মেডিক্যাল ছাত্রী পায়েলের আত্মহত্যা কী বার্তা রেখে গেল

বেঁচে থাকলে তিনি হতে পারতেন দক্ষ স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ৷ বাঁচাতে পারতেন বহু মুমূর্ষু রোগীকে৷ সমাজ তাঁর দ্বারা নানাভাবে উপকৃত হতে পারত৷ কিন্তু নিষ্ঠুর সমাজ তাঁকে বাঁচতে দিল না৷ দিনের পর দিন জাত–পাত নিয়ে ক্রমাগত অপমানের জ্বালা সইতে না পেরে ২২ মে হস্টেলের ভেতরেই আত্মঘাতী হন মুম্বাইয়ের বি ওয়াই এল নায়ার হাসপাতালের স্নাতকোত্তরের ছাত্রী পায়েল তদভি৷

পায়েল আদিবাসী পরিবারের সন্তান৷ ভারতের সমাজ কাঠামো অনুযায়ী অধিকাংশ আদিবাসী পরিবার অর্থনৈতিক দিক থেকে খুবই পিছিয়ে৷ অর্থনৈতিক সংকটের কারণে এঁদের পক্ষে উচ্চশিক্ষায় পৌঁছানো কঠিন হয়ে পড়ে৷ এর মধ্যেও বহু প্রতিকূলতা জয় করে খুবই অল্পসংখ্যক ছাত্রছাত্রী ডাক্তারি–ইঞ্জিনিয়ারিং– ভর্তির সুযোগ পান৷ দক্ষতার বিচারে এঁরা কারও থেকে কম নন৷

স্বাধীনতার পরে দীর্ঘ সামাজিক পীড়নের শিকার পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে খানিকটা এগিয়ে নিয়ে আসার ঘোষণা করে ১০ বছরের জন্য সংরক্ষণ ব্যবস্থা কায়েম করা হয়েছিল৷ কিন্তু স্বাধীনতার ৭২ বছর পার করেও এই জনগোষ্ঠীর বিপুল সংখ্যাকে যে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে দেওয়া যায়নি, তা আজ সর্বজনবিদিত৷ সংরক্ষণের শুরু থেকেই ভারতে সংরক্ষণপন্থী ও সংরক্ষণ বিরোধী– দু’টি শিবিরে জনগণকে বিভক্ত করার জন্য কায়েমি স্বার্থবাদীরা সক্রিয়৷ এস ইউ সি আই (সি) সেদিনই বলেছিল, সকলের জন্য কাজ, শিক্ষা–স্বাস্থ্যের ব্যবস্থা না করে বাস্তবে সংরক্ষণের কোনও মানেই থাকে না৷ বেশিরভাগ মনুষের জন্য চাকরি বা শিক্ষার সুযোগ যেখানে নেই বললেই চলে, সেখানে কী সংরক্ষণ করবে সরকার? এই পরিস্থিতে সংরক্ষণ আসলে পিছিয়ে পড়া গোষ্ঠীর মানুষের সাথে এক বিরাট প্রতারণা৷ এর মধ্য দিয়ে পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায়ের অপেক্ষাকৃত সচ্ছলরা লাভবান হবে, সামগ্রিকভাবে সম্প্রদায়গুলির পশ্চাৎপদতা দূর হবে না৷ আবার সংরক্ষণের বাইরে থাকা জনগণের চাকরি না পাওয়ার জন্য যে ক্ষোভ তাকে সংকীর্ণ ভোট রাজনীতির স্বার্থে কাজে লাগাতে একদল নেতা তার জন্য সংরক্ষণকেই কারণ হিসাবে তুলে ধরে পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়িয়ে দিচ্ছে৷ ফলে বেকারত্বের প্রকৃত কারণ অনুসন্ধান না করে সংরক্ষণের আওতাভুক্ত এবং তার বাইরে থাকা দরিদ্র জনগণ একে অপরকে পরস্পরের শত্রু বলে মনে করবে৷

স্ত্রীরোগ ও ধাত্রীবিদ্যা নিয়ে পাঠরতা ২৩ বছরের এই ছাত্রীর মায়ের অভিযোগ, তিনজন সিনিয়র মহিলা ডাক্তার বারবার পায়েলের জাত তুলে তাঁকে উত্যক্ত করতেন৷ কটূক্তিই শুধু নয়,  তাকে অপারেশন থিয়েটারে ঢুকতে না দেওয়ার হুমকি দেওয়া হত৷ পায়েল জানতেন, অপারেশন থিয়েটারে প্রত্যক্ষভাবে কাজের অভিজ্ঞতা না থাকলে তাঁর কেরিয়ার শেষ হয়ে যাবে৷ তিনি কলেজ কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি জানিয়েছিলেন৷ কিন্তু কর্তৃপক্ষ কোনও ব্যবস্থা নেয়নি৷

শুধু পায়েল তদভি নন, দু’বছর আগে নায়ার ডেন্টাল কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী ভাগ্যলক্ষ্মী মুথা আত্মহত্যা করেছেন৷ ২০১৬ সালে হায়দারবাদে আত্মহত্যা করে অপমানের জ্বালা থেকে বেঁচেছেন গবেষক রোহিত ভেমুলা৷ ২০০৬ থেকে এইমস, আই আই টি–র মতো বিভিন্ন উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ২২ জন ছাত্রছাত্রী জাত–পাতগত বিদ্বেষের কারণে আত্মহত্যা করেছেন৷ দেশজুড়ে তালিকা দীর্ঘতর৷ এই আত্মহনন দেখিয়ে দেয় ‘আধুনিক’ ভারতে দলিত–আদিবাসী ছাত্রছাত্রীদের বিপন্নতা কত প্রকট৷ সর্বত্রই, এঁদের অপমান করার সহজ উপায় সংরক্ষণের সাথে তাঁদের মেধাকে জড়িয়ে ব্যঙ্গবিদ্রুপ৷ এ দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের গান্ধীবাদী নেতৃত্ব জাতপাত–ধর্মবর্ণের বিরুদ্ধে সামাজিক লড়াইটাকে রাজনৈতিক লড়াইয়ের অন্তর্ভূক্ত করার মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজটিকে অবহেলা করেছেন চূড়ান্তভাবে৷ শুধু তাই নয় বহু গান্ধীবাদী নেতাও তথাকথিত উচ্চবর্ণের শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে মিথ্যা গরিমায় আচ্ছন্ন ছিলেন৷ আরএসএস, হিন্দু মহাসভার মতো সংগঠনগুলিও উচ্চবর্ণের গৌরবগাথা, হিন্দু ধর্মের বর্ণভেদপ্রথার জয়গান করে গেছে দীর্ঘ সময় ধরে৷ স্বাধীনতার পর বৃহৎ বামপন্থী দলগুলির নেতারাও অর্থনৈতিক দাবি দাওয়া আর ভোট রাজনীতিতেই মগ্ন থেকে এই সামাজিক আন্দোলনকে গুরুত্ব দেননি৷ 

এর ধারবাহিকতায় ভারতের বিরাট অংশের মানুষের মনন জাত–পাত ভেদাভেদে কলুষিত৷ তথাকথিত নিম্নবর্ণের প্রতি উচ্চবর্ণের ঘৃণা, বিদ্বেষ, অপমান আজও বয়ে চলেছে৷ বিজেপি তথাকথিত উচ্চবর্ণের ভোটব্যাঙ্কের রাজনীতি করতে গিয়ে যত ধর্মীয় গোঁড়ামি, কূপমণ্ডুক চিন্তার প্রসার ঘটিয়েছে ততই বেড়েছে জাতপাত নিয়ে ঘৃণার পরিবেশ৷ প্রধানমন্ত্রী দলিতদের পা ধুইয়ে ছবি তুলে দলিতদের ভোট নিতে যতই ভড়ং করুন না কেন তাঁর দলের আদর্শই উচ্চবর্ণ কেন্দ্রীক৷ বিজেপি বিরোধী কংগ্রেসও একই রাজনীতি করেছে৷ আবার কখনও ভোটব্যাঙ্কের স্বার্থে নিম্নবর্ণের ত্রাতা সেজেছে৷ এবার বিপুল ক্ষমতা নিয়ে বিজেপির উত্থান দেশব্যাপী এই বিদ্বেষের পালেই আরও হাওয়া দিচ্ছে৷

শুধু আইন করে এই বিদ্বেষ মোছা অসম্ভব৷ চাই ধর্মনিরপেক্ষ–গণতান্ত্রিক শিক্ষা৷ মানুষকে মানুষ হিসাবে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি চাই৷ যতদিন অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠা না হচ্ছে সকলের জন্য শিক্ষার এবং চাকরির অর্থনৈতিক বনিয়াদ প্রতিষ্ঠিত না হচ্ছে ততদিন পর্যন্ত এই সংকট থেকে মুক্তির রাস্তা নেই৷

(গণদাবী : ৭১ বর্ষ ৪৩ সংখ্যা)