মায়ানমারে ধৃত সাংবাদিকদের মুক্তির দাবি গোটা বিশ্ব জুড়ে

দেশের ‘অফিসিয়াল সিক্রেক্টস অ্যাক্ট’ ভাঙার অভিযোগে রয়টার্সের দুই সাংবাদিক ওয়া লোন ও কিয়াও সোই ইউকে দোষী সাব্যস্ত করে সাত বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে মায়ানমারের ইয়াঙ্গন উত্তর জেলার আদালত৷ এই ঘটনায় মানবাধিকার লঙঘনের অভিযোগে বারবার অভিযুক্ত মায়ানমার সরকার সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণের দায়ে আবারও ধিক্কৃত হল বিশ্বজুড়ে৷

এই দুই সাংবাদিক ঠিক কী করেছিলেন? মায়ানমারের সেনাবাহিনী নির্বিচারে রাখাইন প্রদেশের ইন ডিন গ্রামের দশ জন নিরীহ গ্রামবাসীকে কীভাবে হত্যা করেছিল, তাঁরা তা ফাঁস করে দিয়েছিলেন৷ উল্লেখ্য ‘মায়ানমার সেনাবাহিনী’ও এই ঘটনা স্বীকার করে অভিযুক্তদের শাস্তি দিতে বাধ্য হয়েছে৷ তার পরই সাংবাদিকদের এই শাস্তি তবে কি সরকারের কার্যকলাপ নিয়ে কেউ কিছু বলতে পারবে না?

প্রশ্ন উঠেছে, যে পদ্ধতিতে দুই সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, সেটাও অত্যন্ত ন্যক্কারজনক ধূর্ততার উদাহরণ৷ সাংবাদিকরা আদালতে জানিয়েছেন, পুলিশ প্রথমে তাঁদের একটি রেস্তোরাঁয় ডেকে আনে৷ সেখানে তাঁদের হাতে তথ্য সংবলিত কিছু কাগজপত্র দিয়ে সেগুলি দেখতে বলে৷ ঠিক সেই সময় রেস্তোরাঁয় উপস্থিত সাদা পোশাকের পুলিশ গোপনীয় তথ্য ফাঁস করার চেষ্টার অভিযোগ তুলে তাঁদের গ্রেপ্তার করে৷ ঘটনাটি ২০১৭ সালের ১২ ডিসেম্বরের৷ এর পর থেকে তাঁরা জেলেই রয়েছেন৷ আদালতে বিচারের নামে চলেছে প্রহসন৷

শোন ও সোই দু’জনেই আদালতকে জানান যে রীতিমতো পরিকল্পিত ভাবেই পুলিশ তাঁদের ফাঁসিয়েছে৷ পুলিশের সাক্ষীও জানিয়েছে যে দুই সাংবাদিককে ফাঁসাতে পুলিশ রেস্তোরাঁয় একটি নাটকের পরিকল্পনা করেছিল৷ কিন্তু সরকারের মতটাকেই প্রতিষ্ঠা দেওয়ার মরিয়া চেষ্টায় বিচারক ইয়ে লুইন কোনও প্রমাণ ছাড়াই আদালতে বলেন, গোপন তথ্য পাওয়ার জন্য তারা বহুবার চেষ্টা করেছিল শুধু তাই নয়, অন্যদের সেটা সরবরাহ করতেও চেয়েছিল৷ ফলে এটা মোটেই সাধারণ সাংবাদিককের মতো কাজ নয়৷ তিনি আরও বলেন– ওই গোপনীয় তথ্য সন্ত্রাসবাদী সংস্থা ও দেশের শত্রুদের খুবই কাজে লাগতে পারত৷ ফলে দোষীরা শাস্তি পাওয়ার যোগ্য এবং তাদের সাত বছর কারাদণ্ডের নির্দেশ দেওয়া হয়৷

‘‘রাখাইন প্রদেশের তৈলসমৃদ্ধ এলাকায় পুঁজিবাদী চীন মায়ানমারের ধনকুবেরদের সাথে গাঁটছড়া বেঁধে ব্যাপক  বিনিয়োগ করতে চাইছে৷ ভারতীয় একচেটিয়া মালিকদের  নজরও ওই এলাকায় আছে৷ দেশি বিদেশি মাল্টিন্যাশনালদের স্বার্থে মায়ানমার সরকারের সেনা বাহিনী ওই অঞ্চল খালি করার উদ্দেশ্যে এই হিংস্র আক্রমণ চালিয়েছে৷’’

 

সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ বা সাম্প্রদায়িকতাকে সাহায্য করতে পারে এরকম কোনও তথ্য সাধারণভাবে কোনও দায়িত্বশীল সাংবাদিক প্রকাশ করেন না৷ এটা সংবাদমাধ্যমের নূ্যনতম নৈতিকতার বিরোধী৷ আর যদি দেশের গোপন তথ্য ওই দুই সাংবাদিকের হাতে গিয়েও থাকে তবে তা কীভাবে গেল, কারা এর সাথে যুক্ত তার পূর্ণাঙ্গ  তদন্ত হওয়া উচিত ছিল৷ তা না করে একতরফা বিচারপ্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেভাবে দুই সাংবাদিককে দোষী সাব্যস্ত করা হল তা গণতান্ত্রিক বিচার ব্যবস্থার পরিপন্থী৷

জঙ্গি দমনের ধুয়ো তুলে মায়ানমারের সেনাবাহিনী দীর্ঘ দিন ধরে রোহিঙ্গাদের উপর যে ব্যাপক অত্যাচার চালিয়েছে তা কারও অজানা নয়৷ খনিজ সম্পদের প্রাচুর্য সম্পন্ন রাখাইন প্রদেশ সহ বেশ কয়েকটি প্রদেশের প্রায় ৭ লক্ষ মুসলিম ধর্মাবলম্বী রোহিঙ্গা উপজাতির মানুষ খুন, ধর্ষণ, গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়ার মতো ব্যাপক নির্যাতনের শিকার হন৷ রাখাইন প্রদেশের তৈলসমৃদ্ধ এলাকায় পুঁজিবাদী চীন মায়ানমারের ধনকুবেরদের সাথে গাঁটছড়া বেঁধে ব্যাপক বিনিয়োগ করতে চাইছে৷ ভারতীয় একচেটিয়া মালিকদের নজরও ওই এলাকায় আছে৷ দেশি বিদেশি মাল্টিন্যাশনালদের স্বার্থে মায়ানমার সরকারের সেনা বাহিনী ওই অঞ্চল খালি করার উদ্দেশ্যে এই হিংস্র আক্রমণ চালিয়েছে৷ আক্রমণ যুক্তিগ্রাহ্য করতে সন্ত্রাসবাদের ধুয়ো তুলছে৷ আর তা দমনের নামে মায়ানমার সেনার অত্যাচারে প্রায় সব রোহিঙ্গা পরিবারকে দেশ ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিতে বাধ্য করছে৷ বিদেশি বা অনুপ্রবেশকারী তকমা দিয়ে যেভাবে রোহিঙ্গাদের উপর নির্যাতন করা হয়েছে তা সভ্যতার লজ্জা৷ পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদীদের স্বার্থে একটা বুর্জোয়া সরকার জনজীবনে যে কী ভয়ঙ্কর আক্রমণ নামিয়ে আনতে পারে মায়ানমার সরকার তার নির্লজ্জ নজির রেখেছে৷

দুই সাংবাদিককে ষড়যন্ত্র করে ফাঁসিয়ে কারাদণ্ড দেওয়ার প্রতিবাদে সরব হয়েছে সমগ্র দুনিয়া৷ দুনিয়ার গণতন্ত্র প্রিয় মানুষের চাপ অস্বীকার করতে না পেরে রাষ্ট্রপুঞ্জও এর নিন্দা করে বলেছে, ‘এই রায় আইনের শাসনের উপর কুঠারাঘাত’৷ মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও তথ্য জানানোর অধিকারকে সম্মান দিয়ে লোন ও সোইকে দ্রুত মুক্তি দেওয়ার দাবিও উঠেছে সব মহল থেকে৷ মায়ানমারের স্বৈরাচারী শাসকরা বিশ্ব জনমতকে মর্যাদা দেবে কি না তা নির্ভর করছে বিশ্বজনমতের তীব্রতার উপর৷ আজ বিশ্বের দেশে দেশে সকল শাসক সম্প্রদায় যেভাবে পুঁজিপতিদের স্বার্থে সাধারণ মানুষের উপর একের পর এক আক্রমণ নামিয়ে আনছে এবং প্রতিবাদের কণ্ঠকে স্তব্ধ করতে চাইছে, তার বিরুদ্ধে তীব্র জনমত সংগঠিত করা একান্ত প্রয়োজন গণতন্ত্রের স্বার্থেই৷

(৭১ বর্ষ ৯ সংখ্যা ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৮)