সংকট গভীর বুঝেই উদ্ভট দাওয়াই অর্থমন্ত্রীর

মাত্র কিছুদিন আগেই ভারতের অর্থমন্ত্রীর মুখে একটি অসাধারণ তত্ত্ব শুনেছেন দেশবাসী। আইএমএফ এবং বিশ্বব্যাঙ্কের ‘ডেভলপমেন্ট কমিটি’-র সভায় যোগ দিয়ে তিনি বলেছিলেন, টাকার দাম কমেনি। ডলারের দামটা বেড়ে যাওয়ার ফলে টাকাকে কমদামী মনে হচ্ছে। তিনি প্রবল আস্ফালন করে বলেছেন, বিশ্ব জুড়ে চরম ভূ-রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং সংকট সত্ত্বেও ভারতের অর্থনীতি খুব শক্তিশালী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ভারতের অর্থনীতির মূল বিষয়গুলি এতটাই বলবান যে কোনও সংকটই তাকে ছুঁতে পারবে না।

অথচ, দেশের মানুষ তাঁদের প্রতিদিনের অভিজ্ঞতা থেকে জানেন এ আস্ফালন কতবড় মিথ্যা। মূল্যবদ্ধির চড়া হার, মানুষের প্রকৃত আয় ক্রমাগত কমতে থাকা, মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন এবং আর্থিক বৃদ্ধির নিম্নগামিতা আর যাই হোক কোনও অর্থনীতির শক্তিকে সূচিত করে না। বরং জনগণের শোচনীয় দশা বুঝিয়ে দেয় ভারতীয় অর্থনীতি কোন তলানিতে দাঁড়িয়ে আছে।

ভারত সরকারের রাজকোষ ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১৭ লক্ষ কোটি টাকার বেশি। এই ঘাটতির বেশিরভাগটাই হয়েছে বাজার থেকে নেওয়া ভারত সরকারের ঋণের কারণে। অর্থমন্ত্রীর সর্বশেষ বাজেট বত্তৃতা অনুযায়ী ভারত সরকারের ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৪.১ লক্ষ কোটি টাকা। যদিও গত ৩০ জুনের হিসাব অনুযায়ী ভারত সরকারের মোট ঋণ ৫০ লক্ষ কোটি টাকারও বেশি। কেন্দ্রীয় সরকারের মোট রাজস্ব আদায়ের ৪৫ শতাংশই খরচ হয় এই ঋণের সুদ মেটাতে। এই ঋণ আরও বাড়ার আশঙ্কা সরকারই করছে। তাতে সুদের পরিমাণও বাড়বে, কমবে সরকারের খরচ করার মতো টাকার ভাণ্ডার। এর সাথে কমছে কর বহির্ভূত উৎস থেকে আসা সরকারের আয়।

কেন এই সংকট? সে প্রশ্ন উঠলেই অর্থমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে মন্ত্রিসভার সব সদস্য এবং তাঁদের পেটোয়া অর্থনীতিবিদ-আমলারা কয়েকটি কারণের সাফাই ফাটা রেকর্ডের মতো বাজাতে থাকেন– বিশ্ববাজারের অস্থিরতা, রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ, তেলের চড়া দর, ডলারের তুলনায় টাকার দামের পতন ইত্যাদি। অর্থাৎ যেন কেবলমাত্র বাইরের কিছু বিষয়ের প্রভাবের জন্যই ভারতীয় অর্থনীতি এবং জনগণের দুর্দশা বাড়ছে। কিন্তু সত্যিই কিছু বাইরের কারণই জনগণের দুর্দশার জন্য একমাত্র দায়ী! বাস্তব কিন্তু তা বলে না, পুঁজিবাদের বিশ্বজোড়া সংকটের কিছু প্রভাব ভারতীয় পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে পড়বেই। কিন্তু সেটাই সব নয়। ভারতীয় ধনকুবেরদের সীমাহীন শোষণের পথ করে দিতে ভারত সরকার জনগণের সাথে যে বিশ্বাসঘাতকের ভূমিকা পালন করছে তা জনগণের দুর্দশা আরও বাড়িয়েছে। প্রতিদিন নানা সংস্থার সমীক্ষা এবং শহর গ্রামের বাস্তব চিত্র দেখাচ্ছে বিরাট সংখ্যক মানুষ দু’মুঠো ভাতের সংস্থান করতেই এমন নাজেহাল যে মাছ ডিমের মতো পুষ্টিকর খাবার তো দূরের কথা এক পাতা শ্যাম্পু বা একটা সাবান কিনতেও ইতস্তত করছে। রোজগার নেই, কাজের কোনও নিশ্চয়তা নেই, বহু রাজ্যে ১০০ দিনের কাজের টাকাও মিলছে না। ক্ষুধা অপুষ্টির সূচকে ভারতে স্থান হয়েছে একেবারে নিচের সারিতেই। অথচ এর মধ্যেই দেশের একদল ধনকুবেরের সম্পদ বিপুল হারে বেড়ে চলেছে। দেশের একচেটিয়া মালিকদের মুনাফাকে নিশ্চিত করা শুধু নয়, তা ক্রমাগত যাতে বেড়ে চলতে পারে তার জন্য কেন্দ্রীয় সরকার নানা পদক্ষেপ নিয়ে চলেছে। বুর্জোয়া অর্থনীতিবিদ থেকে শুরু করে কর্পোরেট সংবাদমাধ্যমের কলমচিরা বলেন, সরকার জনগণকে এখনও যতটুকু ছিটেফোঁটা ভর্তুকি দেয়, ১০০ দিনের কাজ বা স্বাস্থ্য-শিক্ষায় যে সামান্য টাকা খরচ করে, সেটাই রাজস্ব ঘাটতির কারণ। অথচ বাস্তব হল কেন্দ্রীয় সরকার জিএসটি এবং অন্য মাধ্যমে জনগণের ঘাড় ভেঙে যত পরোক্ষ কর, সেস ইত্যাদি আদায় করে থাকে তার থেকে অনেক বেশি তারা ছাড় দেয় কর্পোরেট ট্যাক্সে, পুঁজিপতিদের প্রত্যক্ষ করে। বৃহৎ পুঁজিপতিরা ব্যাঙ্কের থেকে নেওয়া লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে মেরে দিলে কেন্দ্রীয় সরকার তা আদায় করার চেষ্টার বদলে ব্যাঙ্কের খাতা থেকে তা মুছে দিয়ে সেই টাকা সরকারি কোষাগার থেকে মিটিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করে। জনগণের জন্য পেট্রল-ডিজেল-কেরোসিন-গ্যাসে যতটুকু সরকারি ভর্তুকি বরাদ্দ ছিল তাও বন্ধ। স্বাস্থ্য-শিক্ষা থেকে শুরু করে জনকল্যাণমূলক খাতে সরকার ক্রমাগত বরাদ্দ কমাচ্ছে। করোনা মাহামারির সময়েও কেন্দ্রীয় সরকার প্যাকেজের নামে বিপুল অর্থ দিয়েছে বৃহৎ পুঁজিপতিদের, অথচ সাধারণ মানুষের রোজগারহীনতায় ক্ষতিপূরণ দিতে, পরিযায়ী শ্রমিকদের সুষ্ঠভাবে খাদ্য এবং আশ্রয় দিতে, তাদের ঘরে ফেরাতে এক টাকাও বরাদ্দ করেনি। বিনামূল্যে কিছুদিন রেশনে চাল-গম দেওয়ার কথা বললেও ক্রমাগত তার পরিমাণ কমছে শুধু তা নয় সরকার বন্ধ করে দেওয়ারও কথা বলছে।

অর্থমন্ত্রী যতই আশার বাণী শোনান না কেন তাঁরও অস্বীকার করার উপায় নেই যে, মূল্যবৃদ্ধির পরিমাণ ভয়াবহ। গত এক বছরে ভোজ্য তেল, চাল, গম, চিনি, আটা ইত্যাদির যে পরিমাণ দাম বেড়েছে তা অতীতের সমস্ত মূল্যবৃদ্ধির রেকর্ডকে ছাপিয়ে গেছে। ভোজ্য তেলের মূল্য ১৪০ শতাংশ বাড়ার পর মাত্র ৯ শতাংশ কমতেই সরকার দাবি করছে দাম কমছে। খাদ্য ছাড়াও জনগণের অতিপ্রয়োজনীয় সমস্ত সামগ্রীর দাম বেড়েছে আকাশছোঁয়া। ওষুধ এবং চিকিৎসা সরঞ্জামের দাম যা বেড়েছে তাতে কোনও সাধারণ মানুষের পক্ষে চিকিৎসা করানোই বিরাট বিলাসিতার সামিল। কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক কয়েক দফায় সুদ বাড়িয়ে দাবি করছে এই পথে মূল্যবৃদ্ধি কমবে। বুর্জোয়া অর্থনীতির টে’টবই তুলে ধরে সরকারের নীতিনির্ধারকরা বলছেন, এর ফলে মানুষ খরচ কমিয়ে বেশি সঞ্চয় করবে।

বইতে লেখা আছে মানুষের হাতে বেশি টাকা থাকলে তারা বেশি জিনিস কেনে, ফলে চাহিদা বাড়ে এবং মূল্যবৃদ্ধি ঘটে। আজকের ভারতের অবস্থা কি তাই? বাস্তব পরিস্থিতি হল মানুষের হাতে কেনার মতো টাকাই নেই। বেশি জিনিস কিনবে কি সামান্য দরকারি জিনিসই অধিকাংশ মানুষ কিনতে পারছে না। মূল্যবৃদ্ধি ঘটছে মুষ্টিমেয় একচেটিয়া মালিকের সুপার প্রফিটের লালসা চরিতার্থ করার জন্য। বুর্জোয়া অর্থনীতির ভাষাতেই ভারতের আজকের পরিস্থিতিকে বলা যেতে পারে ‘স্ট্যাগফ্লেশন’ অর্থাৎ মন্দা, অর্থনীতির অচলাবস্থা ও মুদ্রাস্ফীতির মিশ্রণে তৈরি এক সম্পূর্ণ অচল দশা। ভারতের অর্থমন্ত্রী কিংবা তাঁদের স্নেহধন্য বুর্জোয়া অর্থনীতির পণ্ডিতরা যে সত্যটা স্বীকার করতে ভয় পান–তা হল কোনও টোটকাতেই মরণের পথে চলা আজকের পুঁজিবাদী অর্থনীতির সংকটের রোগ কাটার নয়। আর এই সত্যটা জানেন বলেই অর্থমন্ত্রী আইএমএফ-বিশ্বব্যাঙ্কের সভায় সংকট মোচনের উদ্ভট কিছু দাওয়াইয়ের কথা আওড়েছেন। তিনি বলেছেন, করোনা ভ্যাকসিনের উৎপাদন ও বেশি লোককে তা দিতে পারা, ডিজিটাল মাধ্যমে লেনদেন ও সুবিধা প্রদান বাড়ানো, জ্বালানি তেলের ওপর কিছুটা শুল্ক কমানো ইত্যাদি পদক্ষেপের ফলেই ভারত সংকট কাটিয়ে উঠতে চলেছে। অর্থমন্ত্রী তাঁর প্রধানমন্ত্রীর মতোই ধান ভানতে শিবের গীত গেয়ে অবান্তর কথা বলে আসল বিষয় থেকে মানুষের দৃষ্টি ঘুরিয়ে দেওয়ার কায়দা ভালই রপ্ত করেছেন সন্দেহ নেই।

যে কোনও বুর্জোয়া ক্ষমতাসীন দলের মতোই বিজেপি পুঁজিপতি শ্রেণির সেবাদাস হিসাবেই কাজ করছে। তাদের সরকার পুঁজিপতি শ্রেণির রাজনৈতিক ম্যানেজার। পুঁজিবাদের সংকট যত বাড়ছে তত বাড়ছে তার নিষ্ঠুর শোষণের মাত্রা। বিজেপির সরকার তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়িয়ে চলেছে দেশের সাধারণ মানষের ওপর তার আক্রমণ। অর্থমন্ত্রী জানতেন তিনি আইএমএফ-বিশ্বব্যাঙ্কের যে সব ঝানু আমলা ও শিল্পপতিদের সামনে বক্তব্য রাখছিলেন, তারা এই সব বাগাড়ম্বরের আসল মানে ঠিক বোঝে। তারা বুঝে নেবে দেশের মানুষকে অবাধ শোষেণের ছাড়পত্র দিতে, মানুষকে রক্তশূন্য করে দিতে যে কোনও পদক্ষেপে বিজেপি সরকার পিছপা নয়। বিনিয়োগের নামে পুঁজিপতিরা শোষণ মৃগয়ায় যত মাতবে তত ভরে উঠবে বিজেপির ওপর পুঁজিপতিদের আশীর্বাদের ঝুলি। আজকের দিনে মানুষের কল্যাণ নয় পুঁজিপতি শ্রেণির আশীর্বাদই সরকারি গদিলাভের একমাত্র নিশ্চিত রাস্তা। তাই মিথ্যার ঝুড়ি খুলে ধরতে অর্থমন্ত্রীর লজ্জাবোধ হয়নি। কিন্তু বাস্তাবের আঘাতে জর্জরিত মানুষ এ মিথ্যাকে একদিন চিনবেই।