মহান ফ্রেডরিখ এঙ্গেলসকে কেন স্মরণ করব (৫) — প্রভাস ঘোষ

২০২০ সালের ২৮ নভেম্বর বিশ্ব সাম্যবাদী আন্দোলনের মহান নেতা ফ্রেডরিখ এঙ্গেলসের দ্বিশত জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)-এর সাধারণ সম্পাদক কমরেড প্রভাস ঘোষ সমগ্র দেশের নেতা-কর্মী-সমর্থকদের উদ্দেশে ইংরেজিতে একটি আলোচনা করেন যা অনলাইনে সম্প্রচারিত হয়। ৫ আগস্ট মহান এঙ্গেলসের ১২৬তম মৃত্যুদিবস উপলক্ষে সেই ইংরেজি আলোচনাটির বঙ্গানুবাদ ধারাবাহিকভাবে আমরা প্রকাশ করছি। অনুবাদে কোনও ভুলত্রুটি থাকলে তার দায়িত্ব সম্পূর্ণ আমাদের। এবার পঞ্চম পর্ব। – সম্পাদক, গণদাবী

 

কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো অগ্রগতির একটি ফলক

১৮৪৮ সালে লেখা ‘কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো’ রচনার প্রেক্ষাপট সম্পর্কে এবার আমি বলব। সেই সময় মার্কস ও এঙ্গেলস দু’জনেই ‘কমিউনিস্ট লিগ’ সংগঠনটির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এই সংগঠনটি প্রস্তাব করেছিল, বলা ভাল, তাঁদের উপর দায়িত্ব দিয়েছিল ‘কমিউনিস্ট ইস্তাহার’-এর খসড়া রচনার জন্য। এই ‘কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো’র খসড়া তৈরির আগে এঙ্গেলস ‘সাম্যবাদের মূলনীতি’-র একটি খসড়া রচনা করেছিলেন, যা কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো রচনার ভিত্তি হিসাবে কাজ করেছিল।

১৮৮৩ সালে কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো-র জার্মান সংস্করণ প্রকাশনার বছরেই মার্কসের মৃত্যুর কারণে গভীর বেদনা নিয়ে এঙ্গেলস লিখলেনঃ

‘‘বর্তমান সংস্করণের ভূমিকায়, হায় আমাকে একাই সই করতে হচ্ছে। ইউরোপ ও আমেরিকার সমগ্র শ্রমিক শ্রেণি যাঁর কাছে সবচেয়ে বেশি ঋণী, সেই মার্কস হাইগেট সমাধিভূমিতে শায়িত আছেন এবং তাঁর সমাধির উপর ইতিমধ্যেই তৃণরাজি মাথা তুলেছে। তাঁর মৃত্যুর পর ইস্তেহারে সংশোধন বা সংযোজন অভাবনীয়। তাই এখানে নিম্নলিখিত কথাগুলি আবার স্পষ্টভাবে বলা আমি প্রয়োজন মনে করি – ইস্তেহারের ভিতরে যে মূলচিন্তা প্রবহমান তা হল এই– ইতিহাসের প্রতিটি যুগে অর্থনৈতিক উৎপাদন এবং তা থেকে আবশ্যিকভাবে গড়ে ওঠে যে সমাজ-সংগঠন তা-ই থাকে সে যুগের রাজনৈতিক ও বৌদ্ধিক ইতিহাসের মূলে; তার পরিণামে সমগ্র ইতিহাস (আদিম সমাজ ব্যতীত) হয়ে এসেছে শ্রেণিসংগ্রামের ইতিহাস, সামাজিক বিবর্তনের বিভিন্ন পর্যায়ের শোষক ও শোষিত, অধীনস্থ ও অধিপতি শ্রেণির সংগ্রামের ইতিহাস; কিন্তু এই লড়াই আজ এমন পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে যে শোষিত ও নিপীড়িত শ্রেণি নিজেকে শোষক ও নিপীড়ক শ্রেণির কবল থেকে উদ্ধার করতে গেলে একইসঙ্গে গোটা সমাজকে শোষণ, নিপীড়ন ও শ্রেণিসংগ্রাম থেকে চিরদিনের জন্য মুক্তি না দিয়ে পারে না – এই মূল চিন্তাটি সম্পূর্ণরূপে একান্তই মার্কসের।”

মার্কস সম্পর্কে ১৮৮১ সালে বার্নস্টাইনকে এক চিঠিতে এঙ্গেলস লিখেছেন যে, ‘‘তত্ত্বগত ও বাস্তব প্রয়োগে অবদানের দ্বারা মার্কস নিজে এমন স্থান অর্জন করেছেন যে সারা বিশ্বের শ্রমিক শ্রেণির আন্দোলনের সেরা মানুষরা তাঁর প্রতি পূর্ণ আস্থা রাখেন। কঠিন সময়ে তারা তাঁর পরামর্শের মুখাপেক্ষী হন, তারপর স্বাভাবিকভাবেই সেরা পরামর্শ পান, … ফলে, বিষয়টা এমন নয় যে মার্কস জনগণের উপর তাঁর মতামত এবং তাঁর ইচ্ছা চাপিয়ে দেন। এটার উপরই নির্ভর করে রয়েছে আন্দোলনের ক্ষেত্রে মার্কসের অদ্ভূত প্রভাব, যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।”

এঙ্গেলস সম্পর্কে পল লাফার্জ

এঙ্গেলস-এর মৃত্যুর পর মার্কসের জামাতা পল লাফার্জের কিছু কথা এখন আমি উদ্ধৃত করব। তিনি লিখেছেন– ‘‘এঙ্গেলসের সঙ্গে আমার পরিচয় হয় ১৮৬৭ সালে– যে বছর মার্কসের ‘পুঁজি’ গ্রন্থের প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হয়েছিল। মার্কস আমাকে বললেন, ‘তুমি তো আমার মেয়ের ভাবী স্বামী, তোমাকে এঙ্গেলসের সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিতেই হবে’। … মার্কসের কথা উল্লেখ না করে এঙ্গেলসের সম্পর্কে কিছু বলা সম্ভব নয়। তাঁদের দু’জনের জীবন-সূত্র এমন ঘনিষ্ঠ ভাবে গাঁথা ছিল, যেন তা একটাই জীবন।” (সোস্যাল ডেমোক্র্যাট, খণ্ড-৯, সংখ্যা-৮, ১৫ আগস্ট ১৯০৫)

এঙ্গেলস, যিনি ইংল্যান্ডে থেকে রাজনৈতিক অর্থশাস্ত্রের তত্ত্ব, শ্রমিকদের অবস্থা, শিল্পের বিকাশ, চার্টিস্টদের আন্দোলন অনুশীলন ও পর্যবেক্ষণ করতেন, মার্কসের মনের উপর গভীর প্রভাব ফেলেছিলেন, এর আগে পর্যন্ত মার্কস প্রধানত আগ্রহী ছিলেন দর্শন, ইতিহাস, আইন এবং অংকশাস্ত্রে। এঙ্গেলসই প্রথম তাঁকে রাজনৈতিক অর্থশাস্ত্রে মনোযোগ দিতে পরামর্শ দেন। শীঘ্রই মার্কসের কাছে এটা পরিষ্কার হয়ে গেল যে অর্থনীতির অনুশীলনের মধ্যেই সমাজের এবং ধ্যান-ধারণার ইতিহাসের চাবিকাঠির সন্ধান পাওয়া যাবে। এঙ্গেলস আমাকে বলেছিলেন যে, ১৮৪৮ সালে প্যারিসে তাঁর কাছে মার্কস প্রথম ইতিহাসের বস্তুবাদী ধারণার তত্ত্বটির রূপরেখা তুলে ধরেন।

এঙ্গেলস ও মার্কস একত্রে কাজ করার অভ্যাস গড়ে তুলেছিলেন। হাতে প্রয়োজনীয় তথ্য ইত্যাদি না থাকলে মার্কস কাজ শুরু করতে পছন্দ করতেন না এবং মাঝে মাঝে কাজ শুরু করতে একেবারেই ভরসা পেতেন না। একসঙ্গে কাজ করতে গিয়ে এসব ক্ষেত্রে এঙ্গেলস অনেক সময়ই মার্কসকে উদ্দীপিত করতেন।

এঙ্গেলসের জ্ঞানের ব্যাপ্তি এবং তাঁর মনের বিস্ময়কর প্রখরতা, যার ফলে তিনি বিদ্যুৎগতিতে কোনও কিছু বুঝতে সমর্থ হতেন, তা দেখে বিস্ময় প্রকাশ করতে মার্কসের কখনও শ্রান্তি ছিল না। এঙ্গেলসও সব সময়ই প্রস্তুত থাকতেন মার্কসের বিচার-বিশ্লেষণের ক্ষমতাকে স্বীকৃতি দিতে। যখন তাঁরা একসাথে থাকতেন না, তাঁরা একই বিষয়ে চর্চা করতেন, যাতে একে অপরের গবেষণার ফলাফল নিয়ে মতের আদান-প্রদান করতে পারেন। তাঁরা একে অপরের সম্পর্কে উচ্চ ধারণা পোষণ করতেন … উভয়েই সব সময় চিন্তা করতেন কী করে একে অপরকে সহযোগিতা করা যায়, এবং দু’জনেই একে অপরকে নিয়ে গর্বিত ছিলেন। … মার্কসের মৃত্যুর পর এঙ্গেলসের কর্তব্য হয়ে দাঁড়াল মার্কসের অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপিগুলি ভালভাবে পড়ে ছাপার উপযোগী করে তৈরি করা। ‘পুঁজি’র শেষ দুটি খণ্ড প্রস্তুত করার জন্য নিজেকে নিয়োজিত করতে এঙ্গেলস জ্ঞানজগতের সর্বজনীন দর্শন সম্পর্কিত তাঁর কাজ, যার় জন্য তিনি দশ বছরেরও বেশি সময় ব্যয় করেছিলেন এবং বিজ্ঞানের সমস্ত শাখার সর্বশেষ অগ্রগতির বিষয়ে পুঙক্ষানুপুঙক্ষ পর্যবেক্ষণ করেছিলেন, তা একদিকে সরিয়ে রাখেন।”

মার্কসের বিকাশে এঙ্গেলসের অবদান

আমি এখন বলতে চাই যে, মার্কসের বিকশিত হওয়ার সংগ্রামে এঙ্গেলসেরও অবদান ছিল। সমস্ত সত্তাই বিকাশ লাভ করে দ্বন্দ্বমূলক প্রক্রিয়ার দ্বারা। মার্কস ও এঙ্গেলসের মধ্যেকার আবেগময় বন্ধন দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়ার ভিত্তিতে গড়ে উঠেছিল। একথা ঠিকই যে মার্কস ছিলেন এঙ্গেলসের অগ্রগামী– যেটা এঙ্গেলস নিজেই বলেছেন। মার্কসের নেতৃত্বকারী ভূমিকা ও সাহায্য ছাড়া এঙ্গেলস বিকশিত হতেন না। আবার মার্কসের অগ্রগতিতেও এঙ্গেলস যথেষ্ট পরিমাণে অবদান রেখেছিলেন, যে কথা বলে গেছেন লেনিন, যিনি এঙ্গেলসকে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রবাদ প্রতিষ্ঠায় মার্কসের সহকর্মী বা সহ-প্রতিষ্ঠাতা বলেছেন। ফলে, মার্কস সম্পর্কে বলতে গিয়ে এঙ্গেলস যদিও বলেছিলেন– ‘আমি সব সময়েই ছিলাম দ্বিতীয় বেহালাবাদক’– কথাটিকে পুরোপুরি গ্রহণ করা যায় না। বিশেষ করে বিজ্ঞানের কিছু বিষয়ে দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়া প্রয়োগে তাঁর নিজস্ব অবদান ছাড়াও বিভিন্ন বিষয়ে মার্কসের দৃষ্টিভঙ্গি ব্যাখ্যা ও বিকশিত করার ক্ষেত্রেও দেখা যাবে এঙ্গেলসের অসাধারণ সৃজনশীলতা, যেগুলি মার্কসবাদের জ্ঞানভাণ্ডারে অমূল্য সম্পদ হয়ে আছে।

এখন আমি আপনাদের জানানোর জন্য বইয়ের একটি তালিকা পড়ে শোনাব– যা তাঁরা যৌথভাবে এবং এঙ্গেলস এককভাবে লিখেছিলেন।

১৮৪৫  ইংল্যাণ্ডে শ্রমিকশ্রেণির অবস্থা, লিখেছেন এঙ্গেলস

১৮৪৬ জার্মান ইডিওলজি, মার্কস-এঙ্গেলসের যৌথ রচনা

১৮৪৭ সাম্যবাদের মূলনীতি, এঙ্গেলস লিখিত

১৮৪৭-১৮৪৮ কমিউনিস্ট পার্টির ইস্তেহার, মার্কস-এঙ্গেলসের লেখা

১৮৫১-১৮৫৩ জার্মানিতে বিপ্লব এবং প্রতিবিপ্লব, এঙ্গেলসের লেখা

১৮৫৯ কার্ল মার্কস রাজনৈতিক অর্থশাস্তে্রর সমালোচনায় অবদান – এঙ্গেলস

১৮৭৪ ফ্রান্স ও জার্মানির কৃষক সমস্যা, এঙ্গেলস

১৮৭৫ রাশিয়ায় সামাজিক সম্পর্ক, এঙ্গেলস

১৮৭৫-১৮৭৬ প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতার ভূমিকা, এঙ্গেলস

১৮৭৬ বানর থেকে মানুষে বিবর্তনে শ্রমের ভূমিকা, এঙ্গেলস

১৮৭৭ সমাজতন্ত্র কাল্পনিক ও বৈজ্ঞানিক, এঙ্গেলস

১৮৭৭ কার্ল মার্কস, এঙ্গেলস

১৮৭৮ অ্যান্টি-ড্যুরিং, এঙ্গেলস

১৮৮৪ পরিবার, ব্যক্তিগত মালিকানা ও রাষ্টে্রর উৎপত্তি, এঙ্গেলস

১৮৮৫ কমিউনিস্ট লীগের ইতিহাস, এঙ্গেলস

১৮৮৬ ল্যুডভিগ ফুয়েরবাক ও চিরায়ত জার্মান দর্শনের অবসান, এঙ্গেলস

১৮৭৩-৮৬ প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতা, এঙ্গেলস

১৮৭৮ অ্যান্টি-ড্যুরিং এর পুরাতন ভূমিকা, এঙ্গেলস

আমি নিশ্চিত নই এই তালিকা সম্পূর্ণ কিনা। শুধুমাত্র মার্কস ও মার্কসবাদকে জনপ্রিয় করা এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে শ্রমিক শ্রেণির আন্দোলন শক্তিশালী করার উদ্দেশ্য নিয়েই এঙ্গেলস ভাল সংখ্যায় বই লিখেছিলেন । এখন আমি তাঁর বইগুলির কিছু কিছু অংশ পড়ে শোনাব। আমার এই উদ্ধৃতি-নির্বাচন হয়ত আপনাদের সকলকে সন্তুষ্ট নাও করতে পারে।

ল্যুডভিগ ফুয়েরবাক ও চিরায়ত জার্মান দর্শনের অবসান

১৮৮৮ সালে লিখিত ‘ল্যুডভিগ ফুয়েরবাক ও চিরায়ত জার্মান দর্শনের অবসান’ গ্রন্থে এঙ্গেলসের় অমূল্য অবদানের প্রেক্ষাপট সম্পর্কে আমি বলব। এই বইয়ের ভূমিকায় এঙ্গেলস তাঁর উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য স্থির করে লিখেছেন, ‘‘হেগেলীয় দর্শনের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক, কীভাবে আমরা এই দর্শন থেকেই যাত্রা শুরু করেছি এবং কী করে তার সাথে ছেদ ঘটিয়েছি, সে সম্পর্কে একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণীর প্রয়োজনীয়তা আমি ক্রমশই বেশি করে অনুভব করছিলাম।” (মার্কস এঙ্গেলসঃ ভল্যুম ২, ফরেন ল্যাঙ্গুয়েজ পাবলিশিং হাউস, মস্কো, ১৯৪৯)

‘‘… হেগেলীয় দর্শন ও আমাদের চিন্তাধারার মধ্যে নানা দিক থেকেই ফুয়েরবাক অন্তর্বর্তী যোগসূত্র হলেও তাঁর কাছে আমরা কখনও ফিরিনি।” (মার্কস এঙ্গেলসঃ ফরেন ল্যাঙ্গুয়েজ পাবলিশিং হাউস, মস্কো, ১৯৪৯)

১৮৪৫ সালেই মার্কস এবং এঙ্গেলস মিলিতভাবে এই বিষয় নিয়ে একটা বই লেখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তাঁরা এর একটা পাণ্ডুলিপিও তৈরি করেন, যেটা সেই সময় প্রকাশ করা যায়নি। তেতাল্লিশ বছর পরে তিনি অনেক সমৃদ্ধ জ্ঞানের ভিত্তিতে হেগেল ও ফুয়েরবাকের দৃষ্টিভঙ্গি ব্যাখ্যা করে তাঁদের সাথে মার্কসবাদী দর্শনের পার্থক্য নিরূপণ করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন, নৈতিকতা সম্পর্কে ফুয়েরবাকের ধারণা মানবতাবাদ ছাড়া অন্য কিছু নয়, যা বুর্জোয়া শ্রেণির স্বার্থকেই রক্ষা করে।

এখানে ভাববাদ ও বস্তুবাদের মৌলিক পার্থক্য দেখাতে গিয়ে তিনি বললেন, ‘‘চিন্তার সঙ্গে সত্তার সম্পর্কের প্রশ্নটি, ভাবের সাথে প্রকৃতির সম্পর্কটিই হল সমস্ত দর্শনের সর্বপ্রধান প্রশ্ন।” (ঐ)

‘‘এই প্রশ্নের যে যেমন উত্তর দিয়েছেন সেই অনুসারে দার্শনিকেরা দু’টি বৃহৎ শিবিরে বিভক্ত হয়েছেন। যাঁরা প্রকৃতির তুলনায় ভাবকে প্রাধান্য দিয়েছেন এবং শেষ পর্যন্ত কোনও না কোনওভাবে জগৎ সৃষ্টির কথা কল্পনা করে নিয়েছেন … তাঁরা গঠন করেছেন ভাববাদী শিবির। অন্যেরা যাঁরা প্রকৃতিকে প্রধান মনে করেছেন, তাঁরা বিভিন্ন বস্তুবাদী গোষ্ঠীতে অবস্থান করেন।” (ঐ)

এর পর তিনি হেগেলের দৃষ্টিভঙ্গি ব্যাখ্যা করে বলেছেন, ‘‘হেগেলের মতে, দ্বন্দ্বতত্ত্ব হল ধারণার আত্মবিকাশ। পরম ধারণা শুধু যে অনন্তকাল ধরে অজ্ঞাত কোথাও অবস্থান করে তাই নয়, এটা বিদ্যমান বিশ্বের প্রকৃত জীবন্ত-আত্মাও। … তারপর প্রকৃতি রূপে পরিবর্তিত হয়ে সেই ধারণা নিজেকে বিচ্ছিন্ন (অ্যালিয়েন্ট) করে নেয়, সেখানে প্রাকৃতিক আবশ্যিকতার মোড়কে তার এক নব-বিকাশ শুরু হয় আত্ম-চেতনাহীন ভাবে নয়, এবং শেষ পর্যন্ত পুনরায় তা মানুষের মধ্যে আত্মচেতনা হিসাবে ফিরে আসে। তারপর হেগেলীয় দর্শন অনুযায়ী ইতিহাসে সেই আত্মচেতনা স্থূলরূপ থেকে আবার নিজেকে বিকশিত করে সেই পরম ধারণায় সম্পূর্ণরূপে নিজেতে প্রত্যাবর্তন করে। (ঐ)

‘‘বস্তুবাদ অনুসারে প্রকৃতিই যেখানে একমাত্র সত্য, হেগেলীয় তন্ত্র অনুসারে সেখানে প্রকৃতি আসলে পরম ভাবসত্তার ‘অন্যীভবন’ (অ্যালিয়েনেশন) মাত্র, অন্য কথায় ভাবসত্তার অধঃপতনবিশেষ। সবকিছুর পরিণামে চিন্তা ও তার ফল অর্থাৎ ভাবসত্তাই হল আদি, প্রকৃতি হল তার থেকে উৎপন্ন বস্তু, তার অস্তিত্ব রয়েছে কেবল ভাবসত্তার অনুমতি সাপেক্ষে।” (ঐ) ‘‘…তাঁর মতে, ভাবসত্তার শুধু ‘অন্যীভবন’ হিসাবে প্রকৃতির কোনও কালগত বিকাশ সম্ভব নয়, তার শুধুমাত্র স্থানগত বৈচিত্র্য বহুগুণ প্রসারিত হতে পারে, যাতে তার মধ্যে বিকাশের সমস্ত স্তর একই সময়ে এবং পাশাপাশি প্রদর্শিত করে, একই প্রক্রিয়ার অনন্তবার পুনরাবৃত্তি করতে বাধ্য।” (ঐ)

এঙ্গেলস দেখালেন, ফুয়েরবাক কীভাবে হেগেলের সাথে ছেদ ঘটিয়ে বস্তুবাদী হিসাবে শুরু করলেন, কিন্তু ভাববাদী ঐতিহ্যের বেড়িতে আটকে গেলেন, ‘‘ভাব থেকে বস্তু সৃষ্টি হয়নি, বরং ভাব হল বস্তুর সর্বোচ্চ সৃষ্টি। নিঃসন্দেহে এ কথা হল বিশুদ্ধ বস্তুবাদ। কিন্তু এই পর্যন্ত অগ্রসর হয়েই ফুয়েরবাক হঠৎ থেমে যান। তিনি প্রচলিত দার্শনিক সংস্কার অতিক্রম করতে পারেননি, যদিও সে সংস্কার বিষয়টার বিরুদ্ধে নয়, বস্তুবাদ নামটির বিরুদ্ধে। তিনি বলেন, ‘আমার কাছে বস্তুবাদ হল মানবিক সত্তা ও জ্ঞানের ইমারতের ভিত্তি। কিন্তু শারীরবৃত্তবিদের, সংকীর্ণ অর্থে প্রকৃতিবিজ্ঞানীর কাছে, যেমন মলেৎশ-এর কাছে বস্তুবাদ যা, আমার কাছে তা নয়। তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ও পেশার দিক থেকে ওইটিই তার ইমারত। বস্তুবাদীদের সঙ্গে পেছনের দিকে আমি সম্পূর্ণ একমত, কিন্তু সামনের দিকে নয়।’ (ঐ)

‘‘এই ‘ভিত্তি’টি সত্ত্বেও তিনি সাবেকী ভাববাদের বন্ধনে আবদ্ধ রইলেন, যে কথা তিনি এই বলে স্বীকার করেছেন যে, ‘বস্তুবাদীদের সঙ্গে পেছনের দিকে আমি সম্পূর্ণ একমত, কিন্তু সামনের দিকে নয়!’ কিন্তু এক্ষেত্রে ফুয়েরবাক স্বয়ং সামনের দিকে অগ্রসর হননি।” (ঐ)

এরপর ফুয়েরবাকের ধর্মসম্বন্ধীয় দর্শন ও নৈতিকতার মধ্যে ভাববাদ এবং তাঁর দ্বারা বিবৃত পার্থিব মানবতাবাদী নৈতিকতা সব যুগে ও সমস্ত শ্রেণির জন্য প্রযোজ্য– এই ভুল ধারণার স্বরূপ এঙ্গেলস উন্মোচিত করেন।

‘‘ধর্ম ও নীতিশাস্ত্র বিষয়ে ফুয়েরবাকের দর্শন দেখলেই তাঁর আসল ভাববাদটি স্পষ্ট ধরা পড়ে। তিনি কোনও মতেই ধর্মের উচ্ছেদ চান না, তিনি ধর্মকে উন্নত করতে চান। দর্শনকে ধর্মের মধ্যেই বিলীন হতে হবে।” (ঐ)

‘‘নিজেদের ক্ষেত্রে যুক্তিসঙ্গত আত্মসংযম এবং অন্যদের সঙ্গে সংযোগের ক্ষেত্রে ভালবাসা– কেবল ভালবাসা– ফুয়েরবাকের নৈতিকতার এই হল মূল নিয়ম। এ থেকেই অন্য সব কিছু উদ্ভূত হয়েছে।” (ঐ)

‘‘… ফুয়েরবাকের নৈতিকতার তত্ত্ব তাঁর পূর্ববর্তী সকলের মতোই। সব যুগের, সব মানুষের এবং সব অবস্থার জন্য উপযোগী করে এটি তৈরি হয়েছে। এবং ঠিক এই কারণেই তা কোথাও কখনও প্রযোজ্য হতে পারে না।” (ঐ)

এখানে এঙ্গেলস দেখিয়েছেন, কীভাবে মার্কস ফুয়েরবাকের দৃষ্টিভঙ্গিকে নস্যাৎ করেছেন। ‘‘কিন্তু ফুয়েরবাক না করলেও সেই পদক্ষেপ গ্রহণ করতেই হল। ফুয়েরবাকের নবধর্মের যে নির্যাস বিমূর্ত মানবপূজার কথা বলেছিল, তার পরিবর্তে এল বাস্তব মানুষেরা এবং তাদের ঐতিহাসিক বিকাশের বিজ্ঞান। ফুয়েরবাককে ছাড়িয়ে ফুয়েরবাকের দৃষ্টিভঙ্গির পরবর্তী বিকাশের সূত্রপাত করেছিলেন মার্কস ১৮৪৫ সালে তাঁর ‘পবিত্র পরিবার’ গ্রন্থে।” (ঐ)

মার্কসের একটি পুরানো ডায়েরিতে ফুয়েরবাক সম্পর্কে এগারোটা থিসিসের পয়েন্ট পেয়ে এঙ্গেলস প্রশংসা করে মন্তব্য করেছিলেন যে, ‘‘এগুলোতে নিহিত রয়েছে প্রজ্ঞাদীপ্ত নতুন বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গির বীজ।” তাঁর বইয়ের পরিশিষ্টে এগুলো ছাপা হয়েছিল। আমি মার্কসের সেই ঐতিহাসিক থিসিসের কয়েকটা পয়েন্ট এখানে উল্লেখ করতে চাই।

১)     ফুয়েরবাক শুরু করেন ধর্মমূলক আত্ম-অন্যীভবন, একটা ধর্মীয় কল্পিত জগৎ ও বাস্তব জগৎ, বিশ্বকে এইভাবে প্রতিলিপিকরণের ঘটনাটি থেকে। ধর্মীয় জগৎকে তার ইহলৌকিক ভিত্তিতে পর্যবসিত করাই হল তাঁর কাজ। তিনি এইটি উপেক্ষা করেন যে, উক্ত কার্য সমাধার পর প্রধানতম কাজটিই বাকি থেকে যায়। কেন না, ইহলৌকিক ভিত্তিটি যে নিজের কাছ থেকে নিজে বিচ্ছিন্ন হয়ে এক স্বাধীন এলাকা হিসাবে মেঘলোকে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করে, এই ঘটনার একমাত্র প্রকৃত ব্যাখ্যা হল এই ইহলৌকিক ভিত্তিটারই স্ববিভাগ এবং স্ববিরোধিতা। অতএব শেষোক্তটাকে প্রথমে তার স্ববিরোধের দিক থেকে বুঝতে হবে, তারপর এই বিরোধ দূর করে ব্যবহারিক ক্ষেত্রে তার বৈপ্লবিক পরিবর্তন করতে হবে। ফলে যেমন ধরা যাক, পবিত্র পরিবারের রহস্য পার্থিব পরিবারে আবিষ্কৃত হবার পর, পার্থিব পরিবারটিকেই তত্ত্বগতভাবে সমালোচনা করা এবং ব্যবহারিক বৈপ্লবিকভাবে পরিবর্তিত করা প্রয়োজন।” (কার্ল মার্কস, ফুয়েরবাক সম্বন্ধে থিসিস সমূহ, মার্কস এঙ্গেলস নির্বাচিত রচনাবলী, খণ্ড ২, ফরেন ল্যাঙ্গুয়েজ পাবলিশিং হাউস, মস্কো, ১৯৪৯)

২)     ধর্মীয় সারার্থকে ফুয়েরবাক মানবীয় সারার্থে পর্যবসিত করেন। কিন্তু মানবীয় সারার্থ এমন একটা বিমূর্ত কিছু নয় যা প্রতিটি ব্যক্তি মানুষের মধ্যে নিহিত। বাস্তবপক্ষে তা হল সামাজিক সম্পর্কসমূহের যোগফল।

এই আসল সারার্থের সমালোচনায় প্রবৃত্ত হননি বলেই ফুয়েরবাক বাধ্য হন,

(ক)   ঐতিহাসিক বিকাশ থেকে বিচ্ছিন্ন হতে ও ধর্মীয় অনুভূতিকে আলাদা কিছু একটা জিনিস হিসাবে স্থিরবদ্ধ করে তুলতে এবং একটা বিমূর্ত– বিচ্ছিন্ন– ব্যক্তিমানুষকে ধরে নিতে।

(খ)    তাই মানবিক সারার্থকে তাঁর পক্ষে কেবল বংশসত্তা হিসাবে, একটি আভ্যন্তরিক মূক সাধারণ গুণ হিসাবে গ্রহণ করাই সম্ভব যা দিয়ে বহু ব্যক্তিমানুষকে মেলানো যায় কেবল প্রাকৃতিক বন্ধনে।

৩)    তাই ফুয়েরবাক দেখতে পান না যে, ‘ধর্মীয় অনুভূতি’ নিজেই হল একটা সামাজিক সৃষ্টি এবং যে বিমূর্ত ব্যক্তিটির বিশ্লেষণ তিনি করেন সেও প্রকৃতপক্ষে কোনও একটা নির্দিষ্ট সমাজরূপের অন্তর্ভুক্ত।

৪)     মননসর্বস্ব বস্তুবাদের অর্থাৎ যে বস্তুবাদ সংবেদ্যতাকে ব্যবহারিক কর্ম হিসাবে বোঝে না, তার অর্জিত চরম বিন্দুটি হল ‘নাগরিক সমাজের’ অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তিবিশেষকে নিয়ে ধ্যান।

৫)    পুরনো বস্তুবাদের দৃষ্টিকোণ হল ‘নাগরিক’ সমাজ। নতুন বস্তুবাদের দৃষ্টিকোণ হল মানবিক সমাজ বা সমাজীকৃত মানবজাতি।

৬)    দার্শনিকেরা কেবল জগৎকে নানা ভাবে ব্যাখ্যা করেছেন, কিন্তু আসল কথা হল তাকে পরিবর্তন করা।

ড্যুরিং-এর থিসিসের বিরুদ্ধে

ইউজেন ড্যুরিং, দর্শনগত দিক থেকে যিনি ভাববাদী, মার্কসবাদের বিরুদ্ধতা করতে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে দর্শন, রাজনৈতিক অর্থনীতি ও সমাজতন্ত্রবাদে আমূল বিপ্লব আনার দাবি নিয়ে আবির্ভূত হলেন এবং এঙ্গেলস বাধ্য হলেন ১৮৯৪ সালে অ্যান্টি-ড্যুরিং গ্রন্থ প্রকাশ করে তার স্বরূপ উদঘাটন করতে। এই বই থেকে কিছু উদ্ধৃতি আমি শোনাচ্ছি। ‘‘…অতএব মানুষ একটি স্ববিরোধিতার মুখোমুখি দাঁড়াচ্ছে; একদিকে তাকে সমস্ত আন্তঃসম্পর্কগুলি সমেত জাগতিক পদ্ধতিটি সম্পর্কে পরিপূর্ণ জ্ঞান আহরণ করতে হচ্ছে এবং অন্যদিকে মানুষ ও জাগতিক পদ্ধতি –উভয়েরই অন্তর্নিহিত চরিত্রের জন্য সম্পূর্ণভাবে এই কর্তব্য সম্পাদন করা তার পক্ষে কখনোই সম্ভব হয়ে উঠবে না। কিন্তু এই স্ববিরোধিতা পৃথিবী ও মানুষ – শুধুমাত্র এই দুইয়ের অন্তর্নিহিত চরিত্রের মধ্যেই লুকিয়ে নেই– বরং সমস্ত বৌদ্ধিক অগ্রগতির পেছনে এটাই প্রধান চালিকাশক্তিও বটে। এবং এই স্ববিরোধিতা মানব ইতিহাসের অন্তহীন প্রগতিশীল বিকাশের মধ্য দিয়ে প্রতিদিন নিরন্তর তার সমাধান খুঁজে পাচ্ছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ, একটি অসীম শ্রেণি এবং ধারাবাহিক ভগ্নাংশগুলির মধ্যেই গাণিতিক সমস্যাগুলি তাদের সমাধান খুঁজে পাচ্ছে। বাস্তবিকপক্ষে, জাগতিক পদ্ধতির প্রতিটি ভাবগত প্রতিচ্ছবিকে বস্তুগতভাবে ঐতিহাসিক পরিস্থিতি এবং মনোগতভাবে স্রষ্টার শারীরিক ও মানসিক গঠন সীমাবদ্ধ করে দেয় এবং করে রাখে।”

মানুষের প্রয়োজন থেকে অঙ্কশাস্ত্রের উৎপত্তি এবং বাস্তব জগতের সাথে তার সম্পর্ক প্রসঙ্গে তিনি বলেন– ‘‘বিশুদ্ধ গণিত বস্তুর স্থান-সংক্রান্ত এবং বাস্তব জগতের পরিমাণগত সম্পর্কগুলি নিয়েই কাজ করে– অর্থাৎ এমন উপকরণ নিয়ে কাজ করে যা একেবারেই বাস্তব। এই উপকরণ যে চূড়ান্ত বিমূর্ত রূপে প্রতিভাত হয়– এই ঘটনা এর উৎপত্তিকে বহির্জগত থেকে কেবলমাত্র আপাতভাবে আড়াল করতে পারে।”

‘‘বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখার মতো গণিতেরও জন্ম হয়েছিল মানুষের প্রয়োজন থেকেই– জমির মাপ, পাত্রের ধারণ-ক্ষমতার পরিমাণ, সময় গণনা এবং বলবিদ্যা থেকে।”

‘‘কালের অন্তহীনতা, দেশ (স্থান)-এর অসীমতা– শুরু থেকে এবং শব্দগুলির সরল অর্থে এই কথাই বোঝায় যে, কোনও বিশেষ দিকে– সামনে কিংবা পিছনে, উপরে কিংবা নিচে, ডানদিকে কিংবা বামদিকে– কোথাও কোনও অন্ত নেই।”

পদার্থের গতি সংক্রান্ত বিষয়ে এঙ্গেলস লিখেছেন, ‘‘গতি হচ্ছে বস্তুর অস্তিত্বের শর্ত। কখনও কোথাও গতিকে বাদ দিয়ে বস্তুর অস্তিত্ব ছিল না এবং থাকা সম্ভবও নয়।”

‘‘বস্তু ছাড়া গতির মতোই গতি ছাড়া বস্তুও অকল্পনীয়। অতএব বস্তুর মতোই গতিও সৃষ্টি করা যায় না এবং ধবংস করা যায় না।”

সমাজের শ্রেণি বিভাজন এবং নৈতিকতা ও মূল্যবোধের উপর তার প্রভাব প্রসঙ্গে তিনি বলেছেনঃ ‘‘… যেহেতু এতদিন পর্যন্ত সমাজ শ্রেণিবিরোধের পথ ধরেই অগ্রসর হয়েছে, ঠিক সেই কারণেই নৈতিকতা সব সময়েই শ্রেণি-নৈতিকতা হিসাবেই বিদ্যমান থেকেছে। হয় তা শাসক শ্রেণির আধিপত্য ও স্বার্থের যৌক্তিকতা তুলে ধরেছে, না হয়, যখনই শোষিত শ্রেণি যথেষ্ট শক্তিশালী হয়ে উঠেছে, তখনই তা শাসক শ্রেণির আধিপত্যের বিরুদ্ধে শাসিত শ্রেণির বিদ্রোহ ও ভবিষ্যতের স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করেছে। এ বিষয়ে সন্দেহের কোনও কারণ নেই, মানবিক জ্ঞানের অন্যান্য সমস্ত শাখার তো নৈতিকতার ক্ষেত্রেও সামগ্রিকভাবে কিছুটা অগ্রগতি হয়েছে। কিন্তু আমরা এখনও শ্রেণি-নৈতিকতার গণ্ডি অতিক্রম করতে পারিনি। শ্রেণি-বিরোধগুলির ঊর্ধ্বে অবস্থিত ও এই বিরোধগুলি সম্পর্কে সম্পূর্ণ বিস্মৃত একটি প্রকৃত মানবিক নৈতিকতা একমাত্র সেই সমাজেই গড়ে ওঠা সম্ভব, যে-সমাজে শুধুমাত্র শ্রেণি-বিরোধগুলির অবসান ঘটেনি, সমাজের ব্যবহারিক জীবনেও এইসব বিরোধের স্মৃতি সম্পূর্ণভাবে মুছে গিয়েছে।”

সমাজতন্ত্রঃ কাল্পনিক ও বৈজ্ঞানিক

১৮৯২ সালের ‘ইংরাজি সংস্করণের বিশেষ মুখবন্ধ’-এ এঙ্গেলস এই বইটি রচনার পরিপ্রেক্ষিত এবং কেন তিনি বইটি লিখতে বাধ্য হয়েছিলেন তা তুলে ধরেন। এই বইতে তিনি যেমন সেন্ট সাইমন, ফুরিয়ের এবং রবার্ট ওয়েনের মতো প্রখ্যাত ‘কাল্পনিক সমাজতন্ত্রী’দের প্রতি শ্রদ্ধা ব্যক্ত করেছেন, তেমনি তাদের ধারণার বিরোধিতা করেছেন এবং প্রমাণ করেছেন যে, ইতিহাসের বস্তুবাদী ধারণা থেকে মার্কস-প্রসূত বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রবাদই সমাজতান্ত্রিক সমাজে পৌঁছানোর একমাত্র পথ, যেখানে মানুষের দ্বারা মানুষের শোষণের অবসান ঘটবে। এখানে তিনি প্রমাণ করলেন, কেন কাল্পনিক সমাজতন্ত্রের ধারণাগুলি ভ্রান্ত এবং বিজ্ঞানসম্মত ধারণাগুলি সঠিক। এঙ্গেলসের এই রচনার কিছু কিছু অংশ আমি তুলে ধরছি। ‘‘পূর্বের সমাজতন্ত্রের ধারণা অবশ্যই উৎপাদনের প্রচলিত পুঁজিবাদী পদ্ধতি ও তার পরিণাম সম্পর্কে সমালোচনা করেছে। কিন্তু তার ব্যাখ্যা জানা ছিল না, এবং সেইজন্য এর উপর প্রাধান্য লাভ করা ছিল তার অসাধ্য। সম্ভব ছিল শুধু মন্দ বলে এগুলিকে বর্জন করা। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় যা অনিবার্য, শ্রমিক শ্রেণির উপর সেই শোষণকে এই পূর্বতন সমাজতন্ত্র যতই সজোরে ধিক্কার দিতে থাকল ততই এ কথা পরিষ্কার করে বোঝাতে সে অক্ষম হয়ে উঠল, কী সেই শোষণ, কীভাবে তার উদ্ভব হল। সে জন্য দরকার ছিল, (১) পুঁজিবাদী উৎপাদন-পদ্ধতিকে তার ঐতিহাসিক সম্পর্ক এবং একটা বিশেষ ঐতিহাসিক যুগে তার অনিবার্যতার মধ্যে দেখানো এবং সেই হেতু তার অনিবার্য পতনের কথাও উপস্থিত করা, এবং (২) তার মূল চরিত্র উদঘাটন করা, যা তখনও ছিল অজ্ঞাত। এই কাজ সম্পন্ন হল উদ্বৃত্ত মূল্যের আবিষ্কারে।” (মার্কস এঙ্গেলস রচনাবলি, দ্বিতীয় খণ্ড)

‘‘ইতিহাসের বস্তুবাদী ধারণার শুরু এই প্রস্তাব থেকে যে, মানুষের জীবনের ভরণপোষণের উপায়ের উৎপাদন এবং উৎপাদনের পর উৎপাদিত বস্তুর বিনিময়– এই হল সমস্ত সমাজ কাঠামোর ভিত্তি। … সমস্ত সামাজিক পরিবর্তন ও রাজনৈতিক বিপ্লবের চূড়ান্ত কারণ মানুষের মস্তিষ্কে নয়, শ্বাশত সত্য ও ন্যায়বিচারের প্রতি মানুষের উন্নত অন্তর্দৃষ্টির মধ্যেও নয়, খুঁজতে হবে উৎপাদন ও বিনিময় পদ্ধতির পরিবর্তনগুলির মধ্যে। ‘দর্শন’-এর মধ্যে নয়, তা খুঁজতে হবে প্রতিটি বিশেষ যুগের ‘অর্থনীতি’র মধ্যে।”

‘‘দ্বান্দ্বিকতার প্রমাণ হল প্রকৃতি, এবং আধুনিক বিজ্ঞানের পক্ষ নিয়ে বলতেই হবে যে, দিন দিন বেড়ে চলা অতি মূল্যবান উপাদান দিয়ে এ প্রমাণ সে দাখিল করে চলেছে এবং দেখিয়েছে যে, শেষ বিচারে প্রকৃতির ক্রিয়া অধিবিদ্যামূলক নয়, দ্বন্দ্বমূলক। নিয়ত পৌনঃপুনিক একটা বৃত্তে চিরকালের জন্য একইভাবে সে ঘোরে না, সত্যকার একটা ঐতিহাসিক বিবর্তনের মধ্য দিয়েই তার যাত্রা। এ প্রসঙ্গে সর্বাগ্রে নাম করতে হয় ডারউইনের। সমস্ত জৈবসত্তা, উদ্ভিদ, প্রাণী এবং স্বয়ং মানুষ কোটি কোটি বছরের এক বিবর্তন প্রক্রিয়ার ফল– এটা প্রমাণ করে প্রকৃতির অধিবিদ্যামূলক ধারণার বিরুদ্ধে তিনি চরম আঘাত হানেন।” (চলবে)

গণদাবী ৭৪ বর্ষ ১০ সংখ্যা ১-৭ অক্টোবর ২০২১