সন্ত্রাসবাদী বুঝেও অসীমানন্দকে শাস্তি দিতে পারলেন না বিচারপতি

দিল্লি থেকে লাহোরগামী সমঝোতা এক্সপ্রেসে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ৬৮ জন নিরীহ যাত্রীকে মেরেছিল সন্ত্রাসবাদীরা৷ জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা এনআইএ (ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেটিং এজেন্সি)–র প্রত্যক্ষ সহায়তায় আদালতে পুরোপুরি ছাড় পেয়ে গেল সেই সন্ত্রাসবাদীরা৷ কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের নির্দেশ ছাড়া যে তারা এমন বেকসুর হতে পারত না তা যে কোনও মানুষই বুঝছেন৷ এমনকী এনআইএ–র বিশেষ আদালতের বিচারক জগদীপ সিং পর্যন্ত অনুভব করেছেন, সন্ত্রাসবাদীরা ৬৮ জন মানুষকে হত্যা করল, অথচ তার সঠিক তদন্ত এবং খুনিদের বিচারের প্রতি কোনও আগ্রহই দেখাল না এনআইএ এবং সরকারি উকিল৷ সরকারের যোগসাজস আরও বোঝা গেল যখন বিচারকের পূর্ণাঙ্গ রায় জনসমক্ষে আসার আগেই  কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী বিবৃতি দিয়ে জানিয়ে দিলেন, সরকার উচ্চ আদালতে এই রায়ের বিরুদ্ধে কোনও অ্যাপিল করবে না৷

সন্ত্রাসবাদ নির্মূল করার নামে বিজেপি সরকারের এত ঢাক পেটানো যে কেবল মাত্র ভোটে বাজার গরমের চেষ্টা ছাড়া আর কিছুই নয়, এই ঘটনা তা আবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল৷

২০০৭ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি মাঝরাতে সমঝোতা এক্সপ্রেসে সন্ত্রাসবাদীদের ঘটানো বিস্ফোরণে ৪৩ জন পাকিস্তানি নাগরিক সহ ৬৮ জনের মৃত্যু ঘটে৷ আরও দুই বাক্স বোঝাই না ফাটা বোমা উদ্ধার হয়৷ অভিযোগ ওঠে হায়দরাবাদের মক্কা মসজিদ, মহারাষ্ট্রের মালেগাঁও, রাজস্থানের আজমির শরিফের মতোই এই বিস্ফোরণের পিছনে উগ্র হিন্দুত্ববাদী সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠী ‘অভিনব ভারত’ সহ আরএসএস–বিজেপি ঘনিষ্ঠ কিছু সংগঠনই ধর্মীয় বিদ্বেষ থেকে এই ঘটনা ঘটিয়েছে৷ এই ঘটনাগুলির মতোই সমঝোতা এক্সপ্রেসের বিস্ফোরণে সুনীল কুমার জোশী এবং নব কুমার সরকার ওরফে স্বামী অসীমানন্দের নামই প্রধান চক্রী হিসাবে উঠে আসে৷ কিন্তু তৎকালীন কংগ্রেস সরকারও যেমন হিন্দু ভোটব্যাঙ্ক হারাবার আশঙ্কায় এই হামলায় হত্যাকারীদের শাস্তি দেওয়ার কোনও আন্তরিক চেষ্টা করেনি, একইভাবে বিজেপি ২০১৪ সালে কেন্দ্রীয় সরকারে এসে এনআইএ–র উপর প্রভাব খাটিয়ে এই মামলাকে পুরোপুরি শেষ করে দেওয়ার চক্রান্ত করে গেছে৷

এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ মামলার বিচারক আক্ষেপ করে বলেছেন, দিল্লি স্টেশনের সিসিটিভি ফুটেজ থেকে শুরু করে নানা গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ এনআইএ হেফাজতে নিলেও তা কখনওই আদালতের কাছে ‘অন রেকর্ড’ প্রমাণ হিসাবে দাখিল করেনি৷ তাঁর পর্যবেক্ষণ, ২৯৯ জন সাক্ষীর নাম থাকলেও আদালতে হাজির করা হয়েছিল ২২৪ জনকে৷ তাদের মধ্যে ৫১ জন বারবার বয়ান বদলাতে থাকে, এনআইএ–র হয়ে সরকারি উকিল তাদের জেরা এবং প্রশ্নোত্তরের সামনে ফেলে সত্যটা বার করে আনার চেষ্টাই করেননি৷ এনআইএ–র গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী ডাঃ রাম প্রতাপ সিং বলেছিলেন, তিনি নিজের কানে শুনেছেন যে, স্বামী অসীমানন্দ ভোপালের একটি সভায় ঘোষণা করেছিলেন, জিহাদিদের পথেই হিন্দুদেরও পাল্টা আক্রমণে যেতে হবে৷ বলেছিলেন, ‘বম্ব কা বদলা বম্ব’৷ বিচারক তাঁর রায়ে উল্লেখ করেছেন যে, এমন একজন সাক্ষীকে সরকারপক্ষ কাজেই লাগায়নি, তাঁকে আদালতে দাঁড়িয়ে জেরা করে তাঁর বয়ানকে সঠিক সাক্ষ্যপ্রমাণ হিসাবে আদালতগ্রাহ্য করার চেষ্টাই করেনি৷ যে সুটকেস দু’টিতে না ফাটা বোমাগুলি ছিল এবং যে সুটকেসগুলির বোমা ফেটেছিল তার টুকরোগুলি মিলিয়ে ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞরা বলেছিলেন এগুলি একই হাতে তৈরি৷ এই সব সুটকেসের কভারগুলি সেলাই করেছিল ইন্দোরের যে দর্জি, যে কারখানায় সেগুলি বানানো হয়েছিল, পুলিশ তার সন্ধান পেয়েছিল৷ বিচারক আশ্চর্য হয়ে বলেছেন, ওই সুটকেস এবং তার কভারগুলির ক্রেতাদের শনাক্ত করার জন্য ওই দর্জি এবং সুটকেস বিক্রেতাকে কেন এনআইএ এবং সরকারি আইনজীবী ‘টিআই প্যারেডে’ ডাকেনি, তা একমাত্র তারাই বলতে পারবে!

আদালত আরও বলেছে, এই অভিযুক্তরা যে ঘটনার আগের দিন ইন্দোর থেকে নিজামুদ্দিন স্টেশনে এসেছিল, তারা ঘটনাস্থল ভাল করে রেকি করার জন্য বেশ কয়েকবার পুরনো দিল্লি রেলস্টেশনের ডরমিটরিতে থেকেছে, তার তথ্য আছে বলে এনআইএ এবং সরকারি আইনজীবী মুখে উল্লেখ করলেও সরকারি ভাবে আদালতে কিছু প্রমাণ পেশ করেনি৷ যেমন পেশ করেনি অভিযুক্তদের ফোনের ‘ডিটেল কল রেকর্ডস’৷ ঘটনার আগে এবং পরে এরা নিজেদের মধ্যে কতবার ফোন করেছে, কাকে কাকে ফোন করেছে তার বিস্তারিত তথ্য এনআইএ এবং সরকারি আইনজীবীর কাছে আছে বলে উল্লেখ করা হলেও সরকারিভাবে ‘অন রেকর্ড’ আদালতে জমা দেয়নি সরকারপক্ষ৷ এমনকী অভিযুক্তরা বোমা রাখার পর কীভাবে কোথায় আশ্রয় নিয়েছিল তা মুখে বললেও এনআইএ সেগুলি আদালতে নথিভুক্ত করেনি৷ আন্তর্জাতিক ট্রেনে ওঠার আগে যাত্রীদের কিছু ফর্মে স্বাক্ষর করতে হয়, তা না হলে ওই প্ল্যাটফর্মেই কেউ ঢুকতে পারে না৷ আদালত আক্ষেপ করে বলেছে হস্তরেখা বিশারদের সাহায্যে এগুলি অভিযুক্তদের হাতের লেখার সাথে মেলালে সহজেই তাদের ধরা যেত৷ কিন্তু না সরকারি উকিল, না এনআইএ কেউই এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নেয়নি৷ ফলে বিচারককে আক্ষেপ করে বলতে হয়েছে, এমন নৃশংস হত্যাকাণ্ডে কিছুই প্রমাণিত না হওয়াটা একজন বিচারক হিসাবে তাঁর কাছে বেদনাদায়ক৷

এর আগে হায়দরাবাদের মক্কা মসজিদে বিস্ফোরণের মামলাতেও বিচারক রায় দিতে গিয়ে এমনই আক্ষেপ জানিয়েছিলেন৷ শুধু তাই নয়, এনআইএ–র বিশেষ আদালতের বিচারক এই মামলার পরেই ইস্তফা দিয়েছিলেন৷ এই মামলার একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ ছিল অসীমানন্দের সঙ্গে একই জেলে থাকা এক বন্দির বয়ান৷ যে আদালতকে জানিয়েছিল অসীমানন্দ তার কাছে অপরাধের কথা কবুল করেছে৷ কিন্তু সে আর অসীমানন্দ যে একই সময় একই জেলে ছিল, তা এনআইএ আদালতে সুনির্দিষ্টভাবে প্রমাণ করেনি৷ তার জন্য দরকার ছিল জেল রেজিস্টারটি আদালতে হাজির করা, অথচ এই সামান্য এবং সহজলভ্য প্রমাণটিও এনআইএ আদালতে দাখিল করেনি৷

২০০২ সালে নরেন্দ্র মোদির মুখ্যমন্ত্রীত্বে রাজ্য সরকার এবং বিজেপি ও সংঘ পরিবারের প্রত্যক্ষ পরিচালনায় গুজরাটে সংখ্যালঘু নিধনযজ্ঞ সংঘটিত হয়েছিল৷ তার কোনও তদন্তই গুজরাট সরকার করতে দেয়নি৷ শুধু তাই নয়, যে পুলিশ অফিসার এই নিধনযজ্ঞের প্রধান চক্রান্তকে ফাঁস করে দিয়েছিলেন, তাঁকে মিথ্যা মামলায় জেল খাটিয়েছে বিজেপি সরকার৷ দুই হাজারের বেশি মানুষ নিহত হলেও এই হত্যাকাণ্ডের মূল রূপকার বলে সারা দেশ যাদের জানে, যাদের বিরুদ্ধে সরাসরি প্রমাণ আছে, যারা নিজেরাই এই হত্যার জন্য নিজেদের গর্বিত বলেছে, সংঘ পরিবার–বিজেপির সেই সব নেতার গায়ে আঁচড়টুকুও পড়েনি৷ ভুয়ো সংঘর্ষে হত্যার মামলায় বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতির বিরুদ্ধে যে সমস্ত সাক্ষী দাঁড়িয়েছিলেন তাঁদের বহুজনেরই রহস্য মৃত্যু ঘটেছে৷ এমনকী একজন বিচারক, যিনি অমিত শাহকে ভুয়ো সংঘর্ষ মামলা থেকে ছাড় দিতে অস্বীকার করেছিলেন, তাঁর আকস্মিক মৃত্যু নিয়েও আছে রহস্য৷

সমঝোতা এক্সপ্রেসে বিস্ফোরণ মামলা নিয়ে আজ বিজেপি নোংরা খেলা খেলল, একথা ঠিক৷ কিন্তু তাকে সেই সুযোগ করে দিয়ে গেছে তো কংগ্রেস সরকারই৷ তারাই এই সন্ত্রাসবাদীদের উগ্র হিন্দুত্ববাদী পরিচয়ের জন্য তাদের বিরুদ্ধে মামলা ঠিকমতো সাজায়নি প্রথম থেকেই৷ কারণ একদিকে তাদের চেষ্টা ছিল উগ্র হিন্দুত্ববাদের আগ্রাসী রূপকে দেখিয়ে সংখ্যালঘু মানুষের ত্রাতা সাজা, আবার অন্যদিকে হিন্দু সেন্টিমেন্ট তুলে এর ফয়দা নেওয়৷ বিজেপি তার থেকেও বেশি উগ্রতা দেখিয়ে কংগ্রেসের পালের সেই হাওয়া কেড়ে নেওয়ায় কংগ্রেস এখন মহা সাধু সাজছে বাস্তবে কংগ্রেসই বিজেপির এই সাম্প্রদায়িক রাজনীতির জমি তৈরি করে দিয়ে গেছে৷ যার ফলভোগ করছে সারা দেশের সাধারণ মানুষ৷                                                                                                                               

(গণদাবী : ৭১ বর্ষ ৩৪ সংখ্যা)