মূল্যবৃদ্ধি হচ্ছে, জানেন না নাকি অর্থমন্ত্রী

অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন ৭ সেপ্টেম্বর বলেছেন, দেশে মূল্যবৃদ্ধি কোনও গুরুতর সমস্যা নয়।

বুর্জোয়া গণতন্ত্রে মন্ত্রীদের মিথ্যা কথা বলা রপ্ত করতেই হয়, কিন্তু এতটা নির্জলা মিথ্যা বলতে সকলে পারেন কি না সন্দেহ হয়। এ ব্যাপারে অর্থমন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীর যোগ্য সতীর্থ তা স্বীকার না করে উপায় নেই। অর্থমন্ত্রীর স্মৃতিশক্তি দুর্বল ভাবার কোনও কারণ নেই। তা হলে মূল্যবৃদ্ধির আগুনে মানুষ যখন পুড়ছে, তিনি এ কথা বললেন কেন?

গত জুলাইয়ে প্যাকেটের খাদ্যপণ্যের উপর ৫ শতাংশ জিএসটি বাড়িয়েছে তাঁর সরকার, যার অর্থমন্ত্রী স্বয়ং তিনি। সরকারি এই মূল্যবৃদ্ধির সুযোগ নিয়ে এক মাসের মধ্যে দেখা গেল, বাস্তবে দাম বাড়ানো হয়েছে ২০-৫০ শতাংশ। ১ আগস্ট এক কেজি মিনিকিট চালের দাম ছিল ৪৫ টাকা। ২২ আগস্ট তা বেড়ে হয়েছে ৫৫ টাকা। বৃদ্ধির হার ২২ শতাংশ। খুচরো আটার দাম ছিল ২৫ টাকা কেজি। তার দাম বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৫ টাকা। বৃদ্ধির হার ৪০ শতাংশ। মুড়ি ৫০ টাকা কেজি থেকে দাঁড়িয়েছে ৬০ টাকা। বৃদ্ধির হার ২০ শতাংশ। বিস্কুটের দাম বেড়েছে সব চেয়ে বেশি। ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ। এই অতিরিক্ত দাম বাড়াল কারা এবং কী ভাবে নির্মলা দেবী তার জবাব দেবেন কি?

অর্থনীতির অতি বড় পণ্ডিত না হয়েও যে কেউ বোঝেন, দাম বাড়িয়েছে খাদ্য পণ্যের বড় বড় ব্যবসায়ীরা, একচেটিয়া মালিকরা। কী করে বাড়াতে পারল? কারণ বাজারে সরকারের কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই। সরকার খাদ্য ও কৃষিপণ্য সহ সমস্ত নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের পুরো বাজারকে বৃহৎ একচেটিয়া ব্যবসায়ীদের হাতে ছেড়ে দিয়েছে। তারা যেমন ইচ্ছা দাম বাড়িয়ে মুনাফা লুটছে। আর তার চাপে বিপর্যস্ত হচ্ছে সাধারণ মানুষের জীবন। এটাই আমাদের দেশে বর্তমান পুঁজিবাদী অর্থনীতির অনিবার্য পরিণাম। পুঁজিপতিদের স্বার্থে পুঁজিপতিদের বিশ্বস্ত সেবক সরকার এর বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেয় না। তাই অর্থমন্ত্রী মূল্যবৃদ্ধি দেখতেই পান না। আর যিনি মূল্যবৃদ্ধি দেখতে পান না, তিনি যে মূল্যবৃদ্ধির আসল কারবারিদের দেখতেও পাবেন না– তা তো বলাই বাহুল্য! শুধু বিজেপি কেন, কংগ্রেস, তৃণমূল ইত্যাদি কোনও সরকারই এ প্রশ্নে পুঁজিপতিদের বিব্রত করে না। কারণ, এদের দেওয়া টাকাতেই এইসব দল চলে। পার্টির খরচ, ভোটের খরচ জোগায় এরাই। পুঁজিপতি, বড় ব্যবসায়ী, কালোবাজারিদের খুশি করতেই এরা দেশে কালোবাজারি, মজুতদারির বিরুদ্ধে যে সব আইন ছিল, সেগুলিও নিষ্ক্রিয় করে রেখেছে।

পুঁজিপতিদের সেবক ডান ও বাম দলগুলির ভূমিকা দেখে জনগণের একাংশের মধ্যে এই ধারণা দৃঢ়মূল হয়ে বসেছে যে, মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে কেউ কিছু করতে পারবে না। দেশের অর্থনীতিবিদরা মূল্যবৃদ্ধির নানা ব্যাখ্যা দিলেও মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে কোনও কার্যকরী পথ দেখাতে পারছেন না। সরকারবিরোধী অন্যান্য দলগুলিরও মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে বক্তব্য একান্তই দায়সারা। কারণ মূল্যবৃদ্ধি সমস্যার উৎস যে পুঁজিবাদী অর্থনীতি, তার সেবাদাস হয়ে তারা কী করে ওই দিকে আঙুল তুলবে? ফলে এইসব দলের নেতারা হামেশাই বলে থাকেন, মূল্যবৃদ্ধি কেউ নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। এদের মুখে অবিরাম শুনতে শুনতে জনগণের একাংশ বিশ্বাস করে বসে, এ নিয়ে কিছু করার নেই। কিন্তু সত্যিই কি নেই?

১৯৫০-এর দশকে, ‘৬০-এর দশকে এ রাজ্যে তীব্র বামপন্থী আন্দোলনের সময়ে মূল্যবৃদ্ধি রোধে কার্যকরী ব্যবস্থার রূপরেখা তুলে ধরেন এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)-এর প্রতিষ্ঠাতা মার্কসবাদী চিন্তাবিদ শিবদাস ঘোষ। তাঁর নেতৃত্বে এস ইউ সি আই (সি) দল স্পষ্ট দেখায়, পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় মূল্যবৃদ্ধির সমস্যা নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে প্রয়োজন রাষ্ট্রীয় বাণিজ্য চালু করা, বিশেষত খাদ্যদ্রব্যের ক্ষেত্রে। কারণ বেঁচে থাকাটা প্রধান প্রয়োজন। এই ব্যবস্থা অনুযায়ী সরকার চাষিদের কাছ থেকে ন্যায্য মূল্যে খাদ্যপণ্য কিনে নেবে। তারপর সেগুলি সরকারি ব্যবস্থাপনায় যথাসম্ভব কম দামে বিক্রি করবে যাতে জনগণ তার ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে খাদ্যদ্রব্য সংগ্রহ করতে পারে। ‘নো-প্রফিট নো-লস’ নীতির ভিত্তিতে সরকারি ব্যবস্থাপনায় খাদ্যদ্রব্যের খুচরো ও পাইকারি উভয় ব্যবসাই নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে খাদ্যদ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধির আগুন থেকে মানুষকে খানিকটা বাঁচানো যায়।

এই বক্তব্য মানুষের মধ্যে প্রবল সমর্থনও পায়। কিন্তু পুঁজিপতিদের স্বার্থে তদানীন্তন কংগ্রেস সরকার তা কার্যকর করেনি। ১৯৬৭-১৯৬৯ সালে পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেসবিরোধী যুক্তফ্রন্ট সরকারের বিভিন্ন শরিক দলগুলিও এই প্রস্তাব মেনে নেয়নি। ১৯৭৭ থেকে দীর্ঘ ৩৪ বছরে সিপিএম সরকারও এই নীতি কার্যকর করেনি। ফলে জনগণ মূল্যবৃদ্ধির আগুনে পুড়ছেই। খাদ্যদ্রব্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি জনগণের উপর একটা মারাত্মক আক্রমণ হিসাবেই থেকে যাচ্ছে। পুঁজিবাদী অর্থনীতির স্বাভাবিক নিয়মে বেশির ভাগ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমছে। তার উপর কোভিড অতিমারি আর্থিক দুরবস্থাকে আরও ভয়াবহ করে তুলেছে। ভারতে ক্ষুধা পরিস্থিতি ক্রমাগত বাড়ছে। ২০২১-এর বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে ১১৬টি দেশের মধ্যে ভারতের অবস্থান ১০১, যা ভয়াবহ ক্ষুধা পরিস্থিতিরই উৎকট চিত্র।

মূল্যবৃদ্ধি পুঁজিবাদী অর্থনীতির অনিবার্য ফল। এই সংকটের স্থায়ী সমাধান পুঁজিবাদী ব্যবস্থা বজায় রেখে কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অবসান ও সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রবর্তনের মধ্যদিয়েই মূল্যবৃদ্ধির সমস্যার স্থায়ী সমাধান সম্ভব। কারণ, সমাজতন্ত্রে উৎপাদনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সর্বোচ্চ মুনাফা নয়। কিন্তু যতদিন পর্যন্ত সমাজতন্ত্র না হচ্ছে, মূল্যবৃদ্ধি কি মেনে নিতেই হবে? একেবারেই নয়। একে নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করতে হবে। নিয়ন্ত্রণের এই পথটাই জোরের সাথে তুলে ধরেছে এস ইউ সি আই (সি)।

এই দাবি আন্দোলনের জোরেই মানাতে হবে। এই শিক্ষাই দিয়েছে দিল্লির কৃষক আন্দোলন। এই আন্দোলনের আরেকটি শিক্ষাও স্মরণীয়। এই কৃষক আন্দোলনের বিভিন্ন দাবি সরকার চাপে পড়ে মেনে নিলেও এখন দেখা যাচ্ছে, ঘুরপথে কৃষিক্ষেত্রে বেসরকারি সংস্থাকে ঢোকার রাস্তা করে দিচ্ছে। এদেরই স্বার্থে মোদি সরকার গমের সরকারি সংগ্রহ ৫০ শতাংশ কমিয়ে দিয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারের খাদ্য সচিব সুধাংশু পাণ্ডে সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, গম সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা কমানো হয়েছে যাতে বেসরকারি কোম্পানিগুলি প্রচুর গম কিনতে পারে (সূত্রঃ ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ৮-৯-২২)। এর ফল কী দাঁড়াবে? এরাই পরে নানা কিসিমের ব্র্যান্ডের ছাপ মেরে আটা, ময়দা, সুজি ইত্যাদি বিক্রি করবে আগুন দামে। খুচরো ব্যাবসাটার পুরো ক্ষেত্রটা এই বৃহৎ একচেটিয়াদের দখলে চলে যাবে। তা হলে দেখা যাচ্ছে, এদের কবল থেকে উৎপাদনকে মুক্ত করা কত জরুরি। ভোটে এক দলের বদলে আর এক দলকে সরকারি গদিতে বসালেই মূল্যবৃদ্ধির সমস্যার সমাধান হবে না। মূল্যবৃদ্ধি পুরোপুরি রদ হওয়া সম্ভব বুর্জোয়া ব্যবস্থাকে বদলে সমাজতন্ত্র কায়েম করার দ্বারা। কিন্তু যতদিন তা না হয়–লাগাতার সংঘবদ্ধ গণআন্দোলনই হল মূল্যবৃদ্ধিতে কিছুটা লাগাম পরানোতে সরকারকে বাধ্য করার একমাত্র রাস্তা।