মদ নিষিদ্ধ করায় বিহারে অপরাধ কমেছে, পশ্চিমবঙ্গ সরকার করবে না কেন?

বছর চারেক আগে বিহার সরকার মদ নিষিদ্ধ করার নির্দেশ জারি করেছিল৷ জনমনে এই দাবিটি ছিল বহুদিনের৷ সর্বস্তরের সাধারণ মানুষ, বিশেষত মহিলারা, যাদের স্বামীরা মদে আসক্ত, এই দাবিটি নিয়ে দীর্ঘদিন সরব ছিলেন৷ তাঁদের লাগাতার আন্দোলনের চাপেই বিহার সরকার এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছিল৷

স্বল্প মজুরির শ্রমিক, আয়হীন কৃষক, হতাশায় নিমজ্জিত বেকার যুবকেরা অনেকেই তাঁদের জীবনযন্ত্রণার জ্বালা জুড়োতে মদের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকার পথ বেছে নেন৷ তাদের সামান্য রোজগারের বেশিরভাগটাই চলে যায় মদের ঠেকে৷ ফলে সাংসারিক অশান্তি হয়ে ওঠে নিত্যসঙ্গী৷ এই পরিবেশে শিশু এবং মহিলারা সবচেয়ে বেশি নির্যাতিতা হন৷ ঘরে–বাইরে তাঁদের নির্যাতন যেন স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে দাঁড়ায়৷ ভারতের যে কোনও রাজ্যের মতো বিহারের পরিস্থিতিও ছিল ঠিক একই রকম, বরং কিছুটা বেশি খারাপ৷ এই পরিস্থিতিতে দরিদ্রের সংসারের কোণ থেকে উঠে আসা পুঞ্জীভূত ক্ষোভ প্রকাশ পেয়েছিল শিক্ষার আলো বঞ্চিত, আর্থিক শোষণে নিষ্পেষিত, জীবনযুদ্ধে জেরবার গ্রামীণ মহিলাদের সোচ্চার প্রতিবাদের মধ্যে৷ প্রতিবাদের এই স্বরকে ভোটলোভী ক্ষমতালিপ্সু রাজনৈতিক নেতারাও উড়িয়ে দিতে পারেনি৷ সরকারকে নিষিদ্ধ করতে হয়েছিল মদ৷

আজ চার বছর পর বিহার সরকারের মহিলা বিকাশ নিগমের অধীনস্থ জেন্ডার রিসার্চ সেন্টারের সমীক্ষা বলছে, রাজ্যে যেখানে ৫৪ শতাংশ পরিবারে মহিলা এবং শিশুরা গার্হস্থ্য হিংসার শিকার ছিলেন, তা কমে এখন ৫ শতাংশ পরিবারের মধ্যে দাঁড়িয়েছে৷ সংসারে অশান্তি বেশ কিছুটা কমেছে৷ এর আগে ফাইনান্সিয়াল এক্সপ্রেসের রিপোর্টও দেখিয়েছে, মদ নিষিদ্ধ হওয়ার পর বিহারে ৫৫ শতাংশ পথ দুর্ঘটনা, ২৪ শতাংশ হত্যা, ১৬ শতাংশ লুঠ ও ৩৭ শতাংশ মারামারির ঘটনা কমেছে৷ এই অভিজ্ঞতার পর তামিলনাডু সরকারও জনমতের চাপে মদের উপর লাগাম টানতে বাধ্য হয়েছে৷

অথচ পশ্চিমবঙ্গে মদ তৈরি বা বিক্রির উপর নিয়ন্ত্রণ দূরের কথা, তৃণমূল সরকার মদকে সম্ভাবনাময় শিল্প হিসাবে দেখছে৷ মদ বিক্রি করেই সিংহভাগ রাজস্ব আদায়ের পরিকল্পনা করছে৷ রাজস্ববৃদ্ধির অজুহাতে নতুন করে ১২০০ মদের দোকানের লাইসেন্স দিচ্ছে৷ এমনকী সরকার নিজেই পাইকারি মদের ব্যবসায় নামছে৷ নতুন নতুন মদের কারখানা খোলার কথা বলছে৷ জেলায় জেলায়, এমনকী প্রত্যন্ত গ্রামেও কী করে মদ পৌঁছানো যায়, সেই চিন্তায় সরকারের ঘুম নেই৷ অজুহাত হিসাবে দেখানো হচ্ছে বিষাক্ত চোলাই মদ খেয়ে একের পর এক মৃত্যু মিছিলকে৷ ভাবখানা এমন সরকার যেন নিতান্তই দয়া পরবশ হয়ে বিশুদ্ধ মদ মানুষের হাতে তুলে দিতে তৎপর হয়ে উঠেছে৷ কিন্তু গ্রামের ছেলেমেয়েদের উন্নত শিক্ষা, মানুষের উন্নত চিকিৎসা, উন্নত পানীয় জল সরবরাহ ব্যবস্থা, উন্নত কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা, উন্নত নিকাশি ব্যবস্থা, উন্নত সেচ ইত্যাদি নিয়ে তাদের কোনও মাথাব্যথা দেখা যায় না৷

এ রাজ্যে খুন–ধর্ষণ–নারী নির্যাতনের ঘটনা ক্রমাগত বাড়ছে৷ প্রতিদিন দুই বছরের শিশু থেকে শতায়ু বৃদ্ধা পর্যন্ত ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন৷ ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর রিপোর্ট বলছে, ধর্ষণ–নারী নির্যাতনের ঘটনার ৮৫ শতাংশ ক্ষেত্রেই অপরাধীরা মদ্যপ৷ মদের প্রসার এতটাই ভয়াবহ ভাবে বেড়েছে, কিশোর–কিশোরীদেরও তার থেকে মুক্ত রাখা যাচ্ছে না৷ সাম্প্রতিক কালে এক কিশোরীর জন্মদিনের পার্টির হুল্লোড়ে মদের নেশায় আচ্ছন্ন এক কিশোরের মর্মান্তিক মৃত্যু, দমদমের সুক্লে ক্লাসরুমে বসে কিশোরীদের মদ্যপানের ঘটনায় বিবেকবান মানুষ মাত্রেই আঁতকে উঠেছেন৷ এই পরিস্থিতিতে দেশের যৌবনকে ধ্বংস করে মদ বেচা পয়সায় সরকার মানুষের কল্যাণ করবে?

মদ স্নায়ুর উপরে ক্রিয়া করে মানুষের বোধশক্তি–সংযম–ন্যায়নীতিবোধ অকেজো করে দেয়৷  মদ্যপদের বেপরোয়া করে তোলে৷ সেই সময় কোনও চূড়ান্ত অনৈতিক কাজ করতেও তাদের বাধে না৷ এর সাথে শাসক দলের প্রশ্রয়, সমাজের উপর তলার সাথে দুষ্কৃতীদের যোগসাজসে যা খুশি করার অবাধ সুযোগের মেলবন্ধন ঘটলে সমাজে এক ভয়াবহ দুষ্ট শক্তির জন্ম হয়৷ যা সমাজ পরিবেশকে বিষিয়ে তোলে৷ ভোটের সময় ভোটবাজ দলগুলি এই দুষ্ট শক্তিকে ব্যবহার করার লক্ষ্যে তাকে প্রশ্রয় দেয়৷ গণআন্দোলনের জমিকে নষ্ট করতেও এই প্রশ্রয় কাজ দেয়৷ যে কারণে বুর্জোয়া শ্রেণির স্বার্থে ঝান্ডার রঙ নির্বিশেষে শাসকদলগুলি মদের প্রসারের জন্য কাজ করে যায়৷

আশার কথা, মদের প্রসারের বিরুদ্ধে বহু জায়গায় সাধারণ মানুষ বিশেষত মহিলারা রাস্তায় নামছেন৷ মদের ঠেক ভাঙতে, মদের ঢালাও লাইসেন্স রুখতে তাঁরা সক্রিয় ভূমিকা নিচ্ছে৷ মা–বোনেদের পণ– তাঁদের সন্তান ও ভাইদের আর সর্বনাশ হতে দেবেন না৷ এআইএমএসএস এই আন্দোলনকে রাজ্য ভিত্তিতে সংগঠিত রূপ দিতে উদ্যোগ নিয়েছে৷ প্রয়োজন জনগণের সহযোগিতায় এই আন্দোলনের দ্রুত শক্তিশালি করা৷

(গণদাবী : ৭১ বর্ষ ২১ সংখ্যা)