শাসক দলগুলি পঞ্চায়েতি ব্যবস্থাকে দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত করেছে

তিন বছরের শিশু মৃণাল মণ্ডলের মাথা ফুঁড়ে বেরিয়ে গেল গুলি৷ মালদহের মানিকচক ব্লকের রামনগর গ্রামের ছোট্ট মৃণাল যখন মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে, ঠিক তখনই এই ব্লকের গোপালপুর গ্রামে বোমার স্প্লিন্টারে ক্ষতবিক্ষত হল বছর তিনেকের শেখ জিশান৷

ওরা কেউ পঞ্চায়েত ভোটে প্রার্থী ছিল না৷ শাসক দল মানে কী, বিরোধী মানে কী– এ সব বোঝার মতো বয়সও হয়নি ওদের৷ তবুও ত্রিস্তর পঞ্চায়েত নির্বাচনে সন্ত্রাসের শিকার ওরা৷

পঞ্চায়েতকে শাসকদলগুলি ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ বলে থাকে৷ পঞ্চায়েতের মধ্য দিয়ে একেবারে গ্রাম স্তর পর্যন্ত  গণতন্ত্রের সম্প্রসারণ হয়ে গেছে বলে তাদের গর্বিত দাবি৷ কিন্তু গণতন্ত্রের এই ছদ্মবেশের আড়ালে কী দেখা গেল এবারের নির্বাচনে? প্রবল সন্ত্রাস কায়েম করে ২০,১৫৯ আসনে বিরোধীদের নমিনেশনই জমা দিতে দিল না শাসক তৃণমূল৷ নমিনেশন জমা দিতে গিয়ে মার খেয়ে রক্তাক্ত হল বহু মানুষ৷ বাড়ি ভাঙচুর হল বহু মানুষের, বেশ কয়েকজন মারাও গেল৷ শুধু ভোটের দিনই সন্ত্রাসের বলি হল ১৯ জন৷ গণতন্ত্রকে বেআব্রু করে গণনাকেন্দ্রেও চলল শাসক দলের অবাধ ছাপ্পা৷ তারপর বোর্ড গঠনের সময় বন্দুকের নল বুকে ঠেকিয়ে অথবা লক্ষ লক্ষ টাকা দিয়ে বিরোধী দলের সদস্য ভাঙানোর যে ন্যক্কারজনক নজির সৃষ্টি করছে কোথাও তৃণমূল, কোথাও বিজেপি তাতে গণতন্ত্রের ছিটেফোঁটাও কোথাও আছে কি?

সিপিএম এভাবেই ৭–৮ হাজার আসন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতত৷ সেই সময় মারা যেত শুধু বিরোধীরা৷ তৃণমূল রাজত্বে মধুভাণ্ড দখলের কামড়াকামড়িতে দলের লোকেরাও মারা যাচ্ছে অসংখ্য৷ ‘বিরোধীরা প্রার্থী দিতে না পারলে আমরা কী করব’– সিপিএমের এই বক্তব্যই এখন বিরোধীদের উদ্দেশে ছুঁড়ে দিয়ে তৃণমূল সন্ত্রাসের আগুনে শান্তির জল ছেটাতে চাইছে৷ গ্রাম পঞ্চায়েত, পঞ্চায়েত সমিতি এবং জেলা পরিষদ মিলে ৫৮,৬৯২টি আসনের মধ্যে ২০,১৫৯টি আসনে তারা সন্ত্রাস কায়েম করে, নমিনেশন জমা আটকে দিয়ে গণতন্ত্রকে হত্যা করেছে৷ এই সব বুথে প্রায় দেড় কোটি মানুষের ভোটাধিকার হরণ করেছে৷

শাসক দলের বহু প্রচারিত ‘উন্নয়ন কর্মসূচি’ যদি জনজীবনে সত্যি সত্যি উন্নয়ন আনতে পারত তা হলে পঞ্চায়েত ভোটে জেতার জন্য তাদের এভাবে সন্ত্রাসের পথ নিতে হত কি? কেন সুস্থ–স্বাভাবিক–গণ প্রতিযোগিতা এড়িয়ে তাদের গায়ের জোরে জেতার জন্য তাণ্ডব চালাতে হল? বন্দুকের ডগায় আর নোটের বান্ডিলের জোরে বোর্ড গঠনের মরিয়া চেষ্টা কেন করতে হচ্ছে? এর মধ্যে গণতন্ত্র কোথায়? কোথায় মানুষের অধিকার? গোটা প্রক্রিয়াটার মধ্যে কোথাও মানুষের কল্যাণের চিন্তা আছে? জেলায় জেলায় মাসের পর মাস ধরে অবাধে দলের নেতা–কর্মীরা সন্ত্রাস চালাল, আর এতদিনে মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, ‘ব্যক্তিস্বার্থই অশান্তির মূল কারণ’৷ 

এ কথা তো কেউ অস্বীকার করতে পারবে না, ভোটবাজ দলগুলি পঞ্চায়েতি ব্যবস্থাকে স্বার্থ গোছানোর আখড়া হিসাবে ব্যবহার করে চলেছে৷ সাধারণ মানুষ চোখের সামনে দেখছে পঞ্চায়েতকে ঘিরে লক্ষ লক্ষ টাকার দুর্নীতি এবং দলবাজি৷ পঞ্চায়েতেকে ঘিরে তাই শাসকদলের মধ্যেও এত গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব৷ ‘ব্যক্তিস্বার্থই অশান্তির মূল’ এ কথা বলে মুখ্যমন্ত্রী খুন–সন্ত্রাস–অপহরণের দায় কি নিছক ব্যক্তির বলতে চান? এর পিছনে তাঁর দলের ভূমিকা কি তিনি অস্বীকার করতে চান? তিনি কি এই ‘ব্যক্তিস্বার্থ’ আটকানোর কোনও চেষ্টা করেছেন?

এবারের পঞ্চায়েত নির্বাচনে তৃণমূলের এত সন্ত্রাসের লক্ষ্য শুধু বিরোধীদের আটকানো ছিল না, দলের মধ্যে অসংখ্য গোষ্ঠীকে আটকানোও ছিল অন্যতম লক্ষ্য৷ পঞ্চায়েতের দখল মানে ৫ বছরের জন্য বরাদ্দ ১০ কোটি টাকার উপর আধিপত্য কায়েম৷ স্বাভাবিকভাবেই এই টাকার বখরা নতুন নতুন গোষ্ঠীর জন্ম দিচ্ছে৷ এই বখরায় ভাগ বসানোর লক্ষ্যেই দল বদলের, গোষ্ঠী বদলের ঘটনা অহরহ ঘটছে৷ পঞ্চায়েতকে ঘিরে এই মধুভাণ্ডের ভাগবাঁটোয়ারার লড়াই গ্রামের মানুষকে ক্রমাগত দুর্নীতিগ্রস্ত করছে৷ পঞ্চায়েতি ব্যবস্থা এইভাবে একটা কায়েমি স্বার্থবাদী ব্যবস্থায় অধঃপতিত হয়েছে৷ পঞ্চায়েত থেকে কে কী আর্থিক সুবিধা পেল, কে পেল না এই চিন্তার আবর্তেই গ্রামের মানুষকে আটকে দেওয়া হয়েছে৷ পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতির ফাঁসে জড়িয়ে দিয়ে তাদের নৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়া হচ্ছে৷ ভোটবাজ দলগুলির দুর্নীতিগ্রস্ত নেতাদের নানা অপকর্মের নীরব সাক্ষীতে পরিণত করা হচ্ছে৷

এই পঞ্চায়েতি চৌহদ্দির মধ্যে গ্রামের মানুষের জীবনের মৌলিক সমস্যার সমাধান নেই৷ পঞ্চায়েতি ব্যবস্থা ভারতের বুর্জোয়া শাসন ব্যবস্থারই গ্রাম স্তরের সংগঠন৷ এই ব্যবস্থা দুর্নীতি এবং দলবাজি মুক্তরূপে চালাতে পারলে পঞ্চায়েতের জন্য বরাদ্দ টাকায় এলাকায় কিছু পরিকাঠামোগত উন্নয়ন হতে পারে, এর বেশি নয়৷ কিন্তু তীব্র বেকারত্ব, ফসলের ন্যায্য দাম না পাওয়া, তীব্র মূল্যবৃদ্ধি, সার–বীজ–কীটনাশকে দাম বৃদ্ধি, শিক্ষা–স্বাস্থ্যের সমস্যা ইত্যাদির থেকে মুক্তি এই পঞ্চায়েতি ব্যবস্থার মধ্যে সম্ভব নয়৷ অথচ এগুলিই তো গ্রামীণ মানুষের মূল সমস্যা৷ এ সবের বিরুদ্ধে গ্রামের জনপ্রতিনিধিদের কোনও ভূমিকা আছে কি?

(৭১ বর্ষ ৬ সংখ্যা ৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৮)