মতবাদিক বিতর্ক হোক আক্রমণ–হত্যা নয়

লোকসভা নির্বাচনের পর থেকেই কেন্দ্রের শাসকদল বিজেপি এবং রাজ্যের শাসক দল তৃণমূলের মধ্যে সংঘর্ষে রাজ্যে এক উদ্বেগজনক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে৷ জেলায় জেলায় খুন, সন্ত্রাস, অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর প্রতিদিন লাগামহীন ভাবে ঘটে চলেছে৷ ৮ জুন সন্দেশখালিতে সংঘর্ষে তিন জন গ্রামবাসীর মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটেছে৷ কোন দলের কে কোথায় আক্রমণ করছে, অভিযোগ–পাল্টা অভিযোগের আবর্তে তা বোঝা দুরূহ৷ অথচ মায়ের কোল প্রতিদিন খালি হচ্ছে৷ বহু মানুষ আতঙ্কে ঘরছাড়া৷ পক্ষকাল বা তারও বেশি সময় ধরে এই যে নৈরাজ্যের বাতাবরণ রাজ্যে তৈরি হয়েছে এর দায় বিজেপি বা তৃণমূল কেউই অস্বীকার করতে পারে না৷ রাজ্যে শান্তি–শৃঙ্খলা রক্ষা করা, মানুষের জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব শাসক হিসেবে দু’দলেরই৷ অথচ রাজনৈতিক ফয়দা তোলার উদ্দেশ্যে সেই দায়িত্ব দুই দলই এড়িয়ে যাচ্ছে৷

এবারের নির্বাচনে এ রাজ্য থেকে বিজেপি ১৮টি আসনে জিতে রীতিমতো উৎফুল্ল৷ তাদের কাছে এ ফলাফল অপ্রত্যাশিত ভাবে বেশি৷ আগামী বিধানসভা ভোটে এ রাজ্য দখলের স্বপ্ণ নিয়ে জেলায় জেলায় দলের শক্তিবৃদ্ধির জন্য তারা তৎপর হয়েছে৷ নানা বিরোধী দল ভাঙাচ্ছে তারা৷ বিজেপি–তৃণমূলের এলাকা দখল বা রক্ষার পরিণতিতেই এই সংঘর্ষগুলি ঘটছে৷ পার্টি অফিস পর্যন্ত দখল–পুনর্দখল হচ্ছে৷ এতে নষ্ট হচ্ছে সুস্থ রাজনৈতিক পরিবেশ৷ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে মত পার্থক্য থাকা স্বাভাবিক এবং থাকবেও৷ কিন্তু রাজনৈতিক সহনশীলতার পরিবেশ নষ্ট হয়ে গেলে সেই রাজনীতি হয়ে দাঁড়ায় গুন্ডাতন্ত্রের সমার্থক৷ সরকারি ক্ষমতাকে ব্যবহার করে, পুলিশ প্রশাসনকে কাজে লাগিয়ে, বিরোধী সংগঠন ভাঙার এই ঘৃণ্য রাজনীতির চর্চা অবিলম্বে বন্ধ হওয়া দরকার৷ মতবাদে মতবাদে সংঘর্ষ হোক৷ আদর্শগত সংগ্রাম হোক, মানুষের সামনে উঠে আসুক কোন আদর্শ আজকের দিনে সামাজিক সমস্যার, জীবনের সমস্যার সমাধান করতে পারে, কোনটা পারে না৷ এই আদর্শগত সংগ্রাম রাজনৈতিক পরিবেশকে সুস্থ রাখে৷ মানুষকেও পথ দেখায়৷ কিন্তু এর বিপরীতে যা ঘটছে তার পরিণাম কী?

এই সংঘর্ষের রাজনীতি রাজ্যকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? রাজনীতিতে নৈতিকতা বলে কিছু থাকছে? শাসক দলগুলির হাত ধরে রাজনীতির মানে যদি দাঁড়ায় সুবিধাবাদ এবং খুনোখুনি, সেই রাজনীতি মানুষকে, সমাজকে কী দেবে? ভোটবাজ এই দলগুলির লক্ষ্য শুধুই ক্ষমতা দখল, মালিক শ্রেণির স্বার্থ রক্ষা এবং তার বিনিময়ে নিজ স্বার্থপূরণ৷ কেন্দ্র–রাজ্য দুই সরকারের কাজ বেকার সমস্যার সমাধান, শিল্পায়ন, কৃষির আধুনিকীকরণ, বিনামূল্যে উন্নত মানের শিক্ষা ও চিকিৎসা সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া, তাদের জীবন উন্নত করা, সমাজের নৈতিক মানের উন্নয়ন ঘটানো ইত্যাদি৷ কিন্তু এসব বিষয় কোনও সরকারের ভাবনাতেই নেই৷ এদের রাজনীতির দ্বারা তাই জনজীবনের মৌলিক সমস্যার সমাধান হতে পারে না৷

মানুষ দেখেছে এ বারের লোকসভা ভোটে বিপুলভাবে জয়ী বিজেপি ভোটের ময়দানে মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সমস্যা নিয়ে বিশেষ কথা খরচ করেনি৷ সব পরিষদীয় দলগুলি সম্পর্কেই এ কথা সত্য৷ এমনকী আগের নির্বাচনে যে সব চটকদার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিজেপি বাজিমাত করেছিল, যেমন কালো টাকা উদ্ধার করে প্রত্যেকের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ১৫ লাখ টাকা ভরে দেওয়া, বছরে ২ কোটি বেকারের চাকরি, ১০০ দিনের মধ্যে মূল্যবৃদ্ধি কমিয়ে আনা ইত্যাদি ইত্যাদি, এর কোনওটাই মোদি ও তার সরকার গত পাঁচ বছরে পূরণ করতে পারেনি৷

মানুষের প্রাপ্তির খাতা একেবারে শূন্য– এ কথা বললে অবশ্য ভুল বলা হবে৷ নির্বাচন মিটতেই পেট্রল–ডিজেলের বাড়তি দাম ঘাড়ে চেপেছে মানুষের৷ রান্নার গ্যাস আরও মহার্ঘ হয়েছে৷ বাজারের মূল্যস্তর আরও ঊর্ধ্বমুখী৷ বেকারি ৪৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ রেকর্ড করেছে৷ তা ছাড়া সরকারের দেওয়া উন্নয়নের নানা তথ্যে যে অনেক জল মেশানো আছে, বিশেষজ্ঞদের মতামতে তা বারবার সামনে এসেছে৷ ‘প্রাপ্তির’ খাতায় এমন আরও কত কী ভবিষ্যতে জমা হবে, এখন শুধু তারই অপেক্ষা তবে এই সব ‘প্রাপ্তি’ যে সাধারণ মানুষের জীবনের সমস্যা কমাবে না, আরও বাড়াবে– তা বুঝতে বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই৷ এবং পুঁজিবাদে এটাই দস্তুর৷ ভোট আসে, ভোট যায়৷ এক ম্যানেজারের জায়গায় আর এক ম্যানেজার আসে৷ তারা আবার ‘আচ্ছে দিনের’ গল্প শোনায়৷ কিন্তু সে ‘আচ্ছে দিন’ মানুষের জীবনে অধরাই থেকে যায়৷ সেখানে শুধু সমস্যার পাহাড় আর হাহাকার৷

অনেকেই লক্ষ করেছেন, রাজ্যে নির্বাচনী ফলাফল ঘোষণার পর সাধারণ মানুষের মধ্যে উচ্ছ্বাস প্রায় ছিল না বললেই চলে৷ সেখানে বরং কাজ করেছে নানা উদ্বেগ ও আশঙ্কা৷ এর একটি বড় কারণ সন্ত্রাস৷ শুধু সন্দেশখালি নয়, রাজ্যে প্রায় প্রতিদিন কোনও না কোনও স্থানে রাজনৈতিক সংঘর্ষ, অফিস ভাঙচুর বা দখল এবং খুনের ঘটনা ঘটেই চলেছে৷ ফলাফলের নিরিখে রাজ্যের অনেকটা জমি হাতছাড়া হওয়ায় তৃণমূল কংগ্রেস বাইরের চেহারায় যখন খানিকটা রক্ষণাত্মক, তখন রাজ্যে অভাবিত সাফল্য পেয়ে বিজেপির উল্লাস একেবারে বাঁধনছাড়া৷ তাদের বেপরোয়া কথাবার্তা ও রণং দেহি মনোভাব সর্বত্র প্রকট৷ পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে পৌঁছেছে তার কিছুটা আন্দাজ পাওয়া যায়, যখন দেখা যায়, ঘরছাড়া তৃণমূল কর্মীদের ঘরে ফেরাতে মুখ্যমন্ত্রীকে ছুটতে হচ্ছে৷ আজকের উদ্ভূত পরিস্থিতির সঙ্গে ২০১১ সালের উত্তপ্ত অবস্থার একটা সাদৃশ্য লক্ষণীয়৷ ফারাক শুধু এখানেই যে, সেদিন তৃণমূল কংগ্রেস প্রবল সিপিএম বিরোধী জোয়ারে ভেসে ক্ষমতার মসনদে আর আজ সেই তৃণমূলের বিরুদ্ধেই প্রবল স্রোত বিজেপিমুখী৷ অবশ্য এখানে সিপিএম কর্মী–সমর্থকদেরও একটা বড় অবদান আছে– তাঁরা ভাবছেন কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলে শেষ হাসি হাসবেন৷ কী চরম সর্বনাশা রণনীতি!

দিল্লির ক্ষমতায় যাওয়ার পথে গণতান্ত্রিক রীতিনীতি মূল্যবোধের প্রতি বিজেপির যে মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে তার মধ্যেও অশনি সংকেত লুকিয়ে আছে৷ নির্বাচনী বিধি লঙঘন করে গোটা প্রচারপর্বে তারা দেশরক্ষার নামে উগ্র জাতীয়তাবাদে উস্কানি দিয়েছে৷ ভোটব্যাঙ্কের দিকে তাকিয়ে হিন্দুত্বের চ্যাম্পিয়ন সেজে সাম্প্রদায়িক বিভাজনের সর্বনাশা রাজনীতির চর্চা করেছে৷ নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে বিশাল অঙ্কের টাকা ব্যয় করে অতীতের সমস্ত রেকর্ডকে ম্লান করে দিয়েছে৷ কারা জুগিয়েছে এত টাকা? জুগিয়েছে কর্পোরেট পুঁজির মালিকরা৷  বিজেপির পাঁচ বছরের অপশাসন, নোটবন্দি, জিএসটির আঘাত, রেকর্ড বেকারি, হাজার হাজার চাষির আত্মহত্যা– সব কিছুকে তারা ঢেকে দিয়েছে অর্থ আর প্রচারের দাপটে৷ কারণ, ক্ষয়িষ্ণু পুঁজিবাদ বর্তমানে যে সর্বাত্মক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে সেখানে কেন্দ্রীয় সরকারে সে স্থায়িত্ব চায় এবং তাদের বিচারে বর্তমানে বিজেপিই তাকে তা দিতে পারে৷ এর অর্থ এটা নয়, দেশে যে দ্বিদলীয় পরিষদীয় ব্যবস্থা তারা কায়েম করতে চায় সেখানে তার অন্যতম পক্ষ কংগ্রেসকে সে টাকা দেয়নি বা প্রচার দেয়নি৷ কংগ্রেসকেও  তারা টাকা দিয়েছে, প্রচার দিয়েছে৷ কিন্তু ক্ষমতায় বিজেপিকেই চেয়েছে৷ তাই নির্বাচনী বিধি, প্রশাসনিক নিরপেক্ষতা পদে পদে লঙিঘত হতে দেখেও নির্বাচন কমিশন কোনও উচ্চবাচ্য করেনি৷ নির্বাচনী সভায় উস্কানিমূলক বক্তৃতা, ভোটের দিন কেন্দ্রীয় বাহিনীকে সংকীর্ণ স্বার্থে ব্যবহারের মতো ঘটনা ঘটতে দেখেও তারা কোনও ব্যবস্থা নেয়নি৷

আরও একটি বিপজ্জনক প্রবণতা এবার বিশেষ করে পশ্চিমবাংলায় ব্যাপকভাবে ঘটতে দেখা গিয়েছে৷ তা হল দল ভাঙানোর উস্কানি৷ স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী এ রাজ্যে এসে নির্বাচনী সভায় বলেছেন, ৪০ জন তৃণমূল বিধায়ক দলবদল করে বিজেপিতে যোগ দিতে পা বাড়িয়ে আছেন৷ সংখ্যাটা নানা জনের মুখে বাড়তে বাড়তে একশোতে পৌঁছেছে৷ নীতিহীনভাবে দল ভাঙানোর মধ্যে যে কোনও অন্যায় আছে, তা ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে৷ অবশ্য, দল বদলের খেলায় তৃণমূল কংগ্রেসের ভূমিকাও কম নিন্দনীয় নয়৷ ভোটের আগে উভয়েই দল বদলে প্রশ্রয় দিয়েছে এবং বহু ক্ষেত্রে দলত্যাগীদের প্রার্থী করেছে৷ ভোটের পরও এই নোংরা খেলা অব্যাহত মূলত বিজেপির হাত ধরে৷ গণতন্ত্রের পক্ষে এ এক অশুভ প্রবণতা– যা গণতন্ত্রের অবক্ষয়কেই সূচিত করছে৷

আরও একটি বিপজ্জনক প্রবণতা নির্বাচনোত্তর পরিবেশে গোটা দেশে লক্ষ করা যাচ্ছে যা সমাজপরিবেশ বিষাক্ত ও রক্তাক্ত করছে৷ অতি সম্প্রতি দিল্লিতে এক সংখ্যালঘু ব্যক্তি, মধ্যপ্রদেশে তিন সংখ্যালঘু যুবক, পুণেতে প্রখ্যাত এক চিকিৎসক, গড়বেতা কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ, উত্তরবঙ্গের জনৈক ছাত্রী প্রমুখ যেভাবে কোথাও ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি দেওয়ার ফতোয়া, কোথাও গো–রক্ষকদের তাণ্ডবের মুখে পড়েছেন এবং আক্রান্ত হয়েছেন, এর মধ্যে এক গভীর বিপদ লুকিয়ে আছে৷ প্রায় একই রকম ঘটনা বিহার, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশেও ঘটে চলেছে৷ ভোটের একেবারে শেষলগ্ণে কলকাতায় এদের তাণ্ডবে মহান বিদ্যাসাগরের মূর্তি চূর্ণবিচূর্ণ হয়েছে৷

এই অশুভ শক্তির আক্রমণের লক্ষ্য শুধু সংখ্যালঘুরা নয়, সমস্ত বিরোধী কণ্ঠস্বর৷ আমরা ভুলে যাইনি, অতীতে এদের হাতেই খুন হয়েছিলেন পানসারে, দাভোলকর, কালবুর্গি, গৌরী লঙ্কেশের মতো প্রতিবাদীরা৷ দেশদ্রোহিতার ছাপ লাগিয়ে যে কোনও রকম বিজেপি–বিরোধিতা বা ভিন্ন মতামত তারা মুছে দিতে চায়৷ সমাজের যা কিছু শুভ, যা কিছু সুন্দর– সবই এদের আক্রমণের লক্ষ্য৷ একে ঠেকাতে হবে দীর্ঘ সামাজিক সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পথে সমাজে সুস্থ চিন্তা, উন্নত সংস্কৃতি এবং সর্বস্তরে সম্প্রীতি ও সহিষ্ণুতার পরিবেশ ফিরিয়ে এনে৷ সমাজের সমস্ত অংশের মানুষের শুভবুদ্ধিকে জাগ্রত করে৷ রামমোহন, বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, নজরুল, নেতাজি, ভগৎ সিং, আসফাকুল্লা প্রমুখের জীবন ও সংগ্রামের ব্যাপক চর্চার মধ্য দিয়ে সমাজে গণতান্ত্রিক চিন্তা–চেতনা ও মূল্যবোধ ফিরিয়ে এনে৷

(গণদাবী : ৭১ বর্ষ ৪৪ সংখ্যা)