‘মধ্যপ্রাচ্য শান্তি পরিকল্পনা’ — প্যালেস্টিনীয়দের অস্তিত্বকে কার্যত নস্যাৎ করার নয়া কৌশল

ইজরায়েল-প্যালেস্টাইনের দীর্ঘদিনের সমস্যা নিরসনের নাম করে যুদ্ধবাজ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ এক ‘শান্তি পরিকল্পনা’ নিয়ে হাজির হয়েছে। ‘শতাব্দীর চুক্তি’ নাম দিয়ে উগ্র ইহুদিবাদী শাসককুল সহ ইজরায়েলের দক্ষিণপন্থী শক্তিগুলি এই ‘শান্তি পরিকল্পনা’র প্রশংসায় মুখর। তাদের হিসাবে, এই পরিকল্পনা রূপায়িত হলে স্বাধীন প্যালেস্টাইন রাষ্ট্র গড়ে ওঠার সম্ভাবনা নির্মূল করা যাবে। এই কারণে ইজরায়েলের বামপন্থী শক্তি, প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন (পিএলও) এবং যাঁরা দু’টি পৃথক রাষ্ট্র গঠনের মধ্য দিয়ে ইজরায়েল-প্যালেস্টাইন সমস্যার সমাধান হবে বলে মনে করেন, তাঁরা এর বিরুদ্ধতা করছেন। বিষয়টি এমনই যে বুর্জোয়া প্রচারমাধ্যমও বাধ্য হয়ে বলছে– প্যালেস্টাইন সমস্যা সমাধান সম্পর্কে প্যালেস্টাইনের জনসাধারণ ও গোটা বিশ্বের মানুষের যে ভাবনা রয়েছে, এই পরিকল্পনা তা বানচাল করারই ষড়যন্ত্র নয়?

শান্তি পরিকল্পনা

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু-র উপস্থিতিতে এ বছরের ২০ জানুয়ারি তাঁর মধ্যপ্রাচ্য শান্তি পরিকল্পনার রূপরেখাটি তুলে ধরেন। লক্ষ করার বিষয়, এ ব্যাপারে প্যালেস্টিনীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কোনও আলোচনার ধার ধারেননি তাঁরা। এই পরিকল্পনায় প্রাচীন শহরটি সমেত জেরুজালেমকে ইজরায়েলের অবিভক্ত রাজধানী বানাতে চেয়েছেন ট্রাম্প। পাশাপাশি, ১৯৬৭-র পর ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক ও পূর্ব জেরুজালেমে ইজরায়েলিরা যে সমস্ত বেআইনি বসতি তৈরি করেছে, সেগুলিকে ইজরায়েলের অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলা হয়েছে। এর সাথে জর্ডন উপত্যকাকেও ইজরায়েলে সংযোজনের সুপারিশ করা হয়েছে, যাতে জর্ডন নদী বরাবর ইজরায়েলের একটি স্থায়ী পূর্ব সীমান্ত তৈরি করা যায় এবং প্যালেস্টাইন হয়ে পড়ে ইজরায়েলি এলাকা দিয়ে ঘিরে রাখা বিচ্ছিন্ন একটি দ্বীপপুঞ্জ রাষ্ট্র। ট্রাম্পের শান্তি পরিকল্পনায় জেরুজালেমের বাইরে অবস্থিত ‘আবু ডিস’-কে ভবিষ্যতের প্যালেস্টাইন রাষ্টে্রর রাজধানী করার প্রস্তাবও রয়েছে যা প্যালেস্টাইনের জনগণ সেই মুহূর্তেই প্রত্যাখ্যান করেছে (আল-জাজিরা, ১ ফেব্রুয়ারি, ‘২০)। বোঝাই যায়, এই ‘শান্তি পরিকল্পনা’টি পুরোপুরি ইজরায়েলের স্বার্থরক্ষা এবং প্যালেস্টাইনের মানুষের ন্যায্য দাবি নস্যাৎ করার জন্য তৈরি করা হয়েছে।

পরিকল্পনা পেশের সময়কালটিও লক্ষ করার মতো। ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়া, ইয়েমেন, প্যালেস্টাইনের মতো দেশগুলিতে সাম্রাজ্যবাদী লুটপাট চালানোর কারণে গোটা বিশ্বের মতো মধ্যপ্রাচ্যের জনসাধারণের কাছে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ অত্যন্ত ধিক্কৃত। তার উপর, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের অপর লক্ষ্যস্থল ইরান মধ্যপ্রাচ্যে প্রভাব বিস্তারে রণকৌশলগত লড়াইয়ে এগিয়ে রয়েছে বলে অনেকের অভিমত। এই পরিস্থিতিতে ট্রাম্প তাঁর ধূসর ভাবমূর্তি ধুলো ঝেড়ে উজ্জ্বল করার লক্ষে্য ঔদ্ধত্য ও পেশিশক্তির আস্ফালন দেখাতে এই ‘শান্তি পরিকল্পনা’ কায়েম করতে উদ্যোগী হয়েছেন। এর তাৎপর্য বুঝতে হলে ইজরায়েল-প্যালেস্টাইন সমস্যার ইতিহাসে চোখ রাখা জরুরি।

ইজরায়েল-প্যালেস্টাইন সমস্যা

ইজরায়েল-প্যালেস্টাইন সমস্যা বাস্তবে প্যালেস্টিনীয় জনগণের জীবন বলি দিয়ে উগ্র ইহুদিবাদী ইজরায়েলের সম্প্রসারণবাদী কৌশল যার পিছনে রয়েছে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির সর্বাত্মক সমর্থন। ১৯১৭ সালে ব্রিটিশ সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, প্যালেস্টাইনে ইহুদিদের জন্য আশ্রয়স্থল (ন্যাশনাল হোম) প্রতিষ্ঠা করবে, যদিও প্যালেস্টাইনের মোট জনসংখ্যার মধ্যে ইহুদিরা হলেন ৮ শতাংশেরও কম। ৩০ বছর পর রাষ্ট্রসংঘ প্যালেস্টাইনকে ভাগ করার সুপারিশ করে– জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশেরও কম এবং মোট জমির ৭ শতাংশেরও কম অংশের দখলদার ইহুদিদের জন্য বরাদ্দ করে মোট এলাকার বেশিরভাগ অংশ। এর পর প্যালেস্টাইনের বাসিন্দা আরবদের জন্য বরাদ্দ অঞ্চলের অর্ধেকেরও বেশি অংশ দখল করে ইজরায়েল এবং উচ্ছেদ হয়ে পড়া আরব জনগণকে নিজের এলাকায় ফিরে যেতে দেয় না। ১৯৬৭-র যুদ্ধের পর ইজরায়েল প্যালেস্টাইনের অবশিষ্ট জমির ২২ শতাংশ দখল করে নেয়। পাশাপাশি মিশরের কাছ থেকে সিনাই উপদ্বীপ এবং সিরিয়ার কাছ থেকে গোলান হাইটস কেড়ে নেয়। অধিকৃত এলাকায় বেআইনিভাবে বসতি স্থাপন করে ইজরায়েল এবং একই এলাকায় বসবাসকারী ইজরায়েলি ও প্যালেস্টিনীয় আরবদের জন্য আলাদা আইন-কানুন চালু করে শাসন ব্যবস্থার পত্তন করে। ১৯৮০ সালে ইজরায়েল আনুষ্ঠানিকভাবে পূর্ব জেরুজালেমের দখল নেয়। ১৯৯৩ সালে অসলো চুক্তি অনুযায়ী, দ্বীপের মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কিছু এলাকার ওপর প্যালেস্টিনীয়রা সীমিত আকারে স্বশাসনের অধিকার পায়। এই চুক্তিতে ইজরায়েলি বসতিগুলিকে ভেঙে দেওয়ার কথা তো ছিলই না, এমনকি বসতি স্থাপনের প্রক্রিয়া বন্ধ করার কথাও এতে বলা হয়নি। স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে প্যালেস্টাইনকে গড়ে তোলার নামে ২০০০ সালে প্রেসিডেন্ট ক্লিন্টনের আমল থেকে ২০২০ সালে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের আমল পর্যন্ত মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ যা করেছে তা হল– গোটা এলাকার এক-চতুর্থাংশেরও কম অঞ্চলে ভূমিপুত্র আরবদের আটকে ফেলে আরও এলাকা দখলে ইজরায়েলকে সাহায্য করা এবং প্যালেস্টাইনের সামরিক শক্তি হ্রাস করা। এসবই তারা করেছে প্যালেস্টাইনের স্বশাসনের অধিকার বৃদ্ধি করার নাম করে। অবস্থা এখন এমন যে, ইজরায়েলের সেনাবাহিনীও স্বীকার করছে– ইজরায়েলের আয়ত্তাধীন এলাকায় ইহুদিদের চেয়ে বেশি সংখ্যায় বাস করেন প্যালেস্টিনীয়রা।

মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সমর্থনপুষ্ট উগ্র ইহুদিবাদী ইজরায়েলের এই সম্প্রসারণবাদ ও নিপীড়নের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে সাম্রাজ্যবাদীরা ইজরায়েল-প্যালেস্টাইন সমস্যা সমাধানের নামে ‘শান্তি পরিকল্পনা’ বানিয়েছে। পরিকল্পনায় কতকগুলি শর্ত দেওয়া হয়েছে যা পূরণ করতে পারলে তবেই প্যালেস্টাইনকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হবে। যদি শর্ত পূরণ না হয় তাহলে মিলিটারি নামিয়ে এলাকা দখল করে নেওয়ার অধিকার থাকবে ইজরায়েলের। প্যালেস্টাইন শর্ত পূরণ করতে পারল কি না, তা বিচারের দায়িত্বও কিন্তু থাকবে ইজরায়েল আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাতেই। শান্তি পরিকল্পনা আরও নানা সুপারিশ করেছে। যেমন, পুরো এলাকার আকাশপথ ও ‘ইলেক্ট্রো-ম্যাগনেটিক স্পেক্ট্রাম’-এর ওপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থেকে যাবে ইজরায়েলের হাতে। ইজরায়েলি নৌবাহিনীর অধিকারে থাকবে ‘নিষিদ্ধ’ অস্ত্রশস্ত্র ও অস্ত্র তৈরির সামগ্রী প্যালেস্টাইনে ঢোকার পথে আটকে দেওয়ার– যদিও কোন অস্ত্র আটকানো হবে আর কোনটা ছাড় পাবে, তা-ও ঠিক করবে ইজরায়েল। প্যালেস্টাইন অন্য কোনও দেশ বা সংস্থার সাথে কূটনৈতিক বা নিরাপত্তা সংক্রান্ত এমন কোনও চুক্তি করতে পারবে না যা ইজরায়েলের ‘না-পসন্দ’। এছাড়াও, পরিকল্পনায় রয়েছে আল-আকসা মসজিদ সহ ‘টেম্পল-মাউন্ট’কে ইজরায়েলের আওতায় রাখার কথা। প্যালেস্টাইনের চাষবাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে যে জর্ডন নদী ও জর্ডন উপত্যকার, সেই উপত্যকার ওপরেও ইজরায়েলি আধিপত্য কায়েমের কথা রয়েছে।

বিরোধিতায় সোচ্চার নানা দেশ

ট্রাম্পের পরিকল্পনার শর্তগুলি জেনে প্যালেস্টাইনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস ২৯ জানুয়ারি প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছেন, ‘‘জেরুজালেম এবং আমাদের অধিকারগুলি বিক্রি কিংবা দরাদরি করার জিনিস নয়।” ওই দিনই প্যালেস্টাইনের হাজার হাজার মানুষ গাজা ভূখণ্ডে বিক্ষোভ দেখান, প্রতিবাদ দিবস পালন করেন। ‘শান্তি পরিকল্পনা’র প্রতিবাদে প্যালেস্টিনীয় কর্তৃপক্ষ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইজরায়েলের সঙ্গে নিরাপত্তা-সংক্রান্ত বিষয় সহ সমস্ত যোগাযোগ ছিন্ন করার কথা ঘোষণা করেছে। ২২ সদস্য দেশের সংগঠন ‘আরব লীগ’ ‘মধ্যপ্রাচ্য শান্তি পরিকল্পনা’ প্রত্যাখ্যান করেছে। তারা বলেছে, ১৯৬৭-র যুদ্ধের আগেকার সীমানাকে মেনে প্যালেস্টাইন রাষ্ট্র গঠন ও তার রাজধানী হিসাবে পূর্ব জেরুজালেমকে এই পরিকল্পনায় স্বীকৃতি দেওয়া না হলে এই পরিকল্পনা রূপায়ণে ট্রাম্পকে তারা কোনও রকম সাহায্য করবে না। আরব দেশগুলিও ট্রাম্পের পরিকল্পনার প্রতিবাদ জানিয়েছে। ৩ ফেব্রুয়ারি ৫৭ সদস্যের সংগঠন ‘অর্গানাইজেশন অফ ইসলামিক কো-অপারেশন’ প্রত্যাখ্যান করেছে এই পরিকল্পনা। ইউরোপীয় ইউনিয়ন এই পরিকল্পনার কয়েকটি বিষয়ে আপত্তি জানিয়েছে। প্রতিবাদ এসেছে তুরস্ক, কাতার ও জর্ডন থেকেও। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হওয়া সত্ত্বেও সৌদি আরবের মতো দেশও বলেছে, পূর্ব জেরুজালেমকে রাজধানী করে স্বাধীন প্যালেস্টাইন রাষ্ট্র গঠনে বাধা দেয় যেসব ইহুদি বসতি, সেগুলিকে তারা সমর্থন করে না। বাস্তবিকই ট্রাম্পের এই পরিকল্পনা রাষ্ট্রসংঘের ২৪২ নং প্রস্তাবকে সরাসরি অস্বীকার করে, যেখানে ইজরায়েলি বসতিগুলি উঠিয়ে নিয়ে প্যালেস্টিনীয় উদ্বাস্তুদের ফিরিয়ে আনার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

কী করা উচিত

এই পরিস্থিতে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের অধিকার অর্জন করতে হলে প্যালেস্টাইনের মানুষকে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। পূর্ব জেরুজালেমকে রাজধানী করে স্বাধীন প্যালেস্টাইন রাষ্ট্র গড়ে তোলা এবং ১৯৬৭-তে ইজরায়েল কর্তৃক অধিকৃত অঞ্চলগুলি ফিরিয়ে দেওয়ার দাবিতে গোটা বিশ্বের সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী মানুষেরও সোচ্চার হওয়া কর্তব্য। আইন, ন্যায্যতা ও মানবিকতার খাতিরে প্যালেস্টাইনের সংগ্রামী মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে শক্তিশালী ও সংগঠিত গণআন্দোলন গড়ে তোলাই এখন সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের কর্তব্য হওয়া উচিত।

(গণদাবী : ৭২ বর্ষ ২৮ সংখ্যা)