শারদোৎসবের নামে সরকারি মোচ্ছব, মানুষের জীবনে আনন্দ কোথায়

দুর্গা প্রতিমার ভাসান কি সরকারি কর্মসূচি? পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অর্থানুকূল্যে এবং বিশেষত মুখ্যমন্ত্রীর উৎসাহে কয়েক বছর ধরে অনুষ্ঠিত ‘বিসর্জনের কার্নিভাল’ যে ভাবে জৌলুসে ও আড়ে–বহরে বেড়ে চলেছে তা দেখলে মনে হতে পারে এটাই এখন সরকারের অন্যতম প্রধান কর্মসূচি৷

শারদোৎসবে বাংলার মানুষের আনন্দমুখরতা সাহিত্যেও জায়গা করে নিয়েছে৷ কিন্তু সরকারি ব্যবস্থাপনায় বিসর্জনের হুল্লোড় শারদোৎসবের অঙ্গ কী করে হয় তা বাংলার মানুষ ভাবতে পারছেন না৷ উৎসবের কল্লোল কোলাহল হয়ে উঠলে তা শেষ পর্যন্ত উৎপাত এবং বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়৷ দুর্গাপুজোর নামে একদল শক্তিমান রাজনীতিকের কাণ্ড–কারখানায় কলকাতার মানুষ তা ভালই টের পেয়ে চলেছেন৷

কলকাতার শারদোৎসবে এক সময় পাড়ায় পাড়ায় সাধারণ মানুষের একত্রিত প্রয়াসের ছাপ ছিল৷ তাই তাকে ঘিরে পাড়ার মানুষের মধ্যে একটা সৌন্দর্য ফুটে উঠত৷ কিন্তু দিনে দিনে তা নানা রাজনৈতিক দলের দাদাদের ক্ষমতা প্রদর্শনের প্রতিযোগিতায় পরিণত হয়েছে৷ তাঁদের পুজোর জৌলুসের রোশনাই যত বেড়েছে তত কমেছে সাধারণ মানুষের সরাসরি অংশগ্রহণ৷ একেকটি পুজো প্যান্ডেল এক এক নেতা–মন্ত্রীর নামে চিহ্ণিত হয়ে গেছে৷ তৃণমূল ক্ষমতায় থাকার সুবাদে তাদের হাতেই এখন এইসব প্যান্ডেলের রাশ বেশি৷ অন্য দলের কিছু নেতাও কম যাচ্ছেন না৷ একজন রুপো দিয়ে প্যান্ডেল বানালে অন্যজন আর একটা কিছু চমকের জন্য ছুটছেন৷ তাঁদের সকলেরই উদগ্র বাসনা তাঁর প্যান্ডেলে মানুষের ঢল নামুক৷ তাতে উদ্যোক্তা হিসাবে নেতার নাম ছড়াবে, ভোটের সময় তাঁর দাপট বাড়বে৷

হাজার হাজার কোটি টাকা এর পিছনে গলে যাচ্ছে৷ অথচ এই বিপুল সম্পদের ব্যয় মানুষের জীবনের জ্বলন্ত সমস্যাগুলি সমাধানে এতটুকুও কাজে আসছে না৷ শারদোৎসব নতুন কিছু নয়, বহু বছর ধরে তা হয়ে এসেছে৷ কিন্তু এমন ক্ষমতা প্রদর্শনের অসুস্থ প্রতিযোগিতার মঞ্চ তা ছিল না৷ এই দাপটের প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকতে কলকাতা কর্পোরেশনের মেয়র তথা মেয়র পারিষদরা থেকে শুরু করে সরকারি মন্ত্রীরা পর্যন্ত দুর্গাপুজোর বেশ কিছুদিন আগে থেকেই দপ্তরে মুখটুকুও দেখানোর সময় পাননি৷ সাধারণ মানুষ অতিপ্রয়োজনেও সরকারি অফিসে গিয়ে শুনছেন ও সব দেখার সময় এখন কর্তাদের নেই৷ সব হবে পুজোর পরে৷ সেখানেও বিপদ, সরকারি উৎসবের বহরের সাথে মিলিয়ে রাজ্য সরকারি দপ্তরে ছুটির বহর যা বেড়েছে তাতে এবারে পুজো এবং শনি–রবিবার মিলিয়ে রাজ্য সরকারি অফিসে কাজ বন্ধ থেকেছে প্রায় ১৫–১৬ দিন৷ প্রতিযোগিতার তীব্রতা এত বেশি যে মহালয়ার আগেই কোনও কোনও তৃণমূল নেতা তাঁদের পুজো মুখ্যমন্ত্রীকে দিয়ে উদ্বোধন করিয়ে ফেলেছেন৷ তৃণমূল নেতাদের মধ্যে প্রতিযোগিতার ঢল নেমেছে কে কত বেশি মুখ্যমন্ত্রীর অনুগত তা দুর্গাপুজোর মধ্যেই তুলে ধরার৷

পাশাপাশি রাজ্য সরকার ঘোষণা করল রাজ্যের সমস্ত দুর্গাপুজো কমিটিকে ১০ হাজার টাকা করে দেওয়া হবে৷ তাতে রাজ্য সরকারের কোষাগার থেকে কম করেও ২৮ কোটি টাকা খসে গেছে৷ এছাড়াও সমস্ত পুজো কমিটিকে বিদ্যুৎ–এর বিলে ছাড় দেওয়া হয়েছে৷ যা শেষ পর্যন্ত মেটানো হবে জনগণের ঘাড় ভেঙে কর আদায় করেই৷ এর সাথে বিসর্জনের কার্নিভালের নামে মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল কংগ্রেসের নেতা–মন্ত্রীদের কুর্নিশ কুড়ানোর আসরেও গলে গেছে বেশ কয়েক কোটি টাকা৷ যদিও কোটি কোটি টাকার বাজেটের পুজো কমিটিগুলির কাছে এই টাকা নস্যি বললেও বেশি বলা হয়৷ কিন্তু প্রশ্ন অন্য জায়গায়, সরকার কেন পুজো কমিটিকে এইভাবে টাকা দেবে? বিসর্জনের কাজও কি সরকারের করার কথা? সরকারের যেগুলি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ সেই স্বাস্থ্য, শিক্ষা, রাস্তাঘাট নির্মাণ, পানীয় জল, এই সমস্ত কাজ টাকার অভাবে ধুঁকছে৷ মিড–ডে মিল কর্মসূচিতে টাকার অভাবে ছাত্র পিছু বরাদ্দ সাড়ে তিন টাকা–চার টাকার বেশি হয় না৷ টাকার অভাবের অজুহাতে ১০০ দিনের কাজের মজুরি বকেয়া থাকে মাসের পর মাস৷ রাজ্য সরকারি দপ্তরগুলিতে নিয়োগ প্রায় বন্ধ৷ কারণ মাইনে দেওয়ার মতো টাকার সংস্থান নাকি সরকারি কোষাগারের নেই৷ রাজ্য সরকারি কর্মচারিরা তাঁদের বহু ন্যায্য পাওনা থেকে দীর্ঘদিন বঞ্চিত একই অজুহাতে৷ এই কাজগুলি না করে কোনও ধর্মীয় উৎসবে একটা গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ দেশের সরকার কেন কোষাগার থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা খরচ করবে? পুজো কমিটিকে সরকারি টাকা দেওয়ার ক্ষেত্রে আদালতেও রাজ্য সরকার এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে পারেনি৷

শারদোৎসবের মতো একটি উৎসব যার সাথে সাধারণ মানুষের আবেগ জড়িত, তাকে নিজেদের মুনাফার স্বার্থে ব্যবহার করার জন্য দৈত্যাকার কর্পোরেট কোম্পানিগুলি উৎসবের বদলে উন্মাদনার আবহ তৈরি করছে৷ এই উন্মাদনায় মানুষকে মাতিয়ে দিতে পারলে নানাবিধ কেনাকাটা এমনকী অপ্রয়োজনীয় কেনার দিকে মানুষকে ঠেলে দিয়ে তাদের মুনাফা নিশ্চিত হয়৷ কর্পোরেট পুঁজি পরিচালিত সমস্ত সংবাদ মাধ্যম এই উদ্দেশ্যে উন্মাদনায় মদত দিচ্ছে৷ এদের সাথে হাত মিলিয়ে সরকারও মদের ও নানা নেশার বন্যা বইয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা পুজোর নাম করে করে দিচ্ছে৷ যার মারাত্মক ফল বর্তাচ্ছে যুব সমাজের বিরাট অংশের উপর৷ নারী নির্যাতন, ইভ টিজিং উৎসবের সময় ভয়াবহ আকার নিচ্ছে৷

কর্পোরেট পুঁজি মালিকদের মতোই সরকারও উন্মাদনার অন্যতম মদতদাতা৷ এই মদত এমন পর্যায়ে পৌঁছচ্ছে যে নেতা–মন্ত্রীদের মদতপুষ্ট পুজো কমিটিগুলি ন্যূনতম কোনও নিয়ম মানারও তোয়াক্কা করছে না৷ তাতে জনজীবন বিপন্ন হলে কিংবা মানুষের প্রাণ সংশয় হলেও তাদের কিছু যায় আসে না৷ এই উন্মাদনার মারাত্মক ফল আমরা দেখেছি অমৃতসরে রাবণ দহণের উৎসবে৷ বেঘারে ৬১টি প্রাণ চলে গেলেও কারও যেন হেলদোল নেই৷ পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির থেকে বড় হিন্দুত্ববাদী হওয়ার চ্যাম্পিয়ানশিপে জিতে ভোটব্যাঙ্ক গড়ার জন্য তৃণমূলের উগ্র বাসনা তাদের এই উন্মাদনা তৈরির চেষ্টার অন্যতম কারণ৷ যদিও শুধু এটাই নয়৷ বেকারি, মূল্যবৃদ্ধিতে জেরবার মানুষ যখন ক্ষোভে ফেটে পড়তে চায়, বন্ধ কারখানার শ্রমিক যখন কাজ ফিরে পেতে ঐক্যবদ্ধ হতে চায়, ক্রমবর্ধমান নারী নির্যাতন, তোলাবাজির জুলুম এইসব থেকে মুক্তি চেয়ে যখন মানুষ প্রতিবাদে নামতে চায়– যে কোনও শাসকই ধর্মীয় উৎসবের নামে উন্মাদনাকে হাতিয়ার করে মানুষকে বিভ্রান্ত করে তার দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে৷ শাসকরা চায় যুব সমাজ যাতে এইসব নিয়েই মেতে থাকে, সুষ্ঠু চিন্তা–ভাবনার অবকাশই যেন তাদের না থাকে৷

রাজ্যের শাসকদল হিসাবে তৃণমূল এই চরিত্রকেই অনুসরণ করছে৷ উৎসব আসে আবার চলে যায়, মানুষের জীবনের সমস্যা আরও গেড়ে বসে৷ ক’দিনের হট্টগোলের রেশ কাটতে না কাটতেই অভাব তার রক্তচক্ষু নিয়ে তেড়ে আসে গরিবের জীর্ণ সংসারে৷ তাই ভাবা দরকার শাসকরা মাতালেই সাধারণ মানুষ মাতবেন কেন? উৎসবের আনন্দ তাঁদের থাকুক কিন্তু হুঁশিয়ার থাকাটাও জরুরি, মতলববাজরা যাতে এই সুযোগে মতলব হাসিল করতে না পারে৷

(৭১ বর্ষ ১২ সংখ্যা ২ – ৮ নভেম্বর, ২০১৮)