শাহিনবাগ ৮ মার্চকে এক নতুন মাত্রা দিল

৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। বিশ্বের সমস্ত সচেতন নারীর কাছে এই দিনটি অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক-সামাজিক সমানাধিকার অর্জনের দাবিতে শোষণ ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের দিন। এই দিনটিকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসাবে ঘোষণার পিছনে রয়েছে নারীদের দীর্ঘ আন্দোলন, রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের ইতিহাস। নারী স্বাধীনতা, সমকাজে সম মজুরি, নারীর সার্বিক নিরাপত্তা, ৮ ঘণ্টা কাজের দাবি আজও অপূরিত। এ সমস্ত কিছুর মধ্যেও এ বারের আন্তর্জাতিক নারী দিবসের তাৎপর্য আলাদা। এ বারের ৮ মার্চ এসেছে এমন সময়ে, যখন মানুষের নাগরিক অধিকার রক্ষার লড়াইয়ে সারা দেশকে পথ দেখাচ্ছেন মহিলারা। দিল্লির শাহিনবাগ সারা দেশের কাছে আন্দোলনের প্রতীকে পরিণত হয়েছে। দেশের নানা প্রান্তে গড়ে উঠেছে হাজারো ‘শাহিনবাগ’।

দিনের পর দিন যে মহিলারা বাড়ির অন্দরমহলে রান্না-খাওয়া, সন্তান মানুষ করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলেন, যাঁদের অনেকেই আত্মীয়-পরিজনের সঙ্গে ছাড়া কখনও বাড়ির বাইরে পা পর্যন্ত দিতেন না, বাইরের জগৎটা যাঁদের কাছে ছিল সম্পূর্ণই অচেনা, সেই চেনা ছন্দ ভেঙে আন্দোলনের ময়দানে তাঁরা শুধু সামিলই হননি, নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এ বারের ৮ মার্চ সেই অর্থে এক নতুন মাত্রা পেয়েছে।

১৮৫৭ সালের ৮ মার্চ আমেরিকার সুতোকলের মহিলা শ্রমিকরা কাজের সময় কমানো, ন্যায্য মজুরি সহ নানা দাবিতে আন্দোলনে নেমেছিলেন। পুলিশ গুলি চালিয়ে রক্তাক্ত করেছিল রাজপথ। রক্তে রাঙা সেই পথ বেয়েই বিশ্বের দেশে দেশে নানা দাবিতে চলতে থাকে নারী আন্দোলন। ১৯১০ সালে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বিশ্বসাম্যবাদী আন্দোলন ও নারী আন্দোলনের অন্যতম নেত্রী ক্লারা জেটকিন ৮ মার্চ দিনটিকে ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস’ হিসাবে ঘোষণা করার দাবি জানান। ১৭টি দেশের ১০০ জন মহিলা প্রতিনিধির সমর্থনে সেই দাবি গৃহীত হয়। প্রথম দিকে নারীদিবস মূলত নারীর ভোটাধিকার এবং নাগরিক অধিকারের আন্দোলন ছিল। পরে তা সামাজিক বঞ্চনা থেকে নারীর মুক্তি আন্দোলনে পরিণত হয়।

নারী-পুরুষের মজুরি বৈষম্য আজও অটুট। ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায় ভেদে মানুষের উপর চলছে নিপীড়ন-শোষণ। মহিলাদের উপর নির্যাতনের ঘটনায় আজ এ দেশ প্রথম সারিতে, শিশুকন্যা থেকে বৃদ্ধা পর্যন্ত পাশবিক লালসার হাত থেকে রেহাই পাচ্ছেন না। পরিবারে কিংবা কর্মস্থলে যৌন নিগ্রহ, নিরাপত্তাহীনতা, অসম্মান অহরহ ঘটে চলেছে। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, নারী ও শিশুপাচারে পশ্চিমবঙ্গ প্রথম। পণের জন্য বধূহত্যা, অনার কিলিং, অ্যাসিড আক্রমণ, ধর্ষণ, গণধর্ষণ, হত্যা ঘটেই চলেছে প্রতিদিন। বেড়ে চলেছে মদ ও মাদকের ব্যবসা। জুয়া-সাট্টার ঠেক পাড়ায় পাড়ায়। মোবাইল, ইন্টারনেটের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে যৌন উত্তেজনা সৃষ্টিকারী পর্নোগ্রাফি। শুধু যুবকরা নয়, কিশোর-কিশোরীরাও এতে বুঁদ হয়ে পড়ছে। নষ্ট হচ্ছে শিক্ষা-মূল্যবোধ-নৈতিকতার ভিত্তিমূল। এর বিষময় প্রভাব পড়ছে নারী সমাজের উপর, বিপথে যাওয়া যুবক-কিশোরদের লালসার শিকার হচ্ছেন তাঁরা। অন্ধ আবেগ, দারিদ্র ও আর্থিক প্রলোভনে কিশোরীরা পাচার হয়ে যাচ্ছে। সমাজের চরম অবক্ষয়ের মধ্যে এ সব যেন গা-সওয়া হয়ে আসছে।

পুঁজিপতিদের অর্থপুষ্ট শাসক দলগুলি এ সব অবাধে চলতে দিচ্ছে। সমাজ জুড়ে সীমাহীন শোষণকে কেন্দ্র করে মানুষের মনে যে ক্ষোভ বারুদের মতো জমা হচ্ছে, তা যাতে সংগঠিত বিক্ষোভ-আন্দোলনের আকারে ফেটে পড়তে না পারে, সেজন্য তাদের অসামাজিক কাজে লিপ্ত রাখার পরিকল্পিত আয়োজন চলছে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে শাসক দলগুলির নেতাদের পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব। মহিলাদের সম্পর্কে তাঁদের ক্রমাগত কুৎসিত মন্তব্য দুষ্কৃতীদের এই ধরনের অপরাধে আরও উৎসাহিত করছে। একচেটিয়া পুঁজির সংস্থাগুলি পণ্যের বিক্রি বাড়াতে নারীদেহকে বিজ্ঞাপনে কাজে লাগাচ্ছে।

অন্যদিকে কেন্দ্রের শাসক বিজেপি দল এনআরসি-সিএএ-এনপিআরের মাধ্যমে দেশের মানুষের নাগরিক অধিকার হরণ করতে চাইছে এবং তাদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে দিচ্ছে। এর মাধ্যমে ধর্মীয় বিভাজন এনে মানুষে-মানুষে ভেদাভেদ বাড়িয়ে তুলছে। অর্থনৈতিক সংকটে জেরবার মানুষ, রুজি-রোজগারহীন মানুষ যখন কোনওরকমে পেট চালানোর জন্য উদয়াস্ত পরিশ্রম করছেন, তখন জীবনের ন‍্যূনতম চাহিদা পূরণ না করে সরকার তাঁদের দৃষ্টি অন্যদিকে ঘোরাতে এই চরম বৈষম্যমূলক, সাম্প্রদায়িক আইন সাধারণ মানুষের উপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। এর বিরুদ্ধে সর্বাগ্রে পথে নেমেছেন মহিলারা। সমাজের সর্বস্তরের মানুষ সামিল হয়েছেন এই আন্দোলনে। সরকার এই আইন প্রত্যাহার না করা পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছেন হিন্দু-মুসলিম-শিখ নির্বিশেষে আন্দোলনকারীরা।

এই আন্দোলন দেখিয়ে দিল এক ঐতিহাসিক সত্য। শোষিতের মধ্যে মহিলারাই বেশি শোষিত– তাই তাঁরা যখন লড়েন তার শক্তি ও প্রভাব শাসক শ্রেণির বুকে কাঁপন ধরায়। ৮ মার্চের মিছিলই রাশিয়ায় একদিন শোষণ উচ্ছেদের ডাক দিয়েছিল। অধিকার রক্ষার লড়াইয়ের পরিপূরক করেই আজ নারীর মর্যাদা ও সুরক্ষার আন্দোলন করতে হবে। প্রয়োজন নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের প্রতি যে শোষণ-বৈষম্য-অবমাননা এই সমাজে চলছে, তার বিরুদ্ধেও সংগঠিত লড়াই।

(গণদাবী : ৭২ বর্ষ ৩১ সংখ্যা)