শ্রমিকদের ওরা মানুষই মনে করে না

দিল্লির আনন্দ বিহার, গুজরাটের সুরাটের পর মহারাষ্ট্রের বান্দ্রাতে হাজার হাজার পরিযায়ী শ্রমিক তাদের ঘরে ফেরানোর দাবিতে বিক্ষোভে ফেটে পড়লেন। একটি টিভি চ্যানেলে ট্রেন চলাচলের সংবাদ পেয়ে ১৪ এপ্রিল আশেপাশের এলাকা থেকে হাজার হাজার শ্রমিক জড়ো হয়েছিলেন বান্দ্রা স্টেশনে। তাঁদের দাবি, তাঁরা খেতে পাচ্ছেন না। সরকার তাঁদের ঘরে ফেরার ব্যবস্থা করুক। পরিবর্তে মহারাষ্ট্র সরকারের পুলিশ বেধড়ক লাঠি চালিয়ে তাঁদের ছত্রভঙ্গ করেছে।

মূলত নির্মাণকর্মী এইসব শ্রমিকদের বেশিরভাগই বিহার ও পশ্চিমবাংলার বাসিন্দা। এ ছাড়াও অন্যান্য নানা পেশায় দিনমজুরি করেন এঁরা। হঠাৎ করে তিন সপ্তাহের লকডাউন ঘোষণা এঁদের জীবনে গভীর বিপর্যয় নামিয়ে আনে। অসংগঠিত এমন লক্ষ লক্ষ শ্রমিক কাজ করেন ‘নো ওয়ার্ক নো পে’-র ভিত্তিতে। তাই কাজ বন্ধ হওয়ার সাথে সাথে মজুরিও বন্ধ। বেশির ভাগ শ্রমিককেই মালিক কিংবা ঠিকেদার পাওনা টাকাটুকুও দেয়নি। ফোনের সুইচ অফ করে দিয়েছে। কাজের জায়গায় এঁদের কারওরই রেশনের ব্যবস্থা নেই। তিন সপ্তাহে হাতের জমানো সামান্য টাকাটুকুও শেষ। খাবার জুটছে না, পানীয় জলের সংকট। জায়গার অভাবে এক সঙ্গে থাকছেন গাদাগাদি করে। উপরি হিসেবে বাইরে বেরোলেই জুটছে পুলিশি নিগ্রহ।

লকডাউন শুরুর পর প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেছিলেন, ‘‘যারা দিনমজুর, রোজকার আয়ে যাদের সংসার চলে, তারা আমার পরিবার। আমার অন্যতম অগ্রাধিকার তাদের কষ্ট লাঘব করা”। এই উক্তি যে কত বড় শঠতা তা দেশ জুড়ে এই শ্রমিকদের দুরবস্থা দেখলেই স্পষ্ট হয়ে যায়। রাজ্যে রাজ্যে আটকে পড়া শ্রমিকদের বেশিরভাগই অভিযোগ করছেন, সরকার তাঁদের প্রতি কোনও দায়িত্বই পালন করছে না। বান্দ্রার শ্রমিকরা অভিযোগ করেছেন, তাঁরা খেতে পাচ্ছেন না। যতটুকু জুটছে তা সরকারের থেকে নয়, যে মালিকের কিংবা ঠিকাদারের অধীনে তাঁরা কাজ করতেন তাদের কারও থেকে নয়, কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের থেকে।

দিল্লির কাশ্মীরি গেটের ত্রাণশিবিরে একই অভিযোগ শ্রমিকদের। শিবিরের পরিবেশ অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর। খাবারও অত্যন্ত নিম্নমানের। সেখানেও পুলিশ তাঁদেরক্ষোভ মিটিয়ে দিয়েছে লাঠি চালিয়ে। পুলিশি অত্যাচার থেকে বাঁচতে কয়েক জন শ্রমিক যমুনায় ঝাঁপ দিলে একজনের মৃত্যু হয়। গুজরাটের সুরাটে আটকে পড়া কয়েক লক্ষ শ্রমিকেরও একই অভিযোগ। সেখানেও ক্ষুধার্ত শ্রমিকরা বিক্ষোভে ফেটে পড়েছেন বারে বারে।

এই শ্রমিকদেরই কি প্রধানমন্ত্রী পরিবারের সদস্য বলেছিলেন? এদেরই কষ্ট লাঘব করাকে অগ্রাধিকার বলেছিলেন? প্রধানমন্ত্রীর সেই সব ভাল ভাল কথা শ্রমিকদের কী কাজে লেগেছে?

প্রধানমন্ত্রী লকডাউন ঘোষণার সময়ে সংস্থাগুলিকে কর্মী ছাঁটাই না করার আর্জি জানিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি কি জানতেন না এই আর্জির পরিণতি কী হবে? লকডাউন ঘোষণার সাথে সাথেই দেশ জুড়ে কয়েক কোটি শ্রমিক কাজ হারিয়েছেন। কাজ হারাতে চলেছেন আরও কয়েক কোটি মানুষ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংখ্যাটা কমপক্ষে ৪০ কোটিতে দাঁড়াবে। অথচ শুধু ওই আর্জিটুকু জানিয়েই প্রধানমন্ত্রী তাঁর দায়িত্ব শেষ করলেন। মালিকরা জানে, এসব কথায় কান দেওয়ারই দরকার নেই। কারণ প্রধানমন্ত্রী সত্যি সত্যি মালিকদের মুনাফার অংশ ছেড়ে শ্রমিকদের সুবিধা দিতে যে বলবেন না, প্রধানমন্ত্রীর প্রতি এই দৃঢ় বিশ্বাস তাদের রয়েছে। তারা জানে, প্রধানমন্ত্রীর এ আর্জি আসলে শ্রমিকদের, দেশের মানুষকে ভোলানোর জন্য। তাই তারা নিশ্চিন্তে শ্রমিকদের ছেঁটে চলেছে। প্রধানমন্ত্রী যদি সত্যি মনে করতেন এই দুর্দিনে মজুরি পাওয়াটা দরিদ্র শ্রমিকদের পক্ষে জরুরি, তবে শুধু আর্জি জানিয়েই দায়িত্ব শেষ করলেন কেন? কেন তা অমান্যে তিনি শাস্তির নির্দেশ দিলেন না? সুদিনে যে শ্রমিকরা মালিকদের কোটি কোটি টাকা মুনাফা এনে দিয়েছে আজ এই দুর্দিনে মালিকরা যে তাদের এমন কষ্ট এবং যন্ত্রণার মধ্যে ছুঁড়ে ফেলে দিতে পারল তা কি সরকারের সমর্থন না থাকলে সম্ভব হত? সংক্রমণ রোধের অজুহাতে যে সরকারি ব্যবস্থা এমনি করে মানুষগুলিকে সব রকমের নাগরিক প্রয়োজন থেকে বঞ্চিত করে পশুর মতো খোঁয়াড়ে গাদাগাদি করে আটকে রাখতে চায়, সেই ব্যবস্থা আর যা-ই চাক, এদের মঙ্গল যে চায় না, তা নিয়ে সন্দেহের কোনও কারণ আছে কি?

অথচ তাদের বর্তমান দুরবস্থার জন্য তো শ্রমিকরা নিজেরা দায়ী নন, দায়ী সরকারি নীতি। এই মানুষগুলি যে পরিবার ছেড়ে, গ্রাম ছেড়ে, নিজের রাজ্য ছেড়ে, বহু দূরে ভিন রাজ্যে গিয়েছেন তা কি নিজেদের ইচ্ছায়? না, একান্তই বাধ্য হয়ে। বর্তমান পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থা, যার রাজনৈতিক ম্যানেজার হিসেবে প্রধানমন্ত্রীরা কাজ করছেন, সেই ব্যবস্থা আজ দেশের মানুষের খাওয়া-পরার নূ্যনতম ব্যবস্থাটুকু করতেও অক্ষম। তা আজ প্রতিদিন ভয়ঙ্কর বেকারির জন্ম দিয়ে চলেছে। পরিবারের জন্য দু’বেলা দু’মুঠো ভাতের জোগাড় করতেই এই মানুষগুলোকে এইভাবে দেশের এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্তে ছুটে বেড়াতে হচ্ছে। নির্মম শোষণের শিকার হয়ে ন্যূনতম মজুরিতে, অমর্যাদাকর শর্তে কাজ করতে হচ্ছে।

প্রধানমন্ত্রী লকডাউন ঘোষণার আগে একবারও এই মানুষগুলোর কথা ভাবেননি। ভাবেননি, ভিন রাজ্যে আটকে পড়া কয়েক কোটি পরিযায়ী শ্রমিক কীভাবে বাড়িতে ফিরবেন, কিংবা আটকে পড়া শ্রমিকরা কিভাবে মাসের পর মাস টিকে থাকবেন। এতদিন ধরে এই মানুষগুলি যেমন অর্ধাহারে, দুশ্চিন্তায় দিন কাটাচ্ছেন তেমনই তাদের পরিবারগুলিও অর্ধাহারে-অনাহারে, উদ্বেগের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। সরকারের দায়িত্ব ছিল ভিন রাজ্য থেকে মানুষগুলিকে দ্রুত ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করা। বিদেশে আটকে পড়া মানুষদের কিন্তু সরকার বিশেষ বিমান পাঠিয়ে দেশে ফিরিয়ে এনেছে। সে কি তাদের বেশিরভাগই সমাজের উঁচুতলার মানুষ বলে? আর এঁরা শ্রমিক বলে সেই দায়িত্ব থেকে সরকার হাত গুটিয়ে বসে থাকল? কেন, এই শ্রমিকরা কি দেশের নাগরিক নন? তা হলে প্রধানমন্ত্রী স্পষ্ট করে বলুন যে তাঁরা এঁদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক মনে করেন! প্রধানমন্ত্রী তো স্বাধীনতা দিবসের বক্তৃতায় দেশবাসীর উদ্দেশে বলেছিলেন, যারা সম্পদের স্রষ্টা তাদের সম্মান দিন। এই কি তাঁদের সম্মান দেওয়ার নজির? বাস্তবে এইসব বক্তৃতা যে কিছু ছেঁদো কথার ফুলঝুরি ছাড়া কিছু নয়, এমন সংকটের সময়ে মানুষের কাছে তা জলের মতো স্পষ্ট হয়ে যায়।

কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারগুলির আচরণ থেকে স্পষ্ট, এইসব শ্রমিকদের তারা কল চালাবার, বোঝা বইবার জানোয়ার ছাড়া আর কিছুই মনে করে না। তারাও যে মানুষ, তাদেরও যে পেট ভরে খাবার, মানুষের মতো বাঁচবার অধিকার রয়েছে, এই সত্যিটাকে এরা তাদের সব রকমের শক্তি দিয়ে, শঠতা দিয়ে শ্রমিকদের কাছে, দেশের মানুষের কাছে গোপন করতে চায়। তাই যখনই এই ক্ষুধার্ত, উপায়হীন মানুষগুলি সেই অধিকার দাবি করেছে তখনই তাদের উপর নির্মম লাঠির আঘাত নেমে এসেছে। তাই এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীও অন্য রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের দু’লাইনের চিঠি লিখেই রাজ্যে রাজ্যে আটকে পড়া এ রাজ্যের লক্ষ লক্ষ শ্রমিকের প্রতি তাঁর দায়িত্ব শেষ করেছেন।

শ্রমিকদের প্রতি সরকারগুলির এই আচরণ তাদের শ্রেণিচরিত্রকেও স্পষ্ট করে চিনিয়ে দিয়েছে। মালিকদের স্বার্থ রক্ষায় তাদের যে তৎপরতা তার একাংশও তাই শ্রমিকদের রক্ষায় দেখা গেল না। কথায় কথায় যারা মালিকদের জন্য হাজার হাজারকোটি টাকার ত্রাণ প্রকল্প ঘোষণা করে, সভ্যতার স্রষ্টা, সমস্ত সম্পদের স্রষ্টা শ্রমিকদের জন্য সেই সরকারগুলো কিন্তু কোনও ত্রাণ প্রকল্প ঘোষণা করল না। কেউ মাথাপিছু এক হাজার টাকা, কেউ পাঁচশো টাকা অনুদান ঘোষণা করেই শ্রমিকদের প্রতি দরদের পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছেন। পরিযায়ী শ্রমিকদের বেশিরভাগই কোথাও সরকারের খাতায় নথিভুক্ত নন। ফলে এই ঘোষণার ছিটেফোঁটাও তাদের জুটবে না। মন্ত্রীদের দরদ ওই টিভির ঘোষণা পর্যন্তই।

ক’দিন আগে পর্যন্ত কেন্দ্রের বিজেপি সরকার দেশের শ্রমজীবী মানুষদের জাতপাত ধর্ম বর্ণে বিভক্ত করতে তৎপর ছিল। লকডাউনে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে দুর্দশাগ্রস্ত শ্রমিকদের সম্পর্কে মালিকদের এবং তাদের রাজনৈতিক ম্যানেজার হিসেবে কাজ করা সরকারগুলির আচরণ স্পষ্ট করে দিল, হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে শ্রমিকদের সম্পর্কে সরকারের আচরণে কোনও ফারাক নেই। এ থেকে আবার স্পষ্ট হল, শোষিত মানুষের স্বার্থ ধর্ম-বর্ণ জাতপাত নিয়ে লড়াইয়ের মধ্যে নেই। তা আসলে আছে ধনীর বিরুদ্ধে দরিদ্রের, মালিকের বিরুদ্ধে শ্রমিকের, জনবিরোধী সরকারের বিরুদ্ধে বঞ্চিত জনগণের আত্মরক্ষার লড়াইয়ের মধ্যে। এই লড়াইয়ে জাত নেই, ধর্ম নেই, বর্ণ নেই, হিন্দু নেই, মুসলমান নেই। এর একদিকে আছে ধনোন্মত্ত মালিক আর তাদের সেবাদাস সরকারগুলি, আর অন্য দিকে সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ শোষিত নিপীড়িত জনতা আর শ্রমিক শ্রেণি।

বর্তমান পরিস্থিতিতে দেশ জুড়ে শ্রমিক পরিবারগুলিকে, অন্য দিকে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন সাধারণ নাগরিকদের দাবি তুলতে হবে, অবিলম্বে কেন্দ্রীয় সরকারকে দায়িত্ব নিয়ে সমস্ত পরিযায়ী শ্রমিকদের নিজ নিজ রাজ্যে ফিরিয়ে আনতে হবে, তাঁদের কোয়ারেন্টাইন সহ স্বাস্থ্য সুরক্ষার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করে বাড়িতে পৌঁছে দিতে হবে এবং শ্রমিক পরিবারগুলিকে চিহ্নিত করে তাঁদের প্রয়োজনীয় আর্থিক সাহায্যের সমস্ত দায়িত্ব রাজ্য সরকারকে নিতে হবে। যতক্ষণ পর্যন্ত তা না হচ্ছে ততক্ষণ যাতে ভিন রাজ্যে আটকে থাকা শ্রমিকদের খাওয়া, থাকা, স্বাস্থ্য নিরাপত্তার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট রাজ্যের সরকারগুলি নেয় তার নিশ্চিত ব্যবস্থা একদিকে কেন্দ্রীয় সরকার অন্য দিকে তাঁরা যে রাজ্যের অধিবাসী সেই সরকারকে করতে হবে।