মেডিকেল শিক্ষার এই অবনমন কেন?

সম্প্রতি আনন্দবাজার পত্রিকায় ‘একই অঙ্গে এত রোগ’ শীর্ষক একটি ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়৷ তাতে প্রতিবেদক বলেছেন, মেডিকেল শিক্ষার মান পড়ছে৷ কিন্তু কেন পড়ছে সে আলোচনা অত্যন্ত জরুরি৷

আমাদের দেশে আধুনিক চিকিৎসাশাস্ত্রের পাঠক্রম নিয়ন্ত্রিত হয় মেডিকেল কাউন্সিল অব ইন্ডিয়ার (এমসিআই) তত্ত্বাবধানে৷ বহু চিকিৎসক, শিক্ষক ও জনস্বাস্থ্যের দিকপালদের নিয়ে তৈরি হয়েছে সিলেবাস, পঠন–পাঠনের পদ্ধতি ও তার প্রয়োগ৷ বিজ্ঞানের অগ্রগতির সাথে সাথে সবটা তাল মিলিয়ে এই পাঠক্রম গড‌‌‌়ে না উঠলেও এই পাঠক্রমকে বাদ দেওয়ার কোনও প্রশ্নই ওঠে না৷ স্বাধীনতা–উত্তর ভারতবর্ষে শাসক শ্রেণি এমসিআই–কে দু’পায়ে মাডিয়ে চলেছে, মনোনীত ন্যাশনাল মেডিকেল কাউন্সিল (এনএম সি)–কে দিয়ে মেডিকেল শিক্ষার মানোন্নয়ন (!) করাতে চাইছে৷ মেডিকেল কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া (এমসিআই)–এর সমস্ত নিয়ম কার্যকর করতে হলে পর্যাপ্ত পরিকাঠামো জরুরি, যা কেন্দ্র–রাজ্য কোনও সরকারই করেনি৷ মেডিকেল শিক্ষার মানের অবনমনের দায় কিন্তু ছাত্র বা শিক্ষকের নয়, তার দায় বর্তায় সরকারের উপর৷ ১৯৪৬ সালে স্যার জোসেফ ভোর ভারতের স্বাস্থ্যব্যবস্থা নিয়ে মূল্যায়ন রেখেছিলেন৷ ভোর কমিটি যেভাবে ভারতীয় স্বাস্থ্যব্যবস্থার জন্য থ্রি–টায়ার সিস্টেম তথা প্রাইমারি হেলথ কেয়ার, সেকেন্ডারি হেলথ কেয়ার ও টার্সিয়ারি হেলথ কেয়ারের কথা বলেছিলেন এবং জিডিপির ৫ থেকে ১০ শতাংশ পর্যন্ত বরাদ্দ করার পরামর্শ দিয়েছিলেন তা স্বাধীনতা উত্তর ভারতবর্ষে বিজেপি–কংগ্রেস কোনও সরকারই করেনি৷ ভারতের শাসকরা বারবার স্বাস্থ্য ও মেডিকেল শিক্ষাকে দেখেছে একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান বা মুনাফা লোটার কারখানা হিসাবে৷ জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি ১৯৮৩, ২০০২ ও ২০১৭–তে সেটাই বারবার দেখা গেছে৷ স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় ৫ শতাংশ থেকে ক্রমে ক্রমে তলানিতে এসে ঠেকেছে৷

দ্বিতীয়ত,  একজন ডাক্তারি পডুয়া যখন মেডিকেল শিক্ষা গ্রহণ করার জন্য কোনও মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয় তখন তার মধ্যে মূলত বড় মানুষ ও ভাল ডাক্তার হওয়ার আকাঙক্ষাই বিদ্যমান থাকে৷ কিন্তু মেডিকেল শিক্ষাব্যবস্থার সীমাহীন অপর্যাপ্ততা ও  অপসংস্কৃতির পরিবেশ এবং পুঁজিবাদী সমাজ থেকে উদ্ভূত যে কোনওভাবেই হোক অর্থ উপার্জনের মানসিকতা তাকে গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসাতে বাধ্য করে৷ এক্ষেত্রে মেডিকেল কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব হল একজন পডুয়াকে ডাক্তারি পড়ার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে সম্যকভাবে অবহিত করা এবং পঠন–পাঠনের উপযুক্ত পরিবেশ গড়ে তোলা৷

তৃতীয়ত, মেডিকেল শিক্ষায় লেকচার ক্লাস, ক্লিনিক্যাল ক্লাস, প্র্যাক্টিক্যালের যে সিডিউল এমসিআই গাইডলাইন অনুযায়ী হওয়া উচিত এবং বাস্তবিকপক্ষে যে ক্লাস হয়, তাতে ঘন্টা বা দিনের হিসাব মিলে গেলেও গুণগত মান নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়৷ পড়ানোর যে নিজস্ব আর্ট আছে যা ছাত্রছাত্রীদের কাছে গ্রহণযোগ্য হওয়া উচিত, তা না হয়ে ওভারহেড প্রোজেক্টরের স্লাইড আর প্রোজেক্টর স্ক্রিনের আঁকিবুঁকিতে তা বোঝায় পরিণত হয়৷ ফলে ইউনিভার্সিটি বা স্বাস্থ্যদপ্তরের টিচার্স ট্রেনিং ব্যবস্থায় যে গলদ আছে তা স্পষ্টরূপে ধরা পড়ে৷

ক্লিনিক্যাল ক্লাসে কোনও রোগী সম্পর্কে পর্যালোচনার সময়ে রোগীর বেড়ের চারিদিকে প্রতিটি ব্যাচে এতটাই ভিড় হয়ে পড়ে যে কাউকে টুলের উপর বা চেয়ারের উপর দাঁডিয়ে ক্লাস করতে হয়৷ ফলে একদিকে শিক্ষকের অপ্রতুলতা, অন্য দিকে প্রতিটি ব্যাচে অসম্ভব ভিড় এবং তার সাথে এমসিআই–এর নিয়ম অনুযায়ী দুটি বেডের মাঝে অন্তত এক–দেড় মিটার দূরত্ব রাখা– এসব পূর্ণতা না পাওয়ায় বেডসাইড ক্লিনিকস করা অত্যন্ত কষ্টকর৷ এতে ডাক্তারি ছাত্ররা ধৈর্য হারায়৷ ক্লিনিক্যাল ক্লাসে যোগ দেওয়া থেকে বিরত হয়৷ অনেকসময় রোগীর গায়ে হাত দিয়ে বোঝারসুযোগ পর্যন্ত পায় না৷ ফলে আশু কর্তব্য হল আরএমও, অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর, অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর, প্রফেসরের সংখ্যা পর্যাপ্ত পরিমাণে বাড়ানো এবং পরিকাঠামো উন্নত করার সব রকম দায়িত্ব সরকারের গ্রহণ করা৷  এমসিআই ১৯৯৭ রেগুলেশন অনুযায়ী মেডিকেল শিক্ষার সমস্ত ব্যয়ভার বহন করার কথা রাজ্য সরকারের৷ সরকার তা করেছে কি?

চতুর্থত, হেলথ কেয়ার ডেলিভারিতে যে দুই বিষয়ের দ্বন্দ্ব চলছে তার প্রভাব জনসাধারণের উপরও পড়ে, ডাক্তারও তার ব্যতিক্রম নয়৷ তা হল, ক্লিনিক্যাল মেডিসিন বনাম এভিডেন্স বেসড মেডিসিন৷ আসলে ক্লিনিক্যাল মেডিসিন ও এভিডেন্স বেসড মেডিসিনের বিষয়টি বিরোধাত্মক নয়৷ রোগ নির্র্ণয়ের ক্ষেত্রে হাতে হাত ধরে ক্লিনিক্যাল মেডিসিন ও এভিডেন্স বেসড মেডিসিনের চলার কথা, সেখানে কর্পোরেট পুঁজির স্বার্থে এই দ্বন্দ্বকে বিরোধাত্মক দ্বন্দ্বে পরিণত করা হয়েছে৷

এভিডেন্স বেসড মেডিসিনে কোনও রোগের সমস্ত ডিফারেনসিয়াল ডায়াগনোসিসের জন্য প্রযোজ্য পরীক্ষা করে সিদ্ধান্তে উপনীত হতে হয়৷ এটা খরচসাপেক্ষ৷ কিন্তু এতে রোগকে প্রমাণ করা যায় পুরোপুরিভাবে৷ সেখানে ক্লিনিক্যাল মেডিসিনে ডিফারেনসিয়াল ডায়াগনোসিসগুলোর তালিকা সংক্ষিপ্ত করা হয়, তারপর প্রয়োজনীয় পরীক্ষা–নিরীক্ষা তাকে সুনিশ্চিত করে৷ এটাই সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি হওয়া উচিত৷ যথেচ্ছ মুনাফার আশায় স্বাস্থ্যব্যবসার সঙ্গে যুক্ত পুঁজিপতিরা জনগণকে এভিডেন্স বেসড মেডিসিনের প্রতি ঠেলে দিচ্ছে যথেচ্ছ প্রচারের মাধ্যমে৷ উৎসাহিত করা হচ্ছে এটাকে৷ এই সামগ্রিক বিষয়টা ডাক্তারি ছাত্রদের ক্লিনিক্যাল মেডিসিনের প্রতি উন্নাসিক করে তুলছে৷

পঞ্চমত, ডাক্তারি ছাত্রদের প্রত্যেককেই ডাক্তারি পাশ করে কম্পালসারি রোটেটিং ইন্টার্নশিপ করতে হয়৷ সেখানে রেজিস্টারড মেডিকেল প্র্যাক্টিসনার্সের তত্ত্বাবধানে ও তাঁর বা তাঁদের নজরদারিতে থেকে ডাক্তারি জ্ঞান হাতে–কলমে প্রয়োগ করতে হয়৷ প্রিভেন্টিভ, প্রোমোটিভ, কিউরেটিভ ও রিহ্যাবিলিটেটিভ–এর শিক্ষার বাস্তব প্রয়োগ করার কথা৷ কিন্তু সেখানেও যা করার কথা বা শেখার কথা যেমন, সিপিআর করা, ইন্টারকস্টাল টিউব ড্রেনেজ, ভ্যাসেক্টমি, সারকামসিশন, অ্যাডভান্সড এয়ার ওয়ে ইত্যাদি, তা শেখানো হচ্ছে কোথায়? বরং লোকবলের অভাব পূরণ করতে ব্লাড টানা, চ্যানেল করা, ক্যাথেটর করার মতো বিষয়ে আবদ্ধ রাখা হয় এবং সস্তার শ্রম হিসাবে কাজে লাগানো হয়৷ ফলে তারা শেখার মানসিকতা হারায়৷ পুঁথিগত শিক্ষা প্রয়োগে ব্যর্থ হওয়ায় হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে৷ তার সাথে স্ট্যান্ডার্ড ড্রিটমেন্ট গাইডলাইনকে অনুসরণ করে যেভাবে চিকিৎসা করা জরুরি তা পরিকাঠামোর অভাবে করতে না পারায় আরও বেশিমাত্রায় ডিপ্রেসড হয়ে পড়ে৷ যেমন শীতের রাতে এক সিওপিডি–র রোগী প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট ও আচ্ছন্ন অবস্থায় সাধারণ ওয়ার্ডে ভর্তি হলে ওয়ার্ডে যা যা চিকিৎসা (নেবুলাইজেশন, ইঞ্জেকশন) করা সম্ভব, তা করেও বাঁচাতে পারে না৷ কারণ ওয়ার্ডে বাইপ্যাপ নেই অথবা ক্রিটিক্যাল কেয়ারে বেড নেই৷ ফলে এই পরিকাঠামোহীন অবস্থাতেই ঢাল–তরোয়ালহীন নিধিরাম সর্দারের মতো ইন্টার্ন সহ জুনিয়র ডাক্তারদের কাজ করতে হয়৷

ষষ্ঠত, আজকের এই যুগটাকে তুলে ধরা হচ্ছে এভিডেন্স বেসড মেডিসিন ও স্পেশালাইজেশনের যুগ হিসাবে৷ ফলে স্পেশালিস্ট ডাক্তার হিসাবে গড়ে ওঠার দৌড়ে মেডিকেল ছাত্ররা নামতে বাধ্য হচ্ছে৷ কারণ একজন মেডিকেল ছাত্র পাশ করার পর দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থায় কীভাবে নিয়োজিত হবে, তার কোনও দিশা নেই৷ প্রতি বছরই দেশের নানা রাজ্য থেকে হাজার হাজার ডাক্তার পাশ করলেও তাদের হেলথ ক্যাডার হিসাবে যে সর্বোত্তমভাবে কাজে লাগানো যায়– সেসব আন্তরিক প্রচেষ্টা ও পরিকল্পনা কি সরকারগুলোর আছে? বরং সদ্য  পাশকরা ডাক্তারদের উপযুক্ত ট্রেনিং তো দিচ্ছেই না, উপরন্তু পরিকাঠামোহীন হাসপাতালে পাঠিয়ে দিচ্ছে, যেখানে কিছু ওষুধ বিলি করা হলেও জনস্বাস্থ্যের কোনও সুরাহা হয় না৷

স্পেশালাইজেশন জরুরি, কিন্তু তা ফ্র্যাগমেন্টেড মেডিসিন হিসাবে কাজ করে৷ কিন্তু এটার প্রতি অত্যধিক ঝোঁকের ফলে ক্লিনিক্যাল ও ইন্টারনাল মেডিসিনের হোলিস্টিক অ্যাপ্রোচ মার খাচ্ছে৷ জনসাধারণও আজ বাণিজ্যিক প্রচার ও ইন্টারনেটের দৌলতে স্পেশালিস্ট ডাক্তারের কাছেই ছুটছে৷ ডাক্তারি পডুয়ারা প্রথমবর্ষ বা দ্বিতীয়বর্ষ থেকেই এমডি/এমএস অর্থাৎ স্নাতকোত্তর স্তরে ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতিতে নামছে৷ ফলে না শিখছে ক্লিনিকস, না শিখছে পড়াশোনা৷ শুধু এমসিকিউ মুখস্ত করার জোয়ার চলছে৷ স্নাতকস্তরে পঠন–পাঠন ব্যাহত হচ্ছে৷ এর সুযোগে পিজি কোচিং সেন্টারগুলো রমরমিয়ে বাড়ছে৷ তার সাথে সাথে এমবিবিএস সিট ও পোস্ট–গ্র্যাজুয়েট সিটের চূড়ান্ত অসমতা ডাক্তারি ছাত্রছাত্রীদের সার্বিক অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিচ্ছে৷

ডাক্তারি শিক্ষাব্যবস্থার মানোন্নয়নের জন্য জরুরি প্রয়োজন হল, সার্বিক ভাবে পরিকাঠামোর উন্নয়ন ঘটানো, জুনিয়র ডাক্তার, মেডিকেল স্টুডেন্ট ও শিক্ষক–চিকিৎসদের কর্তব্য এবং সমাজে তার কী প্রয়োজনীয়তা, তা তুলে ধরা৷ ক্লিনিক্যাল মেডিসিনের শিক্ষাদানের জন্য উপযুক্ত শিক্ষক গড়ে তোলা ও মেডিকেল এথিক্সকে এগিয়ে নিয়ে চলাই আজকের দিনের আশু কর্তব্য৷ একটি জনকল্যাণকর রাষ্ট্রে যেভাবে স্বাস্থ্যব্যবস্থা চালানো উচিত দেশের শাসকগোষ্ঠী তা করছে না৷ তারা মেডিকেল শিক্ষাকেও বাণিজ্যিকীকরণের লাইনে পরিচালিত করছে৷ এর বিরুদ্ধে চাই সমাজের সকল স্তরের মানুষকে নিয়ে সামাজিক আন্দোলন৷

(৭১ বর্ষ ৮ সংখ্যা ২১ সেপ্টেম্বর, ২০১৮)

 

6 comments