মধুমাখা বুলির আড়ালে আবারও গরিবের সর্বনাশে মেতেছে বিজেপি

দেশে নতুন সরকার গঠিত হওয়ার পরে পরেই সেই সরকার গরিবদের কল্যাণের জন্য কী করবে তার একটা লম্বা ফিরিস্তি দেশের মানুষের সামনে তুলে ধরে৷ বলে, এই সরকার গরিবের জন্যই নিবেদিত প্রাণ৷ তারপর? পরের পাঁচ বছর সরকার কি সেই প্রতিশ্রুতিগুলো মনে রাখে? মানুষের অভিজ্ঞতা কী বলে?

মানুষের বাহাত্তর বছরের অভিজ্ঞতা বলছে, একবার গদি পেয়ে গেলে এসব কোনও কিছুই সরকার আর মনে রাখে না৷ বরং গরিবদের উপরই একের পর এক মূল্যবৃদ্ধির বোঝা, করের বোঝা, নিত্যনতুন ফি আর ফরমানের বোঝা চাপিয়ে চলে৷ এক দিকে গরিব আরও গরিব হয়, ধনী হয় আরও ধনী৷ অন্য দিকে গরিবকেই অপদস্থ হতে হয় প্রতি পদে৷

দ্বিতীয় দফার নরেন্দ্র মোদি সরকার এই চেনা পথেই পা বাড়াল৷ শুরুতেই ঘোষণা করেছে, এবার তাঁরা গরিব কল্যাণে নজর দেবেন৷ চাষিদের ঋণ দেবেন, ঋণের সুদে ছাড় দেবেন, খাদ্য সুরক্ষা প্রকল্পে আরও বেশি মানুষকে খাদ্য দেবেন ইত্যাদি৷ তা হলে কি গত সরকারে গরিবের কল্যাণে তাঁরা এই নজর দেননি? তখন কার কল্যাণে নজর দিয়েছিলেন?

পশ্চিম মেদিনীপুর

সেবারও তো প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেছিলেন সবার বিকাশের কথা, সবার জীবনে আচ্ছে দিন আনার কথা৷ গত পাঁচ বছরে কী বিকাশ হয়েছে দেশের গরিব–সাধারণ মানুষের? কেমন আচ্ছে দিন এসেছে সাধারণ দেশবাসীর? মূল্যবৃদ্ধি রোধ হয়েছে? বেকাররা কাজ পেয়েছে? না, হয়েছে ঠিক এর বিপরীত৷ গত পাঁচ বছর লাগাতার নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বেড়েছে, শিক্ষা–চিকিৎসার ব্যয় আকাশ ছুঁয়েছে৷ প্রধানমন্ত্রীর বছরে ২ কোটি বেকারকে চাকরি দেওয়ার প্রতিশ্রুতিকে মিথ্যা প্রমাণ করে বেকারির হার গত ৪৫ বছরের মধ্যে পৌঁছেছে সর্বোচ্চে৷ ফসলের ন্যায্য দাম পায়নি চাষিরা৷ দেশজুড়ে একের পর এক কৃষক আন্দোলন ফেটে পড়েছে৷ তুলো, আখ, পিঁয়াজ, আলু চাষিদের আত্মহত্যার মিছিল ক্রমাগত লম্বা হয়েছে৷ অর্থাৎ গত পাঁচ বছরে কৃষক–শ্রমিক সহ সাধারণ গরিব মানুষের কোনও কল্যাণই সরকার করেনি৷

পূর্ব বর্ধমান

এবারও নরেন্দ্র মোদি সরকার কেমন জনকল্যাণ করবে, প্রথম থেকেই তা দেশের মানুষ টের পেতে শুরু করেছে৷ সরকার শপথ নেওয়ার কয়েক দিনের মধ্যেই গ্যাসের দাম এক ধাক্কায় পঁচিশ টাকা বাড়িয়ে দিয়েছে৷ বাড়ছে তেলের দাম, দুধের দাম৷ এতে গরিবের কী কল্যাণ হবে? আরও অগাধ মুনাফা বাড়বে আম্বানি সহ বড় বড় তেল কোম্পানির মালিকদের৷ এমনই ‘জনকল্যাণে’ আর কী ঘোষণা করেছে সরকার? ৪২টি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাকে দেশি–বিদেশি পুঁজিপতিদের কাছে ১০০ দিনের মধ্যে বেচে দেবে৷ এই সংস্থাগুলির হাতে বিরাট পরিমাণ জমি রয়েছে তা যাতে বিদেশি কোম্পানিগুলির হাতেও তুলে দেওয়া যায় তার জন্য যে কোনও রকম আইন পরিবর্তনের কথাও ঘোষণা করেছে৷ এর ফল কী হবে? এই ক্ষেত্রগুলিতে কর্মরত বিপুল সংখ্যক শ্রমিক–কর্মচারী কাজ হারাবে৷

এখানেই শেষ নয়, শ্রমিক কল্যাণের আরও এক বড় নিদর্শন রাখতে চলেছে এই সরকার৷ সংসদের আগামী অধিবেশনেই বর্তমান শ্রম আইনের বিলুপ্তি ঘটাতে নতুন বিল পেশ করবে বলে ঘোষণা করেছে সরকার৷ শ্রম ক্ষেত্রে ৪৪টি কেন্দ্রীয় আইনকে উড়িয়ে দিয়ে চারটিতে পরিণত করবে তারা৷ শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি করবার, আন্দোলন করবার, ধর্মঘট করবার অধিকারগুলি, যা বহু লড়াই–আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে তারা অর্জন করেছে, কেড়ে নিতে চলেছে সরকার৷ ইতিমধ্যেই আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে আট ঘণ্ঢার বদলে চোদ্দ ঘন্টা, ষোল ঘন্টায় পর্যন্ত ইচ্ছামতো খাটিয়ে নিচ্ছে মালিকরা৷ অর্থাৎ মালিক শ্রেণি যাতে শ্রমিকদের আরও নিংড়ে নিতে পারে এবং শ্রমিক শ্রেণি তার বিরুদ্ধে কোনও প্রতিরোধ গড়ে তুলতে না পারে তেমন আইনই করতে চলেছে বিজেপি সরকার৷

পূর্ব মেদিনীপুর

জনকল্যাণে এই সরকার যে ব্যর্থ, তা কি শুধু বিরোধীদের অভিযোগ? না, সরকারি পরিসংখ্যানই তা প্রমাণ করছে৷ নরেন্দ্র মোদির নতুন মন্ত্রিসভা যেদিন শপথ নেয় সেদিনই ন্যাশনাল স্যাম্পল সার্ভে অফিস (এনএসএসও)–র এক সমীক্ষা প্রকাশ করেছে কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যান মন্ত্রক৷ তাতেই দেখা যাচ্ছে, নোট বাতিলের পর দেশে বেকারির হার ৬.১ শতাংশে পৌঁছেছে, যা ৪৫ বছরে সর্বোচ্চ৷ সামগ্রিক ভাবে সারা দেশে বেকারত্বের হার গত ছয় বছরে ২.২ শতাংশ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬.১ শতাংশে৷ ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সী যুবকদের মধ্যে বেকারত্বের হার ১৩ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ২৭ শতাংশ৷ নির্বাচনের আগে এই রিপোর্ট চেপে দিতে চেয়েছিল সরকার৷ প্রতিবাদে জাতীয় পরিসংখ্যান কমিশন থেকে পরিসংখ্যানবিদরা পদত্যাগ করেছিলেন৷

আর্থিক যে বৃদ্ধি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী সহ বিজেপি নেতারা গর্বে দেশ মাত করছিলেন সেই বৃদ্ধির হার কী দাঁড়িয়েছে তাঁদের রাজত্বে? কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যান দপ্তর জানিয়েছে, এ বছর জানুয়ারি–মার্চে দেশের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বৃদ্ধির হার কমে দাঁড়িয়েছে ৫.৮ শতাংশ, যা গত পাঁচ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম৷ সামগ্রিক বৃদ্ধির হার দাঁড়িয়েছে ৬.৮ শতাংশে৷ এপ্রিলের হিসেব অনুযায়ী আটটি প্রধান শিল্পে বৃদ্ধি ৪.৯ শতাংশ থেকে কমে হয়েছে ২.৬ শতাংশ৷ সব মিলিয়ে অর্থনীতির বেহাল চিত্রটিই ফুটে উঠেছে৷

কিন্তু এত বড় একটা দেশ, যার জনসংখ্যা বিপুল, তার অর্থনীতির এমন বেহাল দশা কেন? এর অন্যতম কারণ অভ্যন্তরীণ বাজারে চাহিদা কমে যাওয়া৷ চাহিদা কেন কমছে? কারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাচ্ছে৷ দেশের বেশির ভাগ মানুষই ন্যূনতম প্রয়োজনীয় জিনিসটুকু কিনতেই হিমসিম খাচ্ছে, ভোগ্যপণ্য কিছু কেনা তো দূরের কথা৷ গত পাঁচ বছরে বিজেপি সরকার কি মানুষের এই ক্রয়ক্ষমতা স্থায়ী ভাবে বাড়ানোর কোনও চেষ্টা করেছে?

স্থায়ী ভাবে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়াতে গেলে স্থায়ী আয় দরকার৷ তার জন্য দরকার স্থায়ী তথা নিশ্চিত কাজ এবং একটি যুক্তিসঙ্গত পরিমাণে আয়ের ব্যবস্থা করা৷ সেই জায়গাটায় তো মোদি সরকার ডাহা ফেল করেছে৷ স্থায়ী আয়ের পরিবর্তে সরকার কিছু মানুষকে, কাউকে মাসে পাঁচশো টাকা, কাউকে তার থেকেও কম ভাতা, অনুদান, ভর্তুকি ইত্যাদি নাম দিয়ে ভিক্ষের মতো কিছু কিছু ছুঁড়ে দিয়েছে৷ এই দিয়ে কি মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ে? তা যে বাড়ে না, অভ্যন্তরীণ বাজারে ক্রমবর্ধমান মন্দাই তো তার প্রমাণ৷ আগামী পাঁচ বছরও এমন ধারা কল্যাণই তো মোদিজিরা করবেন খেটে খাওয়া মানুষের? অথচ তাঁদের শাসনে ‘কল্যাণ’ কারও হয়নি এমন নয়৷ তাঁদের শাসনের কল্যাণেই এক শতাংশ পুঁজিপতির হাতে দেশের মোট সম্পদের ৭৩ শতাংশ আজ কুক্ষিগত৷ ২০১৭ সালের হিসাবে যা ছিল ৫৮ শতাংশ৷ বিজেপি রাজত্বে অবিশ্বাস্য হারে বেড়েছে পুঁজিপতিদের সম্পদের পরিমাণ৷ ২০১৮ সালে দেশের সবচেয়ে বিত্তবান ১ শতাংশ মানুষের সম্পদ বেড়েছে ৩৯ শতাংশ৷ ২০১৭ সালে দেশের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি মুকেশ আম্বানির সম্পদের পরিমাণ বেড়েছে ৬৭ শতাংশ হারে৷ ঠিক একই রকম অবিশ্বাস্য হারে মানুষ দারিদ্রের অন্ধকারে তলিয়ে গেছে৷ দেশের ৬০ শতাংশ মানুষের হাতে অবশিষ্ট আছে মাত্র ৪.৮ শতাংশ সম্পদ৷ আর পুঁজিপতি–শিল্পপতিদের জন্য এই অবাধ লুঠতরাজের ব্যবস্থা করে দেওয়ার বিনিময়ে সরকারে থাকার, এমএলএ এমপি মন্ত্রী হওয়ার গ্যারান্টি অর্জন করেছে তাদের পলিটিক্যাল ম্যানেজার হিসাবে কাজ করা এই সব বুর্জোয়া দলগুলির নেতারা৷ বিজেপি মন্ত্রীসভায় যে ৫৬ জন মন্ত্রী ‘গরিব কল্যাণের শপথ’ নিলেন, তাঁদের মধ্যে ৫১ জনই কোটিপতি৷ এঁরাই নাকি করবেন গরিব কল্যাণ দেশের দুর্দশাগ্রস্ত অধিকাংশ গরিব নিম্নবিত্ত মধ্যবিত্ত মানুষের সাথে কী কুৎসিত রসিকতাই না করে চলেছে এই সব মিথ্যাচারীর দল

বিজেপি নেতারা বলছেন, নির্বাচনে দেশের মানুষ তাঁদের প্রতি অগাধ আস্থাই তাঁদের বিপুল সংখ্যায় জিতিয়ে এনেছে৷ তাই যদি হয়, তা হলে তো এই দাঁড়ায় যে, বিজেপি রাজত্বে দেশে বৃদ্ধির হার কমছে, বেকার বাড়ছে, মূল্যবৃদ্ধি অবাধে হচ্ছে আর বিজেপির প্রতি সমর্থনও বিপুল গতিতে বাড়ছে? এ কেমন সমর্থন গত নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদিকে দেশের একচেটিয়া পুঁজি পরিচালিত সংবাদমাধ্যম বিপুল প্রচার দিয়ে মানুষের সামনে ‘বিকাশ পুরুষ’ হিসাবে উপস্থিত করে মানুষের মনে একটা আশার সঞ্চার করতে পেরেছিল৷ এবার তো তা–ও ছিল না৷ তা হলে কীসের ভিত্তিতে তাঁরা এই সমর্থন পেলেন৷ যে কোনও মানুষকে প্রশ্ণ করুন, আপনি কি মনে করেন এই সরকারের আমলে আপনার ঘরের বেকার ছেলেমেয়েরা কাজ পাবে? মূল্যবৃদ্ধি রোধ হবে? শিক্ষা–চিকিৎসার ব্যয় কমবে? সকলেরই একই উত্তর যে তাঁরা কেউ আদৌ এমন আশা করেন না৷ মানুষ যদি কোনও সরকারের থেকে জীবনের মূল দাবিগুলোই মেটার আশা না করে তবে সেই সরকারের প্রতি আস্থা প্রকাশ করে কী করে? এ প্রশ্নের উত্তর তো বিজেপি নেতাদেরই দিতে হবে৷

কংগ্রেস নেত্রী ইন্দিরা গান্ধীর ‘গরিবি হঠাও’,  অটল বিহারী বাজপেয়ীর ‘উজ্জ্বল ভারত’ কিংবা নরেন্দ্র মোদির ‘গরিব কল্যাণ’– এই ভাবে যখন যে সরকার এসেছে তারাই এমন সব মধুমাখা গরিব দরদের বুলির আড়ালে পুঁজিপতি–শিল্পপতিদের স্বার্থই রক্ষা করেছে৷ নিত্যনতুন স্লোগান পাল্টে মানুষের সাথে প্রতারণা করেছে৷

(গণদাবী : ৭১ বর্ষ ৪৩ সংখ্যা)