‘মোদিকেয়ার’–এর উদ্দেশ্য জনগণের ‘কেয়ার’ নয়

২০১৮–’১৯ আর্থিক বছরের বাজেটে অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি ‘আয়ুষ্মান ভারত যোজনা’ বা ‘মোদিকেয়ার’ ঘোষণা করে, একে ঐতিহাসিক এবং সারা বিশ্বে রাষ্ট্র পরিচালিত সর্ববৃহৎ স্বাস্থ্য–পরিষেবা প্রকল্প বলে অভিহিত করেছেন৷ এই প্রকল্পের জন্য ১০,৫০০ কোটি টাকার বাজেট বরাদ্দও করা হয়েছে৷ উদ্দেশ্য ভারতের হতদরিদ্র এবং স্বাস্থ্যবঞ্চিত প্রায় ১০ লক্ষ পরিবারের উচ্চস্তরের হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসার খরচ মেটানো এবং অবশ্যই তা বিমার মাধ্যমে৷ এই ‘ন্যাশনাল হেলথ প্রোটেকশন স্কিমের’ আর একটি অংশ হল সারা দেশে দেড় লক্ষ ‘হেলথ ওয়েলনেস সেন্টার’ গড়ে তোলা৷ এই সেন্টারগুলি থেকে সামগ্রিকভাবে প্রাথমিক চিকিৎসা পরিষেবার দেওয়ার এবং বিনামূল্যে অত্যাবশ্যক ওষুধ সরবরাহ করার প্রতিশ্রুতি আছে৷ করা যাবে পরীক্ষা–নিরীক্ষাও৷

এই ঘোষণার পর প্রধানমন্ত্রী ছত্তিশগড়ের বিজাপুর জেলায় গত ১৪ এপ্রিল দেশের প্রথম ‘হেলথ ওয়েলনেস সেন্টার’ বা স্বাস্থ্য কল্যাণকেন্দ্র উদ্বোধন করেছেন এবং ১৫ আগস্ট থেকে এগুলি সারা দেশে ছড়িয়ে পড়বে বলে প্রবল প্রচার করা হচ্ছে৷ বলা হচ্ছে, ২০২২ সালের মধ্যে এক নব ভারতের দর্শন মিলবে৷

নরেন্দ্র মোদি এখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাথে নিজেকে বিভিন্ন বিষয়ে সমতুল্য ভাবতে ভালবাসেন৷ আমেরিকায় স্বাস্থ্য নিয়ে নাগরিকদের উষ্মা ও বিক্ষোভকে প্রশমিত করতে ঠিক যেমন ‘ওবামাকেয়ার’ নীতি চালু হয়েছিল প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার আমলে, তেমনি এই স্বাস্থ্যপ্রকল্পকে মোদির একনিষ্ঠ অনুগামীরা ‘মোদিকেয়ার’ আখ্যা দিচ্ছেন৷

দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার হাল বোঝা যায় স্বাস্থ্যমন্ত্রক প্রকাশিত ‘ন্যাশনাল হেলথ প্রোফাইল–২০১৮’ রিপোর্টে৷ সেখানে বলা হয়েছে দেশের অধিকাংশ নাগরিক স্বাস্থ্যবঞ্চিত শুধু নয়, তারা চিকিৎসা করাতেই যায় না, কারণ চিকিৎসার খরচই বহন করতে পারে না৷ তা সত্ত্বেও স্বাস্থ্যক্ষেত্রে সরকারের বরাদ্দ জিডিপির মাত্র ১.০২ শতাংশ, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ‘হু’ নির্ধারিত ৫ শতাংশের অনেক নিচে৷ গত চার বছরের শাসনে বিজেপি সরকার স্বাস্থ্য বাজেটে ছাঁটাই করেছে একাধিকবার৷ মেডিকেল কাউন্সিল ভেঙে অগণতান্ত্রিক ন্যাশনাল মেডিকেল কমিশন তৈরির বিল এনেছে– যা সারা দেশে প্রবলভাবে ধিক্কৃত৷ এনেছে জনবিরোধী ‘ন্যাশনাল হেলথ পলিসি–২০১৭’– যা আদৌ স্বাস্থ্য সুরক্ষা নয়, ইনসিওরেন্স ব্যাবসারই নামান্তর৷

এবার ‘মোদিকেয়ার’–এর নামে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার নতুন কী করতে চাইছে? এই প্রকল্পে বলা হয়েছে, প্রতিটি নির্বাচিত গরিব পরিবারকে ৫ লক্ষ টাকার বার্ষিক বিমা কভারেজ দেওয়া হবে মূলত হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসার জন্য৷ সরকার এই বিমার প্রিমিয়াম দেবে আনুমানিক বছরে ২০০০ টাকা করে৷ এই টাকা ৬০ : ৪০ অনুপাতে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার দেবে৷ সরকারের দাবি, এই প্রকল্পে প্রায় ৪৩ থেকে ৫০ কোটি নাগরিকের অর্থাৎ দেশের ৪০ শতাংশ গরিব নাগরিকের স্বাস্থ্যপরিষেবা সুরক্ষিত হবে৷

মানুষ ভুলে যায়নি, পূর্বতন ইউপিএ সরকারের আমলে ২০০৮ সাল থেকে দেশে রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্য বিমা যোজনা (আর এস বি ওয়াই) চালু করা হয়েছিল– অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিক ও তাঁদের পরিবারের জন্য৷ বলা হয়েছিল, হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা খরচ হিসাবে পরিবারের সর্বোচ্চ পাঁচজন সদস্যের জন্য বছরে ৩০,০০০ টাকা পাওয়া যাবে৷ দেশের ৯৩ শতাংশ শ্রমিক কর্মচারীই অসংগঠিত ক্ষেত্রে নিযুক্ত৷ তা সত্ত্বেও ২০১৩ সাল পর্যন্ত মাত্র সাড়ে তিন কোটি মানুষের হাতে এই যোজনার স্মার্টকার্ড বিতরণ করা হয়েছিল৷ এই চিকিৎসা পরিষেবা নিয়ে উপভোক্তাদের গভীর অসন্তোষ ও বঞ্চনা রয়েছে৷ প্রায় এক দশকে তা পৌঁছেছে সামান্য অংশের অসংগঠিত পরিবারে৷ এই মোদিকেয়ারেরও যে একই দশা হবে না, তার গ্যারান্টি কোথায়?

যে দেশগুলি বিশ্বে ইউনিভার্সাল হেলথ কভারেজের আওতায় স্বাস্থ্য পরিষেবাকে উল্লেখযোগ্য ভাবে আনতে সক্ষম হয়েছে, স্বাস্থ্যে তাদের বরাদ্দ দেখলে এই প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক৷ স্বাস্থ্য খাতে সুইডেন খরচ করে জিডিপির ৯.২ শতাংশ, ফ্রান্স ৮.৭ শতাংশ, ডেনমার্ক ৮.৭ শতাংশ, বেলজিয়াম ৮.৭ শতাংশ, নেদারল্যান্ড ৮.৬ শতাংশ, সুইজারল্যান্ড ৮.৫ শতাংশ, নরওয়ে ৮.৫ শতাংশ, আমেরিকা ৮.৫ শতাংশ, ইউ কে ৭.৯ শতাংশ ইত্যাদি৷ সেখানে ভারত স্বাস্থ্যখাতে খরচ করে জিডিপির মাত্র ১.০২ শতাংশ৷

এদেশে গ্রামাঞ্চলের প্রয়োজনের তুলনায় স্বল্পসংখ্যক স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে শুরু করে গ্রামীণ ও জেলা হাসপাতালগুলিতে ডাক্তার–নার্স–স্বাস্থ্যকর্মী-চিকিৎসা সরঞ্জাম–ওষুধপত্র ও পরিষেবার প্রচণ্ড অভাব৷ ডাক্তারহীন স্বাস্থ্যকর্মীসর্বস্ব ‘সাবসেন্টার’ গড়ে উঠেছে পঞ্চায়েত স্তরে গ্রামীণ স্বাস্থ্য মিশন প্রকল্পে৷ যেগুলির পরিষেবা নেহাতই অকিঞ্চিৎকর৷ সেখানে সারা দেশে ১.৫ লক্ষ স্বাস্থ্যকল্যাণ কেন্দ্র গড়ে তোলার জন্য মোদিকেয়ারে বরাদ্দ মাত্র ১২০০ কোটি টাকা৷ অর্থাৎ কেন্দ্র প্রতি বরাদ্দ মাত্র ৮০,০০০ টাকা এবং প্রতি তিনটি গ্রাম পঞ্চায়েত পিছু থাকবে দুটি করে স্বাস্থ্যকেন্দ্র৷ এই পরিকল্পনা না প্রচলিত স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলির উন্নয়ন ঘটাবে, না প্রকৃত পরিষেবা কেন্দ্র গড়ে তুলতে সমর্থ হবে৷ তাছাড়া, ৫০ কোটি লোকের জন্য ১০,৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ ধরলে মাথাপিছু দাঁড়ায় বছরে মাত্র ২১০ টাকা৷ আমাদের দেশে ইতিমধ্যে ১,১১২ টাকা মাথা পিছু খরচ হচ্ছে বলে ন্যাশনাল হেলথ প্রোফাইল ২০১৮–তে দাবি করা হয়েছে৷ তা হলে এই যৎকিঞ্চিত বৃদ্ধি দেশের নাগরিক স্বাস্থ্যে কি শ্রীবৃদ্ধি ঘটাতে পারে?

২০০০ সালের মধ্যে সকলের জন্য স্বাস্থ্য ‘জাতীয় গ্রামীণ স্বাস্থ্যমিশনের পরে এই ‘আয়ুষ্মান ভারত’ প্রকল্প বাস্তবে একটি বড় ধোঁকা এবং মানুষের কষ্টার্জিত অর্থে বিমা কোম্পানি ও বেসরকারি স্বাস্থ্য ব্যবসায়ীদের ঘরে গুনাগার দেওয়ার পরিকল্পনা বিশেষ৷ তবে ‘মোদিকেয়ার’–এর ঘোষণায় বিমা কোম্পানিগুলি যারপর নাই খুশি৷ খুশি স্বাস্থ্য পরিষেবা যাদের কাছে পণ্য সেই কর্পোরেট স্বাস্থ্যব্যবসায়ীরা ৷ এই প্রকল্পের সবটাই বিমা নির্ভর৷ সরকার তার প্রিমিয়াম নিশ্চিত করবে মাত্র৷ আর সরকারি হাসপাতাল এই পরিষেবা বিক্রি করবে টাকার বিনিময়ে৷ রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্য বিমা যোজনা যতটুকু বিস্তৃত হয়েছিল তার সিংহভাগ পরিষেবা দিয়েছে বেসরকারি নার্সিং হোম হাসপাতাল৷ আয়ুষ্মান ভারতের ‘আয়ু’ বৃদ্ধি করবে বিমা কোম্পানি ও কর্পোরেট স্বাস্থ্যব্যবসায়ীরা৷

জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি ২০১৭ এবং ইউনিভার্সাল হেলথ কভারেজে এই বিমার কাহিনি শোনানো হয়েছে ছত্রে ছত্রে৷ আর কে না জানে স্বাস্থ্যের বিমা মানে, স্বাস্থ্যের অধিকার বা নাগরিকের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নয়৷ নাগরিকের টাকায় বিমা কোম্পানি ও বেসরকারি স্বাস্থ্য ব্যবসার ক্ষেত্রের উদরপূর্তি ঘটানো৷ স্বাস্থ্যের প্রকৃত অধিকার হল, সব নাগরিকের স্বাস্থ্যের দায়িত্ব রাষ্ট্রের৷ আর তা আদায় করার জন্য চাই জনসাধারণকে যুক্ত দীর্ঘস্থায়ী জনস্বাস্থ্যরক্ষা আন্দোলন৷

(৭১ বর্ষ ৫ সংখ্যা ৩১ আগস্ট, ২০১৮)