মেডিকেল কলেজে সার্বিক চিকিৎসা ও মেডিকেল শিক্ষা বন্ধ

মেডিকেল কলেজকে করোনা হাসপাতাল

সার্বিক চিকিৎসা পরিষেবা ধ্বংসের মুখে, মারাত্মক আঘাত মেডিকেল শিক্ষায়

গত কয়েক মাস ধরে রাজ্য তথা দেশের ঐতিহ্যমণ্ডিত কলকাতা মেডিকেল কলেজে করোনা বহির্ভূত সমস্ত চিকিৎসা পরিষেবা এবং মেডিকেল শিক্ষা বন্ধ রয়েছে৷ করোনাজনিত কারণে রাজ্যের অন্যান্য মেডিকেল কলেজ সহ সমস্ত হাসপাতালেই প্রায় দু’মাসের উপরে অন্যান্য রোগের চিকিৎসা ও মেডিকেল শিক্ষা বন্ধ ছিল৷ বর্তমানে তা চালু হলেও সরকারের সদিচ্ছার অভাব ও পরিকাঠামো এবং ডাক্তার–নার্স–স্বাস্থ্যকর্মীর বিপুল ঘাটতি থাকার ফলে রাজ্য জুড়ে জটিল ও গুরুতর রোগের চিকিৎসা, অপারেশন এমনকি ক্যান্সার রোগীদের কেমো থেরাপি, রেডিও থেরাপি ইত্যাদি পরিষেবা থেকে সাধারণ মানুষ ভীষণভাবে বঞ্চিত হচ্ছেন৷ অন্যদিকে করোনা রোগীকে আলাদা করার জন্য ট্রায়েজ স্ক্রীনিং সঠিকভাবে কার্যকর করা হচ্ছে না৷ চিকিৎসক–নার্স–স্বাস্থ্যকর্মীদের স্বাস্থ্য নিরাপত্তার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে পিপিই কিট, এন–৯৫ মাস্ক এখনও সরবরাহ করা হচ্ছে না এবং যে সব ডাক্তার–নার্স স্বাস্থ্যকর্মীরা করোনা আক্রান্ত রোগীদের সংস্পর্শে আসছেন বা নিজেরাই যখন আক্রান্ত হচ্ছেন সেক্ষেত্রে নিয়ম অনুযায়ী সংস্পর্শে থাকা সকলকেই কনট্যাক্ট ট্রেসিং করার কথা এবং সংস্পর্শে আসা সব ডাক্তার নার্স স্বাস্থ্যকর্মীদেরই কোয়ারান্টিন ও করোনা পরীক্ষার ব্যবস্থা করা উচিত৷ বাস্তবে বেশিরভাগ জায়গাতেই এই নিয়ম মেনে চলা হচ্ছে না এবং সমস্যাটিকে কর্তৃপক্ষ ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করছে৷ ফলে মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালগুলিতে ব্যাপক সংখ্যক চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীর করোনা আক্রান্ত হয়ে পড়ার সম্ভাবনা প্রবল হচ্ছে এবং তার জন্য একসাথে বহু সংখ্যক হাসপাতাল বন্ধ হয়ে যেতে পারে৷ সরকারের এই চূড়ান্ত উদাসীনতা এবং অবৈজ্ঞানিক পদক্ষেপ একদিন মানুষকে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেবে না তো?

ইতিমধ্যে সাধারণ মানুষ করোনা নয় এমন সমস্ত রকম রোগের চিকিৎসা থেকে ভীষণভাবে বঞ্চিত হচ্ছেন৷ হাজার হাজার জটিল অপারেশন জমে থাকছে৷ পরিকাঠামোর অভাবে করোনা–পূর্ব সময়েই যেখানে অপারেশনের ডেট পেতে মানুষকে মাসের পর মাস ঘুরতে হত, আজ তা একেবারেই বন্ধ৷ ফলে বহু মানুষকে বিনা চিকিৎসায় মরতে হচ্ছে এবং ভবিষ্যতে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও অপারেশনের ডেট পেতে বছরের পর বছর কেটে যাবে৷ তাই দরকার ছিল করোনা পরিস্থিতি সামাল দিতে নতুন নতুন হাসপাতাল তৈরি করা, প্রয়োজন মতো ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগ করা৷ করোনা পূর্ববর্তী সময়ে এমনিতেই যেখানে আমাদের দেশে সরকারি হাসপাতালের বেড রয়েছে প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম– প্রতি হাজার মানুষ পিছু মাত্র ০.৭টি বেড৷ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ অনুযায়ী থাকার কথা ন্যূনতম ৩টি বেড৷ বিশ্বের উন্নত দেশগুলিতে এই সংখ্যা ১০–এর উপরে৷ কিউবা, নর্থ কোরিয়ার মতো দেশে প্রতি হাজার মানুষ পিছু হাসপাতালে বেড সংখ্যা রয়েছে যথাক্রমে ৫.২ ও ১৩.২৷

বিশ্বের অনেক দেশই এই সময়ে নতুন নতুন হাসপাতাল তৈরি করে ফেলেছে, সেখানে আমাদের দেশে নতুন কোনও হাসপাতাল তৈরির পরিকল্পনাটুকুও করা হয়নি৷ কেন্দ্র এবং রাজ্য কোনও সরকারই এই উদ্যোগ নেয়নি, উপরন্তু চটকদারি রাজনীতির ঝোঁকে রাজ্য সরকার বিভিন্ন হাসপাতালের চালু বেডগুলিকে করোনা বেড হিসেবে দেখিয়ে দিল৷ কলকাতা মেডিকেল কলেজ ও সাগর দত্ত মেডিকেল কলেজকে পুরোপুরিভাবেই করোনা হাসপাতালে পরিণত করা হল৷ যুক্তি দেখানো হচ্ছে যখন করোনা রোগীর সংখ্যা প্রচুর পরিমাণে বাড়বে এবং অন্যান্য রোগে আক্রান্ত মানুষও যখন বেশি করে করোনা আক্রান্ত হবে সে রকম পরিস্থিতি সামাল দিতেই নাকি চাই উন্নত পরিকাঠামো এবং বিশেষজ্ঞদের সহায়তা, যা কেবল মেডিকেল কলেজেই রয়েছে৷

কর্তৃপক্ষের এই যুক্তি অবশ্যই কিছু প্রশ্ণের জন্ম দেয়৷ সরকার বহু জায়গায় তো করোনা চিকিৎসার জন্য বেসরকারি নার্সিংহোমগুলিও নিয়েছে সেখানে কি সব জায়গাতেই পরিকাঠামো আছে? বা এই রোগের চিকিৎসার ব্যবস্থা কি মেডিকেল কলেজ নয় এমন সব সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালে করা সম্ভব নয়? আসলে মানুষের প্রতি সরকারের দায়বদ্ধতার অভাব পদে পদে প্রকট হয়েছে৷ দেশের সরকার মানুষকে যদি সম্পদ মনে করত তাহলে তারা নিশ্চয়ই নতুন নতুন পরিকাঠামো তৈরির পথেই হাঁটত৷

যদি তর্কের খাতিরে ধরেও নেওয়া হয়, এই মুহূর্তে সরকারের পক্ষে নতুন হাসপাতাল তৈরি করা সম্ভব নয়, তাহলেও কি মেডিকেল কলেজের পুরোটাকেই করোনা হাসপাতালে পরিণত করা অপরিহার্য ছিল? নাকি সবটাই করোনা নিয়ে চূড়ান্ত পরিকল্পনাহীনতার ফল? ভেবে দেখা দরকার৷ কারণ মেডিকেল কলেজের মতো ঐতিহ্যবাহী হাসপাতালকে পুরো করোনা হাসপাতালে পরিণত করার ফলে একদিকে যেমন হাজার হাজার মানুষ চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন, তেমনই মেডিকেল শিক্ষাও ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে৷ দীর্ঘদিন ধরে রাজ্যের সবচেয়ে মেধাবী ছাত্রদের এমবিবিএস পাঠক্রম এবং এমডি, এমএস পাঠক্রমের পড়াশোনা ও ট্রেনিং বন্ধ৷ যার পরিণতিতে কয়েক হাজার ছাত্রছাত্রী এমসিআই–এর রেকগনাইজেশন বাতিলের মুখে পড়ে যেতে পারেন৷ আবার এই সব হবু চিকিৎসকদের ট্রেনিং অসম্পূর্ণ থেকে গেলে সমাজ ভবিষ্যতে ভাল চিকিৎসক পাবে তো? প্রশ্নগুলি কিন্তু থেকেই যায়৷

যে কাজ অনায়াসেই করা যেত অর্থাৎ রোগ যাতে দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে না পড়ে তার ব্যবস্থা করা, কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকার কেউই কার্যত তা করল না৷ লকডাউন নিয়ে চলল চূড়ান্ত অবৈজ্ঞানিক পদক্ষেপ এবং সরকার লকডাউনের নাম করে কার্যত করোনা নিয়ন্ত্রণের দায় জনগণের উপর ছেড়ে দিয়ে পুরোপুরি হাত গুটিয়ে নিল৷

মেডিকেল সার্ভিস সেন্টার ও সার্ভিস ডক্টর্স ফোরামের পক্ষ থেকে প্রথম থেকেই দাবি জানানো হয়েছিল– করোনা সমস্যা সমাধানে নতুন নতুন হাসপাতাল তৈরির উদ্যোগ নিতে হবে৷ সেই সাথে মেডিকেল কলেজগুলোকে পুরোপুরিভাবে করোনা হাসপাতালে পরিণত না করে যত দিন পর্যন্ত করোনার জন্য নির্দিষ্ট হাসপাতাল তৈরি না করা হচ্ছে ততদিন সেগুলির একটা অংশ করোনা রোগীদের জন্য নির্ধারিত করে বাকি অংশে অন্যান্য সব পরিষেবা এবং মেডিকেল শিক্ষা ও ট্রেনিংয়ের কাজ চালু রাখা হোক৷ আজও রাজ্যের সাধারণ ডাক্তার, মেডিকেল ছাত্ররা এই দাবিতেই আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন৷