শিবদাস ঘোষ জন্মশতবর্ষে তাঁর অমূল্য শিক্ষা

‘‘রেভলিউশনারি কেউ হতে পারে না শুধু বুদ্ধি দিয়ে, বুদ্ধি এবং হৃদয়াবেগ, বুদ্ধি এবং মন, বুদ্ধি এবং নীতি-সংস্কৃতি এবং তা নিজের সমস্ত জীবনের সাথে মেলাতে হবে। এই মেলাতে না পারলে বিপ্লবী হওয়া যায় না। আবার বিপ্লবী হওয়ার পরও বিপ্লবীর অনেক স্তর আছে। তা হল, বিপ্লবী সংগ্রামের রাস্তায় অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানে সমৃদ্ধ ক্ষমতাশালী স্তর। এটা বিপ্লবী হওয়ার স্তরই। আমি বিপ্লবের প্রক্রিয়ায় সচেতনভাবে ক্রিয়া করছি। তার মানে আই অ্যাম অ্যাক্টিভলি এনগেজড ইন দ্য স্ট্রাগল অফ দ্য মাসেস ফর জাস্টিস এগেনস্ট ইনজাস্টিস। একজন সচেতন কর্মী যে নাকি অত কিছু না বুঝলেও, বিদ্যাবুদ্ধি তেমন না থাকলেও বিপ্লবের জন্য যে কোনও সংগ্রাম করার প্রতিজ্ঞা নিয়ে পার্টির দায়দায়িত্ব গ্রহণ করেছে, বিদ্যাবুদ্ধি সম্পন্নরাও তার শ্রেষ্ঠত্ব মেনে নেবে। এই দুইজন দুই দিক থেকে যদি এটাকে মেনে নেন, তা হলেই একমাত্র কাজ সুশৃঙ্খলায় চলতে পারে। কাজেই যে কমরেডটি প্রশ্ন করেছিলেন বিপ্লব ছাড়া হবে না বুঝি অথচ এসব আমি তো করতে পারি না, তিনি আসলে বিপ্লবী হওয়ার জন্য যে মৌলিক দিকগুলোর কথা বললাম– যে পরিষ্কার প্রশ্নগুলো তার সামনে থাকা দরকার, যেটার মধ্যে তত্তে্বর এত ঝঞ্ঝাট নেই, এত আলোচনা করার বিষয় নেই, সোজা বলতে হবে আমি পারি কি পারি না। এই পারি না-র মধ্যে যদি আমার বোঝার গণ্ডগোল থাকে আমি বুঝে নেব।

অনেক কর্মীর খুব আবেগ থাকে। প্রথমে যখন তারা বোঝেন যে, একটা কিছু করা দরকার, আই শুড ডু সামথিং, আমি কিছু করব। এইরকম ফ্রেস মাইন্ড নিয়েই প্রথমে আসেন। বহু ঝড় ঝাপটা ধাক্কাধাক্কির ব্যাপার আছে। তিনি গিয়ে প্রবল উৎসাহে একটা অলীক ভাবনা ভেবে নিলেন যে আমি গিয়ে খুব উৎসাহের সাথে শুরু করার সঙ্গে সঙ্গেই জনগণ সাড়া দিতে শুরু করবে। আর এই সাড়া না পেলেই ফ্রাসেCশন আসে। আসলে কাজ করবার সঙ্গে সঙ্গে বোঝার স্তরকেও উন্নত করতে হয়। আমি কাজ করে যাচ্ছি এটা বড় কথা নয়। আমি যথার্থই একটা সেকশন অফ পিপলের নেতা হতে পেরেছি কি না– যে সেকশন অফ পিপল আমার মুখ চেয়ে বসে আছে। আমার নিজের যাই কিছু দুঃখবেদনা, কষ্ট, সুবিধা-অসুবিধা থাকুক, আমার আত্মমর্যাদার জন্য, তাদের কাছে আমার সম্ভ্রম, সম্মান রক্ষার জন্য আমাকে তাদের জন্য না করে উপায় নেই। আমার মাথা তা হলে লুটিয়ে যাবে। আমি এইভাবে তাদের কাছে প্রতিষ্ঠিত। তাদের আমি ঘরবাড়ি ছাড়িয়েছি। তাদের আমি অনেক কথা বলে উদ্বুদ্ধ করে সংগ্রামে নিয়ে এসেছি। তারা আমার মুখ চেয়ে বসে আছে। এই অবস্থাটি সৃষ্টি করা হচ্ছে একটা গ্যারান্টি টু সেভ ইউ ফ্রম ফ্রাসট্রেশন।

এই যে প্রথম প্রথম অনেক আবেগ থাকে, পরের দিকে অতটা থাকে না কেন, এ বোঝার মধ্যে কী এত জটিলতা আছে? থাকে না এই কারণে যে, প্রথমে সে যখন আসে তখন সে একটা ভাসাভাসা কল্পনা, একটা রোমান্টিক আবেগ নিয়ে আসে। পরে কঠিন বাস্তবের মুখোমুখি হয়ে সে ঘা খেতে থাকে। তার লড়াইয়ের শক্তিকে যদি সে ক্রমাগত তেমন করে বাড়াতে না পারে তা হলে তার ভাটা পড়বে। দুটো শক্তি–একটা তার সাংগঠনিক শক্তি, জনতার মধ্যে থাকা, তাকে সংগঠিত করা, তাকে লিড করবার শক্তি; আর একটা তার আদর্শ এবং চেতনার স্তর ক্রমাগত উন্নত করা। এই দুটি জিনিসকে যদি সে তালে তালে তার সঙ্গে বাড়াতে না পারে তা হলে তার ভাটা পড়বেই। এমন নয় যে সকলেরই ভাটা পড়ে। তা হলে না হয় একটা বিচার্য বিষয় ছিল। একদলের ভাটা পড়ে। আর আজকাল দেখা যাচ্ছে বেশিরভাগেরই ভাটা পড়ে। কিন্তু যে কমসংখ্যক লোকের ভাটা পড়ে না, ক্রমাগত আরও ধারালো হয়, সেটা তা হলে কী করে হয়? সেখানে খুঁজলেই তো উত্তরটা পাওয়া যাবে। এরকমও তো কিছু অল্পসংখ্যক কর্মী আছে যারা প্রবল উৎসাহ নিয়ে এসে দীর্ঘদিন দলে নানা ক্রাইসিসের মধ্যে, জটিল অবস্থার মধ্যে, ঘা খাওয়া সত্তে্বও তাদের চেতনা আরও উন্নত হয়েছে, দৃষ্টিশক্তি আরও পরিচ্ছন্ন হয়েছে, কর্মক্ষমতা ও উদ্যোগ আরও বেড়েছে এবং ডিটারমিনেশন আরও বেড়েছে। তা এরকম একটা সংখ্যা আছে। কিন্তু বেশিরভাগের ভাটা পড়ছে। ওই যে অল্পসংখ্যক কর্মীর কথা বললাম যাদের ভাটা পড়েনি, তারা লড়াই করবার সাথে সাথেই, লড়াইয়ে নামবার সাথে সাথেই বাস্তবের ঘা খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই একটা চেতনার দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে নিজেকে দ্রুত একদিকে রাজনৈতিক চেতনার দিক থেকে, দর্শনগত উপলব্ধির দিক থেকে, রুচি-সংস্কৃতি-মানসিক গঠন পরিবর্তন করার দিক থেকে, নিজেকে ভেঙে নতুন করে গড়া, আর অপরদিকে জনসাধারণের মধ্যে থাকা, তাদের আন্দোলন পরিচালনা করা, তাদের সাথে জীবনটাকে মিলিয়ে দেওয়া, তাদের যথার্থ নেতা হওয়ার চেষ্টা করা– এই দুটো একসঙ্গে প্রবলভাবে করেছে। আর আর একদল কাজ করতে এসেছে প্রবল উৎসাহে কিন্তু করেছে রুটিন ওয়ার্ক, কখনও পাবলিককে অর্গানাইজ করার চেষ্টা করে তাদের নেতা হতে পারেনি। এই না পারার জন্য তাদের এই ফ্রাসট্রেশন, এই ভাটা পড়া। খালি না পারার জন্য নয়, তার সাথে সাথে আদর্শগত, রুচিগত ও মানসিক কাঠামোর মধ্যে চাওয়া-পাওয়ার নানা দিক যেগুলো থাকে সেগুলো বিপ্লবমুখী করে ভেঙে নতুন করে গড়ার কাজটিও তার হয়নি। সিম্পলি উপর থেকে বুদ্ধি দিয়ে বিপ্লবটা গ্রহণ করে সে ঝাঁপিয়ে পড়ে কয়েক দিন ঝড়ের মতন কাজ করল। করে দেখলো কোথাও কিছু হচ্ছে না, শুধু তার পরিশ্রমই সার। সঙ্গে সঙ্গে উৎসাহ থিতিয়ে পড়তে শুরু করল। এর মধ্যে তো বিশেষ একটা রহস্যজনক তত্ত্ব নেই যে এর একটা উত্তর করতে হবে। যে মানুষ বিপ্লবী সংগ্রামে কাজ করতে আসবে তাকে একই সঙ্গে জানতে হবে এটা একটা দুরূহ সংগ্রাম, এর উত্থান-পতন, ঘাতপ্রতিঘাত, বহু জিনিস রয়েছে। এই সংগ্রামটাই জীবন। এই জীবনে ফেলিওর হোক, সাকসেস হোক, এর মধ্যেই আমার মর্যাদাসম্পন্ন জীবনযাপনের পথ নিহিত, তা ছাড়া আর কোনও রাস্তা নেই। আর যত ভাবেই তুমি যুক্তি কর না কেন, আর সব হল ফাঁকির রাস্তা। এই হল প্রথম উপলব্ধি।

দ্বিতীয়ত হচ্ছে, এখানে টিকে থাকতে হলে শুধু ইচ্ছার দ্বারা, সততার দ্বারা টিকে থাকতে পারবে না। আজ যত প্রবল ইচ্ছাই থাকুক, সততাই থাকুক, ত্যাগ করার ক্ষমতাই থাকুক, দীর্ঘদিন এই কঠিন সংগ্রামে ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে আমাকে টিকে থাকতে হলে আমার রাজনৈতিক চেতনা, চরিত্রের গঠন পাল্টে ফেলতে হবে এই লড়াইয়ের মধ্যে। আর আমার সীমিত ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র হলেও একটা সেকশন অফ পিপলের যথার্থ নেতায় পর্যবসিত হতে হবে।”

(‘বিপ্লবী জীবনই সর্বাপেক্ষা মর্যাদাময়’: শিবদাস ঘোষ)