‘সনৎদা ছিলেন আত্মপ্রচার বিমুখ’ স্মরণসভায় কমরেড শঙ্কর সাহা

এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)–এর পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির প্রবীণ সদস্য, বিশিষ্ট শ্রমিক নেতা কমরেড সনৎ দত্ত ২৩ ডিসেম্বর ৯০ বছর বয়সে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন৷ রাজ্য কমিটির উদ্যোগে ২ জানুয়ারি তাঁর স্মরণসভা অনুষ্ঠিত হয় কলকাতার মৌলালি যুবকেন্দ্রে সকাল ১১ টায়৷ সভাপতিত্ব করেন রাজ্য সম্পাদক কমরেড সৌমেন বসু৷ সভার শুরুতে সাধারণ সম্পাদক প্রভাস ঘোষ সহ পলিটব্যুরো সদস্য কমরেড রণজিৎ ধর, কমরেড অসিত ভট্টাচার্য মাল্যদান করে শ্রদ্ধা জানান৷ উপস্থিত কেন্দ্রীয় কমিটির ও রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্যবৃন্দও মাল্যদান করেন৷ সভার সূচনায় কমরেড সৌমেন বসু প্রয়াত নেতার জীবনাবসানে শোক প্রকাশ করে একটি প্রস্তাব পেশ করেন৷ সভার অপর বক্তা রাজ্য কমিটির সদস্য, উত্তর চব্বিশ পরগণা জেলা পার্টির প্রাক্তন সম্পাদক কমরেড সদানন্দ বাগলও সংক্ষিপ্ত স্মৃতিচারণা মধ্য দিয়ে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন৷

সভার প্রধান বক্তা কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, সর্বভারতীয় শ্রমিক নেতা কমরেড শঙ্কর সাহা তাঁর ভাষণে বলেন, প্রয়াত কমরেড সনৎ দত্ত  ভারতের শ্রমিক আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন এবং সেটা তিনি করেছেন এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট) পার্টির পথনির্দেশ অনুসরণ করেই৷

তিনি বলেন, ‘‘আমি ১৯৬২ সাল থেকে শ্রমিক আন্দোলনের সাথে যুক্ত, তখন থেকেই কমরেড সনৎ দত্তকে দেখেছি৷ এস ইউ সি আই (সি) দলের প্রতিষ্ঠাতা, সর্বহারার মহান নেতা কমরেড শিবদাস ঘোষ ১৯৫৪ সাল নাগাদ আগরপাড়ায় জুট শ্রমিকদের মধ্যে কাজ শুরু করেছিলেন৷ ১৯৫৫ সালে সেখানে তিনি একটি ইউনিয়ন গড়ে তোলেন৷ ইউনিয়নের কাজ পরিচালনার জন্য তিনি দায়িত্ব দেন কমরেড তাপস দত্ত ও কমরেড সনৎ দত্তকে ৷ পরে সনৎদাকে রেখে তাপসদাকে পাঠিয়ে দেন রৌরকেল্লায় ইস্পাত শিল্পে শ্রমিক সংগঠন গড়ে তোলার কাজে৷

কমরেড সনৎ দত্ত কলেজের কৃতী ছাত্র ছিলেন, কিন্তু কেরিয়ার গড়ে সচ্ছল জীবন যাপনের কথা ভাবেননি৷ টিউশন পড়ানোর টাকায় সনৎদা ও তাপসদার খরচ–খরচা চলত৷ এখন পার্টি অনেক বড় হয়েছে, চাকরিজীবী কর্মী–সমর্থক আছেন৷ কিন্তু গোড়ায় তো এরকম ছিল না, সে সময়ের কথা ভুললে চলবে না৷ প্রবল আর্থিক সংকট ও দারিদ্রের মধ্যে, নানা অসুবিধার মধ্যে গোড়ার দিকের নেতা–কর্মীরা কীভাবে কাজ করেছেন, সেসব কথা আমাদের মনে রাখতে হবে৷

একটি ইউনিয়নের কাজ দিয়ে শুরু করলেও কমরেড সনৎ দত্ত গঙ্গার দুই পাড়ে প্রায় সব চটকলে যেতেন, শ্রমিক বস্তিতে থাকতেন, ক্লাস করতেন৷ দক্ষিণে বজবজ পর্যন্ত যেতেন, আমি তাঁর পিছন পিছন গিয়েছি৷ ট্রেড ইউনিয়নের পাশাপাশি তিনি উত্তর ২৪ পরগণা জেলা পার্টির সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন বহুকাল৷ এখানে একটি কথা বলা দরকার যে, আমাদের অভিজ্ঞতা হচ্ছে, পার্টি ছাড়া ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন গড়ে তোলা একপ্রকার অসম্ভব৷ পার্টিকেই দায়িত্ব নিয়ে কর্মী ডেপুট করে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন গড়ে তুলতে হয়৷ 

কমরেড দত্ত জুট শ্রমিকদের মধ্যে কাজ করেছেন বিপ্লবী নিষ্ঠার সাথে, নিরলসভাবে পড়ে থেকে৷ খুব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তাঁদের সমস্যা তিনি বুঝতেন এবং গভীর দরদ দিয়ে বিভিন্ন বিষয় তাঁদের সঙ্গে আলোচনা করতেন৷ এই কাজ করতে গিয়ে তিনি শ্রমিকদের অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় হয়ে উঠেছিলেন৷ বুকভরা ভালবাসা পেয়েছেন৷ আবার অন্য দিকে তাঁকে সইতে হয়েছে মালিক শ্রেণির পেটোয়া রাজনৈতিক দলগুলোর গুণ্ডাবাহিনীর আক্রমণ৷ ১৯৭২ সালে যখন গণআন্দোলনের উপর, বিশেষত শ্রমিক আন্দোলনের উপর কংগ্রেসের মারাত্মক আক্রমণ নেমে আসে, তখন একবার তাঁকে একা পেয়ে ম্যানেজমেন্টের গুণ্ডারা প্রচণ্ড মারধর করে বেঁধে রাখে প্রবর্তক জুট মিলের সামনে৷ পরে আশপাশের ২–৩টি কারখানার শ্রমিকরা গিয়ে তাঁকে মুক্ত করেন৷ সিপিএম সরকারের আমলেও এরকম ধরনের হামলা তাঁর উপর হয়েছে৷ সাধারণ শ্রমিকরাই তাঁকে রক্ষা করেছেন৷

এ রাজ্যে শ্রমিক আন্দোলনে তাঁর বিরাট পরিচিতি ছিল৷ আন্দোলনের ময়দানে থেকেই এটা হয়েছিল৷ কিন্তু এরকম একটা জায়গায় থেকেও কমরেড সনৎ দত্ত বিপ্লবী সংস্কৃতি আয়ত্তের সংগ্রাম থেকে বিরত হননি৷ এত বড় সংগঠনের নেতা ছিলেন৷ এত নাম–ডাক ছিল, কিন্তু কখনও সামনে আসতেন না৷ এগিয়ে গিয়ে নিজের নামে প্রেসে একটা বিবৃতি দেওয়া – এ সব তাঁর মধ্যে ছিল না৷ আজকাল অনেককে দেখি, এমনকী একটা স্ট্রিটকর্নার মিটিং শেষ করেই অফিসে এসে নিজের কথা লিখে প্রেসে পাঠাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন৷ এ জিনিস জুনিয়ার–সিনিয়ার– অনেকের মধ্যেই দেখছি৷

আমার মনে আছে, দিল্লিতে আমাদের ট্রেড ইউনিয়নের সর্বভারতীয় সম্মেলন হয় বিশাল আকারে৷ বিদেশ থেকে প্রতিনিধিরা এসেছিলেন৷ সনৎ দাকে অনুরোধ করা হয়েছিল নতুন কমিটির নামগুলো পড়বার জন্য৷ সেখানে তাঁর নিজের নাম ছিল না৷ তিনি হাসিমুখে সেই কমিটির নাম পড়ে দিয়েছিলেন৷ নিজের নাম না থাকার জন্য এতটুকু ব্যথা পাননি৷ শেষে বলেছিলেন, ‘এখানে যাঁদের নাম আছে তাঁরা অত্যন্ত যোগ্যতার সাথে দায়িত্ব পালন করতে পারবে বলে আমি বিশ্বাস করি৷ আপনারা এঁদের সমর্থন করুন’৷ আরেকবার ২০০৮ সালে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সম্মেলনে তাঁকে সভাপতির পদ থেকে সহ–সভাপতি করা হয়৷ তখন, আমার যদ্দুর মনে আছে, উত্তর ২৪ পরগণারই কয়েকজন এ নিয়ে প্রশ্ন তুললে তিনি তাঁদের বোঝান৷ বলেন, ‘এরকম হতেই পারে৷ সাংগঠনিক প্রয়োজনে সভাপতি থেকে সহ–সভাপতি হওয়ার মধ্যে কী সমস্যা আছে?’কত বড় মনের অধিকারী হলে এ জিনিস হতে পারে ভেবে দেখবেন৷ আমি অনেকের মধ্যে দেখি, কমিটিতে নাম আছে কি না, থাকলে কত নম্বরে আছে– এ সব নিয়ে মন খারাপ হয়ে যায় তাঁদের৷ কয়েকদিন কাজকর্ম করতে ইচ্ছা করে না৷ আসলে ব্যক্তিবাদ প্রতিনিয়ত আমাদের কুরে কুরে খাচ্ছে৷ এর বিরুদ্ধে সংগ্রামটাও প্রতিনিয়ত জারি না থাকলে মুশকিল৷ আমরা একবার ব্যক্তিবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করি, তারপরও আক্রমণ আসে, আবার সংগ্রাম করতে হয়৷ সনৎ দত্ত এই সংগ্রাম করতে পেরেছিলেন মহান শিক্ষক কমরেড শিবদাস ঘোষের আদর্শের শক্তিতে৷ শিবদাস ঘোষ যে পার্টি গড়েছেন অর্থাৎ এস ইউ সি আই (সি) পার্টি, এই পার্টিই একমাত্র পার্টি যে আজকের এই প্রবল ব্যক্তিবাদী আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করছে৷

আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আমি বলব৷ সনৎদা কমরেডদের প্রবল স্নেহ করতেন, ভালবাসতেন৷ আমি যতটুকু দেখছি, ইদানীং কমরেডদের মধ্যে ভালবাসার সম্পর্কের খুবই অভাব৷ শুধু কাজের সম্পর্ক৷ এটা কর, ওটা কর– নির্দেশ দিচ্ছি, অর্ডার করছি৷ বহু কমরেড কাজ করছে কিন্তু বুকের মধ্যে হাহাকার৷ তারা একটু স্নেহ চায়, ভালবাসা চায় সিনিয়রদের কাছ থেকে,  নেতাদের কাছ থেকে৷ আমাদের মনে রাখতে হবে, আমরা সাধারণভাবে সকলেই পার্টিকে ভালবাসি৷ কিন্তু এটা সাধারণ কথা৷ কোনও কংক্রিট ফর্ম নয়৷ যেমন বিপ্লবকে ভালবাসি কথাটা কোনও কংক্রিট এক্সপ্রেশন নয়৷ বিপ্লবকে ভালবাসি মানে বিপ্লবী পার্টিকে ভালবাসি৷ তেমনি বিপ্লবী পার্টিকে ভালবাসি মানে কী? মানে পার্টি কমরেডদের ভালবাসি৷ এটাই কংক্রিট ফর্ম অব লাভ টু দি পার্টি অ্যান্ড রেভলিউশন৷ সনৎদা সকলকে ভালবাসতেন৷ বেশির ভাগই ছিল বয়সে অনেক ছোট৷ তুই তুই করে বলতেন৷ আমাদের বয়স একটু বেশি ছিল বলে তুমি বলতেন৷

একবার তিনি হূদরোগে আক্রান্ত হন৷ দিল্লি ই এস আই ম্যানেজমেন্টের লোকেরা প্রস্তাব দেন এআইআইএমএস–এ চিকিৎসা করাবার জন্য৷ পেসমেকার বসাতে হবে, অনেক খরচ এবং তার পরেও চিকিৎসা চলবে, তারও খরচ আছে৷ দিল্লির এআইআইএমএস– ভারতের বিখ্যাত হাসপাতাল–আপনারা জানেন৷ ইএসআই ম্যানেজমেন্ট কর্তারা বলেন, ‘ট্রেড ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি হিসাবে সনৎবাবুর জন্য ব্যবস্থা আছে৷ কারণ তিনি ইএসআই–এর বোর্ডে এআইইউটিইউসি–র প্রতিনিধি৷ ফ্রিতে চিকিৎসা করাতে পারেন৷ আমরা সব ব্যবস্থা করে দেব’৷ সনৎদা সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বলেন, ‘ইএসআই শ্রমিক–কর্মচারীদের্ জন্য৷ তাঁরা সেখানে টাকা দেন, আমি তো দিই না৷ আমি তাঁদের প্রতিনিধি মাত্র৷ আমার চিকিৎসার জন্য আমার পার্টি যা করার করবে’৷ এখানে ডাঃ সুভাষ দাশগুপ্ত আছেন৷ উনি জানেন৷ সনৎদার পেসমেকার বসানো হয়েছিল হার্ট ক্লিনিকে৷ এটা দিয়েই হার্ট ক্লিনিকে পেসমেকার বসানো শুরু হয়৷ আরও একবার তাঁর অসুস্থতার খবর পেয়ে ম্যানেজমেন্টের এক কর্তা চিকিৎসার প্রস্তাব নিয়ে তাঁর বাড়ি যেতে চান৷ সনৎদা শোনামাত্র তা খারিজ করে দেন৷

আপনারা জানেন, জোকা ইএসআই হাসপাতালের কথা৷ ওই হাসপাতাল একবার তুলে দেওয়ার চক্রান্ত হয়েছিল৷ সনৎদা সেখানকার ডাক্তার–নার্স–কর্মচারীদের নিয়ে আন্দোলন করেন এবং হাসপাতাল রক্ষা করেন৷ খুশি হয়ে ডাক্তার ও কর্মচারীরা লোক–লস্কর নিয়ে সনৎদার ঘোলার বাড়িতে যান বাড়ি রঙ করে দেবেন বলে৷ সনৎদা তাঁদের বুঝিয়ে সুঝিয়ে ফেরত পাঠিয়ে দেন৷ কোনও সময় এ সব কথা তিনি বলতেন না৷ তিনি ছিলেন আত্মপ্রচার বিমুখ৷

শেষ যে কথাটা আবারও বলতে চাই, এই প্রবল ব্যক্তিবাদী আক্রমণের সময় আমরা প্রতিনিয়ত আক্রান্ত হচ্ছি৷ প্রতিনিয়ত যদি আমরা এর বিরুদ্ধে সংগ্রাম না করি তা হলে সব নষ্ট হবে৷ এই কথাগুলি আমাদের মনে রাখতে হবে সব সময়৷’’