মোরবি সেতু বিপর্যয়ঃ সিটের রিপোর্টে বিজেপি সরকার কাঠগড়ায়

গুজরাটের মোরবি সেতু ভেঙে ৫৫টি শিশু সহ ১৩৫ জনের মর্মান্তিক মৃত্যুর পর কেটে গেছে চার মাসের বেশি। বিশেষ তদন্তকারী সংস্থা ‘সিট’ এর রিপোর্টে এই সেতু ভাঙার কারণ সম্পর্কে যে তথ্য উঠে এসেছে, তাতে ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকারের অপদার্থতাই ফুটে উঠেছে।

রিপোর্ট বলছে, সেতুটির রক্ষণাবেক্ষণ এবং মেরামতিতে চূড়ান্ত গাফিলতি এবং অবহেলার কারণেই এই ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনা। দুর্ঘটনার আগে থেকেই সেতুটি বিপজ্জনক অবস্থায় ছিল। সেতুর দু’টি তারের মধ্যে একটির ক্ষয়জনিত সমস্যা ছিল। এই ধরনের সেতুর উপযোগী সিঙ্গল রড সাসপেন্ডার্স ব্যবহার না করে, সারাইয়ের সময় পুরোনো সাসপেন্ডার্স (সেতুর পাটাতনের সঙ্গে তার জুড়ে রাখা স্টিলের মোটা রড) এর সঙ্গে নতুন সাসপেন্ডার্স জুড়ে ঝালাই করা হয়েছে। মরচে পড়া তারে রং করে চকচকে করার চেষ্টা হয়েছে। সেতুর ৪৯টি তারের মধ্যে ২২টি আগেই ক্ষয়ে গিয়েছিল, ২৭টি তার দুর্ঘটনার সময় ছিঁড়ে পড়ে। সেতুর ওপর দিয়ে চলাচলের জায়গায় কাঠের তক্তার পরিবর্তে অ্যালুমিনিয়মের পাত ব্যবহার করা হয়, যা সেতুর নমনীয়তা আরও কমিয়ে দেয়। ১৮৮৭ সালে বৃটিশ আমলে নির্মিত এই প্রাচীন ঝুলন্ত সেতুটি মেরামতের দায়িত্ব কোনও দক্ষ পেশাদারি সংস্থার বদলে দেওয়া হয় অজন্তা ম্যানুফ্যাকচারিং লিমিটেড (ওরেভা গ্রুপ) নামে একটি ঠিকাদার সংস্থা, যারা মূলত ঘড়ি তৈরি করে। শুধু তাই নয়, মেরামতির পর ভার বহন ক্ষমতা যাচাই না করেই সেতুটি চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয়। তার পরেও সেতুতে একসাথে কতজন উঠবেন, কতক্ষণ থাকবেন সে ব্যাপারে নূ্যনতম নজরদারি বা সতর্কতা পুলিশ-প্রশাসন-সরকারের তরফে নেওয়া হয়নি। দুর্ঘটনার সময় সেতুর ওপরে ৩০০-র বেশি মানুষ ছিলেন, যা সেতুটির বহন ক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি। সিটের রিপোর্টে এই ঘটনাকে ‘ম্যান মেড ডিজাস্টার’ হিসাবে অভিহিত করা হয়েছে। যদিও একে ‘গভর্নমেন্ট মেড ডিজাস্টার’ বলাই উচিত। বলা হয়েছে, এই ধরনের পাবলিক সেতুর নিয়মিত চেকিং হওয়া প্রয়োজন যাতে কোনও অবস্থাতে একজনেরও প্রাণহানি না হয়। অথচ এই সব প্রয়োজনীয় কাজগুলি সরকার করেনি। জীবন দিয়ে এর মূল্য চোকাতে হল কারও মা, কারও বাবা, কারও ভাই বোন সন্তানকে।

সরকারের পক্ষ থেকে নিজেদের ভুল স্বীকার করা দূরের কথা, এমন এক একটি দুর্ঘটনায় শত শত মানুষের মৃত্যুর পর উপযুক্ত তদন্ত, দোষীদের শাস্তি দেওয়া, নিহতদের পরিবারের ক্ষতিপূরণ পর্যন্ত কথার কথা হয়ে থেকে গেছে। গুজরাট হাইকোর্ট ওর়েভা গ্রুপকে নিহতদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেবার কথা বলেছে, যদিও তা কবে কার্যকর হবে কেউ জানে না। সাধারণ মানুষের অভিজ্ঞতা বলে, পশ্চিমবঙ্গের পোস্তা হোক বা গুজরাটের মোরবি, এমন এক একটি ঘটনার পর কিছুদিন সংবাদমাধ্যমে এ নিয়ে খবর হয়, ক্যামেরার সামনে নেতা-মন্ত্রীরা তদন্ত-ক্ষতিপূরণ-দোষীদের শাস্তি নিয়ে অনেক গালভরা কথা বলেন, তারপর সব কথা সব প্রতিশ্রুতি চাপা পড়ে যায়, যতদিন না আবার এমন কোনও ঘটনায় আরও কিছু প্রাণহানি ঘটছে।

গুজরাটের এই ঘটনা আবারও প্রমাণ করল, আজকের সমাজব্যবস্থায় জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকারের কাছে জনগণের জীবনের দাম কানাকড়িও নয়। এই মর্মান্তিক ঘটনায় দুঃখপ্রকাশের ভদ্রতাটুকুও নরেন্দ্র মোদী দেখাননি, গুজরাটের বিজেপি সরকার উপযুক্ত তৎপরতায় নিহতদের ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করেনি, সব দায় ঠেলে দিয়েছে সেতু সংস্কারের দায়িত্বে থাকা ওর়েভা কোম্পানির ওপর। কিন্তু এসব করে সরকার নিজের অপদার্থতা এবং দায়িত্বজ্ঞানহীনতা চাপা দিতে পারে কি?

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সহ বিজেপি নেতা-মন্ত্রীরা তাদের সুশাসন বোঝাতে প্রায়শই গুজরাট মডেলের উদাহরণ দেন, কেন্দ্র-রাজ্যের ‘ডবল ইঞ্জিন সরকার’ এর প্রশস্তি করেন। মোরবির ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, বিজেপি সরকারের দুটি ইঞ্জিনই জংধরা এবং অকেজো। দেশজোড়া দারিদ্র-বেকারি-মূল্যবৃদ্ধি-নারী নির্যাতন-সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের দায় যেমন তাদের নিতে হবে, তেমনই জনতার আদালতে এ কথাও স্বীকার করতে হবে যে কুড়ি বছরের বেশি ক্ষমতায় থেকেও গুজরাটের মানুষকে নূ্যনতম নিরাপত্তা দিতে তারা ব্যর্থ হয়েছে।