ভোটের লক্ষ্যেই প্রধানমন্ত্রীর নেতাজি–ভজনা

সম্প্রতি আজাদ হিন্দ সরকারের ৭৫ বর্ষ পূর্তি উপলক্ষে লালকেল্লাতে বছরে দ্বিতীয়বার জাতীয় পতাকা উত্তোলন এবং আইএনএ–এর টুপি পরে দেশবাসীর সামনে আবারও এক চমক হাজির করলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি৷ খোদ নেতাজি সুভাষচন্দ্রের নাম করে প্রকাশ্যে একগুচ্ছ সত্য–মিথ্যা জড়ানো কথা যেভাবে তিনি পরিবেশন করেছেন তাতে বোঝা যায় সস্তা চমকের আড়ালে সত্যের অপলাপ করার আর্ট তিনি ভালই রপ্ত করেছেন৷ এটা এখন এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে সর্বজন শ্রদ্ধেয় নেতাজিকেও রাজনৈতিক মতলব হাসিল করার হাতিয়ারে পরিণত করতেও আটকাচ্ছে না তাঁর৷

তাঁর অভিযোগ, স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতাজির অবদানকে জাতীয় কংগ্রেস উপযুক্ত স্বীকৃতি দেয়নি৷ এটাও আসলে অর্ধ সত্য৷ সত্যটা হল শুধু জাতীয় কংগ্রেস কেন, স্বাধীনতার পর যত রাজনৈতিক দল বিভিন্ন রাজ্য বা কেন্দ্রে দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হয়ে বসেছে, তারা কেউই নেতাজির সংগ্রামকে যথাযথ মর্যাদা দেয়নি৷ মোদিজি যে বিজেপির প্রতিনিধিত্ব করেন, তাদের মূল সংগঠন আর এস এস এবং হিন্দু মহাসভা স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতাজির বিপরীত মেরুতে অবস্থান নিয়েছিল৷ আজকের সময়েও তাদের দৈনন্দিন কর্মে প্রতিফলিত সংস্কৃতির সাথে নেতাজির আদর্শের কোনও মিল আছে কি?

আজ একথা নতুন করে অবতারণা করা নিষ্প্রয়োজন যে বিজেপি–আরএসএসের রাজনীতির মূল বক্তব্যই হল ধর্মের ভিত্তিতে দেশ গঠন৷ এ প্রসঙ্গে নেতাজির বক্তব্য কী? দ্ব্যর্থহীন ভাষায় তিনি বলেছেন, ‘‘ধর্মকে সম্পূর্ণরূপে রাজনীতি থেকে বাদ দেওয়া উচিত৷ ধর্ম ব্যক্তিবিশেষের বিষয় হওয়া উচিত, …ধর্মীয় কিংবা অতীন্দ্রিয় বিষয়ের দ্বারা রাজনীতি পরিচালিত হওয়া উচিত  নয়’’ (ক্রসরোডস)৷ নেতাজিকে  উপযুক্ত মর্যাদা দিতে গেলে তাঁর এই বক্তব্য সর্বাগ্রে শিরোধার্য করতে হয়৷ নরেন্দ্র মোদি  এ কথা মানেন কি?

নেতাজি আরও বলেছেন, ‘‘… হিন্দু ও মুসলমানের স্বার্থ পৃথক, এর চেয়ে মিথ্যা বাক্য আর কিছু হতে পারে না৷ বন্যা, দুর্ভিক্ষ, মড়ক ইত্যাদি বিপর্যয় কাউকে রেহাই দেয় না৷…হিন্দুরা ভারতে সংখ্যাগরিষ্ঠ বলে ‘হিন্দু রাজের’ ধবনি শোনা যায়, এগুলি সর্বৈব অলস চিন্তা’’৷ এই প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেছেন, ‘‘আমাদের দেশের হিন্দু–মুসলমান এই দুই প্রধান সম্প্রদায়ের মধ্যে বিরোধের কোনও চিরন্তন কারণ থাকতে পারে না– এটা নেই৷ … এক শ্রেণির স্বার্থান্বেষী লোক ক্ষুদ্র ব্যক্তিগত স্বার্থের লোভে উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে কলহ ও মনোমালিন্য সৃষ্টি করে বেডাচ্ছে…স্বাধীনতা সংগ্রামে এ শ্রেণির লোককেও শত্রু রূপে গণ্য করা প্রয়োজন৷’’ তাহলে কী দাঁড়াল? রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করতে যারা বাবরি মসজিদ ভাঙে, গুজরাটের সংখ্যালঘু নিধনযজ্ঞের মতো গো–রক্ষার অজুহাতে মানুষ খুন করে, শুধু ধর্মে মুসলমান বলে ট্রেনের মধ্যে কিশোরকে পিটিয়ে মারে তাদের চেয়ে বড় দেশের শত্রু আর কে?

প্রধানমন্ত্রী দাবি করেছেন নেতাজির বিশেষ নজর ছিল উত্তর–পূর্বের রাজ্যগুলির প্রতি৷ যেন নরেন্দ্র মোদির দলও উত্তর–পূর্বের মানুষের জন্য ভেবে ভেবে অস্থির হয়ে উঠেছে৷ সুভাষচন্দ্র কোনও দিন বিচ্ছিন্ন করে কোনও প্রদেশের কথা বলেননি৷ স্বাধীনতা সম্পর্কে নেতাজির স্পষ্ট ধারণা, ‘‘গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়গত খণ্ড চিন্তা নয়, সমগ্র জাতিকে জড়িয়েই চিন্তা করতে ও অনুভব করতে আমাদের শিখতে হবে৷ সামাজিক ও আর্থিক ক্ষেত্রের যে সত্যটি সম্বন্ধে আমাদের নিরক্ষর দেশবাসীর চোখ আমাদেরই খুলে দিতে হবে, তা হল, ধর্ম, জাত ও ভাষার পার্থক্য থাকলেও আর্থিক সমস্যা ও অভাব অভিযোগগুলি আমাদের সকলেরই এক৷…দারিদ্র্য ও বেকারি, অশিক্ষা ও রোগগ্রস্ততা, কর ও ঋণের বোঝা সব সমস্যাই হিন্দু ও মুসলমান সহ অন্যান্য সম্প্রদায়ের জনগণকে একই ভাবে আঘাত করে এবং এগুলির সমাধানও সর্বাগ্রে রাজনৈতিক সমস্যার সমাধানের উপর নির্ভর করে’’ (ক্রসরোডস)৷ অর্থাৎ ভারতের উত্তর–পূর্বের সমস্যা আলাদা নয়, বরং তাদেরও সমস্যার সমাধান সারা দেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সমস্যা মোচনের প্রশ্নের সাথে জড়িত৷ কথাটা আজও সমান ভাবে সত্য নয় কি? অথচ জাতীয় নাগরিক পঞ্জির নাম করে একটা অন্যায় ও অমানবিক নীতিকে জোর করে বৈধতা দেবার জন্য, এখন উত্তর–পূর্বের রাজ্যগুলির মানুষের ‘মিত্রোঁ’ সাজা মোদিজির খুব দরকার হয়ে পড়েছে৷ তাই নেতাজির মতো বড় মানুষকে টেনে আনা ও তাঁর মুখে একটা মনগড়া কথা লাগিয়ে দিয়ে নিজেকে তাঁর সমতুল্য প্রতিপন্ন করার হীন প্রচেষ্টা৷ এতবড় মিথ্যা মানুষ মেনে নেবে?

মোদিজি আজ যে দাবিই করুন না কেন, তাঁদের আদর্শ কোনওদিন নেতাজি সহ বিপ্লবীদের চিন্তাকে সম্মান তো করেইনি, বরং আদ্যোপান্ত বিরোধিতাই করেছে৷ তাঁদের তাত্ত্বিক নেতা গোলওয়ালকর বলেছিলেন ‘‘…  আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনকে কার্যত ব্র্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে পর্যবসিত করা হয়েছে৷ ব্র্রিটিশ বিরোধিতার সাথে দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদকে সমার্থক করা হয়েছে৷ এই প্রতিক্রিয়াশীল ধারণা সমগ্র স্বাধীনতা আন্দোলন, তার নেতৃবৃন্দ এবং সাধারণ মানুষের উপর সর্বনাশা প্রভাব ফেলেছে’’ (উই অর আওয়ার নেশনহুড ডিফাইনড)৷ অর্থাৎ তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে সমস্ত স্বাধীনতা আন্দোলনটাই হল প্রতিক্রিয়াশীল এবং স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ সকলেই প্রতিক্রিয়াশীল৷ সেই কারণেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সুযোগ নিয়ে দেশজোড়া তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষ্যে যখন নেতাজি মরণপণ প্রচেষ্টাতে অবতীর্ণ হয়েছেন, তখন হেডগেওয়ার, গণেশ দামোদর সাভারকর (বিনায়ক দামোদর সাভারকরের ভাই), শচীন্দ্রনাথ সান্যাল প্রমুখ হিন্দু মহাসভার নেতারা ব্রিটিশকে সাহায্য করেন, যার প্রমাণ আছে বিপ্লবী নেতা ত্রৈলোক্য মহারাজের আত্মজীবনীতে৷ ব্র্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করবেন না বলে হিন্দু মহাসভা নেতারা মুচলেকা দিয়েছে, আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে  সাক্ষ্য দিতে পিছ–পা হয়নি৷ এটাই তো সত্য ইতিহাস,  নরেন্দ্র মোদীদের নেতাজির প্রতি শ্রদ্ধার নিদর্শন ভোটের স্বার্থে কি ইতিহাস বদলানো যায়?

বিজেপি যার গর্ভ হতে আত্মপ্রকাশ করেছে, সেই হিন্দু মহাসভা যখন হিন্দুত্বকে হাতিয়ার করে রাজনীতিতে অবতীর্ণ হচ্ছিল, তখনই তার ভয়াবহ পরিণাম বিবেচনা করে নেতাজি শঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন৷ ঝাড়গ্রামের ভাষণে তিনি বলছেন, ‘‘সন্ন্যাসী ও সন্ন্যাসিনীদের ত্রিশূল হাতে হিন্দু মহাসভা ভোট ভিক্ষায় পাঠিয়েছেন৷ ত্রিশূল আর গেরুয়া বসন দেখলে হিন্দুমাত্রই শির নত করে৷ ধর্মের সুযোগ নিয়ে, ধর্মকে কলুষিত করে হিন্দু মহাসভা রাজনীতির ক্ষেত্রে দেখা দিয়েছে৷… এই বিশ্বাসঘাতকদের আপনারা রাষ্ট্রীয় জীবন থেকে সরিয়ে দিন, তাদের কথা কেউ শুনবেন না৷ আমরা চাই দেশের স্বাধীনতাপ্রেমী নরনারী এক প্রাণ হয়ে দেশের সেবা করুক’’ (আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৪মে, ১৯৪০)৷ ট্র্যাজেডি হল সেদিন নেতাজির সেই আহ্বানের গুরুত্ব বুঝেছিলেন মুষ্টিমেয় মানুষ৷ নেতাজি এ কথাও বুঝেছিলেন, শুধুমাত্র ব্র্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে দেশবাসীর অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় বন্ধনমোচন সম্ভব নয়৷ একসময় কংগ্রেসকে প্ল্যাটফর্ম করেই আরও বৃহত্তর আন্দোলনের স্বপ্ন দেখেছিলেন, যা দক্ষিণপন্থী কংগ্রেস নেতাদের সাথে তাঁর তীব্র বিরোধ সূচনা করে৷ সেদিন শুধু দক্ষিণপন্থীরা নয় ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিও তাঁর পাশে দাঁড়ায়নি৷ তাই তিনি পৃথকভাবে বামপন্থীদের ঐক্যবদ্ধ করে স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়লেন৷ এখানে মনে রাখা দরকার, স্বাধীনতা সম্পর্কে নেতাজির ধারণা ছিল অত্যন্ত সুসংহত এবং গান্ধীবাদী কংগ্রেস নেতা বা সিপিআই–এর নেতাদের থেকে মৌলিকভাবেই পৃথক৷ তিনি বলেছেন, ‘‘ …স্বাধীনতা বলিতে আমি বুঝি সমাজ ও ব্যক্তি, নর ও নারী, ধনী ও দরিদ্র সকলের জন্য স্বাধীনতা, শুধু ইহা রাষ্ট্রীয় বন্ধন–মুক্তি নহে, ইহা অর্থের সমান বিভাগ, জাতিভেদ ও সামাজিক অবিচারের নিরাকরণ ও সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতা ও গোঁড়ামি বর্জনও সূচিত করে’’ (নতুনের সন্ধানে)৷ বলা বাহুল্য, নেতাজির এই ভাবধারা আজকের সময়ে দাঁড়িয়েও নরেন্দ্র মোদিদের কাছে বিপজ্জনক৷

তাই ভোটের স্বার্থে নিজেদের সংকীর্ণ কংগ্রেসবিরোধী রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করতে সূক্ষ্মভাবে গান্ধীজি ছাড়া আর পাঁচজন কংগ্রেস নেতার সাথে নেতাজিকে এক পংক্তিতে ফেলে দিয়ে বাস্তবে নেতাজির আপসহীন সংগ্রামী চরিত্রকে খাটো ও বিকৃত করার প্রচেষ্টাই মুখ্য হয়ে দাঁডাচ্ছে৷

সবশেষে বলতেই হয়, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, যিনি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার মধ্য দিয়ে ক্ষমতার শীর্ষে আরোহণের ব্র্যান্ড আইকন, তিনি রাতারাতি সংগঠনের আগাপাশতলা বদলে দিয়ে ধর্মীয় উন্মাদনার বদলে নেতাজির আদর্শকে সম্মান জানাতে শুরু করবেন, এমন ভাবনা শুধু আকাশকুসুম নয়, চূডান্ত বালখিল্যতারই পরিচায়ক৷ সামনে নির্বাচন এসে পডায় নিকৃষ্ট ভোটস্বার্থ চরিতার্থ করতে নেতাজির ভক্ত সেজে মানুষকে প্রতারণা করার এই অপচেষ্টার বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া প্রয়োজন৷

(৭১ বর্ষ ১৫ সংখ্যা ২৩ – ২৯ নভেম্বর, ২০১৮)