সরকারি পৃষ্ঠপোষকতাতেই মাদকাসক্তি মারণ রোগে পরিণত

শরৎচন্দ্রের পথের দাবীতে একটা বর্ণনা আছে, ‘‘অনাবৃত কাঠের মেঝেতে বসিয়া ছয়–সাতজন পুরুষ ও আট–দশ জন স্ত্রীলোক মিলিয়া মদ খাইতেছিল৷ একটা ভাঙা হারমোনিয়াম  ও একটা বাঁয়া মাঝখানে, নানা রঙের ও নানা আকারের খালি বোতল চর্তুদিকে গড়াইতেছে৷ …পাশের ঘরে দুটো অনাথ ছেলে–মেয়ে মরে, একজন কেউ চেয়ে দেখে না যা চাক্ষুষ করে অপূর্ব বলে উঠেছিল, নরক আর আছে কোথায়?’’ বাস্তবে এই নরকের ছবি আজ সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে৷ মদ ও মাদকাসক্তি ছাত্র–যুব সহ সমাজের বিস্তীর্ণ অংশে মারণ রোগের মতো তার প্রভাব বিস্তার করছে৷

মদ ও মাদকে আসক্তি মানুষকে যে কতটা নিচে নামাতে পারে সে কথা অজানা নয় কারোওরই৷ বেশিদিন আগের কথা নয়– মদ খেয়ে মাতাল বাবা তার শিশু সন্তানকে আছড়ে মেরে ফেলেছে এ খবরও তো সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত৷ মদ ও মাদক দ্রব্য এ দেশের সমাজজীবনে, কতটা গভীরতা ও ব্যাপকতায় গেড়ে বসেছে, সাম্প্রতিক একটি সরকারি পরিসংখ্যানে তা আবার প্রমাণিত৷ রিপোর্ট বলছে, এ দেশে ১০ থেকে ৭৫ বছরের প্রায় ১৬ কোটি মানুষ প্রায় প্রতিদিন মদ খায়৷ তার মধ্যে প্রায় ৫ কোটি ৭০ লক্ষ মানুষ নেশার কারণে বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত৷ পাঞ্জাব, ত্রিপুরা, ছত্তিশগড়, গোয়া, অরুণাচল প্রদেশের মতো রাজ্যে মাদকাসক্তের সংখ্যা শতাংশে বেশি (জন সংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি)৷ আর সংখ্যার নিরিখে উত্তরপ্রদেশে ৪ কোটি ২০ লক্ষ, পশ্চিমবঙ্গে ১ কোটি ৪০ লক্ষ, মধ্যপ্রদেশ ১ কোটি ২০ লক্ষ৷ দেশের ৩ কোটি ১০ লক্ষ লোক নিয়মিত চরস, গাঁজা, ভাঙ খেয়ে থাকে৷ আফিম জাতীয় মাদক বিশেষত হেরোইনের নেশা করে ১.১৪ শতাংশ মানুষ (সূত্র : এইমস দিল্লির অধীনস্থ ন্যাশনাল  ডিপেনডেন্স ট্রিটমেন্ট  সেন্টার কৃত সমীক্ষা)৷

কেন বাড়ছে নেশাগ্রস্তের সংখ্যা? পশ্চিমবঙ্গের কথাই ধরা যাক, গত বছর নতুন করে ১৮০০ মদের দোকান খোলার ফরমান জারি করেছে তৃণমূল সরকার৷ যার পরিণতিতে গ্রামে গ্রামে, পাড়ায় পাড়ায়, অলিতে–গলিতে গজিয়ে উঠছে নতুন নতুন মদের দোকান৷ আর টার্গেট ক্রেতা কারা? স্কুল–কলেজ–বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী থেকে গরিব–নিম্নবিত্ত–মধ্যবিত্ত মানুষ৷ এমন একটা প্রচার বুর্জোয়া সংবাদমাধ্যম উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে করে থাকে যে, মদ খাওয়া, ধূমপান করা সাবালকত্বের মাপকাঠি, ‘স্ট্যাটাস সিম্বল’ এ হেন সাবালকত্বের জেরে শুধু জনস্বাস্থ্য (শারীরিক এবং মানসিক) নয়, আঘাত নামছে পরিবারগুলির অর্থনীতির উপরেও৷ মাদকাসক্তিজনিত কারণে পরিবারে পরিবারে অশান্তি তথা গার্হস্থ্য হিংসা, পরিবারের মধ্যে মারাত্মক অপরাধজনিত ঘটনা বেড়েই চলেছে৷ দেখা যাচ্ছে চুরি–ছিনতাই থেকে খুন–ধর্ষণের মতো নৃশংস অপরাধ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কারণ স্রেফ মাদকাসক্তিজনিত নৈতিক অবনমন৷ কেন না মদ ও মাদক দ্রব্যের মতো নেশায় আসক্তি মানুষকে এমন একটা মানসিক দশায় নিয়ে যায় যা মস্তিষ্কের উপর নিয়ন্ত্রণের অযোগ্য মারাত্মক প্রভাব ফেলে৷ বোধশক্তি, বিচারবোধ, সংযম, ন্যায়–নীতিবোধ হারিয়ে নেশাগ্রস্ত মানুষ অচিরেই হয়ে পড়ে অপরাধপ্রবণ ও সমাজবিমুখ৷

নিত্যদিনের জীবনযন্ত্রণা ভুলতে, বাস্তব জীবন থেকে পলায়নবাদী মানসিকতা থেকে অথবা নিছক অ্যাডভেঞ্চার প্রিয়তা থেকে নেশার স্বাদ নিলেও পরবর্তীতে সে তার শিকার বনে যায়৷ যার বিষময় ফল শেষপর্যন্ত ভোগ করে যেতে হয় তাকে, তার পরিবারকে তথা গোটা সমাজকে৷ অথচ সরকারি কোষাগার পূরণের লক্ষ্য থেকে বিভিন্ন রাজ্যের সরকার মদ ও মাদকের প্রসার রোধে কোনও ব্যবস্থা তো নেয়ই না, বরং সুকৌশলে তাতে উৎসাহ বাড়িয়ে চলে৷ এ ছাড়া যে কোনও অত্যাচারী শাসক জানে জনগণের নৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙে পড়লে  দীর্ঘায়িত হয় শাসন৷ তাই এই দ্বিবিধ উদ্দেশ্য পূরণের জন্য মদের প্রসার নীতির বদল হয় না৷

চীনের জনগণকে আফিমে বুঁদ করে রেখে দীর্ঘদিন পদানত রাখতে চেয়েছিল সাম্রাজ্যবাদী শক্তি৷ রুখে দাঁড়িয়েছিলেন চীনের জনগণ৷ এ দেশে স্বাধীনতা সংগ্রামেও একটি অন্যতম কর্মসূচি ছিল মাদক বর্জন৷ মদের দোকানে পিকেটিং৷ স্বাধীনতা পরবর্তীতে এ দেশে শাসক সরকারি দলগুলি নানাভাবে মদ ও মাদক প্রসারের নীতি নিয়ে চললেও, তার বিরুদ্ধে স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিরোধে বহু মানুষ সামিল হচ্ছেন, এটাই আশার৷ জনমতের চাপে বিহারে নিষিদ্ধ হয়েছে মদ৷

এ রাজ্যেও জেলায় জেলায় মানুষ সংগঠিতভাবে প্রতিবাদ–প্রতিরোধের্ মাধ্যমে মদের দোকান বন্ধ করতে বাধ্য করছেন প্রশাসনকে৷ মদের ভাঁটি ভেঙে দিচ্ছেন৷ এলাকায় এলাকায় গড়ে উঠছে মদ ও মাদক বিরোধী গণকমিটি৷ মদ নিষিদ্ধকরণের দাবিতে জেলায় জেলায় থানা ডেপুটেশন, বিক্ষোভ কর্মসূচি চলছে৷ ১৫ মার্চ রাজ্যব্যাপী বিক্ষোভের ডাক দিয়েছে এসইউসিআই (সি)৷

(গণদাবী : ৭১ বর্ষ ৩০ সংখ্যা)