সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নারী ও শিশুরা পেয়েছিল অভাবনীয় সব অধিকার

(সোভিয়েত ইউনিয়নে নারী ও শিশুদের অধিকার পর্যালোচনা করেছেন লেখক বিয়াট্রিস কিং৷ অ্যাংলো–সোভিয়েত মহিলা কমিটি কর্তৃক প্রচারিত একটি পুস্তিকায় এটি প্রকাশিত হয়েছিল৷)

ইউ এস এস আর (ইউনাইটেড সোভিয়েত সোস্যালিস্ট রিপাবলিক) একটা সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র৷ এখানে উৎপাদন হয় মানুষের ব্যবহারের উদ্দেশ্যে, লাভের উদ্দেশ্যে নয়৷ ১৯৩২ সালেই বেকারি সম্পূর্ণ দূর হয়ে গিয়েছিল৷ কোনও নাগরিকেরই ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তা ছিল না৷ সামাজিক নিরাপত্তার বিষয়টি অনেক আগেই গৃহীত হয়েছিল এবং তা কার্যকর করা হয়েছিল৷ পারিবারিক অনুদান (অ্যালাউন্স) থাকা উচিত কিনা সেটা আজকে আর বিতর্কের বিষয় নয়, বিতর্কের বিষয় হল কী রূপে তারা সেটি নেবে৷ মাতৃত্বকালীন ছুটি থাকবে কি না, এটাও বিতর্কের বিষয় নয়, আলোচ্য বিষয় হল– কতদিন থাকবে৷ রাষ্ট্র যথেষ্ট সংখ্যক নার্সারি ও কিন্ডারগার্টেন করে দিয়েছিল, ফলে তা নিয়ে তর্ক হত না, বরং সবচেয়ে ভাল নার্সারি ও কিন্ডারগার্টেন গড়ে তোলা নিয়ে আলোচনা হত৷ কারখানা কমিটির মাধ্যমে এবং পূর্ণ অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সমতার মাধ্যমে মানুষই নানা শহর কিংবা অঞ্চল পরিচালনা করত৷

মহিলাদের পরিস্থিতি

ইউ এস এস আর–এর প্রত্যেক মহিলার ভালভাবে বাঁচার সুযোগ ছিল৷ মহিলারা যে কোনও কাজের ক্ষেত্রে পুরুষের সমান বেতন ও পদ পেতেন৷ প্রত্যেক মহিলাকে নাগরিক হিসাবে ক্রিয়া করার পাশাপাশি স্ত্রী, মা কিংবা শ্রমিক হিসাবে কাজ করার ক্ষেত্রেও উৎসাহিত করা হত৷ তারা স্থানীয় কাউন্সিল, কারখানা কমিটি, যৌথ কৃষি কমিটি কিংবা অন্য কোনও সাংগঠনিক কমিটিতে কাজ করার সুযোগ পেতেন৷ তাঁদের ক্রিয়াকলাপের সম্ভাবনা বা পছন্দসই কাজের ক্ষেত্রে কখনও কোনও সীমা বেঁধে দেওয়া হত না৷ বিবাহিত কিংবা অবিবাহিত যাই হোন না কেন, লেখক, বিজ্ঞানী, শ্রমিক, কৃষক– সকলেরই জীবন ছিল পরিপূর্ণ৷ আগে যে সমস্ত মহিলা বাইরের কোনও কাজ সম্পর্কে আগ্রহী হতেন না, তাঁরা তাঁদের জীবনকে অবরুদ্ধ বলে মনে করতেন, উপরোক্ত পরিবেশে গত ২৫ বছর ধরে বসবাসকারী সোভিয়েত মহিলারা জীবন সম্পর্কে তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে ফেলেছিলেন৷

ইউ এস এস আর–এর শিশুরা

শিশুরা ইউ এস এস আর–এ অত্যন্ত চমৎকার পরিবেশে থাকত৷ রাজনীতি ও আদর্শনিষ্ঠা ছাড়াও রাশিয়ানরা শিশুদের প্রতি অত্যন্ত স্নেহপ্রবণ৷ সবচেয়ে বড় কথা, তাঁরা শিশুদের সম্ভাবনার উপর আস্থাশীল ছিলেন৷ যখন গৃহযুদ্ধে দেশ জেরবার, সর্বত্র ক্ষুধার্ত মানুষ, শিল্প–কারখানা প্রায় স্তব্ধ, সেই সময়ও শিশুদের পরিচর্যার পরিকল্পনা যতটা সে সময় করা সম্ভব ছিল, তার এতটুকু ব্যাঘাত ঘটেনি৷ যখন শান্তি ফিরে এল, শিল্প–কৃষি হল উন্নত, ক্রমাগত বেশি বেশি সুযোগের ব্যবস্থা করা হল শিশুদের জন্য৷ ১৯৪০ সাল পর্যন্ত অধ্যাপক, ডিরেক্টর কিংবা ঝাড়ুদার যাঁরই সন্তান হোক– সবার ক্ষেত্রেই পৃথিবীর যে কোনও দেশের তুলনায় বেশি যত্ন নেওয়া হত৷ পূর্ণবয়স্ক্ মানুষের মতো শিশুদের জীবনে অনেক বিপত্তি নিয়ে এসেছিল যুদ্ধ, কিন্তু সেখানে প্রতিটি পদক্ষেপ নেওয়া হত যাতে বিপত্তি যতদূর সম্ভব কমানো যায় সেদিকে লক্ষ রেখে৷

প্রাথমিক পদক্ষেপ

১৯১৮ সালে সোভিয়েত সরকার গর্ভপাত সংক্রান্ত নতুন আইন চালু করে৷ আরেকটা আইন করে সহজে বিবাহবিচ্ছেদ করা সংক্রান্ত (দুটোই ব্রিটেন ও অন্যত্র প্রচণ্ড সমালোচনার মুখে পড়ে)৷

সোভিয়েতের নেতারা ভালো করেই জানতেন যে কিছু আইন প্রয়োগ করে কিংবা শাস্তি দিয়ে মানুষের নৈতিক মানের উন্নয়ন সম্ভব নয়৷ এটার জন্য প্রাথমিক কিছু শর্তের প্রয়োজন যাতে উন্নত নৈতিক মান গড়ে তোলা সম্ভব হয় ও তা আকর্ষণীয় হয়৷ তাহলেই শিক্ষা এবং জনগণের মতামতকে কার্যকরী করা যাবে৷ কিন্তু শিক্ষা ও জনমত ফলদায়ী করতে হলে উপযুক্ত জমিতেই তা বপন করা দরকার৷

বিপ্লবের প্রথম দিকের বছরগুলিতে রাশিয়া ছিল দারিদ্রপীড়িত, জীর্ণ তাদের ঘরবাড়ি৷ অধিকাংশ মানুষ ছিলেন অশিক্ষিত৷  কৃষকদের কাছে জন্মনিয়ন্ত্রণের বিষয়টি ছিল অত্যন্ত ভয় এবং সন্দেহের৷ এই পরিস্থিতিতে কোনও আইন কিংবা শাস্তির ভয় মহিলাদের অহরহ গর্ভপাত করানোর অভ্যাসকে আটকাতে পারেনি৷ কাজেই পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত বিশেষজ্ঞদের নজরদারির ভিত্তিতে এবং নিরাপদ পরিবেশে গর্ভপাত করানো হত৷

গর্ভপাত বৈধ হলেও, এর বিরুদ্ধে তীব্র শিক্ষামূলক প্রচার এবং জন্মনিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে শিক্ষিত করার এক আন্দোলন গড়ে তোলা হল৷ মাতৃসদন (ম্যাটারনিটি হোমস), নার্সারি এবং শিশুদের ক্লিনিকগুলির জন্য নানা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হল৷ কারখানা ও অফিস কর্মচারীদের তিন মাসের মাতৃত্বকালীন ছুটির সাথে পুরো বেতন দেওয়া চালু হল৷ এই মহিলাদের স্বাস্থ্যের দিকে নজর রাখতে শ্রমিক ইউনিয়নের আলাদা কমিটি ছিল৷

পরবর্তী পদক্ষেপ

১৯৩৬ সালে ইউ এস এস আর দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা প্রায় সম্পূর্ণ করে ফেলে৷ এতে বেকারি পুরোপুরি দূর হয় এবং জীবনমানের উন্নয়ন হয় অনেকখানি৷ সোভিয়েত ব্যবস্থায় সোভিয়েত শিক্ষা ছিল অত্যন্ত ফলপ্রসূ৷ একটা প্রজন্ম গড়ে উঠেছিল যারা বিবাহ এবং মূল্যবোধকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করত৷ প্রত্যেকের কাছ থেকেই  অধিকতর  দায়িত্ববোধ  এবং  উচ্চ  নৈতিক  মান  দাবি করা যেত৷

এই সময়ে এসে স্বাস্থ্যের কারণ ছাড়া গর্ভপাতকে অবৈধ ঘোষণা করে নতুন একটি আইন পাশ হল৷ বিবাহবিচ্ছেদের আইন শক্তপোক্ত করা হল৷ বিবাহবিচ্ছিন্না মহিলাদের বেতন এবং মজুরি  বাড়ানো হল, শিশুদের পালন করার জন্য পিতার দেয় অর্থের পরিমাণ কমানো হল৷

যে সময় এই সমস্ত পরিবর্তনগুলি চলছিল, তখন বিশাল বিশাল বাড়ি তৈরি করা হল, মানুষের বাসস্থানের মান উন্নত করা হল এবং মাতৃসদন, নার্সারি ও কিন্ডারগার্টেনের সংখ্যা বাড়ানো হল৷ ১৯৩২ সালের মতো ১৯৩৬–এও একটা আদেশনামা জারি করা হল, যাতে কারখানা ও যৌথ খামারগুলি নার্সারি ও কিন্ডারগার্টেনগুলির জন্য যে সমস্ত পদক্ষেপ নিত, তা আরও ভালভাবে করা যায়৷ ছয়ের বেশি সন্তান আছে এমন পরিবারে শিশুদের দেখাশোনার জন্য অনুদান দেওয়া হত৷ শিশুর জন্মের সাথে সাথে বাড়তি অর্থ বরাদ্দ করা হত৷ মহিলাদের সাহায্য করতে সর্বপ্রকার পদক্ষেপ নেওয়া হত৷

সোভিয়েতের আইন ও নির্দেশনামাগুলি দেশের অগ্রগতির প্রয়োজনে জারি করা হত৷ এর একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল সমস্ত মানুষকে সাহায্য করা৷ যখন এগুলি সেই উদ্দেশ্য পূরণ করত না কিংবা আরও অগ্রগতির ক্ষেত্রে বাধা হত, তখন সঙ্গে সঙ্গেই তা প্রত্যাহার করা হত৷ এটাও সেই সময় দেখা গিয়েছিল, জীবন মানের উন্নয়নের সাথে সাথে যে কোনও ব্যক্তির দায়িত্ববোধ ও উচ্চ নৈতিক মান উন্নততর হয়ে উঠেছিল৷

মায়েরা

শিশুর জন্মের পাঁচ ও ছয় সপ্তাহ আগে মাতৃত্বকালীন ছুটি বাড়িয়ে দেওয়া হত৷ যমজ সন্তানের ক্ষেত্রে এটা আট সপ্তাহ করে দেওয়া হয়েছিল৷ গর্ভধারণের চার মাস পর কিংবা সন্তান যখন মায়ের বুকের দুধ খেত তখন মহিলাদের ওভারটাইম বা রাতের ডিউটি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হত৷ মাতৃত্বকালীন ছুটি দুটি বিষয়ের উপর নির্ভর করত – মহিলাদের স্বাস্থ্য ও দেশের প্রয়োজন৷ এখন, কয়েক বছর যুদ্ধের ক্ষত মেরামত করতে এবং দেশকে উন্নতির শিখরে পৌঁছে দিতে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রয়োজন প্রতিটি জোড়া হাতের৷ গর্ভধারিণী মায়েদের শেষ তিন মাসের খাবারের বরাদ্দ বাড়িয়ে দ্বিগুণ করা হয়েছিল৷ মা ও সন্তানদের প্রয়োজনীয় বিশ্রাম নেওয়ার জন্য ঘরের ব্যবস্থা ছিল৷ কারখানার কাছাকাছি নার্সারি ও কিন্ডারগার্টেনের ব্যবস্থা থাকত, যাতে মহিলারা সন্তানদের দুধ খাওয়াতে পারেন এবং নিজেদের স্বাস্থ্যের যত্ন নিতে পারেন৷

মায়েদের জন্য পুরস্কার

মাতৃত্বকে স্বীকৃতি দিতে এ সমস্ত উপায় নিতে হয়েছিল সমাজ সভ্যতাকে এটা বোঝাতে যে, শিশুদের আলাদা অস্তিত্ব নেই, তারা সামাজিক সম্পদ৷ বই লেখা, ছবি আঁকা এবং কোনও সংগঠনের প্রধান হয়ে ওঠা সন্তান পালন করার থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ– এরকম একটা ধারণা চালু আছে সর্বত্র৷ সোভিয়েত ইউনিয়নে পরিবার সম্পর্কে আবেগ গড়ে তুলতে এক শক্তিশালী আন্দোলনের প্রয়োজন হয়েছিল, যা সুন্দর সমাজ গড়ে তুলতে সাহায্য করেছিল৷ অন্যান্য মহৎ কাজের সাথে সাথে সেই সমস্ত মহিলাদের পুরসৃক্ত করা হত, যারা পাঁচ অথবা বেশি সন্তানকে বড় করে তুলেছেন৷

জার্মানিতে ফ্যাসিস্টরা যা করেছিল, সোভিয়েতেও তা করা হয়– এই ধরনের সমালোচনা চালু ছিল৷ এ কথা ঠিক যে, শুধু সোভিয়েত ইউনিয়ন নয়, অন্যান্য নানা দেশ থেকে নাৎসিরা বহু বিষয় রপ্ত করেছিল৷ কিন্তু তারা এ সমস্ত ধারণার বিকৃতি ঘটিয়েছিল৷ মানুষকে সুখী করার পরিবর্তে, তাদের স্বাধীনতা দান ও সৃষ্টিশীল কাজে উৎসাহ সৃষ্টি করার পরিবর্তে তারা সাধারণ মানুষের জীবনে দুঃখ, নিষ্পেষণ এবং ধ্বংসই নিয়ে এসেছিল৷ শিশুদের বড় করে তোলার ক্ষেত্রে তাদের উদ্দেশ্য ছিল, তারা যাতে অন্যান্যদের মৃত্যু ও ধ্বংসের মুখে নিয়ে যেতে পারে৷ নাৎসিদের প্রথম পদক্ষেপ ছিল, ছাত্রীদের উচ্চশিক্ষার দরজা বন্ধ করে দেওয়া, যে কোনও সামাজিক অনুষ্ঠানে মহিলাদের যেতে না দেওয়া৷ এক কথায়– রান্নাঘরে ও নার্সারিতে তাদের আবদ্ধ রাখা এবং তাদের মনে এই বিশ্বাস ঢুকিয়ে দেওয়া যে, ‘রণক্লান্ত সৈনিকদের আনন্দ দেওয়া’ই তাদের প্রধান কাজ৷ ইউ এস এস আর–এ মহিলাদের সম্পূর্ণ ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখা হত৷

বিবাহ এবং অবিবাহিত মা

বিবাহ ও বিবাহবিচ্ছেদের ক্ষেত্রে নিয়ম কানুনে সুদূরপ্রসারী পরিবর্তন ঘটেছিল৷ যতক্ষণ পর্যন্ত না নতুন বিবাহ আইন বলবৎ হচ্ছে ততক্ষণ অনুষ্ঠানের আয়োজনটা ছিল ধর্মীয় অনুষ্ঠানের মতো ব্যক্তির ইচ্ছাভিত্তিক৷ সে সময় অনথিভুক্ত ও নথিভুক্ত বিবাহকে একই দৃষ্টিতে দেখা হত৷ নতুন আইনে নথিবদ্ধ বিবাহকেই বৈধতা দেওয়া হল এবং তা নাগরিকের দায়িত্ববোধের পরিচায়ক বলে অভিহিত হল৷ অবিবাহিত মায়েরা সন্তান প্রতিপালনের ক্ষেত্রে পিতার কাছ থেকে খোরপোষ দাবি করতে পারত না৷ অবিবাহিত মহিলাদের সন্তান পালনের জন্য অনুদান রাষ্ট্রের পক্ষ থেকেই দেওয়া হত৷ মায়েরা ইচ্ছা করলে সরকারি হোমে রেখে শিশুদের লালন–পালন করতে পারতো৷ মা যদি মনে করত বাড়িতে না রেখে অন্যত্র তাকে বড় করবে, সে অধিকারও তাকে দেওয়া হত৷ নতুন আইন শিশুদের রক্ষাকবচ হিসেবে এবং অন্যান্য শিশুদের সাথে তাদের একই দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখার ক্ষেত্রে সহায়ক হয়েছিল৷

সোভিয়েত ব্যবস্থায় এমনই নমনীয়তা ছিল যে, যখনই মানুষের যৌথ অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বোঝা যেত যে, এই সমস্ত আইন মানুষের পক্ষে মঙ্গলজনক নয় তখনই তা প্রত্যাখ্যান করা হত৷ সোভিয়েত ব্যবস্থার আলোকে নতুন আদেশনামা নির্ধারিত হত৷