মাঝেরহাট কিংবা টালা ব্রিজ — সরকারি অবহেলারই পরিণাম

এই মুহূর্তে কলকাতার উত্তর ও দক্ষিণ শহরতলির লক্ষ লক্ষ মানুষ, যাঁরা রুজি–রোজগারের জন্য হোক, চিকিৎসা করানোর জন্য হোক কিংবা সন্তানকে স্কুলে দেওয়া–নেওয়ার জন্য হোক, নিত্য মূল কলকাতায় আসেন, তাঁরা চরম দুর্ভোগের শিকার৷ দক্ষিণ শহরতলির ক্ষেত্রে এই দুর্ভোগ চলছে এক বছরেরও বেশি সময় ধরে৷ মাঝেরহাটে নতুন ব্রিজ তৈরির সরকার ঘোষিত সময়সীমা কবেই পেরিয়ে গেছে৷ অথচ এখনও অনেক কাজ বাকি৷ কবে কাজ শেষ হবে, কবে ভুক্তভোগী মানুষগুলির সুরাহা মিলবে, কেউ বলতে পারছেন না৷ আবার সম্প্রতি ব্রিজ বিশেষজ্ঞদের সুপারিশে গুরুত্বপূর্ণ সংযোগকারী টালা ব্রিজ বন্ধ করে দেওয়ায় কলকাতার উত্তর শহরতলির বিস্তীর্ণ অঞ্চলের মানুষ এখন চরম আতান্তরে পড়েছেন৷ কোন বাস কোথা দিয়ে যাবে, কতদূর যাবে, ব্যাপক যানজট ও প্রায় দশ কিলোমিটার অতিরিক্ত পথ ঘুরে কখন গন্তব্যস্থলে পৌঁছে দেবে, তার কোনও হিসেব নেই৷ আগে পনেরো মিনিটে যে রাস্তাটুকু পার হওয়া যেত, এখন সেখানে লাগছে এক ঘণ্ঢার উপর৷ চাকরির হাজিরা ঠিকঠাক রাখতে বাস বদলে বদলে কিংবা অটো ধরে পৌঁছতে গুনতে হচ্ছে অতিরিক্ত কড়ি৷ তাই প্রতিদিন এক ঘন্টা থেকে দেড়ঘন্টা অতিরিক্ত সময় হাতে নিয়ে তাঁদের বেরোতে হচ্ছে৷ বাড়ি ফিরতেও একই সমস্যা৷

মাঝের হাট ও টালা ব্রিজটি ছিল কলকাতার দক্ষিণ ও উত্তর শহরতলির বিস্তীর্ণ অঞ্চলের মানুষের গেটওয়ে৷ কলকাতা শহরের বড় হয়ে ওঠার সাথে এই শহরতলি দু’টির সাথে সংযোগের প্রয়োজনে ষাটের দশকের শুরুতে ব্রিজগুলি তৈরি হয়েছিল৷ তখন যে চাপ ও ভার বহনের কথা ভাবা হয়েছিল, তা থেকে কলকাতা আজ অনেকদূর এগিয়ে গেছে৷ রুটি–রুজির টানে এবং শিক্ষা–স্বাস্থ্য সহ আরও বহু প্রয়োজনে শহরতলির মানুষ বেশি বেশি করে প্রতিদিন শহরমুখী হয়েছে৷ ব্রিজগুলির উপর দিয়ে গাড়ির চাপ তার ক্ষমতাকে ছাড়িয়ে গিয়েছে৷ প্রশাসন নজর দেয়নি৷ ব্রিজ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এমনিতেই পঁচিশ–ত্রিশ বছর পর ব্রিজের ক্ষয় ধরা শুরু হয়৷ কেবল উপরিভাগের সংস্কার করতে গিয়ে পিচ ও স্টোনচিপের ভারে ব্রিজকে আরও ভারী করে তোলা হয়েছে৷ বৃষ্টির জল চুঁইয়ে পড়ে শুধু গার্ডারগুলির কংক্রিটের ক্ষতি করেনি, ঢালাইয়ের ইস্পাতের রডগুলিকেও ক্ষতিগ্রস্ত করেছে৷ ব্রিজের গার্ডারগুলি একটি শক্তিশালী লোহার তার দিয়ে আড়াআড়িভাবে বাঁধা থাকে, যাতে ব্রিজের ভার সমস্ত গার্ডারগুলির উপর সমভাবে পড়ে৷ প্রযুক্তির পরিভাষায় একে বলে ‘ক্রস প্রি–স্ট্রেসড ডেক’, সেই লোহার তারেও মরচে ধরেছে৷ ফলে গার্ডারগুলির উপর অসম চাপ বেড়ে সেতুর ভার বহন ক্ষমতাকে কমিয়ে এনেছে৷ সেতু বিশেষজ্ঞের মতে ২০০০ সালের পর কংক্রিটের প্রযুক্তিতে বড়সড় পরিবর্তন এসেছিল৷ ব্রিজের কাঠামোয় কত পুরু কংক্রিটের ব্যবহার করা হবে, তা নিয়ে নতুন কোড বেরিয়েছিল৷ প্রযুক্তির এই অগ্রগতির সাথে তাল মিলিয়ে পঞ্চাশ–ষাট বছর আগেকার এই ব্রিজগুলির নিয়মিত পর্যবেক্ষণ এবং সংস্কার করার প্রয়োজন ছিল৷ পূর্বতন সিপিএম সরকার কিংবা বর্তমান তৃণমূল সরকার কেউই এইসব ব্রিজ সংস্কারের বা পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে কোনও ভূমিকাই নেয়নি৷ এই ব্রিজের তলা দিয়ে গিয়েছে টালাট্যাঙ্ক থেকে পানীয় জলের পাইপ, বিদ্যুতের কেবল, নিকাশির পাইপ এমনকি পরিত্যক্ত গ্রেটার ক্যালকাটা গ্যাস সার্ভিসের পাইপ লাইন৷ ব্রিজ ভাঙার আগে এগুলির বিকল্প ব্যবস্থা করতে হবে৷ এত গুরুত্বপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও ব্রিজের কাঠামোগত দুর্বলতা কী করে সরকারের বা প্রশাসনের নজর এড়িয়ে গেল?

ওরা ঘোষণা করেছিল, কলকাতাকে তিলোত্তমা বানাবে৷ বানাবে লন্ডন৷ কিন্তু শহরে একের পর এক ব্রিজ ধসে পড়া, উড়ালপুল ভেঙে পড়া, বিশুদ্ধ পানীয় জলের অভাব, সামান্য বৃষ্টিতেই কলকাতা ডুবে যাওয়া, মশার উৎপাত, ডেঙ্গুতে মৃত্যু ইত্যাদি রোধ করার দায়িত্বে সরকারের যে বা যারাই থাকুক প্রকৃতপক্ষে নাগরিক পরিষেবা তলানিতে৷ তিলোত্তমার বা লন্ডনের ঘোষণা বাস্তবে ভঙ্গি দিয়ে ভোলানোর ছল৷ নাগরিক আন্দোলনের দুর্বলতার সুযোগে নাগরিক জীবন নিয়ে এমন উদাসীনতা দেখাতে পারছে সরকার৷

(গণদাবী : ৭২ বর্ষ ১২ সংখ্যা)