ভোটের জন্যই  যুদ্ধ–যুদ্ধ জিগির

সাড়ে তিনশো জঙ্গি নিধনের খবরটিকে ভুয়ো বলল আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলি৷ তারা জানিয়ে দিয়েছে, সেদিন ভারতীয় বিমান হানায় কোনও জঙ্গির নিধন হওয়ার সত্যতা পাওয়া যায়নি৷ অথচ বিজেপির সরকারের নেতা–মন্ত্রীরা সরকারের সাফল্য প্রমাণ করতে ঝাঁপিয়ে পড়ে দেশজুড়ে তুমুল শোরগোল ফেলে দিয়েছিলেন৷ কেমন সেই শোরগোল?

মাত্র দেড় মিনিট তার মধ্যেই নাকি পাকিস্তানে ঢুকে ভারতীয় বায়ুসেনার যুদ্ধবিমান নিখুঁত লক্ষ্যে বোমা ফেলে জইশ–ই–মহম্মদের জঙ্গি ঘাঁটি গুঁড়িয়ে দিয়েছে৷ সাতাশে ফেব্রুয়ারি সকালেই দাবি করল নরেন্দ্র মোদি সরকার৷ ব্যস৷ অমনি দেশজুড়ে বিজেপি–সংঘ পরিবারের ট্রেনিংপ্রাপ্ত কর্মীরা এবং সরকারের ধামাধরা এবং ভাড়াটে সংবাদমাধ্যমগুলি এই বিমান হানার ‘নিখুঁত’ বর্ণনা প্রচার শুরু করে দিল৷ ১২টি মিরাজ যুদ্ধবিমান পাকিস্তানের খাইবার–পাখতুনখোয়া প্রদেশের বালাকোটে ১০০০ কেজি ওজনের বোমা ফেলেছে৷ তাতে মারা গিয়েছে ৩৫০ জন জঙ্গি৷ যাদের মধ্যে জইশ–প্রধান মাসুদ আজহারের শ্যালক মৌলানা ইউসুফ আজহারও রয়েছে৷ ১৯৯৯ সালে ভারতীয় বিমান ছিনতাই করে কন্দহরে নিয়ে যাওয়ার পিছনে এই ইউসুফই ছিল মূল মাথা৷ মোদি সরকার দাবি করে, ভারতে আরও একটি আত্মঘাতী হামলার জন্য বালাকোটের ওই শিবিরে জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছিল৷ বিদেশ সচিব বিজয় গোখলে দাবি করেন, ‘‘আমাদের কাছে বিশ্বাসযোগ্য গোয়েন্দা তথ্য ছিল যে, বালাকোটের ওই ঘাঁটিতে আরও একটি আত্মঘাতী হামলার জন্য জিহাদিদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে৷  এই  হানায় বিরাট সংখ্যক জইশ জঙ্গি, প্রশিক্ষক, সিনিয়র কমান্ডার, জিহাদির মৃত্যু হয়েছে৷’’ বিজেপি নেতারা দাবি করতে থাকেন, এই হামলা পুলওয়ামার বদলা৷ একমাত্র মোদিরই এমন সাহসী সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা আছে৷ রাজস্থানের জনসভায় নরেন্দ্র মোদি ঘোষণা করলেন, ‘‘নিশ্চিন্ত থাকুন, দেশ সুরক্ষিত হাতে রয়েছে৷’’ বিজেপি নেতা–কর্মী বাহিনী প্রচার করতে থাকলেন, সারা রাত জেগে অপারেশনের উপর নজর রেখেছেন নরেন্দ্র মোদি৷ অভিযান শেষ হওয়ার পরে সব ক’টি মিরাজ যুদ্ধবিমানের পাইলটের সঙ্গে কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী৷ বিজেপি নেতারা বলতে থাকেন, প্রধানমন্ত্রী নিজের বাসভবনে তিন বাহিনীর প্রধানের সঙ্গে বৈঠক করে ফের তাঁদের ‘পূর্ণ স্বাধীনতা’ দিয়েছেন৷ সেখানে সেনাকে বলা হয়েছে, কবে, কখন, কী ভাবে জবাব দেওয়া হবে, তারাই ঠিক করুক৷ অর্থাৎ এই বিরাট সাফল্যের পিছনে যে ব্যক্তিগত ভাবে প্রধানমন্ত্রীই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে, এটাই তাঁরা দেশবাসীর সামনে প্রচার করতে থাকলেন৷ মজা হল, এই সব তথ্য, খবর, সাফল্যের কথাই কিন্তু উদ্ধৃত করা হল নাম না বলা ‘সূত্র’ থেকে৷ কোথাও সরকারি বিবৃতিতে এসব প্রকাশ করা হল না৷

মন্ত্রীসভার দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি অরুণ জেটলি তো এই অভিযানকে তুলনা টানলেন মার্কিন সেনার পাকিস্তানে ঢুকে বিন লাদেনের হত্যা করার ঘটনার সাথে৷ এই ‘সাফল্য’ প্রচার করতে করতে বিজেপি শিবির থেকে ভাসিয়ে দেওয়া হতে থাকল লোকসভায় বিজেপি কত আসন জিতবে বা জিততে পারে তার সংখ্যাও৷ কেউ বললেন, আড়াইশো, কেউ তিনশো, কেউ তাতে না থেমে চারশোতে পৌঁছে গেলেন৷

সেনা অভিযানের সাফল্যকে প্রধানমন্ত্রীর সাফল্য, বিজেপির সাফল্য হিসাবে দেখিয়ে ভোটের প্রচারে নেমে পড়ল গোটা বিজেপি৷ প্রধানমন্ত্রী ভিডিওর মাধ্যমে এক কোটি কর্মীর সঙ্গে কথা বললেন৷ অনুষ্ঠানটির নাম দেওয়া হল, ‘মেরা বুথ, সবসে মজবুত’৷ অর্থাৎ সেনার কৃতিত্বের প্রচারকে ভোটের প্রচারে পরিণত করতে চাইলেন প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর দল বিজেপি৷ এই উদ্দেশ্য একেবারে নগ্ন হল যখন কর্ণাটকে বিজেপির প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ইয়েদুরাপ্পা দাবি করলেন, মোদি যেভাবে পাকিস্তানে হামলা করেছেন, তারপর কর্ণাটকে ২৮টির মধ্যে ২২টি আসনই পাবে বিজেপি৷ সব মিলিয়ে বুঝতে অসুবিধা হয় না, এই সব কর্মকাণ্ডের পিছনে যত না ছিল দেশকে সুরক্ষা দেওয়ার তাগিদ, তার চেয়ে বেশি ছিল বসে পড়া জনসমর্থন পুনরুদ্ধার করা৷ বিজেপি বাহিনীর এই প্রচার–দামামার সামনে পড়ে সংসদীয় বিরোধীদেরও মোদির তারিফ করতে হল৷ রাফাল কেলেঙ্কারি, দেশের অর্থনৈতিক দুরবস্থা, নজির বিহীন বেকারত্ব, কৃষকদের সমস্যা, সব কিছুকে পিছনে ফেলে প্রধান আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠল প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ‘সাহসী’ সিদ্ধান্ত৷ এমনকী পুলওয়ামার হত্যাকাণ্ডের তদন্ত পর্যন্ত পিছনে চলে গেল৷

এই ভাবে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, দলের সভাপতি অমিত শাহ এবং বিজেপি নেতা–কর্মীরা যখন ভোটের অঙ্ক গুনছিলেন তখনই কয়েক হাজার টন বোমার মতো তাঁদের মাথার উপর এসে পড়ল নির্মম সত্যটা৷ কাশ্মীরের পুঞ্চ ও রাজৌরি সেক্টরে নিয়ন্ত্রণ রেখার কাছে দুই দেশের বিমান বাহিনীর লড়াইয়ে পাকিস্তান একটি মিগ বিমান ধ্বংস করেছে এবং তার চালককে গ্রেফতার করেছে৷ অন্য দিকে ক্রমাগত খবর আসতে থাকল যে, আগের দিন ভারতীয় সেনাদের বোমাবর্ষণে ৩৫০ জঙ্গির মৃত্যুর যে ঘোষণা করা হয়েছিল, তা সত্য নয়– নেহাতই গল্প৷ বাস্তবে কোনও জঙ্গি ঘাঁটিও ধ্বংস হয়নি৷ দেশের বেশিরভাগ সংবাদমাধ্যমে সেনা অভিযানের সাফল্যের প্রচারে কান পাতা দায় হলেও বিদেশের খ্যাতনামা কাগজগুলিতে এই সাফল্যের অবাস্তবতার কথা প্রকাশ পেতে থাকল৷ নিউ ইয়র্ক টাইমস লিখল, ২০০৫ সালে বিধ্বংসী ভূমিকম্পের পরই জঙ্গিরা ওই এলাকা থেকে শিবির সরিয়ে নেয়৷ ওয়াশিংটন পোস্ট জানাল, বালাকোট শহরের কয়েক কিলোমিটার দূরে পাহাড়ি এলাকায় বোমা ফেলা হয়েছে৷ দ্য গার্ডিয়ান লিখল, ফাইটার জেটের হানায় আদৌ কোনও ফল হয়েছে, নাকি পুলওয়ামার পর আমজনতার মধ্যে তৈরি হওয়া ক্ষোভ প্রশমনের উদ্দেশ্যেই এই পদক্ষেপ, তা স্পষ্ট নয়৷ এলাকার বাসিন্দারা জানিয়েছেন, সংরক্ষিত বনাঞ্চলের কয়েকটা পাইন গাছ আর একটা কাক ছাড়া আর কিছুই মারা যায়নি৷ সরকারের পক্ষ থেকে কোথাও এই আন্তর্জাতিক সংবাদের প্রতিবাদ করা হয়নি৷ বা বলা হয়নি, সঠিক সংবাদটি ঠিক কী৷ ঘটনার একদিন পর সেনাবাহিনীর সাংবাদিক বৈঠকে ৩৫০ জঙ্গি হত্যা সংক্রান্ত প্রশ্নের উত্তরে সেনা অফিসাররা জানালেন, নিহত জঙ্গির সংখ্যা বলাটা এখনও ‘প্রিম্যাচিওর’৷ কিন্তু আমরা জইশ শিবিরের নিশানা যে গুঁড়িয়ে দিয়েছি, তার বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ আছে৷ কিন্তু কোথায় সেই প্রমাণ? কেন তা দেশবাসীর সামনে আনা হচ্ছে না? কেন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের খবর উদ্ধৃত করে সরকারের কাছে সেনা অভিযান সংক্রান্ত তথ্যপ্রমাণ দাবি করলেই তাকে ‘পাকিস্তানের সুরে কথা’ বলে দেগে দেওয়া হচ্ছে? সেনা জানায়, এটা সরকারের সিদ্ধান্ত৷ প্রধানমন্ত্রী যদি সেনাকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়ে থাকেন তবে সাফল্যের প্রমাণ প্রকাশ্যে আনার স্বাধীনতাটুকু তাঁদের দেখা যাচ্ছে না কেন?

এই অবস্থায় মুখরক্ষার জন্য বিজেপি সরকার যখন উইং কমান্ডার অভিনন্দন বর্তমানকে মুক্ত করে আনতে পুনরায় সেনা অভিযানের কথা ভাবছে তখন আবার একটি আঘাত এল পাকিস্তান প্রেসিডেন্টের পক্ষ থেকে৷ তিনি নাকি শান্তির সপক্ষে তাঁদের আগ্রহের প্রমাণ হিসাবে তাঁকে নিশর্তে মুক্তি দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছেন৷ সেই সাথে বলেছেন, অনেক দেশ ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে ধ্বংস হয়ে গিয়েছে৷ যুদ্ধ কোনও সমাধান নয়৷

সব মিলিয়ে গোটা বিশ্বের সামনে ভারতকে হাস্যকর জায়গায় পৌঁছে দেওয়া হল৷ ভারতের বেশিরভাগ সংবাদ মাধ্যম যেভাবে দেশপ্রেমের জিগির তুলে সংবাদকে বিকৃত করে, ফুলিয়ে–ফাঁপিয়ে প্রচার করেছে তাতে বিশ্বের বহু দেশের টিভি চ্যানেল ও সংবাদ মাধ্যমে ব্যঙ্গ করা হয়েছে৷ আর এই ফাঁপানো খবরই দেশের মানুষকে বিশ্বাস করাতে চেয়েছিলেন বিজেপির নেতা–মন্ত্রী–কর্মীরা৷ সেনাদের মর্মান্তিক মৃত্যুর দ্রুত তদন্ত করে দোষীদের চিহ্ণিত করে শাস্তি দেওয়ার পরিবর্তে তাঁরা ভোটে জেতার বাজি করলেন সেই মৃত্যুকে৷ বাস্তবে বিজেপির নেতা–মন্ত্রীরা দেশের মানুষের সাথে প্রতারণা করেছেন৷ মানুষের দেশপ্রেম নিয়ে ভোট রাজনীতি করতে নেমেছেন৷ এ সবই তাঁরা করেছেন তাঁদের গত পাঁচ বছরের শাসনের সর্বাত্মক ব্যর্থতাকে ঢাকতে৷ মানুষকে বলার মতো সত্যিই কিছু তাঁদের ঝুলিতে নেই৷ দেশি–বিদেশি একচেটিয়া পুঁজির স্বার্থ দেখতে গিয়ে জনস্বার্থ রক্ষার প্রতিটি ক্ষেত্রে এই সরকার ব্যর্থ প্রমাণ হয়েছে৷ বেকারদের জন্য কোনও কর্মসংস্থান এই সরকার করতে পারেনি৷ নতুন শিল্প, কল–কারখানা খুলতে পারেনি৷ একই রকম ভাবে ব্যর্থ হয়েছে কৃষকদের মূল সমস্যা– ফসলের ন্যায্য দামের ব্যবস্থা করতে৷ প্রতিবেশী দেশগুলির সাথে সুসম্পর্ক রক্ষাতেও এই সরকার সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে৷ এই অবস্থায় দেশপ্রেমের জিগির তুলে ভোটে জিততে সেনা মৃত্যুকে, সেনা অভিযানকে কাজে লাগাতে চাইছেন বিজেপি নেতারা৷ সে জিগির তুলতে বিজেপি নেতারা এতদূর পৌঁছেছেন যে, গুজরাটে মোদিকে স্বাগত জানাতে যে পোস্টার দেওয়া হয়েছে, তাতে বন্দুক হাতে মোদির ছবির পাশে লেখা, ‘রক্ততিলক পরে গুলির আরতি করব’৷ স্বাভাবিক ভাবে দেশের সাধারণ মানুষ যখন যুদ্ধের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে আলাপ–আলোচনার মধ্য দিয়ে সমাধানের পক্ষে মত প্রকাশ করছেন তখন বিজেপি নেতারা এই ভাবে যুদ্ধোন্মাদনা তৈরি করে চলেছে৷ আজ দেশের প্রতিটি শান্তিপ্রিয় মানুষকে এর বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে৷

(গণদাবী : ৭১ বর্ষ ৩০ সংখ্যা)