সভ্যের বর্বর লোভ নগ্ন করল আপন নির্লজ্জ অমানুষতা

কবি রবীন্দ্রনাথের এই কথাটি মনে পড়ছে সম্প্রতি আমেরিকার একটি মর্মান্তিক ঘটনা লক্ষ করে৷

আমেরিকার সীমান্ত জুড়ে এখন শুধু শিশুদের হাহাকার৷ ‘মায়ের কাছে যাবো, মায়ের কাছে যেতে দাও’ আর্তনাদে বন্দি শিবিরের দেওয়ালগুলিও যেন কেঁপে উঠছে৷ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নয়া শরণার্থী নীতি এই শিশুদের মায়ের কোল থেকে কেড়ে নিয়েছে৷ ট্রাম্প ঘোষণা করেছেন, আমেরিকায় কোনও শরণার্থী শিশুসহ বেআইনিভাবে ঢুকলে তাকে আটক করে বিচার করা হবে এবং বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত সন্তান ছেড়ে থাকতে হবে তাদের৷ এই নিষ্ঠুর নীতির বিরুদ্ধে গোটা বিশ্বজুড়ে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে৷

কোনও অজুহাতেই কি ছোট ছোট শিশুদের মায়ের কোল থেকে কেড়ে নেওয়া যায়? তাহলে শিশুদের কে দেখবে? কে খাওয়াবে? কে কান্না থামাবে? আজ ওদের সামনে এতটুকু সান্ত্বনা দেওয়ার কেউই নেই৷ রয়েছে শুধু মার্কিন প্রশাসনের দানবরা– যাদের দেখে আঁতকে উঠছে এই নিষ্পাপ শিশুগুলি৷ কেন আঁতকে উঠছে? কী করছে তারা? এই শিশুদের কান্না যাতে হাজার মানুষের বিবেককে না জাগাতে পারে সেই লক্ষ্যে ইনজেকশনের সিরিঞ্জ নিয়ে এদের সামনে হাজির তারা৷ এক একটা বাচ্চাকে ধরে ইনজেকশন দিয়ে শরীরে এমন ড্রাগ ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে যে, তাদের কান্নার ক্ষমতাই আর থাকবে না, মাথা ঝিমঝিম করবে, হাঁটতে পারবে না, ঘুমোতে পারবে না, মারাত্মক অবসাদের শিকার হবে৷

কোনও শিশু কি এই ইনজেকশন নিতে চায়? ওদের প্রতিবাদের একটাই রাস্তা, কান্না, আরও জোরে কান্না৷ এই কান্না যদিও বা নিষ্প্রাণ পাথরকে স্পর্শ করে, সাম্রাজ্যবাদের প্রতিভূ মার্কিন প্রশাসনের কর্তাদের হৃদয়কে স্পর্শ করে না৷ তারা হিংস্র পশুর মতো এই শিশুদের মারতে মারতে গর্জন করছে, ‘যদি মায়ের কাছে যেতে চাও ইনজেকশন নাও৷’ এই বর্বরতা, এই অমানুষতা কীসের ফল? একি কোনও সভ্য সরকারের কাজ? যে আমেরিকায় এক সময় উদার গণতন্ত্রের বিকাশ ঘটেছে, যে আমেরিকার স্ট্যাচু অব লিবার্টি বিশ্ববাসীর নজর কাড়ে, শিশু পীড়নের এই দানবীয় ঘটনা দেখাল আমেরিকায় লিবার্টি আজ শুধুই একটি স্ট্যাচু৷পার্লামেন্টারি গণতন্ত্রের কি নিষ্ঠুর পরিণাম!

বেঁচে থাকলে কী বলতেন রবীন্দ্রনাথ? প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে এসে বলতেন, ‘সভ্যের বর্বর লোভ নগ্ন করল আপন নির্লজ্জ অমানুষতা’৷ বলতেন, ‘নারীঘাতী, শিশুঘাতী কুৎসিত এ বীভৎসা পরে ধিক্কার হানিতে পারি যেন’৷

বিশ্বজুড়েই রয়েছে শরণার্থী সমস্যা৷ এই সমস্যা মেটাতে হবে আন্তর্জাতিক রীতি–নীতির ভিত্তিতে, মানবিক দৃষ্টিতে৷ তাহলে কেন আমেরিকা এমন দানবীয় শরণার্থী নীতি গ্রহণ করেছে? জাতীয়তাবাদের মোড়কে এই নিষ্ঠুরতা ঢাকতে ট্রাম্প ঘোষণা করেছেন আমেরিকাকে তিনি শরণার্থীদের দেশ হতে দেবেন না৷ তাঁর এই ঘোষণা একতরফা৷ আন্তর্জাতিক নীতি অনুযায়ী, কোনও দেশ অন্য দেশ থেকে আগত শরণার্থীদের ফিরিয়ে দিতে বা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে না৷ শরণার্থীদের নিজ দেশে ফেরত পাঠাতে হলে পাঠাতে হয় আন্তর্জাতিক রীতি–নীতি মেনেই৷ কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প সব কিছুর ঊর্ধ্বে, তিনি কোনও আইন–কানুনের ধার ধারেন না৷

শরণার্থী সমস্যা পুঁজিবাদী–সাম্রাজ্যবাদী শাসকদেরই সৃষ্টি৷ সাত পুরুষের ভিটেমাটি ছেড়ে স্বেচ্ছায় কেউ শরণার্থী হতে চায়? মানুষ শরণার্থী হয় নিতান্ত বাধ্য হয়ে, অন্য উপায় থাকে না বলেই৷ আমেরিকা নানা দেশ আক্রমণ করে লক্ষ লক্ষ মানুষকে দেশ ছাড়া করে কি শরণার্থী বানায়নি? নানা দেশে সন্ত্রাসবাদী–জঙ্গি কার্যকলাপে মদত দিয়ে তাদের আক্রমণ থেকে বাঁচতে মানুষকে কি এলাকা ছাড়া করেনি? যুদ্ধ এবং সন্ত্রাসবাদ ছাড়াও স্বাভাবিক পরিস্থিতিতেও মানুষ এক দেশ থেকে আরেক দেশে যেতে বাধ্য হয় জীবিকার সন্ধানে, বাঁচার তাগিদে৷ সবসময় এদের বৈধ কাগজপত্র থাকে না৷ সীমান্তে এরা ধরা পড়লে আন্তর্জাতিক রীতি মেনেই সংশ্লিষ্ট দেশগুলিকে ব্যবস্থা নিতে হবে৷ তাহলে আন্তর্জাতিক রীতি নীতি লঙঘন করার অপরাধে, সর্বোপরি নিষ্পাপ শিশুদের উপর নগ্ন হিংস্র আক্রমণের অপরাধে কেন ডোনান্ড ট্রাম্পের শাস্তি হবে না?

ভারতেরও প্রায় ১৫০ জন শরণার্থী আমেরিকার কারাগারে বন্দি৷ বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশ বলে কথিত ভারতের প্রধানমন্ত্রী এই বন্দিদের উদ্ধারের ব্যাপারে একটি কথাও বলছেন না৷ কোথায় তাঁর মন কি বাত? আমেরিকায় ভারতীয় শরণার্থীরা মরে মরুক– এ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কোনও উদ্বেগ নেই কেন তিনি এখন ব্যস্ত কাশ্মীরের নির্বাচিত সরকার ফেলে দিয়ে রাজ্যপালের বকলমে সেনা শাসন চাপাতে৷ পার্লামেন্টারি গণতন্ত্রে এটাই দস্তুর৷ এখানে গণতান্ত্রিক ধ্যান–ধারণা, মানবিক মূল্যবোধের নিষ্ঠুর দলন যে অতি বাস্তব তা ট্রাম্পের দানবীয় শরণার্থী নীতি আবারও স্পষ্ট করে দেখিয়ে দিল৷ ট্রাম্প প্রশাসনের নিষ্ঠুরতার প্রতিবাদে হাজার হাজার শিশুর সমবেত কান্না বিশ্বজুড়ে মানুষকে পথে নামিয়েছে৷ নগ্ন পুঁজিবাদ–সাম্রাজ্যবাদের স্বরূপ দেখিয়ে বিশ্ববাসীর দরবারে শিশুদের কাতর আবেদন ‘‘আমাদের বাঁচাও’’৷

(৭০ বর্ষ ৪৫ সংখ্যা ২৯ জুন, ২০১৮)