Breaking News

মোদি সরকারের এফআরডিআই বিল ঋণ নেবে ধনকুবেররা, শোধ করবে জনগণ

দেশজোড়া প্রবল বিক্ষোভের সামনে পড়ে সরকার সাময়িকভাবে পিছু হটলেও এফ আর ডি আই তথা ফিনান্সিয়াল রেজলিউশন অ্যান্ড ডিপোজিট ইনসিওরেন্স বিল প্রত্যাহার করে নেয়নি৷ সহজে তা নেবেও না৷ ব্যাঙ্কিং শিল্পকে ধীরে ধীরে বেসরকারি মালিকদের হাতে তুলে দেওয়ার এক সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা থেকেই সরকার এই বিল তৈরি করেছে৷ এর পিছনে রয়েছে দেশীয় একচেটিয়া পুঁজিপতিদের মাথা৷ পুঁজিপতি শ্রেণির পলিটিক্যাল ম্যানেজার হিসাবে বিজেপি সরকারের লক্ষ্য এই বিলকে আইনে পরিণত করে তা ব্যাঙ্ক সহ অন্যান্য আর্থিক ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা৷

সরকারের নেতা–মন্ত্রীরা বলছেন, বড় মাপের কোনও আর্থিক প্রতিষ্ঠান দেউলিয়া হয়ে গিয়ে যাতে অর্থনীতিকে নড়বড়ে করে দিতে না পারে তা নিশ্চিত করতেই এই বিল৷ অথচ এ–সব প্রতিষ্ঠানের দেউলিয়া হওয়ার কথা উঠছে কেন বা তা কী করে আটকানো যায় সে বিষয়ে একটি কথাও বিলে উল্লেখ করা হয়নি৷ ব্যাঙ্কগুলিকে দেউলিয়া তো সাধারণ আমানতকারীরা করে না৷ বরং দেশের সাধারণ মানুষের অর্থই ব্যাঙ্কের মোট অর্থের সিংহভাগ৷ দেশের মানুষের মোট আর্থিক সম্পদের ৬৩ শতাংশই ব্যাঙ্কে রয়েছে৷ তা হলে ব্যাঙ্কের দেউলিয়া হওয়ার কারণ কী? কারণ দেশের কর্পোরেট পুঁজিপতিদের অবাধ লুঠতরাজ৷ এই পুঁজিপতিরা দেশের ব্যাঙ্কগুলি থেকে লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা ঋণ হিসাবে নিয়ে শোধ করেনি৷ শুধুমাত্র রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে এর পরিমাণ ২০১৫–র মার্চের ২.৭৫ লক্ষ কোটি থেকে বেডে ২০১৭–র জুনে দাঁডিয়েছে ৭.৩৩ লক্ষ কোটি৷ এ ছাড়া রয়েছে বেসরকারি ব্যাঙ্কগুলির অনাদায়ী ঋণ (এনপিএ)৷ সব মিলিয়ে পরিমাণ প্রায় ১০ লক্ষ কোটি টাকা৷ তাদের অজুহাত, শিল্প রুগ্ন, তাই ঋণ অনাদায়ী৷ বাস্তবে কোনও শিল্পপতিকেই রুগ্ন দেখা যাচ্ছে না৷ তাদের  মুনাফার পরিমাণ বেড়েই চলেছে৷ তা ছাড়া কোনও শিল্প রুগ্ন হলে তার দায় কি সাধারণ মানুষের? শিল্পের রুগ্নতার কারণ তার পুঁজিবাদী পরিচালন ব্যবস্থা৷ তার দায় সাধারণ মানুষের ঘাড়ে চাপবে কেন? মালিকরা যখন শত–সহস্র কোটি টাকা মুনাফা করে তার ভাগ তো তারা জনগণকে দেয় না!

অনাদায়ী এই বিপুল পরিমাণ ঋণের টাকা আদায়ের দায়িত্ব কার? ব্যাঙ্কের বোর্ডগুলির– যারা এই ঋণ মঞ্জুর করেছে, সরকারের রিজার্ভ ব্যাঙ্কের– যাদের তত্ত্বাবধানে ব্যাঙ্কগুলি চলে, সবার উপরে দায়িত্ব সরকারের৷ এরা কেউই তাদের দায়িত্ব পালন করে না৷ কেন করে না? কারণ বোর্ড এবং রিজার্ভ ব্যাঙ্কও পুঁজিপতিদের স্বার্থের বাইরে যায় না৷ সম্প্রতি রিজার্ভ ব্যাঙ্কের এক ডেপুটি গভর্নর বলেছেন, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলির আবার বেসরকারিকরণ প্রয়োজন৷ চেম্বার অফ কমার্সগুলিও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলিতে সরকারি শেয়ার চল্লিশ শতাংশের নিচে নামাতে বলেছে৷ সরকারগুলি তো আজ খোলাখুলি পুঁজিপতিদের পদসেবা করছে৷ বিজেপি–কংগ্রেসের মতো সব ভোটবাজ রাজনৈতিক দলই আজ পুঁজিপতিদের টাকার উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল৷ একের পর এক নির্বাচনে এই যে জলের মতো টাকা খরচ করে এই দলগুলি, সেই টাকা এসেছিল কোথা থেকে? জনগণের কাছে হাত পেতে তো এই টাকা তারা জোগাড় করে না৷ জোগান দেয় একচেটিয়া পুঁজিপতিরা৷ স্বাভাবিক ভাবেই তাদের গায়ে হাত দেওয়ার ক্ষমতা এই দলগুলি তথা সরকারের নেই৷ তাদের থেকে টাকা আদায় বা অনাদায়ে শাস্তি তো দুরের কথা, ‘রাইট অফ’ বা ‘ওয়ান টাইম সেটলমেন্ট’–এর মধ্য দিয়ে তাদের হাজার–লক্ষ কোটি টাকার দায় থেকে রেহাই দেওয়া হচ্ছে৷ এমনকী তাদের নাম প্রকাশ করতেও সরকার রাজি নয়৷ এ নিয়ে পার্লামেন্টারি কমিটির সুপারিশগুলি কার্যকর করার ব্যাপারেও সরকার কোনও হেলদোল নেই৷ উল্টেএই সংকট থেকে পরিত্রাণ পেতে সরকারের অনুমোদন সাপেক্ষে ব্যাঙ্কগুলি জমা টাকার উপর সুদের হার কমাচ্ছে, নানা ক্ষেত্রের ‘সার্ভিস চার্জ’ বৃদ্ধি করে গ্রাহকদের উপর আক্রমণ নামিয়ে এনেছে৷ অর্থাৎ পুঁজিপতিদের লুঠতরাজের বিষময় ফল ভোগ করতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে৷ সাধারণ মানুষের উপরই চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে অনাদায়ী ঋণের সমস্ত বোঝা৷ সেই পরিকল্পনা থেকেই এফআরডিআই বিল৷

বিলটি আইনে পরিণত হলে ব্যাঙ্কে রাখা সাধারণ মানুষের আমানতের নিরাপত্তা দারুণভাবে বিঘ্নত হবে৷ এই বিলের সবচেয়ে বিপজ্জনক ধারা হল ৫২ নম্বর ধারা৷ ৫২(১) ধারায় বলা হয়েছে, ওই আইনের আওতায় থাকা কোনও সংস্থার লোকসান হলে তাকে বাঁচাতে মূলধন জোগানোর জন্য ‘বেইল ইন’ নামক একটি প্রকল্প তৈরি হবে৷ ৫২(৩) ধারায় পরিষ্কার বলা হয়েছে, সংশ্লিষ্ট সংস্থার যে দায় গ্রাহকদের প্রতি রয়েছে, প্রয়োজনে তা বাতিল করা যেতে পারে৷ এর সবটাই দেখভাল করবে ‘ফিনান্সিয়াল রেজলিউশন কর্পোরেশন’ নামের একটি সংস্থা৷ এই সংস্থা ১১ জনকে নিয়ে গঠিত হবে যার ৭ জন হবেন সরকারের প্রতিনিধি৷ এর ফলে বর্তমান ডিপোজিট ইনসিওরেন্স ও ক্রেডিট গ্যারান্টি কর্পোরেশন তার অস্তিত্ব পুরোপুরি হারিয়ে ফেলবে৷ এতদিন পর্যন্ত ব্যাঙ্কের বিভিন্ন অ্যাকাউন্টে যত টাকাই কারও থাকুক, ডিআইসিজিসি–এর মাধ্যমে এক লক্ষ টাকা পর্যন্ত ফেরত পাওয়ার নিশ্চয়তা আছে৷ বাকি টাকার একাংশও মিলতে পারে ব্যাঙ্কের সি আর আর, এস এল আর বা অন্যান্য সম্পদ বিক্রি করে৷ নতুন বিলে প্রস্তাব করা হয়েছে আর্থিক সংকটে ব্যাঙ্ক দেউলিয়ার মুখে থাকলে, আমানতের টাকা গ্রাহকের অনুমতি না নিয়েই বাড়তি সময় আটকে রাখতে পারবে ব্যাঙ্ক৷ গ্রাহকের সঙ্গে সবরকম চুক্তি অস্বীকার করে জমা টাকার উপর সুদের হার কমাতেও পারবে৷ এমনকী প্রয়োজনে তা বদলে দিতে পারবে শেয়ার, ডিবেঞ্চার বা বন্ডে৷ এই বিল শুধু জনবিরোধী নয়, মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারের উপরও সরাসরি হস্তক্ষেপ৷ কারণ এখানে সম্পদের কোনও দায়বদ্ধতা থাকবে না৷ ‘রেজলিউশন কর্পোরেশ’নের কোনও সিদ্ধান্তকে আদালতেও চ্যালেঞ্জ করা যাবে না৷

এই বিল শুধু গ্রাহকদের নয়, ব্যাঙ্ককর্মীদের উপরও আক্রমণ নামিয়ে আনবে৷ বিলের সেকশন ৪৪(৩–সি)–তে বলা হয়েছে, ‘রেজলিউশন কর্পোরেশন’ দুর্বল হয়ে যাওয়া ব্যাঙ্কের কর্মীদের বেতন বা পারিশ্রমিক প্রয়োজনে চুক্তির বাইরে গিয়েও কমিয়ে দিতে পারবে৷ ১৪ নম্বর অধ্যায়ে ‘কর্পোরেশন বোর্ড’কেই ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে যে, তারাই বিচার করবে কোন ব্যাঙ্ক তার কাজ চালাতে অক্ষম বা কোনও ব্যাঙ্ককে দেউলিয়া হিসাবে ঘোষণা করা হবে এবং এর পরিণামে কর্মীদের যে কোনও ধরনেরই অনভিপ্রেত অবস্থার মুখোমুখি হতে হবে, এমনকী তাদের কাজও হারাতে হতে পারে৷ বিলের সেকশন ৪৯ আই এবং জে–তেও বলা হয়েছে কেবল দেউলিয়া নয়, ব্যাঙ্ক সংযুক্তিকরণের বা একটা ব্যাঙ্কের সমস্ত দায় অন্য ব্যাঙ্কের উপর চাপিয়ে দেওয়ার পর যে নতুন পরিস্থিতির উদ্ভব হবে সেখানেও ব্যাঙ্ককর্মীদের চাকরি হারাতে হতে পারে৷ ফলে এই বিল আইনে পরিণত হলে গ্রাহকদের সাথে সাথে ব্যাঙ্ককর্মীদের উপরও নতুন করে নানাবিধ আক্রমণ নেমে আসবে৷ নোট বাতিল ও জিএসটির ধাক্কায় যখন লক্ষ লক্ষ শ্রমিক কর্মহীন, নিঃস্ব রিক্ত অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন, তখন আমানতকারীদের উপর আর্থিক সংস্থার এই আক্রমণ নিঃসন্দেহে সাধারণ মানুষকে আরও সংকটে ফেলবে৷

এই বিলটি সম্পূর্ণ জনবিরোধী এবং বৃহৎ পুঁজিপতিদের স্বার্থরক্ষার জন্যই৷ সরকার জানে, আম্বানি, আদানি, বিজয় মালিয়া, ললিত মোদি, পবন রুইয়াদের চটিয়ে ক্ষমতার গদিতে পৌঁছানো বা টিকে থাকা যাবে না৷ ভোট সর্বস্ব এই রাজনীতিই জনগণকে আজ এই দুর্দশায় ফেলেছে৷ এই বিল পরিষ্কার দেখিয়ে দিল, দেশটা আপাতদৃষ্টিতে একটি সরকার চালালেও এর মূল চালিকাশক্তি দেশের পুঁজিপতি শ্রেণি৷ রাষ্ট্রটা পরিচালিত হচ্ছে তাদের স্বার্থেই৷ পুঁজিপতিদের স্বার্থের কাছে জনগণের স্বার্থ অনায়াসে বলি দেওয়া হচ্ছে৷ পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের এটাই বৈশিষ্ট্য৷ সরকার হল এই পুঁজিবাদী রাষ্ট্র ব্যবস্থার পাহারাদার৷ ভোট সর্বস্ব বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে কে যোগ্য পাহারাদার হতে পারবে চলছে তারই প্রতিযোগিতা৷ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলির পরস্পর বিরোধিতা এই বিষয়কে কেন্দ্র করেই আবর্তিত৷ পুঁজিপতি শ্রেণির এই আক্রমণকে প্রতিহত করতে হলে পুঁজিবাদী এই ভোট রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে৷ গড়ে তুলতে হবে শোষিত মানুষের ঐক্য৷ ব্যাঙ্কক্ষেত্রে এই আক্রমণকে প্রতিহত করতে আমানতকারীদের সমিতি গড়ে তুলে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে৷