রক্তে রাঙা ১৯ আগস্ট ১৯৮৩

রঘুনাথপুর

‘…এমন সময় গর্জে ওঠে মানতে হবে দাবি

কি অপরূপ এই যে মানুষ, সবাই যখন মেলে

রূপ দেখে তার আঁখি পাগল, তাই চলি ভিড় ঠেলে

দাবির পরে দাবি আসে ঢেউয়ের পরে ঢেউ

ঢেউয়ের মাথায় মানিক জ্বলে ঝান্ডা হাতে কেউ’

১৯৮৩। পরিবহণের ভাড়া বৃদ্ধির বিরুদ্ধে উত্তাল পশ্চিমবাংলা। তৎকালীন রাজ্য সরকারের জনবিরোধী পরিবহণ নীতির বিরুদ্ধে রাজ্য জুড়ে উত্তাল গণআন্দোলনের ঢেউ। সেই ঢেউয়ে আন্দোলিত হল ঝাড়খণ্ড সীমান্তের পুরুলিয়া জেলা। সারা রাজ্যের মতো এ জেলার মানুষও সামিল হলেন বর্ধিত ভাড়া বয়কট, অবরোধ, ডেপুটেশন, বিক্ষোভ, সভা, মিছিলে।

১৯৮৩ সালের ১৯ আগস্ট। এস ইউ সি আই (সি) দলের আহ্বানে সারা বাংলা জুড়ে সংগঠিত হল প্রতিবাদ, বিক্ষোভ। পুরুলিয়া জেলার কুড়িটি জায়গায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে সমবেত হলেন সাধারণ মানুষ, মালিক তোষণকারী পরিবহণের অন্যায় ভাড়া বৃদ্ধির বিরুদ্ধে। রঘুনাথপুর শহরে সংগঠিত হল বিশাল গণবিক্ষোভ। দাবি নিয়ে সামিল হলেন হাজারে হাজারে নিরস্ত্র নারী পুরুষ।

একদিকে জনতার দাবি নিয়ে দাঁড়াল সংগ্রামী বামপন্থা, বিপরীতে মালিক তোষণের অ-বাম নীতির পক্ষে দাঁড়াল গণআন্দোলনের বিরোধী ‘বামপন্থী’ তকমাধারী সরকারি দল। রচিত হল গণআন্দোলন দমনের এক কালো অধ্যায়।

ওই দিন সকাল ন’টা নাগাদ রাজ্য সরকারের ‘স্বেচ্ছাসেবক’ (পড়ুন ঠ্যাঙাড়ে) বাহিনী লাঠি-রড-হকিস্টিক নিয়ে অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকারীদের ওপরে। একই সাথে ঝাঁপিয়ে পড়ে আগের রাত্রিতে পুরুলিয়া ব্যারাক থেকে মোতায়েন করে রাখা বিশাল পুলিশবাহিনী। শুরু হয় বর্বর লাঠিচার্জ। প্রতিরোধী জনতাকে কোনওভাবেই পিছু হটাতে না পারায় তৎকালীন রাজ্য সরকারের তল্পিবাহক রেসিডেন্সিয়াল ম্যাজিস্টে্রট জয়ন্ত মিত্র আকস্মিকভাবে টিয়ার গ্যাস ও গুলিচালনার নির্দেশ দেন। বিশাল পুলিশবাহিনী মুটে, রিকশাচালক, পরিচারিকা– হতদরিদ্র, নূ্যr সাধারণ মার-খাওয়া জনগণের এই উজ্বল সংগ্রামী রূপ দেখে আতঙ্কিত হয়ে ওঠে। সারা রঘুনাথপুর জুড়ে তাণ্ডব চালায় পুলিশ বাহিনী, দোকান-বাজার-বাসস্থান লক্ষ্য করে, আন্দোলনের পক্ষে থাকা শহরবাসী ও আন্দোলনকারীদের আতঙ্কিত করে তোলার জন্য গুলি চালাতে থাকে। শহরের পাইসাপাড়ায় অবস্থিত তৎকালীন এসইউসিআই(সি) অফিস বাড়িটিতে গুলি চালায় পুলিশ, যে গুলির দাগ আজও সেই বাড়িটি বহন করছে। পাড়ায় পাড়ায় ঢুকে পুলিশ তাণ্ডব চালায়। রঘুনাথপুর শহরের ধোবাপাড়ার গরিব শ্রমিক পরিবারের সন্তান হাবুল রজক এবং তাঁতিপাড়ার দোকান কর্মচারী শোভারাম মোদককে গুলি চালিয়ে হত্যা করে। শহরের বিশিষ্ট নাগরিক মানিক নন্দী মৃতদেহ তুলতে গেলে পুলিশ গুলি চালিয়ে তাঁর পা নষ্ট করে দেয়। জিতেন ঘোষাল নামে আরও এক যুবক গুলিবিদ্ধ হন।

পুরুলিয়ায় শহিদ দিবস পালন

১৯ আগস্ট দলের পুরুলিয়া জেলা কমিটির আহ্বানে রঘুনাথপুর, পুরুলিয়া শহর, পাড়া, আড়ষা, কাশিপুর, হুড়া সহ প্রতিটি ব্লকে বাসভাড়া বৃদ্ধি বিরোধী আন্দোলনের ‘শহিদ দিবস’ পালন করা হয়। রঘুনাথপুর শহরে শহিদ বেদির সামনে এ দিন স্মরণ অনুষ্ঠান পালিত হয় । বহু মানুষ সমবেত হয়ে দুই শহিদকে শ্রদ্ধা জানান। এই কর্মসূচিতে সভাপতিত্ব করেন দলের পুরুলিয়া জেলা কমিটির সদস্য এম কে সিনহা এবং বক্তব্য রাখেন জেলা কমিটির অন্যতম দুই সদস্য লক্ষীনারায়ণ সিনহা ও বিনয় ভট্টাচার্য।

ক্রোধে উন্মত্ত এই পুলিশি তাণ্ডবের মধ্যে শহরের জনগণ রাস্তায় নেমে আসেন। প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে ওঠে রঘুনাথপুর শহর। পুলিশ ব্যাপক ধরপাকড় শুরু করে। আন্দোলনকারী থেকে সাধারণ শহরবাসী– পুলিশি ধরপাকড় থেকে কেউ বাদ যায় না।

এরপর শুরু হয় আন্দোলনের আর এক গৌরবময় অধ্যায়। ঘটনার পরের দিনই পালিত হয় জনতার স্বতঃস্ফূর্ত ধর্মঘট। পুলিশী নৃশংসতার প্রতিবাদে রঘুনাথপুর বার অ্যাসোসিয়েশন কোর্ট বয়কট করে। রঘুনাথপুর পৌরসভা লাগাতার বয়কট আন্দোলনের ডাক দেয়। শহরের সাধারণ মানুষ লাগাতার অসহযোগ আন্দোলনে সামিল হন। শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে এই বর্বরতার প্রতিবাদে পুলিশকে সামাজিকভাবে বয়কট করে শহরবাসী। এই নৃশংসতার দুঃস্বপ্ন এবং সংগ্রামের গৌরবময় স্মৃতি আজও বহন করছে পুরুলিয়া জেলার রঘুনাথপুর।

শহিদ হাবুল ও শোভারামের নেতা গরিব মেহনতি মানুষের মহান মার্কসবাদী শিক্ষক কমরেড শিবদাস ঘোষের সুযোগ্য ছাত্র বিপ্লবী শিল্পী শীতেশ দাশগুপ্তের শিল্পরচনা শহিদ স্মৃতিস্তম্ভ শহরের প্রধান সড়কের পাশে আজও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। দাঁড়িয়ে আছে সংগ্রামী বামপন্থার উজ্বল প্রতীক হয়ে।

আজও ১৯ আগস্ট আসে। শোক সন্তাপ নিয়ে বর্ষার কালো মেঘ শহিদের স্মৃতিস্তম্ভে ঝরে পড়ে। আজও সকালে একদল আলোকসন্ধানী মানুষ গভীর শ্রদ্ধায় শহিদদের স্মরণ করে সমবেত হন স্মৃতিস্তম্ভের় সামনে। আজও শহিদ স্মরণের সকালে কেউ পরম আবেগে অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে গেয়ে ওঠেন–

‘…কচি হাবুল রজক ছিল রঘুনাথপুরে

মেকি বামের নখরে গেল অকালে ঝরে,

বাস গেলে বাস ফিরে আসবে,

বাছা হাবুল কি আর ফিরে আসবে ?

ডুকরে ডুকরে কাঁদে হাবুলের মা

বুকের মানিক বুঝি ফিরে এল না।

বাছা ফিরে এল না…’

আজও শহিদ স্তম্ভের সামনে দাঁড়িয়ে বৃহত্তর সংগ্রামের আকাঙ্খায় কোনও যুবক স্লোগান তোলে– ‘সংগ্রামী বামপন্থা জিন্দাবাদ’, ‘অমর শহিদ হাবুল রজক-শোভারাম মোদক লাল সেলাম’, ‘১৯ শে আগস্ট লাল সেলাম’। আজও রক্তপতাকা, চেতনাদীপ্ত আপসহীন সংগ্রামের গভীর প্রত্যাশায় আন্দোলিত হয়। আজও রক্তস্নাত সংগ্রামধৌত শহিদ দিবস ডাক দিয়ে বলে যায়– ‘…তাকে তোমরা বাঁচিয়ে রেখো।

কার কথা বলছি তোমরা নিচয়ই জানো,

সে রকম একজন হয়ত তোমাদের গ্রামেও আছে,

যে নিজের বাঁচার কথা চিন্তা করতে জানে না,

সকলের বাঁচার ভাবনা তার।

আমার বিদ্যুৎ-আলোকিত শহরে মাঝে মাঝে সে হারিয়ে যায়,

অথচ বিষাদের রাত্রিতে তাকে খুঁজে পাই আকাশের তারার মতো।

তাকে তোমরা বাঁচিয়ে রেখ।’

(কবিতা ঋণ : গোলাম কুদ্দুস)

(ডিজিটাল গণদাবী-১৫_২০ আগস্ট, ২০২০)