Breaking News

যে মহানবিপ্লব আজও পথ দেখায়

১৯১৭–এর ৭ নভেম্বর রাত ৯ টা ৪৫ মিনিট৷ গর্জন করে উঠল ‘অরোরা’ যুদ্ধ জাহাজের কামান৷ শুরু হল রুশ বুর্জোয়া সরকারের ঘাঁটি শীত প্রাসাদের ওপর গোলাবর্ষণ, মহান নেতা লেনিনের নেতৃত্বে ‘রুশ সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব’৷ চলেছিল আরও দশদিন ১৭ নভেম্বর পর্যন্ত৷ অবশেষে জয়ী হল বিপ্লব৷ প্রতিষ্ঠিত হল বিশ্বের প্রথম শোষণহীন সমাজব্যবস্থা–‘সোভিয়েত সমাজতন্ত্র’৷

এই অভূতপূর্ব বিপ্লবের দিনগুলি মানব ইতিহাসে পরিচিত হয় ‘দুনিয়া কাঁপানো দশদিন’ হিসাবে৷ শোষণহীন সমাজ, বঞ্চিত–নিপীড়িত–খেটে খাওয়া মানুষের সমাজ নিছক কল্পনা নয়, জীবন্ত বাস্তব৷ মহান দার্শনিক কার্ল মার্কসের শিক্ষাকে ভিত্তি করে তাঁর সুযোগ্য উত্তরসাধক লেনিনের নেতৃত্বে যুগ যুগ ধরে মানুষের স্বপ্ণের সেই সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয় বাস্তবের মাটিতে৷ এই নতুন সমাজ নির্মূল করল বেকারি–ভিক্ষাবৃত্তি–পতিতাবৃত্তি-দারিদ্র-নিরক্ষতা৷ এক জাদুকাঠির স্পর্শে জেগে উঠল সেই ‘ঘুমন্ত দৈত্য’৷ শিল্পে পশ্চাদপদ রাশিয়া ইউরোপের শিল্পকে সব দিক দিয়ে ছাপিয়ে গেল৷ ১৯৩২ সালে মহামন্দার প্রভাবে পুঁজিবাদী অমেরিকায় যেখানে ৮৪ শতাংশ, ব্রিটেনে ৭৫ শতাংশ, জার্মানিতে ৫৫ শতাংশ উৎপাদন হ্রাস হচ্ছে সেখানে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির কল্যাণে সোভিয়েত রাশিয়ায় উৎপাদন বৃদ্ধি পেল ৩৩৪ শতাংশ৷ জারের আমলে অনাহারে, অশিক্ষায় জর্জরিত রাশিয়ার কৃষক সমাজ সমাজতন্ত্রকে হাতিয়ার করে হাজার হাজার বছরের পশ্চাদপদতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে হয়ে উঠেছিল নব যুগের অগ্রদূত৷ হাল–বলদের দেশ থেকে সোভিয়েত রাশিয়ার স্পুৎটনিকের দেশের আশ্চর্য রূপান্তরের রহস্য কী ছিল?

বিপ্লবের মধ্য দিয়ে সোভিয়েত রাশিয়ার মানুষ হস্তগত করেছিল এক অমোঘ হাতিয়ার– মার্কসবাদী–লেনিনবাদী আদর্শ এবং বিজ্ঞান৷ অন্যান্য প্রাণী প্রকৃতির দাস৷ আর মানুষ দুনিয়ার সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর জন্য দুনিয়াকে বদলায়৷ প্রকৃতির নিয়মকে জেনে, তাকে কাজে লাগিয়ে প্রাকৃতিক শক্তিকে জয় করে মানুষ৷ এই কাজে তার অন্যতম হাতিয়ার বিজ্ঞান৷ বিজ্ঞানের কাজ প্রাকৃতিক শক্তিকে বশ মানানো, মানুষের অভাব মেটানো, তার মেহনতের বোঝা কমানো৷ বিজ্ঞানের এই আশ্চর্য শক্তিতে ক্ষিপ্ত হয়েছিল অত্যাচারী শাসকরা৷ যদি মেহনতি মানুষ এই হাতিয়ারের সন্ধান পায় তা হলে এদের বিপদ তারা যখন দেখল বিজ্ঞান মানুষকে চিরকালের মতো অত্যাচারের হাত থেকে মুক্তি দেবে, ভয় ও কুসংস্কারের অন্ধকার ঘোচাবে তখন তারা বিজ্ঞানকে নিঃশেষ করতে চাইল৷

অন্ধকারাচ্ছন্ন সেই সামন্তী যুগে শত শত বছর ধরে বিজ্ঞানীদের ওপর চলেছে অকথ্য অত্যাচার৷ পুড়িয়ে মারা হয়েছে, তাদের দেহ ছিন্নভিন্ন করা হয়েছে৷ এ কথা ঠিক যে পুঁজিবাদ তার বিকাশের স্তরে বিজ্ঞানের সামনে নতুন পথ খুলে দিয়েছিল৷ কিন্তু ক্ষয়ের স্তরে এসে বুর্জোয়ারা চাইল তার  বিকাশ আটকাতে৷ কেবলমাত্র বিজ্ঞানের টেকনোলজির উন্নতি ঘটিয়ে তাকে ব্যক্তি মালিকের মুনাফার স্বার্থে কাজে লাগালো৷ সাধারণ মানুষ বিজ্ঞানের অধিকার পেল না৷ সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত রাশিয়ায় বিজ্ঞানের এই বন্ধ দুয়ার উন্মুক্ত হল৷ মহান নেতা লেনিন চেয়েছিলেন ভবিষ্যতের উন্নততর সমাজ সম্ভব করার জন্য মুষ্টিমেয়র লোভের কবল থেকে বিজ্ঞানকে উদ্ধার করে লক্ষ লক্ষ মানুষ যাতে তার মর্ম গ্রহণ করতে পারে বা তাকে ব্যবহার করতে পারে তার চেষ্টা করা৷ তাই সাধারণ মানুষ বিজ্ঞান চর্চার অধিকার পেল৷ নিষ্ক্রিয়তার অবসান ঘটিয়ে তাদের করে তুলল কৌতুহলী৷ বিকাশ ঘটল তাদের সৃজনশীলতার, মননের৷ তারা ভাবতে শুরু করল কৃষিতে–শিল্পে কীভাবে আরও উৎপাদন বাড়ানো যায়৷ স্বাস্থ্যে–শিক্ষায় বিজ্ঞানকে কীভাবে প্রয়োগ করা যায়৷ এই পথে ১৯১৭ সালে ২১০টি গবেষণাগারের সংখ্যা ১৯৩৭ সালে বেড়ে হল ২, ২০০টি৷ ১৯১৭ সালে ওই দেশে ১২ কোটি মানুষ ছিল নিরক্ষর আর ১৯৩৭ সালে ৯ কোটি লোক বিজ্ঞান বুঝতে আর প্রয়োগ করতে পারত৷ পুঁজিবাদী দেশের মতো ব্যক্তি মানুষের মুনাফার স্বার্থে নয় সমগ্র রুশবাসীর কল্যাণের জন্য তারা বিজ্ঞানকে ব্যবহার করল৷

বিপ্লবের পর রাশিয়ার কৃষিক্ষেত্র বিপর্যস্ত৷ দেশ তখন মহামারি–দুর্ভিক্ষ পীড়িত৷ খাদ্যভাব চরম৷ কৃষিতে উৎপাদন পদ্ধতি সাবেকি৷   উৎপাদন প্রচুর বাড়ানো দরকার৷ কিন্তু কীভাবে তা সম্ভব? তরুণ সাইবেরিয়ান চাষি ইয়েফ্রেমভেরও একই চিন্তা– গমের ফলন কীভাবে বাড়ানো যায়? চাষি বন্ধুদের সে বলল, ‘আমরা দর্শক হয়েই তুষ্ট থাকতে পারি না৷ আমাদের কাজ প্রকৃতিকে বশ মানানো’৷

বন্ধুরা হেসে বলে – ‘সে তো ঠিক৷ কিন্তু কী উপায়ে’? ইয়েফ্রেমভ প্রচণ্ড আগ্রহ নিয়ে পড়াশোনা শুরু করল৷ এই সময় তার হাতে এল অধ্যাপক টিমিরিয়াজেভের গবেষণাপত্র৷ পড়ে ফেললেন সেগুলি৷ ক্রমে তার মনে রূপ নিল এক আশ্চর্য চিন্তা – গাছেরা অবশ্যই মাটি থেকে খাদ্য জল আর বাতাস সংগ্রহ করে৷ এটা অত্যন্ত দরকারি৷ কিন্তু সেটাই কি সব? খাদ্য, জল, বাতাসকে শস্যে পরিণত করার জন্য গাছেদের যে শক্তি প্রয়োজন তার জোগান যদি সূর্যতাপ দেয় তবে সেটাই তো সব থেকে দরকারি জিনিস৷ ফলে শস্যের ফলন বাড়াতে হলে প্রতি একরে শস্য ফলাতে বেশি সূর্যতাপ ব্যবহার করতে হবে৷ আর তার জন্য প্রয়োজন একর পিছু গাছ রোপনের সংখ্যা বাড়ানো৷

এ নিয়ে কৃষি বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে মতবিরোধ বাধল৷ তারা বলল, ইয়েফ্রেমভের মতিভ্রম হয়েছে৷ কিন্তু সেও ছেড়ে দেওয়ার বান্দা নয়৷ যে যৌথ খামারে সে কাজ করত সেখানে একটা সভা ডাকল৷ সবাই এল৷ ঠিক হল ইয়েফ্রেমভ গবেষণা করবে৷ গবেষণা করার জন্য যৌথ খামারে তাঁকে জমি দেওয়া হল৷ অনেক সাইবেরিয়ান চাষি এগিয়ে এলেন সাহায্যের জন্য৷ গবেষণা আরম্ভ হল৷ জমিতে বিভিন্ন দূরত্বের একটার পর একটা বীজ লাগানো হল৷ অল্প দিনেই ইয়েফ্রেমভ প্রমাণ করলেন একটি গমের চারার জন্য দেড় বর্গ ইঞ্চি জমিই যথেষ্ট৷ এই গবেষণা সমগ্র দেশকে প্রচণ্ড ধাক্কা দিল৷ হঠাৎ চাষিরা দেখতে পেল সনাতন পদ্ধতির চেয়ে এই পদ্ধতিতে চাষ করলে এবার জমি পিছু পাঁচগুণ বেশি বীজ লাগানো ও পাঁচগুণ বেশি ফলন সম্ভব৷ একবার ভাবুন দেখি ভারতের কোনও জমিতে যদি ইয়েফ্রেমভ দিন মজুরি করত তবে তাকে সরকার গবেষণা করতে দিত?  যদি কোনও চাষি করতও তা হলে তার সুফলটা কে নিয়ে যেত? কিন্তু সোভিয়েত রাশিয়ার ব্যবস্থা অন্যরকম৷ সে দেশে বিজ্ঞান শুধু অধ্যাপক এবং ডিগ্রিধারীদের আয়ত্তাধীন কোনও রহস্যময় ব্যাপার নয়৷ সেখানে বিজ্ঞান সকলের জন্য উন্মুক্ত৷ সেখানে কৃষিবিদরা চাষি আর চাষিরা কৃষিবিদ– কৃষি ও নব বিজ্ঞান সেখানে এক পথের পথিক৷ তাই এই গবেষণার ফলাফল যখন ঘোষিত হল কৃষিবিদরা চটে গেলেন না, সংশয়ও প্রকাশ করলেন  না৷ তারা ছুটলেন ইয়েফ্রেমভের জমিতে৷ হাজার হাজার চাষি নিজেদের ‘ইয়েফ্রেমভপন্থী’ বলতে শুরু করল৷ বিখ্যাত রুশ বৈজ্ঞানিক অধ্যাপক বাস্তি বললেন, ‘ইয়েফ্রেমভই ঠিক, সেই হচ্ছে সাচ্চা সোভিয়েত বিজ্ঞানী৷ কারণ বিজ্ঞান হচ্ছে সমগ্র মানবতার কল্যাণের জন্য’৷

১৯২১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন যখন ভীষণ গৃহযুদ্ধ, মহামারি আর দুর্ভিক্ষের কবলে তখন খরস্রোতা পাহাড়ি নদী নীপারের ওপর বাঁধ তৈরির পরিকল্পনা করা হয়৷ এত বিরাট বাঁধ যে কল্পনা করতেও চমক লাগে৷ এমনকী মার্কিনদের কাছেও পরিকল্পনাটি বিপুল বোধ হল৷ রাশিয়ায়  এই বাঁধ ছিল মানুষের কাছে স্বপ্নের মতো৷ কিন্তু সেই স্বপ্নকে তারা সফল করল৷ আমেরিকার লেখিকা সাংবাদিক আনা লুই স্ট্রং তাঁর দুরন্ত নদী (ওয়াইল্ড রিভার) উপন্যাসে সমাজতান্ত্রিক এই গঠন পর্বের চিত্র সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন৷ দেখা যাচ্ছে বাঁধ তৈরির কাজে যুক্ত হয়েছিল যারা সেই সমস্ত সাধারণ মানুষ– ছন্নছাড়া–গৃহহীন, ভবঘুরে ছেলের দল স্তেপান, মরিন, ইভান, স্তেশা, মরোজফদের জীবন বদলে দিল সমাজতন্ত্র৷ কিছুদিন পর দেখা গেল এই ভবঘুরের দলই কেউ নীপার বাঁধের সুপারিনডেন্ট, কেউ সর্বোচ্চ সোভিয়েতের ডেপুটি, কেউ স্থানীয় পার্টির রাজনৈতিক শিক্ষা–বিভাগের পরিচালক৷

বিজ্ঞানকে গবেষণাগারের চার দেওয়াল থেকে মুক্ত করে দেশের কোটি কোটি মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়ে সোভিয়েত রাশিয়া দেখিয়েছিল কীভাবে রোগ ও অনাহার দূর করতে হয়, কৃষি ও শিল্পের উন্নতি ঘটিয়ে সর্বব্যাপী সুসভ্য জীবনযাত্রার স্বপ্নকে বাস্তবে রূপান্তরিত করতে হয়৷ কেমন করে দেশের মানুষকে মানসিক ও শারীরিক সুস্বাস্থ্যের অধিকারী করা যায়৷

আরও বহু দিক থাকলেও শুধু এই কারণেই রাশিয়ার বুকে নতুন ধরনের সমাজ প্রতিষ্ঠার সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবকে মহান বলতেই হবে৷