শ্রমিক–কৃষক–সাধারণ মানুষের দাবি নিয়ে  ১৩ নভেম্বর নবান্ন অভিযান

ফিরছে পাশ–ফেল প্রথা৷ খবরের কাগজের হেডিংয়ে কথা ক’টি দেখেই উচ্ছ্বসিত কলেজ স্ট্রিট নিবাসী এক প্রৌঢ়া প্রায় জড়িয়ে ধরলেন এস ইউ সি আই (সি)–র এক কর্মীকে– আমিও আপনাদের আন্দোলনের শরিক হয়ে সই করেছিলাম৷ আমার মেয়ে তখন স্কুলে পড়ত, বন্ধুদের দিয়ে সই করিয়েছিল সে–ও৷ এমনই অনুভূতি আজ পশ্চিমবঙ্গের কোটি কোটি মানুষের৷ দীর্ঘ আন্দোলনের এই ধারাবাহিকতায় তাঁরা সকলেই যে শরিক!

এস ইউ সি আই (সি) দলের ১৯ বছর ধরে চলেছিল প্রাথমিক স্তরে ইংরেজি ফিরিয়ে আনার আন্দোলন৷ পাশ–ফেল প্রথা ফেরানোর আন্দোলন চলেছে ৪০ বছর ধরে৷ অবশেষে সরকার মেনে নিল পঞ্চম আর অষ্টম শ্রেণিতে ফিরবে পাশ–ফেল৷ এই দীর্ঘ সময়ে লক্ষ লক্ষ ছাত্রছাত্রী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে৷ আন্দোলনের চাপে সরকার একের পর এক কমিশন বসিয়েছে৷ সেই সব কমিশনও এই ক্ষতির কথা অস্বীকার করতে না পেরে প্রথম শ্রেণি থেকে পাশ–ফেল চালুর সুপারিশ করেছে৷ শিক্ষাবিদ–বুদ্ধিজীবীরাও একই দাবি তুলেছেন৷ এস ইউ সি আই (সি) দল মার্কসবাদ–লেনিনবাদের উন্নততর উপলব্ধি কমরেড শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারার দ্বারা অর্জিত জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতায় প্রথম থেকেই এই সরকারের পদক্ষেপের আসল উদ্দেশ্য এবং তার ক্ষতির দিক ধরতে পেরে  এর বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেমেছে৷

শুধু যে শিক্ষার বেহাল দশা, তা তো নয়, অসংখ্য সমস্যার ভারে দেশের মানুষ আজ বিপর্যস্ত৷ পশ্চিমবঙ্গও তার ব্যতিক্রম নয়৷ মূল্যবৃদ্ধি, ছাঁটাই, স্কুল ছাত্রদের ড্রপ আউট, বেকারি, নারী নির্যাতন, চাষির আত্মহত্যা প্রভৃতি সমস্যায় জনজীবন জর্জরিত৷ অথচ রাজ্যের তৃণমূল সরকার এগুলির সমাধানের জন্য কী করছে? তাদের কার্যকলাপ দেখলে মনে হয় উৎসব, বিসর্জনের কার্নিভাল, মেলা–খেলা এটাই যেন সরকারের কাজ সরকারের কাজ কি মদের পাইকারি বিক্রির ব্যবস্থা করা? মদ বেচে সবচেয়ে বেশি রাজস্ব এসেছে, এটাই নাকি সরকারের সাফল্য? চাষির ফসলের ন্যায্য দাম কোথায়? কে দেখবে তা? ফড়ে মহাজন, বৃহৎ ব্যবসাদার, কর্পোরেট রিটেল চেনের দালালদের খপ্পর থেকে চাষিকে বাঁচিয়ে ধান, পাট, আলু, সরষে, সবজির ন্যায্য দাম পাইয়ে দেওয়া কি সরকারের কাজ নয়? চাষি দাম না পেলেও বাজারে আলু থেকে শুরু করে সমস্ত সবজির দাম কমার কোনও লক্ষণ নেই৷ আশাকর্মী, পৌর স্বাস্থ্যকর্মী, অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী, মিড ডে মিল কর্মী– কারও খেয়ে–পরে বাঁচার মতো বেতন নেই৷ এর ব্যবস্থা করা কি সরকারের কাজ নয়? পুলিশের চাকরি থেকে স্কুলকলেজ সহ সমস্ত সরকারি দপ্তরে কাজ চলছে নামমাত্র মাইনের চুক্তিভিত্তিক কর্মী দিয়ে৷ অথচ হাজার হাজার পদ খালি৷ তাতে স্থায়ী নিয়োগ হবে না কেন? বন্ধ একের পর এক জুটমিল, কলকারখানা৷ তাতে কাজ হারাচ্ছে হাজার হাজার শ্রমিক৷ আবার চালু কারখানাতেও মালিক ইচ্ছামতো ছাঁটাই করছে, মজুরি কমাচ্ছে, বেআইনি শর্ত চাপাচ্ছে৷ চা–বাগান মালিক ও কেন্দ্র–রাজ্য সরকারের যোগসাজশে উত্তরবঙ্গের চা শ্রমিকরা প্রতারিত হচ্ছে৷ অনাহারে মৃত্যু চা–বাগানের স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে উঠছে৷ দারিদ্রের জ্বালায় চা–বাগান এলাকা থেকে শত শত শিশু এবং কিশোরী পাচার হয়ে যাচ্ছে৷ সরকারের কোনও মাথাব্যথা আছে?

মদের প্রসার যাতে বাড়ে তার জন্য রাজ্য সরকার অত্যন্ত সক্রিয়৷ এর বিষময় ফল বর্তাচ্ছে গ্রাম শহরের অসংখ্য পরিবারে৷ মদ্যপদের হাতে নারী নির্যাতন বাড়ছে ভয়াবহ হারে৷ মদ নিষিদ্ধ করে বিহার নারী নির্যাতন, মেয়েদের উপর পারিবারিক নির্যাতন লক্ষণীয় ভাবে কমাতে পেরেছে৷ সেখানে আজ বাংলা নারী নির্যাতনে দেশের মধ্যে তৃতীয় স্থানে৷ মদ্যপদের হাতে বৃদ্ধা থেকে নিতান্ত শিশুকন্যা ধর্ষিতা হচ্ছে৷ শহরে গঞ্জে তো বটেই এমনকী গ্রামেও মেয়েদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন অভিভাবকরা৷

ভোটব্যাঙ্কের স্বার্থে বিজেপির সাথে হিন্দুত্ববাদের প্রতিযোগিতায় নেমে তৃণমূল সরকার কখনও দুর্গাপুজোর অনুদানে কোটি কোটি টাকা খরচ করছে, কখনও বিসর্জনের কার্নিভালের মোচ্ছব করছে৷ শ্মশানের পুরোহিতদের ভাতা দিচ্ছে৷ অন্যদিকে মুসলিম ভোটব্যাঙ্কের লোভে ইমাম–মোয়াজ্জিমদের ভাতা দিচ্ছে৷ এর সুবিধা নিচ্ছে বিজেপির মতো সাম্প্রদায়িক শক্তি৷

চিটফান্ড কেলেঙ্কারি, নারদ দুর্নীতি তো আছেই, তার সাথে একেবারে পঞ্চায়েত থেকে শুরু করে মন্ত্রী স্তর পর্যন্ত পদে পদে কাটমানি আর দুর্নীতিই যেন দস্তুর হয়ে উঠেছে এই বাংলায়৷ তোলাবাজি আর দাদাগিরি যেন অধিকারে পরিণত হয়েছে শাসকদলের ছোট–বড় নেতার৷

অন্য দিকে কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পর বিজেপি সরকারের চাপানো একের পর এক জনবিরোধী নীতিতে মানুষের জীবন ওষ্ঠাগত৷ রেল–ব্যাঙ্ক–টেলিকম সহ বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বিলগ্নিকরণের ষড়যন্ত্র করছে বিজেপি সরকার৷ শিক্ষা–স্বাস্থ্যের বেসরকারিকরণের উদ্দেশ্যে আনা হচ্ছে জাতীয় শিক্ষানীতি–২০১৯ এবং এনএমসি বিল৷ গণআন্দোলন ও মানুষের প্রতিবাদ স্তব্ধ করার মতলবে একদা কংগ্রেসের চালু করা ইউএপিএ আইনের সংস্কারের নামে শুধুমাত্র সন্দেহের ভিত্তিতেই যেকোনও মানুষকে গ্রেপ্তারের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে এনআইএ–কে৷

একদিকে মানুষের সীমাহীন দুর্দশা, অন্যদিকে সরকারের জনবিরোধী পদক্ষেপগুলি থেকে মানুষের দৃষ্টি ঘুরিয়ে দিতে ৩৭০ ধারা বাতিল করে কাশ্মীরকে ভাগ করা নিয়ে উগ্র জাতীয়তার সুর চড়াচ্ছে৷ এমনকী এনআরসির মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ মানুষকে রাষ্ট্রহীন পরিচয়হীন করে দেওয়ার মতো মারাত্মক বিষয় নিয়েও উগ্র হিন্দুত্ববাদী প্রচার তুলতে চাইছে বিজেপি সরকার৷ এনআরসির ধাক্কায় আসামে ১৯ লক্ষ ভারতীয় আজ নাগরিকত্ব হারিয়ে চরম সংকটে৷ হাজার হাজার পরিবার এর ধাক্কায় ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে৷ ডিটেনশন ক্যাম্পে বন্দি মানুষের অসহায় মৃত্যু শুরু হয়ে গেছে৷ এই এনআরসিকেই দেশ জুড়ে ছড়িয়ে দেওয়ার হমকি দিচ্ছে বিজেপি৷ যাতে জীবনের প্রকৃত সমস্যা ভুলে দিশাহারা মানুষ ছুটে বেড়ায় শুধু এক রকম কার্ড থেকে আর এক রকম কার্ডের–দলিলের সন্ধানে৷ একে অপরকে তারা শত্রু ভাববে, ফয়দা লুটবে সরকার৷ শাসকদল মানুষকে বোঝাতে পারবে, মাথা নিচু করে আমার দাসত্ব মেনে নাও তাহলে সমস্যা থাকবে না৷ এর সাথেই দেশ জুড়ে সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়ানো হচ্ছে৷ দলিত ও সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচার,   গণপিটুনিতে হত্যার ঘটনা বেড়েই চলেছে৷

এই শ্বাসরোধকারী পরিস্থিতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে৷ এটাই একমাত্র রাস্তা৷ কিন্তু দাঁড়াবে কে? ভোটের বাজারের লাভ লোকসানের হিসাব করে নীতি বিসর্জন দেওয়া ভোটবাজ দলগুলি কি এ কাজ পারে? মানুষ জানে, ওরা মাঝে মাঝে আন্দোলন আন্দোলন খেলায় নামে৷ যার একমাত্র লক্ষ্য কিছু ভোট কবজা করা, নেতাদের মুখগুলিকে টিভি–খবরের কাগজে তুলে ধরা৷ জনজীবনের এই ভয়াবহ সংকটের বিরুদ্ধে লাগাতার দীর্ঘস্থায়ী আন্দোলন গড়ে তোলা তাদের রাজনীতি নয়৷ তাই দেশজুড়েই বাম–গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রবল সম্ভাবনা থাকলেও শুধু ভোটের হিসাবে কার হাত ধরলে সুবিধা এই নিয়ে জল মাপতেই তাদের শক্তি শেষ হয়ে যাচ্ছে৷

এই পরিস্থিতিতে দীর্ঘস্থায়ী লাগাতার গণআন্দোলন গড়ে তোলার নিরবচ্ছিন্ন চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে এস ইউ সি আই (সি)৷ পশ্চিমবঙ্গের প্রতিটি জেলাতেই গ্রামে, ব্লকে, মহকুমায় বা জেলা স্তরে নানা দাবি নিয়ে আন্দোলন চলছেই৷ স্তরে স্তরে বহু ক্ষেত্রে দাবি আদায় করে ছাড়ছে মানুষের ঐক্যবদ্ধশক্তি৷ এস ইউ সি আই (সি)–র আন্দোলনই পাশ–ফেল চালুর মতো জয় ছিনিয়ে এনেছে৷ এমএলএ–এমপির শক্তিতে নয়, জনগণের সংগঠিত শক্তিশালী আন্দোলনের চাপেই যে দাবি আদায় হয়, প্রমাণ হয়েছে সে কথা৷

এই আন্দোলনের ধারাবাহিকতাতেই আবার এসেছে নবান্ন এবং উত্তরকন্যা অভিযানের ডাক৷ রাজভবনে দেওয়া হবে এনআরসির চক্রান্তের বিরুদ্ধে স্মারকলিপি৷ এই মিছিলে সামিল হবেন রাজ্যের হাজার হাজার শ্রমিক–চাষি–ছাত্র–যুব-মহিলারা৷ মিছিলের দৃপ্ত স্লোগান ঘোষণা করবে সেই আন্দোলনের শপথ, যা রুখে দেবে এনআরসির জঘন্য ষড়যন্ত্র৷ রুখে দেবে মানুষের জীবনের সবকিছু দেশি বিদেশি পুঁজির পায়ে বিকিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্র৷ মদ–মাদকের নেশায় যৌবনকে ভাসিয়ে দেওয়ার হীন চক্রান্তকে রুখবেই এই আন্দোলনের জোয়ার৷  আন্দোলনই চেনাবে বেঁচে থাকার সঠিক পথ, চেনাবে জনজীবনের প্রকৃত দাবিকে৷

(গণদাবী : ৭২ বর্ষ ১২ সংখ্যা)