যেমন ছিল তেমনি চলবে

ভোটে  নেতার পরিবর্তন হয়, নীতির নয়৷ তাই মানুষ প্রতিবারই হারে, জেতে নেতা৷ এবারও মানুষের দাবি যে মুখ থুবড় পড়বে তা শুধু সময়ের অপেক্ষা৷ দেশে মদ চালু থাকবে কোটি কোটি টাকা আবগারি শুল্ক আয়ের জন্য৷ তাতে যদি সারাদিনের হাডভাঙা খাটুনির পর মজুরি নষ্ট হয় তা হোক৷ বুকটা আরও হোক ঝাঁজরা৷ ধর্ষণ, অত্যাচার, অনাচার চলবেই৷

৫৪২ জন সাংসদের মধ্যে ৪৭০ জন কোটিপতি, অনেকেই তার মধ্যে শত কোটিপতি৷ তাদের বেতন আরও বাড়বে৷ তাদের হাত ধরে বাড়বে দুর্নীতি৷ নিত্যব্যবহার্য রান্নার গ্যাসের দাম বাড়ানো হবে নিয়ম করে৷ ভোটের বিপুল খরচ তুলতে দ্রব্য সামগ্রীর দাম বাড়বে লাফিয়ে লাফিয়ে৷ একশ্রেণির কর্মচারীর বেতন বাড়িয়ে বাজারের ভারসাম্য রক্ষা করার চেষ্টা করা হবে, ঋণও দেওয়া হবে৷ কারণ বাজার চাহিদার ৪০ শতাংশ ঋণভিত্তিক৷ সর্বস্তরের মানুষের জন্য নয়, কিছু জনের জন্য উপঢৌকন দিয়ে বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে বহুল প্রচার করা হবে৷

এ পর্যন্ত কয়েক লক্ষ কৃষক আত্মহত্যা করেছেন গোটা দেশ জুড়ে এবং তাদের পরিবারের বেঁচে থাকার কঠিন সংগ্রামের কেউ খোঁজও রাখে না৷ অযথা ‘কৃষি বিমা’–র জালে জড়িয়ে তাদের উৎপাদনের উপকরণের মূল্য হ্রাস এবং উৎপাদনের পর ফসলের ন্যায্য দাম পাওয়ার ব্যবস্থা না করে তাদের জীবনকে বিপজ্জনক করে তোলা হবে৷ আর ঋণ মকুব তো দূর অস্ত৷

প্রতি বছর কয়েক হাজার মানুষ বিনা চিকিৎসায় মারা যায় আর কয়েক হাজার চিকিৎসা করাতে গিয়ে সর্বস্বান্ত হয়৷ তাদের জন্য উপযুক্ত স্বাস্থ্যব্যবস্থা তো হবেই না, উপরন্তু বেসরকারি মালিকের মুনাফা বৃদ্ধির সুবিধার জন্য ‘স্বাস্থ্য বিমা’ প্রকল্প চালু রেখে সরকারি হাসপাতালগুলোর ন্যূনতম চিকিৎসা দেওয়ার পরিকাঠামো ভেঙে ফেলার চেষ্টা হবে৷ এমন পলিসি নেওয়া হবে যাতে বেসরকারি উদ্যোগ বাড়তে থাকে এবং চিকিৎসা বাজারের পণ্য হিসেবে বিক্রি হতে থাকে৷ আর জনগণের ট্যাক্সের টাকা খরচ করে বিল্ডিং তৈরি করে বেসরকারি উদ্যোগের হাতে তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে৷ জনগণের দীর্ঘদিনের দাবি, গ্রামে–গ্রামে ইনডোর চিকিৎসা ব্যবস্থা অধরাই থেকে যাবে৷

বহু মানুষের কষ্টার্জিত জমানো টাকা ব্যাঙ্ক থেকে চুরি করে পালিয়ে যাবে তারা, যারা তাদের ভোটের খরচ জুগিয়েছে৷ দেশের খনিজ সম্পদের মালিকানা তুলে দেওয়া হবে তাদেরই হাতে৷ জনগণের অর্থে নির্মিত বিশাল সরকারি সংস্থা ভারতীয় রেলওয়ে পরিপূর্ণভাবে মালিকদের কুক্ষিগত হবে৷

পূর্ববর্তী রাষ্ট্রপতির ভাষণ অনুযায়ী দেশে বেকারের সংখ্যা প্রায় ৬১ কোটি৷ স্বভাবতই অর্থনীতি পরিচালনা করতে এই অবস্থায় নতুন নতুন কারখানা তৈরি করা ছাডা আর কি উপায় থাকতে পারে? এ ব্যবস্থায় তা হবে না৷ কালো টাকার সমান্তরাল অর্থনীতির ধারাবাহিকতায় ধনীদের সম্পদ ক্রমশ বাড়তেই থাকে আর নিঃস্ব হয়ে যায় অসংখ্য মানুষ৷ ভারতীয় অর্থনীতিতে দুর্নীতির হাত ধরে এই সমান্তরাল অর্থনীতি পাকাপাকি ব্যবস্থা করে নিয়েছে৷ এবং এর বিরুদ্ধে সরকারি নিষ্ক্রিয়তা যথেষ্ট উদ্বেগজনক৷

আগামী দিনে যারা দেশের হাল ধরবে দেশের সমস্ত শিশু–কিশোরদের মধ্যে মনুষ্যত্ব– বিবেক–নীতি–নৈতিকতা গড়ে তোলার জন্য দরকার সময়োপযোগী, বৈজ্ঞানিক, কুসংস্কারমুক্ত শিক্ষা ব্যবস্থা, যাতে তাদের চিন্তা যুক্তিনির্ভর হয়৷ কিন্তু সরকার চলছে ঠিক উল্টো পথে৷ শিক্ষা খাতে ব্যয়বরাদ্দ বৃদ্ধি দূরে থাক, শিক্ষাকে বাজারের পণ্য করে তোলা হয়েছে৷

সরকার শিক্ষা স্বাস্থ্য বিদ্যুৎ সহ মানুষের প্রয়োজনীয় বিষয়গুলি বেসরকারি মালিকদের হাতে তুলে দেওয়ার নীতির কোনও পরিবর্তন করবে না, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মানুষের ছোটো ছোটো চাহিদা পূরণ হবে না৷ তা ভোলাতে ‘জয় শ্রী রাম’ স্লোগানকে আতঙ্ক ছড়াতে ব্যবহার করা হচ্ছে৷ এর মধ্যেও মানুষের আশা– রবীন্দ্র–নজরুলের দেশ যেন বেঁচে থাকে  সম্প্রীতির অটুট মন্ত্র নিয়ে৷

গৌতম দাস, মালদা

(গণদাবী : ৭১ বর্ষ ৪৪ সংখ্যা)