সমাজতন্ত্র প্রমাণ করেছিল বেকারত্ব ও বৈষম্যের অবসান সম্ভব

শ্যামবাজার মোড়ের হজমিওয়ালা যুবক প্রতাপ কিংবা শিয়ালদহ মেন লাইনের লোকাল ট্রেনে মাইক্রোফোনে গান শুনিয়ে পয়সা চাওয়া শ্যামল – এদের চেনেন না এমন নিত্যযাত্রী বিরল৷ দু’জনেই স্নাতক৷ অথচ বেঁচে থাকার মতো একটা চাকরির শিকে ছেঁড়েনি এদের জন্য৷ এমন কয়েক কোটি শ্যামল,  প্রতাপ দেশজুড়ে কোনওরকমে এটা–সেটা করে দিনগুজরান করে চলেছেন৷ কোনও সুরাহার দিশা না পেয়ে এদেশে বছরে ৪৫ হাজার অর্থাৎ প্রতি ১২ মিনিটে ১ জন যুবক আত্মহত্যা করে বেকার জীবনের জ্বালা জুড়িয়েছেন৷

স্বাধীনতার ৭০ বছরে দেশের মানুষ কেন্দ্রে–রাজ্যে অনেক উন্নয়নের মডেলের কথা শুনেছেন৷ ‘নেহেরু মডেল’, ইন্দিরার ‘গরিবি হটাও মডেল’, ‘রাজীব গান্ধীর মডেল’, অটলবিহারীর ‘ফিল গুড মডেল’, ‘মনমোহন সিং–এর বিশ্বায়নের মডেল’, মোদির ‘ভাইব্রান্ট গুজরাটের মডেল’– প্রতিবারই বলা হয়েছিল এর ফলে পুঁজির ঢল নামবে৷ গড়ে উঠবে প্রচুর কলকারখানা৷ ব্যাপক কর্মসংস্থান হবে৷ অর্থনীতির দ্রুত বিকাশ হবে৷ শুধু উঁচুতলা  নয়, সমাজের একেবারে প্রান্তিক স্তর পর্যন্ত আর্থিক উন্নয়ন ঘটবে খুব শীঘ্রই৷ দূর হবে আর্থিক  বৈষম্য৷ কিন্তু বাস্তবে দেখা গেলো  ঠিক উল্টো চিত্র৷ বেকারি বৈষম্য কমা তো দূরের কথা আরও বাড়ল৷

তবে এটাই কি ভবিতব্য? বেকার সমস্যার সমাধান কি সম্ভব নয়? এর থেকে মুক্তির কি কোনও পথ নেই? ১৯১৭ সালের নভেম্বর বিপ্লবের আগে মানুষ ভাবত বেকার সমস্যার সমাধান অসম্ভব! আর্থিক বৈষম্য চিরস্থায়ী৷

সোভিয়েত রাশিয়ার মহান সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব দেখালো বেকার সমস্যার সমাধান সম্ভব৷ আর্থিক বৈষম্য দূর করা সম্ভব৷

মহান দার্শনিক কার্ল মার্কস বলেছিলেন,পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে সমাজে শুধু শ্রম সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটে তাই নয়, উৎপাদনের উদ্দেশ্যেরও পরিবর্তন হয়৷ পূর্ববর্তী সব যুগেই উৎপাদন হত মূলত ভোগের জন্য৷ বিনিময়ও যা হত তাও প্রধানত ভোগের জন্য৷ কিন্তু পুঁজিবাদী উৎপাদনের উদ্দেশ্য মুনাফা, ঠিকভাবে বলতে গেলে সর্বোচ্চ মুনাফা৷

সর্বোচ্চ মুনাফা বা লাভের উৎস কী? বুর্জোয়া অর্থনীতিবিদরা বলেন পণ্য কম দামে কিনে বেশি দামে বিক্রি করেই মালিকের লাভ হয়৷ মার্কস দেখালেন এটা একেবারে ডাহা মিথ্যা৷ আসলে শ্রমিকের শ্রমকে  চুরি করেই হয় মালিকের মুনাফা৷ শ্রমিকের শ্রমকে সে কীভাবে চুরি করে? শ্রমশক্তির মূল্য হিসাবে পুঁজিপতি যে মজুরি দেয়, শ্রমিককে বেশি সময় খাটিয়ে তার চেয়ে বেশি মূল্য সে ফিরে পায়৷ শ্রমিকের শ্রমে সৃষ্ট এই উদ্বৃত্ত মূল্য যা শ্রমিকের পাওয়ার কথা তা আত্মসাৎ করেই হয় মালিকের লাভ বা মুনাফা৷ মুনাফা যত বাড়ে মালিকের  সম্পদ তত বাড়ে আর মেহনতি মানুষ তত নিঃস্ব হয়৷ বৈষম্য তত বাড়ে৷ মার্কস আরও দেখালেন কর্মহীন মানুষ যত বাড়বে কর্মরত শ্রমিককে নানাভাবে শোষণ করে মুনাফার পরিমাণ মালিক তত বেশি বাড়াতে পারবে৷ ৭০ বছরের পুঁজিবাদী শাসনে ভারতবর্ষের অবস্থাও একই রকম৷

পুঁজিবাদে বেকার সমস্যা প্রধান বৈশিষ্ট্য হিসাবে এসেছে এবং উত্তরোত্তর তা বৃদ্ধি পেয়েছে৷ ভারতে জি ডি পি গ্রোথ যত বাড়ছে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বেকার সমস্যা৷ তাই এই উন্নয়নকে বলা হচ্ছে  ‘জবলেস গ্রোথ’৷

বিপ্লবের আগে শিল্পে পশ্চাৎপদ রাশিয়ায় ছিল প্রবল বেকারত্ব৷ লক্ষ লক্ষ লোক কাজের সন্ধানে ভিনদেশে পাড়ি দিচ্ছিল৷ বিপ্লবের পর প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ধাক্কা, চোদ্দটি রাষ্ট্রের যৌথ আক্রমণ, গৃহযুদ্ধ, পরিবহণ ও যোগাযোগ ব্যবস্থা পুরোপুরি ধ্বংস৷ দেশ একটা ধ্বংসস্তূপ৷ ১৯১৮ সালে নথিভুক্ত বেকার ছিল ১৫,১২, ৪৫৫ জন৷ কিন্তু ১৯৩১ সালের মধ্যে সর্বক্ষেত্রে ব্যাপক বিকাশের মাধ্যমে বেকার সমস্যার পূর্ণ সমাধান করল শুধু তাই নয় এমন একটা অবস্থার সৃষ্টি হল যে শ্রমিকের ঘাটতি দেখা দিল৷ সরকার তখন যৌথ খামারগুলিতে আরও যন্ত্রীকরণের পরিকল্পনা করল যাতে সেখানকার উদ্বৃত্ত শ্রমশক্তিকে দিয়ে এই ঘাটতি পূরণ করা যায়৷

উন্নয়নের প্রাচুর্যের জন্য প্রয়োজন হয় উন্নত থেকে উন্নততর প্রযুক্তির৷ উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার পুঁজিবাদী শিল্প উৎপাদনেও হয়৷  পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় মালিক যন্ত্রকে ব্যবহার করে কাজে নিযুক্ত শ্রমিকের সংখ্যা কমিয়ে আর কাজের সময় বাড়িয়ে তার মুনাফা বাড়ায়৷ আর সমাজতন্ত্রে যন্ত্রের ব্যবহার শ্রমিকের কায়িক শ্রমের সাথে কমায় শ্রম সময়ও৷ তাই পুঁজিবাদে উন্নত প্রযুক্তি মেহনতি মানুষের জীবনে আসে অভিশাপ হিসাবে৷

সমাজতন্ত্রে যন্ত্র অভিশাপ নয়, শ্রমিকের জীবনে আশীর্বাদ হয়ে আসে৷ ইংরেজ বৈজ্ঞানিক রামসে আবিষ্কৃত খনির কয়লাকে আগুন লাগিয়ে তাকে গ্যাসে পরিণত করার পদ্ধতি যখন সোভিয়েত ইউনিয়নের গোরলোভকর খনিতে প্রয়োগ করা হয়, তখন শ্রমিকরা আনন্দে আত্মহারা৷ যে খনিতে তাঁরা একদিন জীবিকা অর্জন করতেন তা বন্ধ হবে শুনে তাঁরা অভিনন্দন জানাচ্ছেন ইঞ্জিনিয়ারদের৷ তবে কী তাঁরা পাগল না৷ তাঁরা জানেন এর ফলে খনি মজুরদের কঠিন, নোংরা ও বিপজ্জনক মেহনতের দিন ফুরালো আর ওই কয়লা যন্ত্রকে ঘিরে যে বিরাট রাসায়নিক কারখানা গড়ে উঠবে সেখানে তাঁদের জন্য কাজ থাকবে৷ তাই তাঁদের আনন্দ৷ শ্রমিকের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত ৮ ঘন্টার কাজের অধিকার হারিয়েছেন ভারতবর্ষের শ্রমিকরা৷ কম মজুরিতে ১২–১৪ ঘন্টার হাড়ভাঙা পরিশ্রম করতে বাধ্য হচ্ছেন তাঁরা৷ এর ফলে মালিকদের লাভ বাড়ছে, সম্পদ বাড়ছে৷ অন্যদিকে শ্রমজীবী মানুষ নিঃস্ব হচ্ছেন, বৈষম্য বাড়ছে, বেকারত্ব বাড়ছে৷ আর রাশিয়ায় উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারে শিল্প যত আধুনিক হতে শুরু করেছিল তত কাজের সময় কমতে লাগল৷ বিপ্লবের আগে পুঁজিবাদী রাশিয়ায় শ্রমিকদের কাজ করতে হত ১২–১৩ ঘন্টা, বস্ত্র শিল্পে ১৫–১৬ ঘন্টা৷ বিপ্লবের পরে দৈনিক কাজের সময় নির্ধারিত হয় ৮ ঘন্টা৷ আর তখন সপ্তাহে ৬ দিন কাজ করতে হত৷ ১৯২৩ সালে শ্রম সময় কমিয়ে করা হল ৭ ঘন্টা৷ আর ১৯২৯–এ ঘোষণা করা হল সপ্তাহে ৫ দিন কাজ করতে হবে৷ ১৯৩৭–এ শ্রম–সময় আরও কমে হল দৈনিক ৫ ঘন্টা৷ ফলে সারাদিনে শিফট বেড়ে গেল, বাড়ল কর্মসংস্থানও৷ ব্যক্তি মালিকের লাভের জন্য নয়, মানুষের প্রয়োজনকে ভিত্তি করে সব তৈরি হত বলে পুঁজিবাদী উৎপাদন প্রথায় যেসব গোলমাল দেখা যায়, সমাজতান্ত্রিক উৎপাদন প্রথায় রাশিয়াতে তা থাকেনি৷ সম্পদ যা তৈরি হত তার একটা অংশ শিক্ষা, চিকিৎসা, স্বাস্থ্যোন্নতির জন্য, বৈজ্ঞানিক গবেষণার জন্য, উৎপাদন যন্ত্রের পরিমাণ ও উৎকর্ষতা বৃদ্ধির জন্য, রাস্তাঘাট তৈরি সহ সরকার চালাবার অন্যান্য খরচে ব্যয় করা হত বাকিটা জনগণের মধ্যে বন্টন করা হত৷

এ ছাড়াও শ্রমিকরা নানা ধরনের সামাজিক সুবিধা পেত যাকে সোভিয়েত ইউনিয়নে বলা হত সামাজিক মজুরি বা সোস্যাল ওয়েজ৷ সোভিয়েত ইউনিয়নে একটি কো–পারেটিভ সোসাইটি ছিল শ্রমিকদের জন্য বিশ্রামাগার বা স্যানাটোরিয়াম বানানো জন্য৷ নাম– দ্য হোম অব রেস্ট বা বিশ্রাম নিকেতন৷ হাজার হাজার শ্রমক্লান্ত মানুষ এখানে বিশ্রাম নিত৷ পর্যাপ্ত আহার, যথেষ্ট আরাম সঙ্গে স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য ডাক্তার থাকত৷ এমনভাবে শ্রমিকদের বিশ্রামের প্রয়োজন মহান লেনিন–স্ট্যালিনের নেতৃত্বে সোভিয়েত রাশিয়া ছাড়া আর কেউ কোথাও ভেবেছে যা দেখে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মুগ্ধ হয়ে রাশিয়ার চিঠিতে লিখেছেন, ‘‘যেটা ভেবে দেখবার বিষয় সেটা হচ্ছে জনসাধারণকে এরা (রাশিয়া) ভদ্র সাধারণের উচ্ছিষ্টে মানুষ করতে চায় না৷ শিক্ষা–আরাম–জীবনযাত্রার সুযোগ সমস্তই এদের ষোলো আনা পরিমাণে৷ তার প্রধান কারণ জনসাধারণ ছাড়া এখানে আর কিছু নেই৷ এরা সমাজগ্রন্থের পরিশিষ্ট অধ্যায়ে নয়– সকল অধ্যায়েই এরা’’৷ শ্রমিকের বিশ্রামের ব্যবস্থা দেখে কবি বলেছেন, ‘‘আর কিছু নয়, শ্রমিকদের বিশ্রামের প্রয়োজন এমনভাবে আর কোথাও কেউ চিন্তা করেনি, আমাদের দেশের অবস্থাপন্ন লোকের পক্ষেও এরকম সুযোগ দুর্লভ’’ (রাশিয়ার চিঠি)৷

এমনই এক সমাজ ব্যবস্থার জন্ম দিয়েছিল সোভিয়েত রাশিয়া৷ দেখিয়েছিল বেকারি দূর করা সম্ভব৷ বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা কল্পনা নয়, বাস্তব৷ মানবিক গুণাবলির উন্মেষ ঘটিয়ে সমাজের সঠিক বিকাশের সিংহদ্বার উন্মুক্ত করা সম্ভব৷ শতবর্ষ আগে সেটাই করে দেখিয়েছিল সোভিয়েত সমাজতন্ত্র৷ আবার ১৯৯১ সাল থেকে রাশিয়া সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা থেকে সরে আসায় পুঁজিবাদের সব ব্যাধিতেই আক্রান্ত হল৷ দারিদ্র, বৈষম্য, বেকারি, অশিক্ষা, স্বাস্থ্যহীনতা, অসাম্য, অত্যাচার, সাংসৃক্তিক অবনমন, ভিক্ষাবৃত্তি, পতিতাবৃত্তি, নারী নির্যাতন সহ নানা সমাজিক ব্যাধি সমাজকে বিপন্ন করে তুলল৷ এখানেই সমাজতন্ত্রের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত৷ ফিদেল কাস্ত্রো যথার্থই বলেছিলেন, ‘‘হয় সমাজতন্ত্র, নয় মৃত্যু’’৷

বুর্জোয়া শাসকরা জনগণের স্বার্থরক্ষার নামে বাস্তবে মুষ্টিমেয় ধনকুবেরদের স্বার্থরক্ষা করছে৷  লোভ–লালসা–মুনাফার যে যন্ত্র চলছে তা মুষ্টিমেয়কেই ধনবান করছে আর বাকিদের দারিদ্রের অতল গহ্বরে ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছে৷ মানুষ এর পরিবর্তন চায়৷ পুঁজির মালিকরা বলে শোষণ–বঞ্চনা–অন্যায়-বৈষম্যের এই ব্যবস্থাটিকে পাল্টানো অসম্ভব৷ কিন্তু পাল্টানো যে সম্ভব তা দেখিয়েছিল মহান নভেম্বর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব৷ ভারতের জনগণও শোষণ–বঞ্চনা–লুন্ঠন-দারিদ্র-অন্যায়-অত্যাচারের যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে মুক্তির পথ খুঁজছে৷ সেই পথ কী? সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবই সেই পথ৷ মার্কসবাদ–লেনিনবাদ-শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারা অন্ধকার আকাশে ধ্রুবতারার মতো চেনাচ্ছে মুক্তির পথ৷