্ক তৈরি বা রক্ষার স্বার্থে এরা কখনও হিন্দুত্বের চ্যাম্পিয়ান, আবার কখনও সংখ্যালঘু বা দলিত স্বার্থের চ্যাম্পিয়ান সাজে৷ এই কারণেই তৃণমূল রাম নবমীর পর হনুমান জয়ন্তীকেও হাতছাড়া করেনি৷ একই কারণে কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধীও গুজরাটে নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে রীতিমতো টক্কর লড়ে মন্দিরে মন্দিরে হাজিরা দিয়েছেন৷ এই ভোটরাজনীতি সাম্প্রদায়িকতার বিষ সমাজজীবন থেকে নির্মূল করতে পারে না৷ বরং তাকে বাড়াতেই সাহায্য করে৷ এ কাজ একমাত্র তারাই করতে পারে যারা ধর্ম–বর্ণ, জাত–পাত, ভাষা–আঞ্চলিকতা নির্বিশেষে সমস্ত মানুষকে তাদের সামাজিক অবস্থান চিনতে শেখায়৷ খেটে–খাওয়া মানুষের জীবনের যে মূল সমস্যা—বেকারি–মূল্যবৃদ্ধি–অশিক্ষা– স্বাস্থোহীনতা-নিরাপত্তাহীনতা—সব কিছুর মূলে যে শোষণমূলক পুঁজিবাদী ব্যবস্থা, তার বিরুদ্ধে এক হয়ে লড়তে শেখায়৷ এ কাজ যারা প্রচলিত শোষণব্যবস্থার অবসান চায়, তারাই একমাত্র করতে পারে৷

উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা আজও যে বাংলায় তাদের শক্ত ভিত দাঁড় করাতে পারেনি, আজও যে মানুষের শুভবুদ্ধি কিছুটা দেরিতে হলেও জাগ্রত হয়ে এদের ষড়যন্ত্রকে ব্যর্থ করে দেয়, যার প্রমাণ আমরা আসানসোল–রানিগঞ্জে পেলাম, তার মূলে রয়েছে বাংলার সেই সংগ্রামী ঐতিহ্য, একদিন যার শুরু হয়েছিল রামমোহন–বিদ্যাসাগরের হাত ধরে৷ পরবর্তীকালে এই ধারায়, স্বাধীনতার বেদিমূলে নেতাজি–ক্ষুদিরাম–বিনয়-বাদল-দীনেশ-বাঘা যতীন–প্রীতিলতা প্রমুখ অগণিত বীর বিপ্লবীদের আত্মদান এবং স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বামপন্থীদের নেতৃত্বে বহু রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম এই ঐতিহ্যকে আরও সমৃদ্ধ করেছিল৷ এই ঐতিহ্যই বাংলার বুকে সাম্প্রদায়িকতাকে জায়গা করতে দেয়নি৷ ৩৪ বছরের সিপিএম রাজত্ব এই ঐতিহ্যের ভিতকে অনেকটাই ধসিয়ে দিয়েছে যার সুযোগ নিচ্ছে উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা৷ এর রেশ যতটুকু এখনও টিকে রয়েছে, তাকে আবারও শক্ত ভিতের উপর দাঁড় করাতে পারে সামাজিক চেতনা ও উন্নত নীতি–নৈতিকতার আধারে গড়ে ওঠা শক্তিশালী সামাজিক–সাংস্কৃতিক আন্দোলন৷ এই উপলব্ধি এবং তার বাস্তবায়নের পথেই একমাত্র সম্ভব সাম্প্রদায়িকতাকে প্রতিহত করা৷

(৭০ বর্ষ ৩৫ সংখ্যা ২০ এপ্রিল, ২০১৮)