মোদির রাজত্বে উন্নয়ন মদের বিক্রি বেড়েছে দেদার

ফাইল চিত্র

ভোটের মুখে দেদার উন্নয়নের ফিরিস্তি শোনাচ্ছেন কেন্দ্র–রাজ্যের শাসক দলগুলির নেতা–নেত্রীরা৷ কিন্তু বাস্তবে কী করেছেন তাঁরা মানুষের জন্য? বেকারদের কাজ দিয়েছেন? মূল্যবৃদ্ধিতে লাগাম পরাতে পেরেছেন? সবার জন্য শিক্ষা এবং চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছেন? সমাজে নীতি–নৈতিকতার অধোগতি রোধ করার চেষ্টা করেছেন? না এসব কিছুই তাঁরা করেননি৷ তা হলে তাঁরা মানুষের জন্য কী করেছেন? যে কাজটা তাঁরা করেছেন তা হল, দেশের মানুষ এসব অভাবগুলি যাতে অনুভবই করতে না পারে তার জন্য মদের ঢালাও বন্দোবস্ত করে দিয়েছেন৷

সম্প্রতি বিশ্বখ্যাত ল্যান্সেট জার্নালে প্রকাশিত একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে দেশের মানুষের মধ্যে বার্ষিক মদ্যপানের পরিমাণ ২০১০–১৭ এই সাত বছরে গড়ে ৩৮ শতাংশ বেড়ে গেছে৷ ফলে বিজেপির বিরুদ্ধে যে অভিযোগ উঠছে তারা দেশের মানুষের জন্য কিছুই করেনি, সে কথা ঠিক নয়৷ মানুষ খেতে পাক বা না পাক, বেকারদের কাজ কিংবা রোগে ওষুধ জুটুক বা না জুটুক, শিক্ষার অভাবে অজ্ঞ–মূর্খ হয়েই থাকুক– দেশে মদের সরবরাহে ঘাটতি সরকার রাখেনি৷ সংস্থাটি জানিয়েছে, যে প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে তাতে ২০২৫ সালের মধ্যে ভারতীয়দের বার্ষিক গড় মদ্যপানের পরিমাণ আরও ২.২ লিটার বাড়বে, যা দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার দেশগুলির মধ্যে সর্বাধিক হতে চলেছে৷ অর্থাৎ সরকার চায় মানুষ মদ খেয়ে বুঁদ হয়ে থাকুক আর তার দুঃখ–কষ্টের কথা, বেকারি, মূল্যবৃদ্ধি, অশিক্ষা, বিনা চিকিৎসার কথা ভুলে থাকুক৷ বরং ভোটের সময় সরকারি দলগুলির বদান্যতায় অঢেল মদ খেয়ে তাদেরই আবার ভোট দিয়ে আসুক৷

পিছিয়ে নেই পশ্চিমবঙ্গ সরকারও৷ এ বছর রেকর্ড মদ বিক্রি করে দশ হাজার কোটি টাকা আয় করেছে রাজ্য সরকার৷ এ নিয়ে নিশ্চয়ই নেতা–মন্ত্রীদের গর্বের অন্ত নেই৷ অথচ মদ যে সর্বনাশা, মদের নেশা যে মানুষকে শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক ভাবে অধঃপাতের পথে নিয়ে যায়, এ তো সবারই জানা৷ আন্তর্জাতিক সমীক্ষাটি দেখাচ্ছে, মদ নানা রকম রোগের এক গুরুত্বপূর্ণ উৎস৷ প্রায় ২০০টি রোগের উৎস মদ্যপান৷ শুধু তাই নয়, এক সমীক্ষায় ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন (হু) জানিয়েছে, ভারতে গড়ে প্রতি বছর ২.৬০ লক্ষ মানুষের প্রাণ যাচ্ছে মদ্যপানজনিত রোগ এবং মদ্যপ অবস্থায় পথ দুর্ঘটনায়৷ নারীধর্ষণ ও মহিলাদের উপর অত্যাচারের ঘটনা যে সমস্ত সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে, তার পিছনেও অন্যতম কারণ মদের সর্বনাশা নেশা৷ ধর্ষণ–ত্যাচারের অধিকাংশ ঘটনাতেই দেখা যায়, উৎপীড়করা মদ্যপ অবস্থায় ছিল৷

স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন ওঠে, কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারের নেতা–মন্ত্রীরা কি মদের এই মারাত্মক কুফলের কথা জানেন না? অবশ্যই জানেন৷ মদের এই স্বাভাবিক পরিণতির কথা না জানার কোনও কারণ নেই৷ তা হলে মদের প্রসার তাঁরা আরও বাড়িয়ে তুলছেন কেন? এর থেকেই স্পষ্ট, এই সব দল এবং সরকারগুলি মুখে জনদরদের যে কথা বলে তা কতখানি ভুয়ো৷

আসলে এরা সকলেই চায় সাধারণ মানুষ মদ খাক, নেশা করুক আর এই ভাবে জীবনের শোষণ–যন্ত্রণার কথা ভুলে থাকুক৷ তা হলে গণতন্ত্রের নাম নিয়ে শাসক শ্রেণি এবং তাদের মদতপুষ্ট সরকারি দলগুলি যে শোষণ–ত্যাচার জনগণের উপর চালিয়ে যাচ্ছে তা নির্বিঘ্ণ হয়৷ কেন শোষণ, কেন দারিদ্র, কেন বৈষম্য, এসবের হাত থেকে রেহাইয়ের রাস্তা কী, এসব প্রশ্ন আর কেউ করবে না৷ কেন গণতন্ত্রের নামে বারবার ভোট হয়, বারবার সরকার বদলায় অথচ জনগণের দুরবস্থার বদল হয় না, এ প্রশ্ন কেউ তুলবে না৷ সরকারের নেতা–মন্ত্রীদের চুরি–দুর্নীতির বিরুদ্ধে, জনবিরোধী নীতিগুলির বিরুদ্ধে কোনও যুবকের মুষ্ঠিবদ্ধ হাত তা হলে আর আকাশে উঠবে না, যা শাসকের মনে ভয় ঢুকিয়ে দিতে পারে৷ জনগণকে অজ্ঞ, মূর্খ, অসচেতন, বেহুঁশ রাখতে পারলেই, পশুর মতো করে রাখতে পারলেই শাসকদের সুবিধা৷ নেশাগ্রস্ত জনগণকে তা হলে তাদের বোঝাতে সুবিধা হয় যে, তাদের এই দুরবস্থার জন্য দায়ী মালিক শ্রেণি নয়, শোষণমূলক এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থা নয়, দায়ী তাদের অসংযত চরিত্র৷ অন্যদেরও বোঝানো যায় যে, মানুষের হাতে পর্যাপ্ত অর্থ আছে বলেই তারা মদের পিছনে খরচ করতে পারে, যা আসলে উন্নয়নেরই লক্ষণ৷ বাস্তবে দুর্ভিক্ষের সময়েও সিনেমা হলগুলির সামনে ভিড় দেখিয়েই এরা বলে, কোথায় গরিবের কষ্ট? ভালোই তো আছে মানুষ অথচ পুঁজিবাদী শোষণ–বঞ্চনা মানুষকে যে হীন অবস্থার দিকে ঠেলে দিয়েছে, তা তাকে বিবেকহীন পশুর স্তরে নামিয়ে আনে৷ সে এমনকি পরিবারকে অনাহারে রেখে, সন্তানকে বিনা চিকিৎসায় ফেলে রেখেও ছোটে ভাটিখানার দিকে৷ আর তা দেখিয়ে এই শাসকরা বলে –দেখো ভাটিখানায় কত ভিড় মানুষের হাতে কত অর্থ!

(গণদাবী : ৭১ বর্ষ ৪০ সংখ্যা)