মানুষ চায় প্রতিবাদ হোক, আন্দোলন হোক ২২ মার্চ সেই প্রতিবাদেরই মিছিল


২২ মার্চের মিছিলে চলুন–রাজ্য জুড়ে প্রচার চলছে জোর কদমে। হাটে, বাজারে, স্টেশনে, অফিসে, দোকানে, রাস্তায় সর্বত্র। কর্মীরা প্রচারপত্র বিলি করছেন, দাবিগুলি তুলে ধরছেন, মিছিলে যোগ দেওয়ার আবেদন জানাচ্ছেন। দাবিগুলি শুনে থমকে দাঁড়াচ্ছেন মানুষ। এগিয়ে এসে দাবিপত্র সংগ্রহ করছেন। কর্মীদের আবেদনে আর্থিক সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন।
প্রচার চলছিল কলকাতা মেডিকেল কলেজের সামনে। রাজ্য সরকার কী ভাবে ২৮৩টি ওষুধ হাসপাতালগুলিতে বন্ধ করে দিয়েছে সে কথাই তুলে ধরছিলেন কর্মীরা। ভিড় করে দাঁড়ালেন রোগীর পরিবারের লোকজন। একজন ক্ষোভে ফুঁসে উঠে হাতের প্রেসক্রিপশন দেখিয়ে বললেন, দেখুন, সব ওষুধ বাইরে থেকে কিনতে হচ্ছে। ওষুধের দাম প্রতিদিন লাফিয়ে বাড়ছে। কী করে জোগাবো এই ওষুধ বলতে পারেন! কর্মীরা তাঁকে জানালেন, এর বিরুদ্ধেই তো আমাদের আন্দোলন। এর বিরুদ্ধেই ২২ মার্চের মিছিল। উত্তরে তিনি বললেন, আমি আছি আপনাদের সঙ্গে। হাসপাতালের সুপারের কাছে ডেপুটেশন দেওয়া হবে শুনে তিনিও সঙ্গে গেলেন এবং সুপারের কাছে তুলে ধরলেন তাঁর ক্ষোভের কথা।
বেহালায় প্রচার করছিলেন কর্মীরা। প্ল্যাকার্ডে লেখা দাবিগুলি দেখছিলেন এক ব্যক্তি। ‘দুয়ারে মদ প্রকল্প বাতিল করতে হবে’ এই দাবিটির দিকে আঙুল দেখিয়ে বললেন, কোনও সভ্য সরকার যে এমন ঘোষণা করতে পারে এটা ভাবনার অতীত। আপনারা সঠিক দাবি তুলেছেন। তারপর পকেট থেকে একটি একশো টাকার নোট বের করে বললেন, ২২ তারিখের মিছিলে নিশ্চয় যোগ দেব। সরকারের মদের ঢালাও প্রসারের বিরুদ্ধে দরিদ্র মানুষ, বিশেষত মহিলাদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ লক্ষ করা যাচ্ছে। বেলেঘাটার এক বসতিতে প্রচার চালানোর সময়ে কয়েক জন মহিলা এগিয়ে এসে বললেন, এঁরা কি নেতা? এঁরা কি আমাদের কথা ভাবে? বলুন আমাদের কোথায় যেতে হবে?
উত্তর কলকাতার শোভাবাজারে প্রচার চলছিল। মাইকে কর্মীরা ঘোষণা করছিলেন কী ভাবে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার তেল গ্যাস খনি বন্দর ব্যাঙ্ক বিমা প্রতিরক্ষা প্রভৃতি সব রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলিকে একচেটিয়া পুঁজিপতিদের হাতে তুলে দিচ্ছে। শিক্ষা স্বাস্থ্যের বেসরকারিকরণ করছে। জিনিসপত্রের দাম প্রতিদিন বেড়ে চললেও সরকারগুলি কেমন হাত গুটিয়ে বসে রয়েছে।
প্রচার শুরু হতেই বহু মানুষের মুখেই একই কথা শোনা গেল–প্রতিবাদ করার জন্যে তো এই একটি দলই আছে। এক ব্যক্তি এগিয়ে এসে বললেন, রাস্তাতে তো শুধু আপনাদেরই দেখি। বাকিরা তো শুধু ভোটের দল। কিন্তু কী হবে বলুন দেখি! সরকার যা করছে, এ কি রোখা যাবে? দলের এক কর্মী উত্তর দিলেন, কেন রোখা যাবে না? দিল্লির কৃষকরা তো দেখিয়ে দিলেন, একজোট হলে বিজেপির মতো একটা ফ্যাসিস্ট সরকারকেও পিছু হঠানো যায়। শুধু তা কেন, এ রাজ্যে কি আন্দোলন করে ইংরেজি চালুর দাবি আদায় হয়নি? কদিন আগেই তো ছাত্র-অভিভাবকদের আন্দোলনের চাপে সরকার স্কুল খুলতে বাধ্য হল। তিনি বললেন, তা ঠিক, কিন্তু …। কর্মীটি উত্তর দিলেন, কোনও কিন্তু নেই। জনগণ যদি একজোট হয় তা হলে তার শক্তি সরকারের থেকে অনেক বেশি। সরকারকে পিছু হঠাতে হলে শুধু সমর্থন নয়, আপনাদেরও আন্দোলনে আসতে হবে। যত তাড়াতাড়ি আপনারা আসবেন ততই আন্দোলন জোরদার হবে, সরকারকে আমরা ভাবাতে পারব। আর সরকার যদি বোঝে, জনগণ অসংগঠিত, আমরা যা করব তারা শুধু মুখ বুজে সয়ে যাবে, তবে একের পর এক বোঝা চাপাতেই থাকবে। আর আমরা যদি সংগঠিত হই, নীরবে মেনে না নিই, প্রতিবাদ করি, তবে জনগণের বিরুদ্ধে যেতে সরকারকে পাঁচবার ভাবতে হবে, সহজে এমন বেপরোয়া হতে পারবে না। কথাগুলি মন দিয়ে শুনলেন মানুষটি, তারপর পকেট থেকে দুটি দশ টাকার নোট বের করে কর্মীদের হাতে ধরা লাল শালুতে দিলেন।
প্রচারে গিয়ে ব্যাঙ্কগুলিতে অফিসার থেকে সাধারণ কর্মচারী সবারই স্বতঃস্ফূর্ত সাড়া পাওয়া যাচ্ছে। সরকারের বেপরোয়া বেসরকারিকরণের নীতিতে তথাকথিত ‘হোয়াইট কলার’ কর্মচারীরাও উদ্বিগ্ন। বলছেন, আন্দোলনটা খুবই জরুরি। আমরা আছি আপনাদের সাথে। চাঁদা দিচ্ছেন, নাম-ঠিকানা দিচ্ছেন, যোগাযোগ রাখতে বলছেন। একই রকম সমর্থন লক্ষ করা যাচ্ছে রেল কর্মচারীদের মধ্যে। শিয়ালদহে রেল কলোনিতে প্রচারের সময় একবাক্যে সবাই আন্দোলনকে সমর্থন করেছেন। বলেছেন, সরকার আমাদের জীবনের নিরাপত্তাকেই কেড়ে নিতে চায়। আন্দোলন তো আমাদেরই করার কথা। আপনারা আমাদের কাজই করছেন।
হকারদের মধ্যে প্রচারে গিয়ে দেখা গেল, সরকার যে ভাবে নির্বিচারে উচ্ছেদের পরিকল্পনা নিয়েছে তাতে ভয়ে আছেন তাঁরাও। বলছেন, দেখুন চাকরি তো নেই, সামান্য হকারি করেও যে সংসার চালাব, তা-ও করতে দেবে না সরকার। আপনাদের প্রতিটি দাবিই ন্যায্য। যতক্ষণ পারি মিছিলে হাঁটবো।
এ বারের প্রচারে সব চেয়ে বেশি চোখে পড়েছে আন্দোলনের প্রতি মানুষের ভেতর থেকে একটা সমর্থন। হয়ত সবাই মিছিলে-আন্দোলনে এখনই আসবেন না, কিন্তু মানুষ আন্তরিক ভাবেই চাইছেন আন্দোলন হোক, প্রতিবাদ হোক। তাই মিছিলের কথা শুনে সবাই একবাক্যে বলছেন, এই প্রতিবাদের খুবই দরকার।
একটি চায়ের দোকানে বন্ধুদের আড্ডায় প্রচারপত্র দিতেই এক যুবক বলে উঠলেন, আপনারা তো সব কিছু নিয়েই আন্দোলন করেন তবে ভোট পান না কেন? কর্মীটি কিছু বলার আগেই তাঁদেরই একজন বলে উঠলেন, ভোটএ! আর বলিস না। এর নাম ভোট! সব দলই সমান। যে যেখানে ক্ষমতায় আছে সে-ই তো একই জিনিস করছে। কর্মীটি উত্তর দিলেন, ঠিকই। দেখুন, স্বাধীনতার পর থেকে ভোট তো মানুষ কম দিল না। সরকার তো কম পরিবর্তন হল না। কিন্তু ভোটবাজ দলগুলি ভোটকে পুরোপুরি প্রহসনে পরিণত করেছে। ভোট মানে তো এখন টাকা, গুন্ডাশক্তি আর পুঁজিপতিদের মিডিয়ার প্রচারের জোর। মানুষের সমর্থন কোথায়? মানুষ তো ওদের কাছে দাবার বোড়ে ছাড়া আর কিছু নয়। যুবকটি রাগের সাথে বললেন, এক একজন দশটা বিশটা করে ভোট দিচ্ছে। এর নাম গণতন্ত্র! কর্মীটি বললেন, শুধু ছাপ্পা ভোটই নয়। এই বেকার যুবকদের অসহায়তার সুযোগ নিয়ে টাকার লোভ দেখিয়ে, কাজের লোভ দেখিয়ে, মদ খাইয়ে এমন নীতিহীন কাজে নামিয়ে তাদের নৈতিক মেরুদণ্ডটাকে ভেঙে দিচ্ছে, অমানুষ করে দিচ্ছে। এটা আরও সর্বনাশের। আর এই ভাবে যে ভোট, তাতে তো জেতে ভোটবাজ দলগুলির নেতারা, জিতে এমএলএ হয়, এমপি হয়, মন্ত্রী হয়। মানুষের দুরবস্থা বদলায় না। এই সব দলগুলির নাম আলাদা, পতাকার রঙ আলাদা, নীতি সবার এক। কর্মীটি যুবকদের উদ্দেশ্যে বললেন, দেখুন আমরা বহু দিন ধরে বলে আসছি, ভোট দিয়ে সরকার বদলায় মানুষের দুরবস্থা বদলায় না। আজ মানুষ অভিজ্ঞতা দিয়ে তা ধরতে পারছে। বুঝতে পারছে মানুষের দুরবস্থা বদলাতে পারে একমাত্র নীতিভিত্তিক লড়াই-আন্দোলনের পথেই। ঠিক এই কারণেই ২২ মার্চের মিছিলের ডাক মানুষের মধ্যে সাড়া জাগিয়েছে।

বিক্ষোভ মিছিলের ১৯ দফা দাবি

১। অত্যাবশ্যক পণ্যের কালোবাজারি মজুতদারি ও মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম কমাতে হবে।
২। সব শূন্য পদ এক বছরের মধ্যে পূরণ করতে হবে। সমস্ত কর্মক্ষম যুবকদের চাকরি দিতে হবে। রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের চাকরি নিয়ে প্রতারণা বন্ধ করতে হবে।
৩। ‘দুয়ারে মদ’ প্রকল্প বন্ধ করতে হবে। মদ গাঁজা চরস ড্রাগস সহ সমস্ত মাদকদ্রব্যের ব্যবসা কঠোরভাবে দমন করতে হবে। মদের প্রসার ঘটিয়ে ছাত্র ও যুবকদের নৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙে দেবার চক্রান্ত বন্ধ করতে হবে।
৪। হাসপাতালে ওষুধ ছাঁটাই করা চলবে না। হাসপাতাল থেকে গুরুতর অসুস্থ রোগী ফেরানো চলবে না। স্বাস্থ্যসাথীর নামে চিকিৎসাকে বিমানির্ভর করা চলবে না। সরকারি হাসপাতালে বিনামূল্যে সকলের সব ধরনের চিকিৎসা ব্যবস্থা রাখতে হবে।
৫। কোনও অছিলায় রাজ্যে ‘কেন্দ্রীয় শিক্ষানীতি ২০২০’ চালু করা চলবে না। স্কুল শিক্ষাকে ‘পিপিপি মডেল’-এর আওতায় এনে বেসরকারিকরণ করা চলবে না। শিক্ষার মানোন্নয়নে পাশ-ফেল প্রথা পূর্ণ রূপে চালু করতে হবে। শিক্ষার ধর্মীয়করণ, সাম্প্রদায়িকীকরণ ও ইতিহাসের বিকৃতি ঘটানো চলবে না। শিক্ষায় ফি বৃদ্ধি করা চলবে না।
৬। বন্ধ হয়ে যাওয়া সব কল কারখানা খুলতে হবে। বন্ধ চটকল ও চা বাগান খুলে শ্রমিকদের কাজে ফেরাতে হবে এবং সুস্থভাবে বেঁচে থাকার মজুরি দিতে হবে। ধনকুবেরদের ট্যাক্স ছাড় না দিয়ে অতিরিক্ত ট্যাক্স বসিয়ে বন্ধশিল্পের পুনরুজ্জীবন ঘটাতে হবে।
৭। ভিক্ষাতুল্য সামান্য অর্থ নয়, স্থায়ী কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। শিক্ষক পদে নিয়োগ সহ সব নিয়োগে দুর্নীতি ও দলবাজি বন্ধ করতে হবে।
৮। সরকারি অর্থের ব্যাপক আত্মসাৎ ও অপচয় বন্ধ করে গরিব মানুষের প্রকৃত সাহায্য হয় এমন প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে। মেলা-খেলা-ক্লাবে টাকা না ঢেলে পরিযায়ী শ্রমিকদের রাজ্যেই কাজ দিতে বছরভর কর্মসংস্থান করতে হবে।
৯। নদী ভাঙন প্রতিরোধ করতে হবে। সুন্দরবন সহ সমুদ্রতীরবর্তী জনবসতিকে প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে রক্ষা করার জন্য স্থায়ী নদীবাঁধ নির্মাণ করতে হবে।
১০। নারী পাচার, নাবালিকা ও শিশু পাচার রোধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। নারী নির্যাতন ও নারী ধর্ষণ বন্ধে সরকার ও প্রশাসনকে তৎপর হতে হবে। দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।
১১। দলবাজি বন্ধ করে পুলিশ ও প্রশাসনকে নিরপেক্ষ রাখতে হবে। বিরোধীদের উপর সন্ত্রাস, আক্রমণ বন্ধ করতে হবে। নির্বাচনকে গুণ্ডাতন্ত্র থেকে মুক্ত করতে হবে। নানা অজুহাতে মিছিল-মিটিং নিয়ন্ত্রণ করা চলবে না।
১২। বিদ্যুৎ-এর দাম কমাতে হবে। ‘বিদ্যুৎ বিল ২০২১’ বাতিল করতে হবে। সারের কালোবাজারি বন্ধ করতে হবে। সার-বীজ-কীটনাশকের দাম কমাতে হবে। ফসলের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করতে হবে। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে ও কম সুদে সহজে কৃষিঋণ দিতে হবে।
১৩। আশা-আইসিডিএস, পৌর স্বাস্থ্যকর্মী-মিড ডে মিল-নির্মাণ কর্মী-বিড়ি শ্রমিক-মোটরভ্যান চালক সহ সর্বস্তরের অসংগঠিত শ্রমিকদের দাবি অবিলম্বে মানতে হবে।
১৪। দেউচা-পাঁচামিতে আদিবাসীদের জোর করে উচ্ছেদ করা চলবে না।
১৫। পরিবহণের ভাড়া বাড়ানো চলবে না।
১৬। আনিস হত্যার নিরপেক্ষ তদন্ত দ্রুত শেষ করে দোষী ব্যক্তিদের শাস্তি দিতে হবে।
১৭। শ্রমিকস্বার্থ বিরোধী শ্রমকোড বাতিল করতে হবে। রাষ্ট্রায়ত্ত সম্পত্তির বেসরকারিকরণ করা চলবে না। ধনকুবেরদের অধিক মুনাফার স্বার্থে সরকারি সংস্থা জলের দরে বেচে দেওয়া চলবে না। ধনকুবেরদের কাছে ব্যাঙ্কের পাওনা সমস্ত ঋণ উদ্ধার করতে হবে।
১৮। পেট্রল-ডিজেল-রান্নার গ্যাসের বেলাগাম মূল্যবৃদ্ধি রোধ করতে হবে।
১৯। প্রভিডেন্ট ফান্ডের সুদের হার কমানো চলবে না।