সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন সমস্ত সংক্রামক রোগ রুখে দিতে পেরেছিল

 

কোভিড অতিমারির বিপর্যয় ও বিপন্নতা প্রতিদিন আমরা প্রত্যক্ষ করছি। শুরু থেকে এখনও পর্যন্ত দেশের সংক্রমিতের সংখ্যা তিন কোটিরও বেশি। মারা গেছেন চার লাখেরও বেশি মানুষ। অতিমারির দ্বিতীয় ঢেউ যেতে না যেতেই তৃতীয় ঢেউ আসার কথা শোনা যাচ্ছে।

স্বাস্থ্য পরিষেবার বেহাল দশা

কেন্দ্রের বিজেপি সরকার পরিচালিত স্বাস্থ্যব্যবস্থার বেহাল দশা, সরকারি হাসপাতালের অভাব, হাসপাতালে বেডের অভাব, অিক্সিজেন ও ওষুধ নিয়ে কালোবাজারি, নাগরিকদের টিকা না পাওয়া, টিকা নিয়ে কালোবাজারি প্রভৃতি বিষয়গুলি দেশের মানুষকে চূড়ান্ত অসহায়তার সামনে দাঁড় করিয়েছে। পুঁজিবাদী এই রাষ্ট্রব্যবস্থায় সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষের স্বার্থে নীতি নির্ধারণের বদলে সরকার যে একমাত্র পুঁজিপতি শ্রেণির মুনাফার স্বার্থেই যাবতীয় নীতি প্রণয়নে বদ্ধপরিকর, তা একটু সচেতন থাকলেই নজরে এসেছে। স্বাস্থ্য-পরিষেবা নাগরিকদের মৌলিক ও সর্বজনীন অধিকার হিসাবে সংবিধানে থাকলেও স্বাধীনতা-উত্তর ভারতবর্ষে কোনও সরকারই যে তা রূপায়িত করার উদ্যোগ নেয়নি। বিপরীতে, এই ক্ষেত্রটিকে মুনাফার স্বার্থে ক্রমাগত আরও বেশি করে বেসরকারি মালিকদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে। স্বাস্থ্য খাতে বাজেট-বরাদ্দের পরিমাণ ক্রমাগত কমানো হচ্ছে এবং সরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থা ধীরে ধীরে ভগ্নস্তূপে পরিণত হচ্ছে।

অথচ বেশি মুনাফা অর্জনের লক্ষে্য পরিচালিত বেসরকারি হাসপাতালগুলিতে চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করা দেশের সিংহভাগ মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। বর্তমান কোভিড পরিস্থিতিতে আর্থিক সংকটগ্রস্ত কোটি কোটি মানুষ তাই একটু চিকিৎসার সুযোগ পেতে হন্যে হয়ে পড়ছেন।

ঠিক বিপরীত চিত্রের সাক্ষী থেকেছে পৃথিবী

ঠিক এর বিপরীত চিত্র আমরা দেখেছি সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নে। সেখানে ব্যক্তিগত সম্পত্তি নির্মূল করে সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার মধ্য দিয়ে অবসান ঘটেছিল মানুষের দ্বারা মানুষের শোষণের। সেই সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে মানুষের জীবনের মূল্য ছিল সর্বাধিক। ভূমিষ্ঠ হওয়ার পূর্বে গর্ভাবস্থা থেকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত প্রতিটি নাগরিকের কাছে স্বাস্থ্যপরিষেবা ছিল যথার্থই সর্বজনীন অধিকার। রাষ্ট্রের প্রত্যেক নাগরিককে মর্যাদাময় সুন্দর জীবন উপহার দেওয়ার পাশাপাশি প্রতিটি মানুষের সুস্বাস্থ্য ও সর্বাঙ্গীণ বিকাশে সোভিয়েত সরকার ছিল বদ্ধপরিকর।

বিপ্লবের আগে রাশিয়ার স্বাস্থ্যব্যবস্থা ছিল জঘন্য। যতটুকু স্বাস্থ্যপরিষেবা মিলত, তার পুরোটাই ভোগ করত জার ও অভিজাতরা। অভিজাতদের জন্য হাসপাতাল, স্যানিটোরিয়াম, অ্যাসাইলাম সবই ছিল। গরিব মানুষ এর খরচ চালাতে পারত না। তাদের নির্ভর করতে হত অদক্ষ গ্রামীণ চিকিৎসক, যাজকদের ঝাড়ফুঁক, তুকতাক, ধর্মীয় আচার-কুসংস্কার প্রভৃতির ওপর। রোগ-ব্যাধিতে আক্রান্ত হলে চোখের জল ফেলা বা ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করা ছাড়া তাদের আর কোনও উপায় ছিল না। স্মলপক্স, সাইফাস, যক্ষ্মা ও সূতিকা রোগে হাজার হাজার মানুষ অসহায় ভাবে প্রাণ হারাত।

এই রাশিয়ার বুকেই ১৯১৭ সালে মহান লেনিনের নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সফল হয়। সমস্ত প্রতিকূলতা হঠিয়ে উন্মোচিত হয় মানবমুক্তির নতুন দিগন্ত। সমাজতন্ত্র সকলের কর্মসংস্থান সহ বিনামূল্যে শিক্ষা ও স্বাস্থে্যর অধিকার প্রতিষ্ঠিত করে।

সমাজতন্ত্র সকল নাগরিকের সুরক্ষার ব্যবস্থা করেছিল

সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নে রাষ্ট্রের মালিকানা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ খেটে-খাওয়া মানুষের হাতে। সমাজ গঠনের দায়িত্ব নেবে যে মানুষ, সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের লক্ষ্য ছিল, তাকে দেহ-মনে সুগঠিত করে গড়ে তোলা। তাই সোভিয়েত ইউনিয়নে একদিকে যেমন যেমন শরীর গঠন ও সুস্থতার জন্য ছেলেমেয়েদের খেলাধূলা ও শরীরচর্চার উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল, তেমনই দেশের প্রতিটি মানুষকে মদের নেশা থেকে মুক্ত করার সুপরিকল্পিত প্রয়াস নেওয়া হয়েছিল। প্রতিটি নাগরিকের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সেখানে ছিল রাষ্ট্র পরিচালিত সার্বজনীন সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা। এর খরচ শ্রমিকের মাইনে থেকে কাটা হত না। সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় যেহেতু ব্যক্তিগত মুনাফার কোনও জায়গা থাকে না, তাই সোভিয়েত ইউনিয়নে শ্রমিকরা যা উৎপাদন করত তার একটা অংশ জমা পড়ত এই সামাজিক সুরক্ষা খাতে। আমাদের মতো পুঁজিবাদী রাষ্ট্রে লাইফ ইন্সিওরেন্স, হেলথ ইনসিওরেন্স, হেলথ এন্টাইটেলমেন্ট কার্ড, থার্ড পার্টি ইন্সিওরেন্স প্রভৃতি প্রকল্পগুলির সাথে যখন কোনও না কোনও ভাবে কর্পোরেট সংস্থাগুলিকে যুক্ত থাকতে দেখা যায় এবং ইন্সিওরেন্স ব্যবসা পরিচালিত হয় ব্যক্তির মুনাফার উদ্দেশ্যে, তখন সোভিয়েত ইউনিয়নে রাষ্ট্রই দেশের সকল শ্রমিকের সামাজিক সুরক্ষা তাদের ব্যক্তিগত খরচ ছাড়াই নিশ্চিত করেছিল। সম্পূর্ণ বিনামূল্যে সকলের সুচিকিৎসার জন্য স্তরে স্তরে গড়ে তোলা হয়েছিল প্রচুর সংখ্যায় অ্যামবুলেটোরিয়াম, পলিক্লিনিক, সাধারণ হাসপাতাল, সোস্যাল হাসপাতাল, মেটারনিটি হাসপাতাল, টিবি এবং সাধারণ রোগের ক্লিনিক, টিবি স্যানেটোরিয়াম, নাইট স্যানেটোরিয়াম, বিশ্রামাবাস আর অসংখ্য মেডিকেল কলেজ ও চিকিৎসাবিজ্ঞান গবেষণা প্রতিষ্ঠান। অর্থনৈতিক লেনদেন না থাকায় চিকিৎসক ও রোগীদের মধ্যে ছিল সহজ সম্পর্ক। প্রতিটি নাগরিকের চিকিৎসা পরিষেবা সুনিশ্চিত করতে সরকার স্বাস্থ্য খাতে বিপুল বরাদ্দ করেছিল।

সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন সর্বাগ্রে সুদৃঢ় করতে চেয়েছিল রোগ-প্রতিরোধমূলক চিকিৎসা ব্যবস্থাকে। কারণ প্রতিরোধ উন্নত হলে মানুষ অসুস্থ হবে কম, এটাই চিকিৎসা বিজ্ঞানের মূল কথা। পুঁজিবাদী দেশগুলিতে প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্যব্যবস্থার ঢালাও প্রচার করা হলেও তা আসলে একটা পরিহাস। কারণ মানুষ অসুস্থ না হলে হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানের মালিকদের মুনাফার সুযোগ নেই। রাশিয়া কিন্তু প্রতিরোধমূলক ও সামাজিক চিকিৎসাশাস্তে্রর প্রয়োগে উপযুক্ত পদক্ষেপ নিয়েছিল। ওই সময়ে রাশিয়া সহ ইউরোপের দেশগুলোতে মহামারীর রূপ নিত টাইফাস রোগ। মারা যেত লক্ষ লক্ষ মানুষ। সোভিয়েত ইউনিয়নের বিশাল ভূখণ্ডে আবহাওয়ার তারতম্য, বিভিন্ন জনজাতি ও জীবনযাত্রার মানুষের অবস্থান, প্রভৃতি নানা কারণে ইউরোপীয় অন্য দেশগুলোর তুলনায় বিভিন্ন সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব ও মৃত্যুহার ছিল এখানে বেশি। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সফল হওয়ার পর ১৯১৮ সালে সকলকে বিনামূল্যে চিকিৎসা দেওয়ার কথা ঘোষণা করা হয়়। তখন রাশিয়ায় গৃহযুদ্ধ চলছে। বিশ্বের সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি শিশু সমাজতন্তে্রর গলা টিপে মারতে মরিয়া। সেই কঠিন সময়েও মহামারীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের লক্ষে্য একটি ডিক্রি জারি করা হয়। ১৯১৮ সালেই লেনিন স্মলপক্রেস টিকা নেওয়া বাধ্যতামূলক করলেন। ১৯৩০ সালে ডিপথেরিয়ার বিরুদ্ধে টিকাকরণ বাধ্যতামূলক হয়। ১৯২৯ সালের একটি পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, যখন ইংল্যান্ডের মতো উন্নত পুঁজিবাদী দেশে ১০,৯৬৭ জন স্মলপক্সে মারা গেছেন তখন এর দশগুণ জনবহুল রাশিয়াতে মারা গেছেন মাত্র ৬০৭৯ জন।

প্রবল প্রতিকূলতার মধ্যেও রোগ মোকাবিলায় জোর দিয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন

যুদ্ধপরবর্তী রাশিয়ায় অবর্ণনীয় দুঃখ-দুর্দশায় জর্জরিত ছিল দেশ। চলছিল অর্ধাহার। রুটির রেশন ছিল সীমিত। রেশনে মাংস মিলত না। চিনি হয়ে দাঁড়িয়েছিল একটা বিলাস সামগ্রী। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে অপুষ্টির দরুন মহামারী ছড়িয়ে পড়ছিল। ১৯২০ সালে টাইফাস জ্বরে আক্রান্ত হয়েছিল প্রায় ৩৫ লক্ষ মানুষ। কিন্তু প্রবল প্রতিকূল পরিস্থিতি সত্ত্বেও রোগ সংক্রমণ মোকাবিলায় সোভিয়েত সরকার বিশেষ যত্ন নিয়েছিল। কোনও শ্রমিক অসুস্থ হলে সংক্রমণ ছড়ানো আটকাতে তাকে পরিবার থেকে সরিয়ে বিশ্রামাগারে রেখে চিকিৎসা করা হত। থাকত তাদের বিশ্রাম ও আহারের বন্দোবস্ত। আবার ওই সময়ে অর্থনৈতিক পুনর্গঠনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিচ্ছিল সোভিয়েত সরকার। যুদ্ধ ও অর্থনৈতিক ভগ্নদশা থেকে উদ্ভূত সমস্যাগুলি অতিক্রম করা এবং যথাসম্ভব দ্রুত পুঁজিতন্ত্র থেকে সমাজতন্তে্র উত্তরণের সমগ্র পর্বটির প্রয়োজনের উপযোগী করে ‘নয়া আর্থিক’ কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছিল। পাশাপাশি ১৯২১ সালের নিদারুণ খরা পরিস্থিতি মোকাবিলায় সোভিয়েত সরকারকে ব্যাপক উদ্যোগী হতে হয়েছিল। এত বিপদের মধ্যেও প্রত্যেক অসুস্থ নাগরিকের চিকিৎসা পাওয়া ও সংক্রামক রোগ প্রতিরোধে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়ার কাজটি সোভিয়েত সরকার পুরোদমে চালিয়ে গেছে। সমাজতন্তে্র প্রত্যেক নাগরিক রাষ্টে্রর সম্পদ বলে বিবেচিত হয়। ফলে সেই সম্পদ সুরক্ষিত রাখা সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র নিজের অন্যতম প্রধান কর্তব্য বলে মনে করত এবং সেইমতো নীতি নির্ধারণ করত, যা পুঁজিবাদী রাষ্ট্রে কল্পনার অতীত।

যে কোনও সংক্রমণ রুখে দেওয়ার ক্ষমতা অর্জন করেছিল সমাজতান্ত্রিক রাশিয়া

ভারতের মতো একটি দেশ, যেটি বর্তমানে পৃথিবীর অন্যতম শক্তিধর পুঁজিবাদী দেশে পরিণত হয়েছে, সেখানেও দেখা যাচ্ছে, স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বরাদ্দ ক্রমাগত কমিয়ে দিচ্ছে সরকার। ২০২০-‘২১-এ দেশের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের মাত্র ১.৮ শতাংশ বরাদ্দ করা হয়েছে স্বাস্থ্য খাতে, যা বিশ্বের মধ্যে সর্বনিম্ন (ডব্লিউডব্লিউডব্লিউ.ডাউনটুআর্থ.ওআরজি, ১ ফেব্রুয়ারি, ‘২১)। ঠিক এর বিপরীত চিত্র দেখা গিয়েছিল সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত রাশিয়ায়। সেখানে বিপুল পরিমাণ অর্থ– কেন্দ্রীয় বাজেটের ১৭ শতাংশ সার্বজনীন স্বাস্থ্যপরিষেবা খাতে ব্যয় করা হত। সোভিয়েত সংবিধানের ৪২ নং ধারা প্রতিটি নাগরিকের জন্য বিনামূল্যে স্বাস্থ্য পরিষেবা সুনিশ্চিত করেছিল। প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার শেষে মহান স্ট্যালিনের তত্ত্বাবধানে দেশে ডাক্তারের সংখ্যা ৬৩ হাজার থেকে বেড়ে হয়েছিল ৭৬ হাজার। হাসপাতালে বেডের সংখ্যা ২ লাখ ৫৭ হাজার থেকে বেড়ে হয় ৫৭ লক্ষ ৫০ হাজার। পৃথিবীর মধ্যে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নেই ডাক্তার ও নার্সের সংখ্যা ছিল সবচেয়ে বেশি। চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে যে কোনও সংক্রামক রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করার প্রশিক্ষণ দেওয়া হত। বিপ্লবোত্তর রাশিয়া একেবারে শুরুতেই বলশেভিক ডাক্তারদের নেতৃত্বে মেডিকেল ও স্যানিটারি বিভাগ গড়ে তুলেছিল। গড়ে উঠেছিল স্বাস্থ্য ও মহামারী সংক্রান্ত বিভাগ। যে কোনও মহামারী রোখার কার্যকরী পদক্ষেপ হিসাবে প্রতিষেধক তৈরি ও প্রয়োগ ব্যবস্থার় কেন্দ্রীয় সংস্থা ছিল এই বিভাগটি। এই বিভাগের তত্ত্বাবধানে মহামারী বিরোধী কেন্দ্রীয় কমিশন, ভ্যাকসিন কমিশন, স্প্যানিশ ফ্লু রোগ ও টাইফাস জ্বর বিরোধী কমিশনগুলি গড়ে উঠেছিল। ১৯১৯ থেকে ১৯২১ পর্যন্ত বলশেভিক পার্টি ও সমাজতান্ত্রিক সরকার সংক্রামক রোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে ১৮টি ডিক্রি জারি করেছিল। দেশ জুড়ে সকলকে ভ্যাকসিন দেওয়ার লক্ষে্য সর্বস্তরে স্যানিটারি সেবা সদন গড়ে তোলা হয়েছিল যেগুলি সাধারণ রোগের চিকিৎসা ছাড়াও প্লেগ, কলেরা, স্মলপক্স, অ্যানথ্রাক্স ও ম্যালেরিয়া প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। এই উদ্যোগের ফল দ্রুত পরিলক্ষিত হয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়নে। ১৯৩০ সালের মধ্যেই সেখানে কলেরা, ডিপথেরিয়া বা ম্যালেরিয়ার মতো মারণ রোগ প্রায় নির্মূল হতে শুরু করেছিল। স্মলপক্স ও টাইফয়েড জ্বরের প্রাদুর্ভাব রুখে দেওয়া সম্ভব হয়েছিল। নাগরিকদের প্রাণ ও সুস্বাস্থ্যকে রাষ্টে্রর অগ্রাধিকারের তালিকায় রাখা, মুনাফাচিন্তা বিহীন চিকিৎসা পরিষেবা,স্বাস্থ্য সচেতনতার প্রসার এবং চিকিৎসা বিজ্ঞানের সঠিক ব্যবহার যে সমস্ত সংক্রমণকে রুখে দিতে পারে, তা প্রমাণ করে দিয়েছিল বিশ্বের প্রথম সমাজতান্ত্রিক দেশ সোভিয়েত ইউনিয়ন।

মহামারী প্রতিরোধে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের এই অসাধারণ ভূমিকার দিকে চোখ রাখলে আজকের অতিমারিবিধ্বস্ত ভারত সহ অন্যান্য পুঁজিবাদী দেশের ব্যাপক বৈপরীত্য ভীষণ ভাবে চোখে পড়ে। মুনাফাসর্বস্বতা এই পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলি ও শাসক পুঁজিপতি শ্রেণির কাছে জনস্বাস্থ্যকে পণ্যে পরিণত করেছে। যার ফল আজ জীবন দিয়ে ভুগতে হচ্ছে কোটি কোটি সাধারণ মানুষকে। অথচ সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন আজ থেকে ১০০ বছর আগেই দেশের মানুষকে মহামারীর অভিশাপ থেকে মুক্তি দিয়েছিল। এই কাজ সম্ভব হয়েছিল সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের কর্ণধারদের সঠিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে। এই দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতে রয়েছে মার্কসবাদ ও দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ। সঠিক বিজ্ঞানসম্মত সেই দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিচালিত সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন তার সর্বশক্তি নিয়োগ করে রক্ষা করেছিল সমাজের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ নাগরিকদের জীবন। করোনা অতিমারির এই দুঃসহ পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য পরিষেবার বিশ্বজোড়া চূড়ান্ত সংকটের আবর্তে তাই সোভিয়েত স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে খুঁটিয়ে জানা ও উপলব্ধি করা আজ নিতান্ত প্রয়োজন।

(তথ্যসূত্রঃ প্রোলেটারিয়ান এরা, ৫৪ বর্ষ ১০ সংখ্যা, সোভিয়েত সমাজের ইতিহাস– প্রগতি প্রকাশন, মস্কো এবং সমাজতন্ত্রে জনস্বাস্থ্য– মেডিকেল সার্ভিস সেন্টার)

গণদাবী ৭৩ বর্ষ ৪০ সংখ্যা