মৈপীঠে তৃণমূল দুষ্কৃতীরা নৃশংসভাবে খুন করল সংগ্রামী নেতা কমরেড সুধাংশু জানাকে

 

আমফান ঝড়ে ক্ষতিপূরণ নিয়ে দুর্নীতি ঢাকতে সিপিএমের পুরনো কায়দাতেই সুন্দরবন ঘেঁষা কুলতলির মৈপীঠের নোনা মাটিকে আবার রক্তাক্ত করল তৃণমূল দুষ্কৃতীরা৷ ৪ জুলাই তাদের হামলায় নিহত হলেন মৈপীঠ এলাকার গরিব মানুষের আন্দোলনের অন্যতম নেতা, এস ইউ সি আই (সি) দলের দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য এবং জেলার অন্যতম ট্রেড ইউনিয়ন নেতা কমরেড সুধাংশু জানা৷ পুড়ল দুই শতাধিক মানুষের ঘর, আহত হলেন নারী–শিশু–বৃদ্ধ নির্বিশেষে অসংখ্য মানুষ৷ গুরুতর আহত অবস্থায় ৮ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন৷ অন্তত ৪০ জন আহতকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন থাকলেও দুষ্কৃতী বাহিনী তা করতে দেয়নি৷

এর প্রতিবাদে এস ইউ সি আই (সি) ৬ জুলাই কুলতলি বনধের ডাক দিলে তা সর্বাত্মক রূপ নেয়৷ খবর পাওয়া মাত্রই সারা পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে অসংখ্য বিক্ষোভ মিছিল, পথসভা ইত্যাদি হয়৷ সোশ্যাল মিডিয়াতেও এই আক্রমণের বিরুদ্ধে তীব্র ধিক্কার জানান সাধারণ মানুষ৷ ৬ জুলাই দলের রাজ্য কমিটির ডাকে পালিত হয় সারা বাংলা প্রতিবাদ দিবস৷

৩ জুলাই রাত থেকেই শুরু হয়েছিল দুষ্কৃতীদের তাণ্ডব৷ মৈপীঠ অঞ্চলের বিভিন্ন গ্রামে তারা বেছে বেছে এস ইউ সি আই (সি) সমর্থকদের উপর অক্রমণ করতে থাকে৷ বহু সাধারণ মানুষ যাঁরা পঞ্চায়েতে দুর্নীতির বিরুদ্ধে মুখ খুলছিলেন, তাঁদের উপরও আক্রমণ হয়৷ এক সময়কার সিপিএম হার্মাদ, বর্তমানে তৃণমূল আশ্রিত সমাজবিরোধী অশ্বিনী মান্না ও গণেশ মণ্ডলের নেতৃত্বে বাইক বাহিনী ৩ জুলাই এলাকার বিভিন্ন গ্রামে শতাধিক ঘরে আগুন লাগায়, বোমা ছোঁড়ে৷ ঘরের মেয়েদের পর্যন্ত রাস্তায় টেনে বার করে প্রবল মারধর করে৷ শেষ পর্যন্ত অশ্বিনী মান্নার দলকে প্রতিহত করতে এলাকার মানুষ হাতের কাছে যা পেয়েছেন তাই নিয়ে রুখে দাঁড়ান৷ অশ্বিনী মান্নাকে এলাকার মানুষই ধরে পুলিশের হাতে তুলে দেন৷ পুলিশের হেফাজতেই পরে তার মৃত্যু হয়৷

রাজ্যের অন্যান্য এলাকার মতোই মৈপীঠে আমফান ঝড়ে ক্ষতিপূরণ নিয়ে তৃণমূলের পঞ্চায়েত ব্যাপক দুর্নীতি করেছে৷ তার বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলেছে এস ইউ সি আই (সি)৷ সুন্দরবনের প্রত্যন্ত এলাকার মৈপীঠের মানুষ বিগত কংগ্রেস এবং দীর্ঘ সিপিএম শাসনে জোতদার, মহাজন, মস্তান, জলদস্যুদের বহু আক্রমণ মোকাবিলা করেছে৷ সংগ্রামী বামপন্থী দল এস ইউ সি আই (সি)–র রাজনীতি তাদের জুগিয়েছে শক্তি৷ এই শক্তিই তাদের শেখায় অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে৷ ২ জুলাই ত্রাণ–দুর্নীতির বিরুদ্ধে থানায় ডেপুটেশন দেয় এস ইউ সি আই (সি)৷ সেটাই ক্ষিপ্ত করে তোলে ‘যুব তৃণমূল’ বলে কথিত গণেশ মণ্ডল, অশ্বিনী মান্নাদের দলকে৷ এর সাথে যুক্ত হয়েছে তাদের গায়ের জোরে ধরে রাখা পঞ্চায়েতের ক্ষমতা হাতছাড়া হওয়ার আশঙ্কা৷ ২০১৮ সালে সারা পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল গায়ের জোরে বেশিরভাগ পঞ্চায়েত দখল করলেও, মৈপীঠে বহু সন্ত্রাস করেও সুবিধা করতে পারেনি৷ ২০১১–তে রাজ্যে পালা বদলের পর অতীতের সিপিএম–আশ্রিত দুষ্কৃতীরা প্রায় সকলেই জামা বদলে রাতারাতি তৃণমূল হয়ে যায়৷ সেই সব দুষ্কৃতীদের হামলা, হুমকি মোকাবিলা করে এলাকার মানুষ ১৯টির মধ্যে ১১টি আসনে এস ইউ সি আই (সি) প্রার্থীদের জয়ী করেন৷ তৃণমূল পায় মাত্র ১টি আসন৷ কিন্তু সিপিএমের ৭ জনই তৃণমূলকে সমর্থন জানালে তারা জোর পেয়ে পঞ্চায়েত গঠনের সময় মারাত্মক সন্ত্রাসের পরিবেশ সৃষ্টি করে৷ দুজন এস ইউ সি আই (সি) পঞ্চায়েত সদস্যকে তারা বাধ্য করে প্রাণের ভয় দেখিয়ে তৃণমূলের পক্ষে ভোট দিতে৷ পঞ্চায়েত গঠনের আড়াই বছর পেরিয়ে যাওয়ায় এই বছর নতুন করে আস্থা ভোট নেওয়ার পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে৷ তৃণমূলের স্থানীয় নেতারা বুঝতে পারে এবার আর ভয় দেখিয়ে পঞ্চায়েত ধরে রাখা যাবে না৷ সেই কারণেই এই সন্ত্রাস তৈরি করল তারা৷

৪ জুলাই ভোর থেকেই নগেনাবাদ বাজার, বৈকুন্ঠপুরের বিস্তীর্ণ এলাকায় দুষ্কৃতীরা আগুন লাগানো, বোমাবাজি চালাতে থাকে৷ এলাকার বিশিষ্ট নেতা কমরেড সুধাংশু জানার বাড়িও তারা সম্পূর্ণ ভেঙে আগুন লাগিয়ে দেয়৷ তাঁকে হত্যা করে গলায় দড়ি বেঁধে ঝুলিয়ে দেয় দুষ্কৃতী বাহিনী৷ তাঁর স্ত্রী পঞ্চায়েত সদস্য কমরেড গীতা জানাকে স্বামীর মৃতদেহের সামনে দাঁড় করিয়ে মেরে ফেলার ভয় দেখিয়ে বলে, ‘বল, তোর স্বামী আত্মহত্যা করেছে’৷ কিন্তু তিনি দৃঢ়তার পরিচয় দেন৷ ৩ জুলাই আক্রমণ শুরু হতেই এস ইউ সি আই (সি) দলের নেতৃবৃন্দ বারবার মৈপীঠ কোস্টাল থানা, কুলতলি থানা সহ জেলার এসপি, অ্যাডিশনাল এসপিদের ফোন করে দ্রুত পুলিশ পাঠিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য অনুরোধ করতে থাকেন৷ রাজ্যের স্বরাষ্ট্র সচিবকেও ফোন করে এই দাবি জানানো হয়৷ অথচ পুলিশ প্রায় নীরব দর্শক হয়েই ছিল৷ ৪ জুলাই সকালে ধ্বংসলীলা অবাধে চালানোর জন্য তৃণমূলের বাহিনী রাস্তার একাধিক জায়গায় পুলিশকে আটকায়৷ পুলিশ দাঁড়িয়েই থাকে৷ যেন সব শেষ হয়ে যাওয়ার পর কয়েক বালতি জল ঢালাটাই তাদের দায়িত্ব খবর পাওয়া মাত্র পুলিশ তৎপর হলে বহু ক্ষয়ক্ষতি এবং হত্যার ঘটনা ঘটতেই পারত না৷

কমরেড সুধাংশু জানা ছিলেন মৈপীঠ অঞ্চল এবং জেলার নির্মাণকর্মী, বিড়ি শ্রমিক, মিড–ডে মিল কর্মী, মৎস্যজীবী সহ নানা পেশার শ্রমজীবী মানুষের অধিকার রক্ষার আন্দোলনের অন্যতম নেতা৷ মধ্যবিত্ত জীবনের নিশ্চিন্ততায় জীবন কাটানোর সুযোগ তাঁর সামনে থাকলেও তিনি বেছে নিয়েছিলেন মানুষের মধ্যে থেকে তাদের সমাজ বদলের পথ দেখানোর সংগ্রামের এক সৈনিকের জীবন৷ এভাবেই এস ইউ সি আই(সি) দলের সংগঠক এবং এলাকার মানুষের নেতায় উন্নীত হয়েছিলেন তিনি৷ এলাকায় সুস্থ সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল তৈরির জন্য তাঁর নিরলস চেষ্টা ছিল৷ এই অমায়িক, সর্বদা স্মিত হাসির সৎ নির্ভীক মানুষটিকে এলাকার মানুষ ভালবাসতেন বলেই দুষ্কৃতীদের লক্ষ্য হয়ে উঠেছিলেন তিনি৷

মৈপীঠ সহ কুলতলির মানুষের শপথ ধ্বনিত হয়েছে ৬ জুলাইয়ের সর্বাত্মক বনধের মধ্য দিয়ে৷ শহিদের রক্তস্রোত তাঁরা ব্যর্থ হতে দেবেন না৷ এই অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ মাথা তুলবেই৷